মুজনাই
অনলাইন মাঘ সংখ্যা ১৪৩১
সম্পাদকের কথা
শীত শেষ হতে চলল। আমাদের মতো গ্রীষ্মপ্রধান দেশে শীতের জন্য আমরা মুখিয়ে থাকি। কিন্তু এই বছরের শীতকাল আমাদের একেবারেই হতাশ করেছে। কোথায় সেই ঠাণ্ডার প্রাবল্য আর কোথায় বা কুয়াশা দিন! সব কিছুই যেন হারিয়ে গেছে। কয়েক বছর ধরে এরকম উষ্ণ শীত আমাদের জলবায়ু পরিবর্তনের সুক্ষ ইঙ্গিত দেয়, যা আসলে গভীর তাৎপর্যপূর্ণ।
এই শীতকাল অবশ্য আর একটি ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে রইল। দীর্ঘ ১৪৪ বছর পর প্রয়াগরাজে মহাকুম্ভ মেলার কথাই বলছি। সারা ভারত তো বটেই, বিশ্বের নানা দেশের মানুষ এই মেলা নিয়ে যথেষ্ট উৎসুক। তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি। যদিও এবারও বিপর্যয় এড়ানো যায়নি। পদপিষ্টের দুর্ঘটনায় নিহতদের প্রতি মুজনাই শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করছে।
ইতিমধ্যে মুজনাইয়ের শহর ফালাকাটা খবরের শিরোনামে এসেছিল। পূর্ণ বয়স্ক হাতিরা ফালাকাটার মতো জনবহুল শহরে ঢুকে পড়েছিল খাবারের সন্ধানে। আমাদের ডুয়ার্সের অরণ্যে পশুদের খাদ্য সঙ্কট যে কোথায় পৌঁছেছে তার প্রমাণ এটিই। তবে ফালাকাটার মানুষেরা বন্যপ্রাণদের জঙ্গলে ফেরাতে যে ধৈর্য ও অধ্যাবসায় দেখিয়েছেন সেটি কিন্তু দৃষ্টান্ত হয়ে রইল। সাধুবাদ প্রাপ্য তাদের।
প্রকাশক রীনা সাহার কলাম
শিক্ষার্থীদের কটু কথার খেলা বনাম শিক্ষকদের মান- সম্মানের বস্ত্রহরণ....
আমরা আজকালের শিক্ষক এবং আমাদের তা - য়ে পুষ্ট একালের ছাত্র রূপী "অপসর্প" -গণ তাহাদের তিন ক্রীড়াবলে (সূত্র "দন্ডনীতি"--- নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ী) যুগে যুগে "সুবোধ ছাত্র-বালক" রূপে বিশেষিত হয় । শিক্ষক রূপী অসহায় প্রাণীগণের কর্মস্থলে গিয়া তাহাদের মান- সম্মানের ছাল- চামড়া তুলিয়া পেশী প্রদর্শনের পরীক্ষার মহড়ায় হাত পাকায় এবং সোনার ডিম্ব দেওয়া বঙ্গভূমি সিন্ডিকেটের সদস্য হইবার সার্টিফিকেট অর্জন করে। ইহাদের রকিং ভাষা এবং সিনেমার ডায়লগের ককটেল এইরূপ ----
মাস্টারমশাই আপনি কিন্তু কাঁদেন নাই,চোখ দিয়া হিসু করিয়াছেন। এহ বাহ্য। মাস্টার কূলের প্রতি চটুল শব্দবন্ধ ব্যবহারের সপক্ষে ইহারা কবি নবারুণ ভট্টাচার্যের কবিতার লাইন উল্লেখ করিয়া সম্ভ্রম আদায়ে সচেষ্ট হয়। কালজয়ী কবির কবিতার মর্মার্থের এইরূপ সরলীকরণ, শিক্ষা -মনস্তত্বের ইতিহাসে নিঃসন্দেহে যুগান্তকারী এক আবিষ্কার।
পূর্বকালের ধুতি পরিহিত মাস্টার হইলে কাছা খুলিতে অনেকটাই বেগ পাইতে হইতো। কিন্তু আজকালের মাস্টার শ্রেণীর জিন্স- প্যান্টের বোতাম বা চেনের কান ধরিয়া সমূলে উৎপাটিত করিতে এইরূপ সিন্ডিকেট মার্কা শিক্ষার্থীগণের এক চুটকিই যথেষ্ট। এইসব কাজে ইহাদের পারদর্শিতা দেখিলে যোগী রাজ্যের বুলডোজারও দাঁত ক্যাল্টাইয়া পড়িয়া থাকিবে। খেলার রাজ্যে ইহারাই আওয়াল নম্বর খেলোয়াড়।
ইহারই ফলস্বরূপ মাস্টারকুলের ভূলুন্ঠিত ইজ্জত। তবুও আজ আর তাহাদের ছিন্নমস্তা বোতাম সমূহের জন্য কণা মাত্র কৃপা হয় না। সমাজের সর্বোৎকৃষ্ট শ্রেণীর মেরুদন্ড দুর্বল হেতু জনাদেশ দিবার ইচ্ছা অবলুপ্ত হইলে ভাতা- ভক্ত সাধারণ মানুষের ভোটের দাম অমূল্য হয়। আর তাই শিক্ষকগণের শরীরের চুলের গোছা খুল্লমখুল্লা পিচ রাস্তায় গড়াগড়ি খায় । চান্স পাইলে বলদেও লেঙ্গি মারিয়া মাঝ দিয়া হাঁটে , গাধাতেও ল্যাজ তুলিয়া হ্যাট্রিক হাঁকায়। কচি গোঁফ ছাত্র- বালক, মনুষ্য প্রজাতির শিশু, ইহারা মারিবে না? আলবাত মারিবে । ছাত্র কর্তৃক মাস্টারের কানে- কপালে " চড়াম চড়াম " বিরাশি সিক্কার প্রবল তেজ প্রকাশ না পাইলে শব্দগুলানের বুৎপত্তিগত গরিমা কিরূপে বজায় থাকিবে? শ্রী- ময় বাংলার শিক্ষাঙ্গনে চার অক্ষরের দুইখান কটুকথা, দুই অক্ষরের চারখান অশ্লীল কথা হইবে না ? তাহা না হইলে শ্মশ্রু, গুম্ফ, বিরোধীহীন ময়দানে পুনঃ পুনঃ খেলা জিতিবার আনন্দের বহিঃপ্রকাশ কিরূপে সম্ভব ?
খুব মনে পড়ে শিক্ষকতার পেশায় নিযুক্ত হইবার প্রথম দিককার কথা। ক্লাস ফাইভের অংক মাস্টারমশাই একদিন তাহার ক্লাস শেষে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বিরাম কক্ষে প্রবেশ করিয়া মুখ চাপিয়া বেদম হাসিতেছিলেন । অনেক চাপাচাপি করিতে বলিলেন যে , জয়নাল নামে এক ছাত্র অংক কাজ না করায় তিনি দিন দুই পূর্বে তাহার দুই আঙ্গুলের ফাঁকে কলম ঢুকাইয়া চাপিয়া দিয়াছিলেন । সেদিনের শাস্তির প্রতিবাদ স্বরূপ জয়নাল তাহার সহপাঠিদের বলিয়াছিল যে সে আর কোনোদিন অংক ক্লাস করিবে না এবং সুযোগ পাইলে তাহার নিজের কলম মাস্টারমশাইয়ের পশ্চাদ্দেশে ঢুকাইয়া দিয়া চির জীবনের মতো বিদ্যালয় পরিত্যাগ করিবে । যদিও সেই দিনের পর জয়নালকে আর কখনও বিদ্যালয়ে দেখা যায় নাই এবং তাহার প্রতিশোধ তুলিবার সুযোগও সে পায় নাই।
এই ঘটনার প্রায় দশ বৎসর পর হঠাৎ একদিন সাবালক জয়নাল বিদ্যালয়ে আসিয়া উপস্থিত। তাহাকে দেখিয়া আমরা সকলে উৎফুল্ল হইয়া উঠিতেই সে একছুটে অংক মাস্টারমশাইয়ের দুই পা ধরিয়া ভূপতিত ---- স্যার মাফ চাই , মাফ দ্যান । বালক- ছাত্রের ভুল ক্ষমার যোগ্য ছিল বলিয়াই বহুকাল আগের সে অন্যায় কথা আমরা বেমালুম ভুলিয়া গিয়াছিলাম । তথাপি জয়নালের পীড়াপীড়িতে তাহার কাঁধে হাত রাখিয়া মাস্টারমশাই তাহাকে আশ্বস্ত করিলেন এবং তাহার বর্তমান পেশা সম্পর্কে জানিতে উৎসুক হইলেন । আঠারো চাকার ট্রাক ড্রাইভার জয়নাল সেদিন যে আত্মতৃপ্তি লইয়া বিদ্যালয় পরিত্যাগ করিয়াছিল সে কথা মনে করিলে সত্যিই অনুতাপ হয়। তবে কি অল্প কয়েকটা অক্ষর শিখিয়াছিল বলিয়া সে সঠিক শিক্ষা পাইয়াছিল ? সেই শিক্ষা কি আমরাই তাহাকে দিয়াছিলাম, নাকি তাহার ট্রাক তাহাকে সঠিক মার্গ দর্শন করাইয়াছে ? বড় বিড়ম্বনার বিবেক জিজ্ঞাসা ।
এমতাবস্থায় , কুম্ভকর্ণের হাইবারনেশিয়াম হইতে জাগিয়া, চোখে- মুখে জল দিয়া মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক নামক সাক্ষরতা দূরীকরণের প্রসারে ব্রতী হইবার পূর্বে বিদ্যালয়ে বিদ্যালয়ে বিশ্ব রূপে বিশালাক্ষীর আবাহন হয়। বসন্ত পঞ্চমীর মাসটিকে আজকাল ভ্যালেন্টাইন মাসও বলা হয় বলিয়া দিনভর ডিজে চালাইয়া উদ্দাম নাচগানের আয়োজন করা হয়। এইরূপে পূজা সম্পন্নের কয়দিন পর রায়মার্টিন এবং পারুলের জয়জয়কার । বছর বছর ৯৯ দশমিক ৯৯৯৯ শতাংশ নম্বরের পাশে unsuccessful -এর উন্নয়ন। এইরূপ বৈমাত্রেয় ফলাফলে পাশ করাইয়া দিবার দাবীতে পথে- ঘাটে অবস্থান, ওছা বচন এবং কুশিক্ষার আস্পর্ধা বর্ষণ।
কিছু কিছু "অপারূপী" পি এইচ ডি শিক্ষকের শ্রীঘর গমন - আগমনের রাজযোগে শিক্ষা আর সামাজিক সেবামূলক পেশা নাই বলিয়াই মনে হয়। প্রকৃত শিক্ষকগণের হৃদয়ের echo graph এ সবসময়ই থড়হরি কম্প । কখন উদাম ক্যালানি খাই এই চিন্তায় পাঠদান মাথায় ওঠে।
আর তাই, রিটায়ারমেন্টের অন্তিম লগ্নে আসিয়া সিন্ডিকেট মার্কা ছাত্র গণের শিক্ষক হইবার চাইতে জয়নালের মতো ট্রাক ড্রাইভার ছাত্রের শিক্ষক হিসাবে পরিচিতি পাইবার ইচ্ছা প্রকাশ করিতেছি । যদি কখনও ছাত্রকোপে পড়িয়া শাড়িহরণ হইবার উপক্রম হয়, অন্তরীক্ষ হইতে সেই ধুরন্ধর রাজনীতিবিদ নিশ্চয়ই "দুয়ারে শাড়ি " সাপ্লাই দিতে আসিতে দ্বিধা করিবেন না---- এ বিশ্বাস আজন্ম পোষণ করিয়া আসিতেছি, আমৃত্যু তাহাই করিব ।
(কোট-আনকোট--- ছাতা বানান Amrela , শেখাতে পারিনি, লজ্জা আমাদের। শিক্ষক ঘেরাও, ইউনিয়ন বাজি, চাকরি ঘোটালা, লজ্জা আমাদের। প্রকৃত শিক্ষক হতে পারিনি লজ্জা আমাদের)
নিভৃত বাসিনী, বীণাপাণি , " আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণ ধুলার তলে... ``
🙏💐
মুজনাই
অনলাইন মাঘ সংখ্যা ১৪৩১
রেজিস্ট্রেশন নম্বর- S0008775 OF 2019-2020
হসপিটাল রোড
কোচবিহার
৭৩৬১০১
ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com
প্রকাশক- রীনা সাহা
সম্পাদনা, প্রচ্ছদ, অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায়
এই সংখ্যায় আছেন যাঁরা
ফোকাস: ভ্রমণ
সুদীপ মজুমদার, চিত্রা পাল, শ্যামলী সেনগুপ্ত, কবিতা বণিক, ঋতুপর্ণা ভট্টাচার্য,
গৌতমেন্দু নন্দী, পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়, অনিতা নাগ, মনীষিতা নন্দী,
শুভেন্দু নন্দী, মাথুর দাস, অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী, বিপ্লব রায়, সম্মিলিতা দত্ত
প্রবন্ধ/ নিবন্ধ
জনা বন্দ্যোপাধ্যায়, সঞ্জয় সাহা, জয়তী ব্যানার্জী, বটু কৃষ্ণ হালদার
গল্প
মৌসুমী চৌধুরী, লীনা রায়, অর্পিতা দাস, মনোমিতা চক্রবর্তী
কবিতা
চৌধুরী নাজির হোসেন, আকাশলীনা ঢোল, উৎপলেন্দু পাল, গৌতম সাহা,
রীনা মজুমদার, অর্পিতা মুখার্জী, প্রাণেশ পাল, রীতা মোদক,
সুনন্দ মন্ডল, জুলি আখতরী, মহঃ সানোয়ার, মজনু মিয়া
অনলাইন মাঘ সংখ্যা ১৪৩১
No comments:
Post a Comment