Friday, October 3, 2025


 

বিরুপাক্ষ মন্দিরে এক সন্ধ‍্যে

        কবিতা বণিক


হাজার বছর ধরে পূজো নিয়ে আসছেন, ভক্তদের মনোবাসনা পূর্ণ করছেন যে রূপে , তিনি বিরূপাক্ষ দেব। বিস্ময় জাগে দাক্ষিনাত‍্যের হাম্পিতে যে এত ধ্বংস স্তুপের মধ‍্যও বিরূপাক্ষ মন্দির সহস্র বছর ধরে অবিকৃত রয়েছে। তিনি স্বয়ং কালের কাল মহাকাল দেবাদিদেব মহাদেব। বিরূপাক্ষদেব রূপে পূজিত হন এখানে। চারিদিকে শুধু বিশাল বিশাল পাথরের স্তুপ, ছোট বড় নানান পাথরও চারপাশে প্রচুর রয়েছে। দেখে মনে হয় শ্মশানের স্তব্ধতা। সাথে স্রোতস্বিনী তুঙ্গভদ্রা। অথচ একটু দূরেই পাওয়া যায় ভক্তদের প্রাণ চঞ্চলতায় ভরপুর বিরূপাক্ষ মন্দির। মনে পড়ল কবির গান— “ মৃত‍্যু আপন পাত্রে ভরি বহিছে যেই প্রাণ/ সেই তো তোমার প্রাণ।/ বিশ্বজনের পায়ের তলে ধূলিময় যে ভূমি/ সেই তো স্বর্গ ভূমি।/ সবায় নিয়ে সবার মাঝে লুকিয়ে আছ তুমি / সেই তো আমার তুমি।।/ অন্ধকারের উৎস হতে …..”। বিরূপাক্ষ মন্দিরটা নির্মাণ করেন সপ্তম শতাব্দীর চালুক‍্যর শাসক বিক্রমাদিত‍্য- ২য় র রানী। ভগবান শিব যিনি বিরূপ হন না কখনও তিনিই বিরূপাক্ষ। সাথে আছেন পার্বতী দেবী স্বরূপা পম্পাদেবী। 

এই দেবীর নামানুসারেই তুঙ্গভদ্রা নদীর তীরে পম্পা নগরী নামে বিখ্যাত এক নগরী ছিল। সম্পূর্ণ দাক্ষিণাত্যে এক সময় বিজয় নগর সাম্রাজ্য যখন বিস্তার লাভ করেছিল, সে সময় পম্পা নগরী ছিল তার রাজধানী। রাজা কৃষ্ণ দেবরায় তার নিজের অভিষেকের সময় পনেরো শতাব্দীতে এই মন্দিরের গোপুরম নির্মান করেছিলেন। এগারো তলা অর্থাৎ ১৬৫ ফুট উঁচু এই মন্দিরের সুউচ্চ গোপুরমের মাথায় এক জোড়া গরুর শিং রয়েছে। অনেক দূর থেকে এই গোপূরম দেখা যায়। তুঙ্গভদ্রা নদীর দক্ষিণ দিকে অবস্হিত এই মন্দিরের অভিনব বাস্তুকলা ও ইতিহাস পর্যালোচনা করে ইউনেস্কো এটাকে হেরিটেজ ঘোষণা করেছেন। মন্দিরে তিনটি গোপুরম আছে। রামায়ণ কালের কিষ্কিন্ধ‍্যা নগরী ছিল এই পম্পানগরী। বিরূপাক্ষ মন্দিরের গল্প কথিত আছে যে এখানকার শিবলিঙ্গ রাবণের সাথে সম্বন্ধিত। রাবণ পরম শিবভক্ত ছিলেন। তাই কঠোর তপস‍্যায় ভগবান শিবকে সন্তুষ্ট করেন। ভগবান শিব বর দিতে চাইলে রাবণ শিবকে লঙ্কায় নিয়ে যেতে চাইলেন, শিব যেতে অস্বীকার করেন। কিন্ত এক দিব‍্য শিবলিঙ্গ হাতে দিয়ে বলেন একে মাটিতে নামাবে না তাহলে সেখানেই থেকে যাবে। খুব পরিশ্রমের ফলে পরিশ্রান্ত রাবণ সামান‍্যক্ষণ বিশ্রাম নেবার জন‍্যে এক পশুপালকের হাতে শিবলিঙ্গটি ধরতে দেন, এবং মাটিতে নামাতে বারণ করেন। কিন্ত পশুপালক বেশিক্ষণ তার ভার সহ‍্য করতে পারেননি ফলে মাটিতে নামিয়ে দিয়ে ছিলেন। অনেক চেষ্টা করেও রাবণ সে শিবলিঙ্গ উঠাতে পারেননি। এই ঘটনার বিবরণ , রাবণের শিবলিঙ্গ উঠানোর চেষ্টা সব মন্দিরের গায় চিত্রিত করা আছে। আর এক আশ্চর্য, যা মন্দিরের স্তম্ভগুলো থেকে সংগীতের সুর বের হয়। মন্দিরে পম্পা দেবী অর্থাৎ দেবী পার্বতীর মন্দির আছে। ৩৮ টা স্তম্ভ যুক্ত হল ঘর আছে। একে সভা মণ্ডপ বলা হয়। স্তম্ভগুলোতে খুব সুন্দর ভাস্কর্য করা। স্তম্ভগুলোর নান্দনিকতা বিস্মিত করে। পাথরে খোদাই করা নীচের অংশগুলো পৌরাণিক সিংহ একটা মকরের উপর দাঁড়িয়ে তার উপরের অংশ বর্গাকার। শিব মন্দিরের পাশে রঙ্গ মণ্ডপে বিশাল আকারের সিলিংয়ে রামায়ন, মহাভারত, শিবপুরাণ ও সমসাময়িক জীবন ধারা চিত্রিত করা আছে। এখানে আরও কথিত আছে ভগবান বিষ্ণুও এখানে তাঁর নিজের থাকার জায়গা হিসেবে মনস্হ করে ফিরে যান। পুরোন শিলালিপি থেকে কৃষ্ণপুর নাম পাওয়া যায়। বিরূপাক্ষ মন্দিরের এক কিলোমিটার দূরে বাল গোপালের মন্দির দেখা যায়। এখন সবই ভগ্নস্তুপে পরিনত। বাল গোপালের মূর্তিটি চেন্নাই মিউজিয়ামে রাখা আছে। এখানে বিষ্ণুর দশ অবতারের খোদিত মূর্তিগুলো আজও দেখা যায়। বিরূপাক্ষ মন্দিরের দক্ষিনে ৬.৭ মিটার উঁচু নরসিংহ যিনি বিষ্ণুর অবতার, যোগাসনে অবস্হিত। একটি লক্ষীর মূর্তিও ছিল নরসিংহদেবের সাথে। এখন নেই। 






হাজারো বছর ধরে যিনি প্রতিদিন প্রতিরাত পূজো পেয়ে আসছেন কোটি কোটি গুণ মানুষের প্রার্থনা শুনছেন সেই দেবাদিদেব বিরূপাক্ষ দেবের মন্দিরে ঢোকার সময় চোখের সামনে ভেসে উঠল কতযুগের কত অগুনতি মানুষের পদচিহ্ন আঁকা মাটিতে , মন্দিরের বারান্দায়, মন্দিরের চারিপাশে । কত মানুষেরা তাদের জীবনের যন্ত্রণার কথা জানাচ্ছেন। সপ্তম শতাব্দীতে তৈরি এই মন্দির। আজও ভক্তরা তাঁদের জীবনের হাসি- কান্নার কথা বিরূপাক্ষ দেবকে জানান। কালের কাল এই মহাকাল যুগ যুগ ধরে কত কোটি কোটি মানুষ ধনী, গরীব, রাজা, প্রজা নির্বিশেষে সকলের প্রার্থনা শোনেন। তাইতো আজও অগনিত মানুষ ছুটে আসেন একটু শান্তি লাভের আশায়। সন্ধ‍্যা আরতিকালের শিঙ্গা, মৃদঙ্গ, সিম্বাল, শঙ্খ ধ্বনির মুর্ছনায় সমস্ত মন্দির প্রাঙ্গণ আনন্দ মুখরিত হয়ে ওঠে। সামনে নন্দীজীও বিরাজিত আছেন। এখানে ভগবান গণেশের একটা বড় মূর্তি ও আছে। আজও তীর্থযাত্রীদের জন‍্য গুরুত্বপূর্ণ তীর্থ স্হান এই মন্দির । 

ইচ্ছে পূরণ যণ্ত্র রাখা আছে মন্দির প্রাঙ্গণে । পাথরের ওপর সুন্দর পদ্মফুলের ওপরে ছোট্ট গোলাকৃতি কুঁড়ির মত খোদাই করা আছে। এটাকে বলে “ইষ্টারথিসিড্ডিলিঙ্গা।” ঐ কুঁড়িটাকে দুপাশ থেকে দুহাতের তর্জনী ও বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে ধরে নিজের ইচ্ছে প্রার্থনা করেন ভক্তরা। যদি দুটো আঙুল স্পর্শ করতে পারে তবে সেই ইচ্ছে পূরণ হবে। এমনি ভক্তদের বক্তব্য। মন্দিরের পাশে এক সরোবর আছে। সেই সরোবরের জল দিয়ে রোজ দেবাদিদেব বিরূপাক্ষদেবের অভিষেক হয়। বিজয়া দশমীতে দাক্ষিণাত‍্যে দশেরা উৎসব পালিত হয় খুব সমারোহে।। সেদিন উৎসব শেষে পাল্কীতে করে মূর্তিকে এনে এই সরোবরে ছোট নৌকাকে ফুল দিয়ে সাজিয়ে তাতে বসিয়ে নিয়ে ঘোরানো হয়। খুব উপভোগ‍্য সেই অনুষ্ঠান। আবার পুরাণমতে শিব ও পার্বতীর বিবাহ এখানেই হয়েছিল। ফেব্রুয়ারি বা মার্চ মাসে শিবরাত্রিতে শিবের জন্মোৎসব পালন হয় মহা সমারোহের সাথে। দূর দূরান্ত থেকে অগনিত মানুষ এই উৎসবে সামিল হন। এর পরে হয় রথমহোৎসব। কাঠের তৈরি এক সুদৃশ‍্য রথে ভগবান বিরূপাক্ষ কে ফুল ও প্রদীপ দিয়ে খুব সুন্দর করে সাজানো হয় । খুব সমারোহ ও হর্ষল্লাসের সাথে শোভাযাত্রা বের করা হয়। এই শোভাযাত্রায় গাওয়া গান ও মন্ত্র ভগবান বিরূপাক্ষ ও দেবী পম্পার বিবাহের প্রতীক মানা হয়।

বিরূপাক্ষ মন্দিরের পাশ দিয়ে হেমকুটা পাহাড়ে যাওয়া যায়। সেখান থেকে সূর্যাস্ত ভারী সুন্দর দেখা যায়। অত উঁচু মন্দিরের গাত্রবর্ণ অপূর্ব সোনালী রঙে ভরে যায়। আবার সূর্যদয়ের সূর্যকে যখন গোপুরমের গরুর দুটি শিংএর ওপর দেখা যায়, অতি চমৎকার এই দৃশ‍্য দেখে মনে হল “ আমি কি হেরিলাম হৃদয় মেলে, নয়ন ভুলানো এলে….”

No comments:

Post a Comment