নববর্ষ জনান্তিকে
মধুপর্ণা বসু
কাঠ পুতুলের মত জীবন হয়ে উঠেছে যান্ত্রিক। এই বোধহয় একুশ শতকের দস্তুর। দিন মাস বছরের অনুপুঙ্খ হিসেব রাখায় ভীষণ আলস্যদোষ।যেন-তেন সূর্যোদয় সূর্যাস্ত টপকে সময় খুন করাই এখন অভ্যাসের দাস।আবেগের তাড়নায় বেশ অনুভব করি বাইরে চৈত্র মাস, 'তোমার চোখে দেখেছিলেম, আমার সর্বনাশ।' এখন তো সর্বনাশ বাইরে থেকে ঘরের দরজা ধাক্কা দিয়ে যায় রোজ।দক্ষিণ বায়ু,গোধূলির কালবৈশাখী,শিলাবৃষ্টিতে বাগান, ছাদে শিল কুড়িয়ে মুখে ভরা এইসব আনন্দের বোয়্যাম কবেই উজার করে দিয়ে মনমরা অতিথির মতো পৃষ্ঠ দেখিয়ে কখন চোখের আড়ালে বুঝতেও পারি না। তেমনই মনের তরঙ্গের চূড়ায় এক বৈশাখে কুশল বিনিময়, সন্দেশ, মিষ্টি, নতুন পাটভাঙা ঢাকাই শাড়ি গন্ধ সহযোগে পাজামা পাঞ্জাবীর খড়মড় শব্দে কদাচিত বাঙালী বাড়িতে গাছপাঁঠা, সমেত তেলমশলায় মাংসের ঝোল পঞ্চপদ হয়, অথবা নিছক বাড়িতে রান্না করে নববর্ষ আয়োজন হয় কিনা তা নিয়ে বেশ সংশয় আছে মনে। আমাদের চারপাশ, পরিবার থেকে পাড়া, আর তার থেকে বিস্তারিত অঞ্চল বা শহর ছেড়ে শহরতলি কেমন যেন রুদ্ধশ্বাসে ঝঞ্ঝার সামাল দিতে সবসময়ই প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিসের গন্ধ ওড়ে শহর, রাজ্য তথা গোটা দেশের আকাশে,মাঠে প্রান্তরে? কেউ যেন ভালো নেই। একটা সুখী শান্তির পরিবার থেকে বিন্দু বিন্দু নৈরাজ্য সিন্ধু হতে হতে চাপা উত্তেজনা,ভয়, অস্তিত্বের সঙ্কট, রাজনৈতিক অসহ্য অস্থিরতা, দলাদলির প্রাত্যহিক নাটকে আমাদের সচল জীবনকে তোলপাড় করে দেয় রোজ। আনন্দে মত্ত হয় কিছু মানুষ, কারণে বা অকারণে অথবা নিছকই হুজুগ বুঝে। কিন্তু সুখ শান্তির জায়গা খুঁজে পাওয়া দুর্লভ। পুরানো বছরকে বিদায় দিয়ে নতুনকে অভ্যর্থনা করাও যেন একরকম শুধু দেখানোর জন্যে।নিজেদের ওই কুমিরছানা দেখিয়ে ভোলানো যে আমরা সব ভালো আছি। All is well, নিঃসন্দেহে দারুণ মিথ্যেকে নেশাগ্রস্ত জড়িয়ে ধরে শুধু সামনে খাদের দিকে পা বাড়িয়ে দেওয়া। এই কি সময়? এই কি সেই সমাজ,সেই দেশ যেখানে মানুষ তার সব আশা আর দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারে, সকল দেশের রাণী সে যে... এসব অতীত খুঁড়ে দেখে আমরা ক্লান্ত বিধ্বস্ত। বর্ষবরণ উৎসব আসে, শ্রেণী বিশেষে চাকচিক্য, জমক কিছু কম হয়না। হাতিবাগান, গড়িয়াহাট সেলের বাজার অতি সূক্ষ্ম পরিদর্শনে বেশ বেরঙিন, সাদামাটা। অনলাইনে এখন বাঘের দুধও খুঁজলে মিলতে পারে।সপরিবারে নববর্ষের মেজাজ আনন্দমেলা,গান গল্পের অবকাশ এখন হাতে গুনে সংখ্যা লঘু।বাঙালী নস্টালজিয়া বহু ক্ষেত্রে বেশ চমকিত করার মতো হলেও দূরদর্শনের বর্ষবরণ বৈঠকে যেন পঙ্কজ সাহা, ছন্দা সেন, শাশ্বতী, চৈতালী, অভাবদুষ্ট। রামকুমার চাটুয্যে,বন্যা চৌধুরী, দেবরাজ অনুপস্থিতি নব্যেরা কি তেমন করে ভরিয়ে তুলতে পারেন? এখন শাড়ি অলঙ্কার চড়া মেকআপে ঢেকে গেছে প্রাণের স্পন্দন।ঋতুচক্রের নিয়মে চৈত্র শেষে বৈশাখ আসছে রণ দামামা বাজিয়ে। থার্মোমিটারের পারা চড়বে ঊর্ধ্বমুখে আর দু-এক দিনের আমোদের স্রোতের ভাঁটায় নিভে যাবে আর একটা নববর্ষ। জীবন চলবে গড্ডরিকায় যতদিন না আমরা যুদ্ধকালীন মানসিকতায় পরিবর্তন না আনি। প্রতিবারের মতো আমার বর্ষবরণ অত্যন্ত নীরবে হয়তো কবিতার সাথে, জনান্তিকে।
No comments:
Post a Comment