Thursday, December 26, 2019























শীতের সকাল


শেখ একেএম জাকারিয়া




ছয় ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। এ ঋতু দুমাস পর পর বদল হয়। ছয় ঋতু ক্রমান্বয়ে ঘুরতে থাকে


প্রকৃতির বুকে। ঘুরতে ঘুরতে একসময় শীত আসে বাংলাদেশের সবুজ ছায়াঘন সুনির্মল 

প্রকৃতিতে । হেমন্তের শেষদিকে  ফসল ভরা সবুজহলুদ মাঠ যে সময়ে রিক্ত হয়ে ওঠে,সেই সময়ে 

ঘন কুয়াশার চাদরে মুখ ঢেকে  শীত আসে এদেশের মাঠেঘাটে, অলিতে গলিতে। ধীরে ধীরে 

ইন্দ্ৰিয়গ্রাহ্য জগতে বাড়তে থাকে  শীতের প্রাবল্য। দক্ষিণের বিপরীত থেকে আসা মৃদু  পবন 

এসময় অত্যুগ্র ঠাণ্ডা  নিয়ে  আমাদের মাঝে হাজির হয়। প্রকৃতি এসময় তার দেহবসন খুলে 

নিজেকে মেলে ধরে খসখসে বিরক্তির  মুখে। প্রকৃতিতে সৃজন হয় নতুন এক অধ্যায়ের, নতুন

 এক সৌন্দর্যের।শীতের সকালের এ সৌন্দর্যে প্রাণীজগৎ  বিমোহিত  হয় । প্রতিটি শীতের 

সকাল আমাদের মাঝে উপস্থিত হয় কুজ্ঝটিকায় ঘেরা উপমাহীন সৌন্দর্য নিয়ে। পুবের  সূর্য 

আগুনের শিখা পুরোপুরি ফুটে ওঠার আগেই পশুপাখির হৃদয়ে  সূর্য আসার গোপন সংবাদ সবার

 অলক্ষ্যে ছড়িয়ে পড়ে। শীতের প্রাবল্য থেকে নিজেদের বাঁচানোর জন্য সূর্যকে অভ্যর্থনা 

জানাতে গায়ের প্রতিটি গোয়াল ঘরে,  বনবাদাড়ে পশুপাখির কন্ঠে ভেসে ওঠে সূর্য আসার  

আহ্বান –গীতি। এ সময়ে  মুয়াজ্জিনের  কণ্ঠে ভেসে আসে সুমধুর আযানের ধ্বনি। ধর্মপ্রাণ 

মুসলমানরা তীব্র শীতের কামড় অগ্রাহ্য করে ছুটে চলেন মসজিদে। এর কিছুক্ষণ পরেই 

কুজ্ঝটিকা ভেদ করে ফুটে ওঠে আলোকরশ্মি।  বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামের সবুজমাঠে  গবাদি

 পশুর  ডাক আর রাখালের পদচারণা শুরু হয়। কৃষকেরা লাঙল-জোয়াল কাঁধে করে  গরু- 

মহিষ নিয়ে  চাষবাসের জন্য মাঠে যায়। তাদের গায়ে থাকে গতানুগতিক শীতবস্ত্র । অনেকের

 হয়তো তা-ও নেই। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে আপন কাজে মাঠে  চলে। আমাদের দেশে 

শীত সকালের দৃশ্য একটু ভিন্ন আমেজের। পুরো সকাল এসময় কুহেলিকায় ঢাকা থাকে। 

 মাঠের পর মাঠ বনের পর বন, গ্রামের পর গ্রাম,  শহরের পর শহর অর্থাৎ পুরো প্রকৃতিকে

 কে যেন সাদা কাপড় পরিয়ে  ঢেকে রাখে। ঘড়ির দিকে না তাকালে বোঝার কোনও উপায় 

নেই অনেক বেলা হয়েছে। প্রকৃতির এমন রূপ দেখলে মনে হয় যেন এইমাত্র সকাল হয়েছে। 

এসময় পুরো প্রকৃতি থাকে শিশিরস্নাত। ঘরের বাইরে বের  হলে অনুভব করা যায় 

হাড়কাঁপানো কনকনে শীতের প্রভাব কতটুকু । লেপ-কাঁথা ছেড়ে উঠতে কিছুতেই মন সায় দেয়

 না। শিশু-কিশোরেরা সাতপ্রভাতে সূর্যের  মিঠামুখ দেখার জন্য বারবার জানালায় উঁকি দেয়।

 তা ছাড়া এমন দিনে ছোটোবড়ো সকলেই বাড়ির আঙিনায়, শহর-গ্রামে পাড়ার ভেতরে খোলা

 জায়গায়, সড়কে দলবেঁধে গালগল্পে মেতে ওঠে। কোথাও কোথাও আগুন পোহাবার 

 মনোমুগ্ধকর  দৃশ্যও চোখে পড়ে। শীতের সকালের  প্রধান আকর্ষণ পেঁয়াজ-রসুনের সবুজক্ষেত

, সরিষা ফুলের হলুদ মাঠ, মাচায় ঝুলে থাকা সিম- লাউয়ের বাহারি ফুল। সকালের

সূর্যোলোক যেন তার নিপুণ হাতে প্রতিটি উদ্ভিদ ও পুষ্পকে নবরূপে সাজিয়ে তুলে। শীতের 

সকালে গ্রামের প্রকৃতি এক কথায়
অনির্বচনীয়। এসময় গ্রামের পরিশ্রমী মানুষগুলোর একটু আরাম করার জো নেই । গ্রাম-গঞ্জের

 মানুষের জন্য শীতের সকাল খুবই কষ্টকর। শীত নিবৃত্তির মতো দরকারি কাপড়-চোপড়

 অনেকেরই থাকে না। শীতের তীব্রতা অগ্রাহ্য  করে খুব সকালে তাদেরকে মাঠঘাটে কাজ 

করতে যেতে হয়। কিষাণ বধূরাও তখন ধান সিদ্ধ, সিদ্ধধান শুকানো,  ধান ভানা, 

রান্নাবান্না  ইত্যাদি নানা কাজে ব্যস্ত থাকে। তা ছাড়া শীতসকালে গ্রামে-গঞ্জে  

ফেরিওয়ালাদের  দেখা যায়। এরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে মোয়া-মুড়কি, নানা ধরনের মিঠাই-মিষ্টি,

 খেজুরের রস ইত্যাদি বিক্রি করে থাকে।  এসময় সকালের সোনালি রোদ হীরক দ্যুতি ছড়িয়ে 

দেয় গ্রাম-গঞ্জের মাঠেঘাটে ও হাটে। সবুজ ঘাসের ওপরে জমা  সূর্যালোকিত শিশিরবিন্দু চোখ 

ধাঁধিয়ে দেয়। এ দৃশ্য যথার্থই  মনোরমা। শীতের সকালে যখন কথা বলার সময়  মুখ থেকে

 হালকা গরম সাদা  ধোঁয়ার মত বের হয়, নদী থেকে জলীয় বাষ্প যখন কুয়াশার সঙ্গে মিশে 

বাতাসে ভেসে বেড়ায়, তখন প্রকৃতিতে এক অপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয়। অপরদিকে শীতের 

সকালে শহরের অবস্থা ভিন্নতর। এ সময়ে গ্রামের দিগন্ত বিস্তৃত মাঠঘাট  যে সৌন্দর্য মহিমায় 

সেজে ওঠে, শহরের ইট-পাথর ঘেরা কৃত্রিম পরিবেশে তার আভাস তেমন একটা দেখতে পাওয়া

 যায় না। সকালে আযানের ধ্বনি শেষ হতে না হতেই প্রতিদিনের কর্মচঞ্চলতা নিয়ে জেগে উঠে

 শহর ও শহরের মানুষজন। শিশির ভেজা শীতের সকালে শহরের পাকা রাস্তায় হেডলাইট

 জ্বালিয়ে গাড়ি চালাতে হয়। রিকশাওয়ালা ঘন কুয়াশা ভেদ করে ধীর গতিতে রিকশা চালায়।

 রাস্তার পাশে চায়ের দোকানগুলোতে লোকজনের ভিড় জমে ওঠে।  হকার পত্রিকা নিয়ে ছুটে 

যায় মানুষের  দ্বারে দ্বারে। শীতের সকালে উল কাপড় জড়িয়ে রাস্তায় বের হয় শহরের

 লোকজন। তাদের পোশাকে রয়েছে কত না বৈচিত্র। শিশুকিশোরেরা নানা রং বেরঙের 

শীতের পোশাক পড়ে ছুটতে থাকে বিদ্যালয়ে। আর শহরের  বস্তিগুলোতে  শীত আসে নির্মমতা

নিয়ে। শীত নিবৃত্তির জন্য শীতবস্ত্র তাদের থাকে না। কনকনে শীতে তারা কাঁপতে থাকে। 

তাদের দেখভাল করার জন্য যেন বিধাতাও বিমুখ সেখানে।


শীতের সকালের অনেক উপভোগ্য জিনিস রয়েছে । তারমধ্যে আলোচাল ভাজা ও মুড়ি খুব 

আরামদায়ক খাবার। এসময় গুড়সহ  আলোচাল ভাজা, মুড়ি খেতে খেতে রোদকে উপভোগ 

করার দৃশ্য পল্লি বাংলায় এখনও দেখা যায়। ঘরে ঘরে সে সময়ে পিঠাপুলি খাওয়ার ধুম পড়ে।

  শীতে গরম গরম ভাঁপা  পিঠা খেতে যে মজা পাওয়া যায়, যা অল্পকথায় লিখে প্রকাশ করা 

সম্ভব নয়। এসময়  গাছ থেকে পারা তাজা খেজুরের নির্যাস পান করা খুবই তৃপ্তিদায়ক। এ 

খেজুরের নির্যাস দিয়ে তৈরি পিঠা-পায়েস  খাওয়ার মধ্যেও রয়েছে এক নির্মল আনন্দ। 

শীতঋতুর  এই বৈচিত্র্যময় আমেজ  হোমোসেপিয়ান  গোষ্ঠিভুক্ত প্রণীর অর্থাৎ মানুষের মনকে 

যথার্থই আলোড়িত করে।

No comments:

Post a Comment