বনছায়ার ডাকে : ডুয়ার্সের নতুন স্বপ্নগ্রামে কয়েকদিন
পিনাকী রঞ্জন পাল
ট্রেনের জানালা দিয়ে যখন সবুজ মাঠ আর দূরের পাহাড় দেখা যাচ্ছিল, তখনই বুঝতে পারছিলাম আমি ধীরে ধীরে ডুয়ার্সের কোলে পৌঁছে যাচ্ছি। আকাশে হালকা কুয়াশা, বাতাসে চা পাতার গন্ধ, আর মাঝে মাঝে ছোট ছোট নদী- সব মিলে এক অদ্ভুত মায়ার মতো দৃশ্য চোখে ধরা দিচ্ছিল।
আলিপুরদুয়ার জংশন থেকে গাড়ি নিয়ে বেরোলাম কালচিনির দিকে। শহরের কোলাহল পিছনে ফেলে যত এগোচ্ছি, ততই প্রকৃতির নৈঃশব্দ্যে ভরে উঠছে মন। রাস্তার দুই ধারে সারি সারি চা বাগান, মাঝে মাঝে রঙিন কাপড়ে কাজ করতে থাকা মহিলারা হাত তুলে হাসি দিয়ে অভিবাদন জানাচ্ছিলেন।
প্রায় এক ঘণ্টা যাত্রার পর গাড়ি ঢুকল ভাটপাড়া চা বাগান পেরিয়ে ছোট্ট এক গ্রামে। সাইনবোর্ডে লেখা- “বনছায়া গ্রাম।” নামটুকু পড়তেই যেন মন ভরে গেল। মনে হলো, সত্যিই যেন সবুজ ছায়ার নিচে লুকিয়ে আছে এই গ্রাম।
গাড়ি থামতেই চারপাশে এমন শান্ত পরিবেশ, মনে হচ্ছিল শহরের ধুলো ধোঁয়া থেকে একেবারে অন্য জগতে চলে এসেছি। চারিদিকে কাঠের তৈরি ছোট ছোট বাড়ি, কিছু হোমস্টে সাদা-নীল রঙে রাঙানো। প্রতিটি ঘরের সামনে রঙিন ফুল ফুটে আছে- জবা, গোলাপ, গাঁদা, আর কয়েক জায়গায় অর্কিডের ঝাড়।
গ্রামের লোকেরা হাসিমুখে এগিয়ে এল, যেন বহুদিন পর আপনজনকে ফিরে পেল। স্থানীয় এক দিদি, যিনি আমাদের থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন, হাতে জৈব ফুলের মালা দিয়ে স্বাগত জানালেন। তিনি বললেন, “এখানে অতিথিই দেবতা। আপনারা এসেছেন বলেই তো আমাদের গ্রাম বেঁচে আছে।”
বাড়ির বারান্দায় বসেই চোখে পড়ল দূরে ভুটান পাহাড়ের রেখা। আরেকদিকে রাইমাটাং নদীর ধ্বনি আসছিল, যেন প্রকৃতির মৃদু বাঁশির সুর। হালকা ঠান্ডা বাতাস বয়ে আসছিল পাহাড় থেকে।
হোমস্টের ঘরে ঢুকে মনে হলো যেন আমি নিজের ঘরেই এসেছি। খাটে পরিষ্কার সাদা চাদর, জানালার ধারে বাঁশের চেয়ার। ঘরের দেয়ালে গ্রাম্য শিল্পীর আঁকা পাহাড়-নদীর ছবি। ছোট্ট কিন্তু উষ্ণ আতিথেয়তায় ভরা।
সন্ধে নামতেই গ্রাম যেন নতুন রূপ নিল। মশালের আলো, সঙ্গে স্থানীয় তামাং আর রাই মহিলাদের সমবেত কণ্ঠে লোকগান। গান শেষ হওয়ার পর ছোট ছোট মেয়েরা রবীন্দ্রনৃত্য পরিবেশন করল। বনছায়ার মতো এক দূর গ্রামে বসে রবীন্দ্রনৃত্যের তালে হাততালি দেওয়া- এ অভিজ্ঞতা একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল।
রাত বাড়তেই ঠান্ডা বাতাস গায়ে এসে লাগল। দূরে কোথাও বৃষ্টি নামছিল হয়তো, তার শব্দ মিলেমিশে যাচ্ছিল নদীর কলকল ধ্বনির সঙ্গে। ঘুম ভাঙার আগেই মনে হচ্ছিল আমি কবিতার ভেতরে ঢুকে গেছি।
সেই প্রথম দিনেই বুঝলাম- “বনছায়া” কেবল একটি গ্রাম নয়, এটি যেন প্রকৃতির আঁচল, যেখানে মানুষ, নদী, পাহাড় আর গান সব একসঙ্গে মিলে জীবনের অন্যরকম গল্প লিখছে।
ভোরবেলা ঘুম ভাঙল মোরগের ডাক আর ময়ূরের কণ্ঠে। জানালা খুলে তাকাতেই দেখি কুয়াশার আস্তরণ সরিয়ে সূর্যের আলো ধীরে ধীরে নেমে আসছে ভুটান পাহাড়ের গা বেয়ে। আর সেই আলো এসে পড়ছে রাইমাটাং নদীর স্বচ্ছ জলে। দৃশ্যটা এতটাই মোহময় ছিল যে কিছুক্ষণ নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে শুধু দেখেই গেলাম।
ব্রেকফাস্টের জন্য যখন উঠোনে এলাম, তখন টেবিলে সাজানো ছিল জৈব শাকসবজির তৈরি তরকারি, ভুট্টার রুটি আর তাজা দুধ। সঙ্গে গ্রামের মহিলারা হাসিমুখে বললেন, “এখানে সবই নিজের হাতে ফলানো। কোন রাসায়নিক নেই।” সত্যিই, খাওয়ার স্বাদে ছিল প্রকৃতির নির্যাস।
এরপর স্থানীয় একজন তরুণ আমাদের নিয়ে গেলেন গ্রামের চারপাশ ঘুরতে। তিনি জানালেন, মাত্র আঠারো মাসে গড়ে উঠেছে বনছায়া। আগে সবাই বক্সা টাইগার রিজার্ভের ভেতরে থাকতেন। সরকার তাদের পুনর্বাসন দিয়েছে, আর এখন তাঁরা পর্যটনের মাধ্যমেই আত্মনির্ভর হতে চাইছেন।
গ্রামের প্রতিটি কোণে যেন মানুষের শ্রম আর স্বপ্নের ছাপ। কেউ শাকসবজির খেত করছে, কেউ বাগানে ফুল লাগাচ্ছে। মহিলারা হাতে বোনা চাদর আর ঝুড়ি বানাচ্ছিলেন। ছোট ছোট বাচ্চারা মাটির আঙিনায় খেলতে খেলতে হাসির রোল তুলছিল। তাদের নিষ্পাপ মুখ দেখে মনে হচ্ছিল, প্রকৃতিই যেন এদের স্কুল আর শিক্ষক।
একটি দিদির সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে জানলাম, প্রশাসনের উদ্যোগে এখানকার অনেক মহিলা এখন “হসপিটালিটি ট্রেনিং” পেয়েছেন। তাঁরা অতিথিদের কীভাবে অভ্যর্থনা জানাতে হয়, কীভাবে খাবার পরিবেশন করতে হয়- সব শিখেছেন। তাঁর চোখে স্বপ্নের দীপ্তি- “আগামী দিনে বনছায়া হবে সারা ডুয়ার্সের অন্যতম সেরা গ্রাম,” বললেন তিনি গর্বের সঙ্গে।
বিকেলের দিকে আমরা গেলাম রাইমাটাং নদীর ধারে। স্রোতের টানে জল পাথরে আছড়ে পড়ছিল, যেন সুর বাজাচ্ছে। নদীর তীরে বসে মনে হচ্ছিল সময় থেমে গেছে। কিছু দূরে গ্রামের তরুণেরা মাছ ধরছিল, আর কয়েকজন ভেসে আসা কাঠ সংগ্রহ করছিল। তাদের মুখে শুনলাম অনেক লোককথা- কীভাবে বর্ষার জলে পাহাড় থেকে ভেসে আসে বিশাল গাছের গুঁড়ি, আর সেগুলো কেটে গ্রামে কাজে লাগানো হয়।
রাতে আবার শুরু হল সাংস্কৃতিক আসর। মহিলারা তামাং লোকনৃত্য পরিবেশন করলেন, ছেলেরা বাজাল বাঁশি আর ঢোল। তারপর একসঙ্গে বাংলায় রবীন্দ্রসংগীত গাইলেন- “অতিথি স্বাগতম”- যা শুনে সত্যিই বুক ভরে গেল। এতদূরে, প্রকৃতির কোলে তাঁরা সংস্কৃতিকে কত সুন্দরভাবে ধারণ করছেন, দেখে অবাক হলাম।
বিছানায় শোওয়ার সময় জানালা দিয়ে ঠান্ডা বাতাস আসছিল। দূরে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, মাঝে মাঝে হরিণের আওয়াজ- মনে হচ্ছিল আমি যেন জঙ্গলের বুকেই শুয়ে আছি। শহরের সব দুশ্চিন্তা কোথায় যেন মিলিয়ে যাচ্ছিল।
বনছায়ার দ্বিতীয় দিন আমাকে শিখিয়ে দিল- এখানে প্রকৃতি শুধু চারপাশে নয়, মানুষের ভেতরেও বেঁচে আছে। তারা পরিশ্রম করে, হাসি ভাগ করে নেয়, গান গায়, অতিথিকে আপন করে নেয়। এখানকার প্রতিটি দিন আসলে একেকটি গল্প।
তৃতীয় দিনের সকালটা শুরু হল আরও রঙিন ভাবে। খাওয়ার টেবিলে সেদিন ছিল ভাতের সঙ্গে তাজা সবজি আর গ্রামের এক মহিলার হাতে বানানো বাঁশকপালির আচার। খাবার শেষে আমরা বেরিয়ে পড়লাম আশেপাশের জায়গাগুলি ঘুরে দেখতে।
প্রথমেই গেলাম ভাটপাড়া চা-বাগানে। সবুজ চা-পাতার ঢেউ যেন চোখের সামনে নেচে উঠছিল। চা-বাগানের সরু পথ দিয়ে হাঁটার সময় মনে হচ্ছিল, সবুজ রঙের এক অন্তহীন সমুদ্রে ডুবে আছি। শ্রমিকরা কাজ করতে করতে হাসি-আলাপে মেতে উঠেছিল। গ্রামের ছেলেরা বলল- “চা-বাগানের সৌন্দর্য বর্ষাকালে আরও বেড়ে যায়, তখন মেঘ এসে নেমে বসে পাতার ওপর।”
তারপর আমরা রওনা হলাম রাইমাটাং নদী পেরিয়ে রাইমাটাং বস্তি পর্যন্ত। নদীর স্রোত এতটাই স্বচ্ছ ও ঠান্ডা যে হাঁটার ইচ্ছে হচ্ছিল জলের ভেতর দিয়েই। পথে গিয়ালটং নদীও দেখা দিল, তার স্রোত আরও চঞ্চল। পাহাড় থেকে নেমে আসা এই দুই নদীর মিলন যেন এক অদ্ভুত সুরের মূর্ছনা সৃষ্টি করে।
সেখান থেকে শুরু হল বক্সা পাহাড়ের অভিযান। স্থানীয় গাইড আমাদের নিয়ে গেলেন প্রাচীন জঙ্গলের পথে। আকাশছোঁয়া শাল ও সেগুন গাছের ফাঁক দিয়ে আলো এসে পড়ছিল মাটিতে। কোথাও কোথাও শোনা যাচ্ছিল ধনেশ পাখির ডাক। হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছলাম বক্সা ফোর্টে- ব্রিটিশ আমলের সেই জেলখানা, যেখানে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বন্দি করে রাখা হত। গাইড জানালেন, এখানে একসময় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিনও পালন হয়েছিল। সেই স্মৃতিচিহ্ন আজও সংরক্ষিত আছে।
ফিরতি পথে আমরা থামলাম রাজাভাতখাওয়ার প্রজাপতি পার্কে। চোখের সামনে শত শত প্রজাপতি উড়ছে, যেন আকাশের টুকরো রঙিন ফুল। কেউ লাল, কেউ নীল, কেউ হলুদ- এই দৃশ্য দেখে মনে হচ্ছিল রূপকথার দেশে এসে পড়েছি।
দিনের শেষে ক্লান্ত শরীর নিয়ে যখন আবার বনছায়ার হোমস্টেতে ফিরলাম, তখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে। উঠোনে আগুন জ্বালানো হয়েছিল। চারপাশে বসে আমরা সবাই মিলে গান গাইলাম, গল্প করলাম। গ্রামের প্রবীণরা বললেন নদীকে ঘিরে অনেক লোককথা, কিভাবে তারা ছোটবেলায় ভেসে আসা কাঠ কুড়িয়ে আনত, কিংবা বর্ষায় মাছ ধরতে গিয়ে নদীর স্রোতে ভেসে যাওয়ার ভয় কাটিয়ে উঠত।
সেদিন রাতে যখন বিছানায় শুলাম, মনে হচ্ছিল, আমি যেন একটা দীর্ঘ যাত্রা সেরে ফেললাম। কিন্তু সেই যাত্রার প্রতিটি ধাপ ছিল আনন্দে, ইতিহাসে, প্রকৃতিতে আর মানুষের হাসিতে ভরপুর।
বনছায়ায় কাটানো শেষ দিনের সকালটা শুরু হল এক অন্যরকম আবহে। ময়ূরের ডাক, বুলবুলের গান আর ভোরের ঠান্ডা বাতাস যেন জানিয়ে দিল- আজ বিদায়ের দিন। মনটা তখন থেকেই খানিকটা ভারী হয়ে উঠছিল।
প্রথমেই সকালের ব্রেকফাস্টে পরিবেশন করা হল গরম ভাপা পিঠে আর জৈব মধু। গ্রামের মহিলারা হাসিমুখে বললেন- “আপনারা তো আমাদের অতিথি নন, আপনাদের আমরা আপনজন মনে করি।” সেই কথায় এক অদ্ভুত উষ্ণতা অনুভব করলাম।
খাওয়ার শেষে যখন ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি, তখন গ্রামবাসীরা হঠাৎ আমাদের ডাকলেন কমিউনিটি হলের সামনে। সেখানে পৌঁছে দেখি ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা রঙিন পোশাকে সেজেছে। শুরু হল তাদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। কেউ তামাং লোকগীতি গাইল, কেউ পরিবেশন করল রাই নৃত্য। তারপরে এল সত্যিই অপ্রত্যাশিত চমক- কয়েকজন মহিলা মিলেমিশে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইলেন, তার সঙ্গে স্বাগতম নৃত্য। এতদিন ভেবেছিলাম, এখানে কেবল স্থানীয় লোকসংস্কৃতি দেখব; কিন্তু বাংলার গানের সঙ্গে পাহাড়ি তাল মিশে তৈরি হল এক অসাধারণ সুরেলা আবহ।
তারপর গ্রামের প্রবীণ সমাজসেবী রামকুমার লামা এগিয়ে এসে আমাদের হাতে তুলে দিলেন এক ছোট্ট উপহার- জৈব সবজির ঝুড়ি আর কিছু হাতে তৈরি বাঁশের সামগ্রী। তিনি বললেন, “আপনারা এখানে সময় কাটালেন, সেটাই আমাদের জন্য বড় পাওয়া। তবে ফেরার সময় যদি আপনাদের মনে বনছায়ার নামটা রয়ে যায়, সেটাই হবে আমাদের সবচেয়ে বড় পুরস্কার।”
ফেরার পথে অটো যখন পাকা রাস্তা ধরে এগোচ্ছিল, পিছনে তাকিয়ে দেখলাম বনছায়ার কুঁড়েঘর, ফুলের বাগান, ধোঁয়া উঠতে থাকা রান্নাঘর, আর শিশুদের হাত নেড়ে বিদায় জানানো। চোখ ভিজে আসছিল।
ভ্রমণ শেষ হলেও বনছায়ার স্মৃতি যেন চিরকাল রয়ে যাবে- আতিথেয়তার আন্তরিকতা, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জাদু, আর মানুষের সংগ্রাম থেকে উঠে আসা আত্মনির্ভরতার কাহিনী।
"কিরে ওঠ বেলা যে অনেক হল!"- মার ডাকে ঘুম ভাঙতেই বুঝলাম এতক্ষন আমি স্বপ্ন দেখছিলাম। তবে ঘুম থেকে উঠে ঠিক করলাম এবার পুজোর ছুটিতে মা'কে নিয়ে বেড়াতে যেতেই হবে বনছায়াতে। আপনারাও একবার ঘুরে যেতেই পারেন এই বনছায়া থেকে।
(তথ্য ও ছবি: অরুনকুমার)
No comments:
Post a Comment