পশ্চিমে নব জাগরণের দেশে
চিত্রা পাল
আজ আমরা রোম ছেড়ে চলেছি ফ্লোরেন্সের দিকে। ইটালীর এক প্রাচীন শহর ফ্লোরেন্স। ইউরোপের ইতিহাসে রেনেসাঁস বা নব জাগরণের যে সূচনা হয়েছিলো তাতে ইটালীর অবদান অবিস্মরণীয়। রোমান সাম্রাজ্য কন্সট্যান্টিনোপলের পতনের পরে গ্রীক ও রোমান শিক্ষিত সম্প্রদায় তুর্কী অধিকৃত কন্সট্যান্টিনোপল ছেড়ে দলে দলে চলে আসেন ইটালীতে।এখানে আবার নতুন করে সমস্ত ক্ল্যাসিকাল সংস্কৃতি শিক্ষার চর্চা শুরু হয়।তার ফলে এক বিরাট সাংস্কৃতিক পরিবর্তন আসে। সে পরিবর্তনের আলোয় উদ্ভাসিত হয় সাহিত্য সঙ্গীত বিজ্ঞান শিল্পকলা সকল দিক। তারই ফলশ্রুতিতে আমরা পাই গ্যালিলিও, পেত্রার্ক, বোক্কাচো,মেকিয়াভেলি,লিওনার্দো-দা ভিঞ্চি,মাইকেল এঞ্জেলো, রাফাএল, টিশিয়ান, বটিসেলি এইসব আরও পৃথিবী বিখ্যাত মহান কৃতী শিল্পীদের। যাবার পথে গাইড আমাদের এইসব অমূল্য কাহিনী বলে দেখার আগ্রহ আরও সূক্ষ্ম করে দিয়ে ছিলেন। আমরা সবাই মন দিয়ে শুনছি গাইডের কথা।আমাদের সঙ্গে চলেছে আর্নো নদী। পথপার্শ্বের তরুদল এমন সমান উচ্চতায় যে মনে হয় সবুজের বাহুডোর।
ফ্লোরেন্স অঞ্চল ঘোরা হবে পায়ে হেঁটে। ফ্লোরেন্স প্রদেশের রাজধানী শহর ফ্লোরেন্স। ফ্লোরেন্স শহরের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে আর্নো নদী। এই নদীর ধারে এই ঐতিহ্যময় ঐতিহাসিক শহর ইউরোপীয়ান রেনেসাঁস বা নবজাগরণের জন্মভূমি। ১৯৮২ সাল থেকে ইউনেস্কোএই শহরকে ওয়ার্ল্ডর্ হেরিটেজ বা বিশ্বের ঐতিহ্যশালী শহর বলে চিহ্নিত করেছে। ফ্লোরেন্স শহর বহু বিখ্যাত ব্যক্তির জন্মভূমি ও বাসভূমি। দাঁতে, বোকাচ্চিও, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি,মেকিয়াভেলি, মাইকেল এঞ্জেলো এমন খ্যাতনামা শিল্পীদের জন্মভূমি।
আমরা প্রথমে গেলাম ডেলা সিগনোরিয়া এরিয়া। যাকে সাধারণ লোকে বলে স্থাপত্যের আউটডোর গ্যালারি। সেখানে দেখলাম মাইকেল এঞ্জেলোর করা বিখ্যাত দরজা, যাকে শিল্পী নিজে বলেছেন গেটস অফ প্যারাডাইস বা স্বর্গের দরজা। ডেল একাডেমিয়ায় দেখলাম মাইকেল এঞ্জেলোর ডেভিড। এছাড়াও আছে অনেক বিখ্যাত শিল্পীর শিল্প। অবিস্মরনীয় অপার্থিব কারুকলায় সবাই অভিভূত। পরবর্তী গন্তব্যস্থল ভেনিস। মহাকবি সেক্সপীয়র তাঁর অমর রচনা দি মার্চেন্ট অফ ভেনিসে, ভেনিস শহরের নাম স্বর্ণাক্ষরে খোদিত করে গিয়েছেন। তাই মনে হয় শাইলককে আমরা কেউ ভুলতে পারি না। আজ আমরা সেই ভেনিসে এসেছি। এখানকার লোকের ভাষায় ভেনিজিয়া। ভেনিস ফ্লোরেন্স রোমের অবস্থান একই সরলরেখায় ওপর থেকে নীচে। ১১৮টা দ্বীপের সমন্বয়ে এইশহর। প্রচুর সেতু প্রায় ৪৩৮টা এই শহরের যোগাযোগ রক্ষা করছে। মধ্যযুগ ও রেনেসাঁস নবজাগরণের সময়ে এটি ইউরোপের অন্যতম প্রধান আর্থিক ও সামুদ্রিক শক্তি ছিলো। এর পাশাপাশি ১৭শ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত ভেনিস একটি গুরুত্বপূর্ণ বানিজ্যেরও কেন্দ্র ছিল। শহরের স্থাপত্য ও সংস্কৃতির ওপরে তার যে ছাপ পড়েছিলো আজও তা রয়ে গেছে।
ট্রনচেটো প্ল্যাটফর্ম থেকে এডিয়াট্রিক সাগরের গ্র্যান্ড ক্যাননের ওপর দিয়ে ওয়াটার ট্যাক্সি করে পৌঁছলাম ভেনিসে। এরা বোধ হয় সব শব্দের শেষে একটা করে আ লাগায়।যেমন রোম কে বলে রোমা। একেবারে সমুদ্র পাড় থেকেই শুরু এ শহর। এই জলনগরীতে মোটরগাড়ির চল নেই। শুধু তিনটে বড় বড় সেতু আছে যেখানে গাড়ি চলাচল করে।এখানে যাতায়াতের বাহন গন্ডোলা।প্রথমে দেখলাম এখানকার বড় চার্চ যা হাজার বছরের পুরনো। তারপরে নেপোলিয়নের প্রাসাদ। তার একটু দূরে সেন্ট মার্কস স্কোয়ার। এই স্কোয়ারকে নেপোলিয়ন বলতেন, ওয়ার্ল্ডস বিগেস্ট ড্রয়িং রুম। কাছেই বিখ্যাত মুরনো গ্লাস ফ্যাক্টরি। আমরা গন্ডোলায় ঘুরে বেড়ালাম বেশ কিছুক্ষণ। যেতে যেতে শুনলাম অন্য গন্ডোলা থেকে পিয়ানো একোর্ডিয়ান সহযোগে বেশ দরাজ গলার গান।যে গান এই জলপথ ছাপিয়ে মিশে যাচ্ছে চারপাশে। আমাদের ভাটিয়ালি গানও তো এমন নদীপথেই গাওয়া হতো। গান অন্তর উত্সারিত। তাইতো মন ছুঁয়ে যায় সে ভেনিস ভারত যেখানেই হোক। এরপরে আমরা যাব অস্ট্রিয়ায়, সে কথা সে কথা পরে হবে।
(ছবি- সংগৃহিত)
No comments:
Post a Comment