Friday, January 10, 2020






শীতের পাখি

শেখ একেএম জাকারিয়া


মানুষসহ সচরাচর সব প্রাণীদেরই সীমান্তরেখা থাকে। পাখিদের কোনও সীমান্ত রেখা নেই। পাখিরা স্বচ্ছন্দে সীমাহীন অন্তরীক্ষে পাখনা মেলে এক প্রদেশ থেকে  অন্য প্রদেশে, এক দেশ থেকে অন্য দেশে ঈষৎ মেহনতে উড়ে বেড়ায়। পাখিরা বাঁচার তাগিদে,খাদ্যের অন্বেষণে  প্রত্যহ উড়ে চলে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে। বড়ো বিস্ময়কর তাদের বাসা বুনার সাধনচাতুর্য,সন্তান জন্মদান ও লালনপালন। প্রচণ্ড ঝড়বাদল, প্রখর সূর্যকিরণ, তুষারপাতসহ প্রকৃতির নানা প্রতিকূলতা অগ্রাহ্য করে পাখিরা রওনা দেয় বহুসহস্ৰ মাইল দূরের দেশে। পাখি সম্পর্কে প্রাণিতত্ত্বে বিশদ বিবৃতি রয়েছে। পাখির সহজবোধ্য সংজ্ঞা হচ্ছে,'সচরাচর উড়তে পারে এমন,পালকে আবৃত দেহ, তীক্ষ দৃষ্টি ও প্রখর শ্রবণশক্তিসম্পন্ন উষ্ণ রক্তবিশিষ্ট ডিম্বাজ মেরুদণ্ডী প্রাণিবিশেষই পাখি। অথবা'দুই ডানা ও দুই পা-যুক্ত এবং সাধারণত আকাশে ওড়ার ক্ষমতাযুক্ত ডিম প্রসবকারী প্রাণীই পাখি।'বাংলা একাডেমির  ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে পাখির বিভিন্ন নাম দেখতে পাওয়া যায়। তারমধ্যে পক্ষী, বিহগ,বিহঙ্গ, খগ ইত্যাদি উল্লেখ্য। প্রাণিতত্ত্বের  হিসাব মতে, সূর্যকে প্রদক্ষিণকারী নবগ্রহের অন্যতম গ্রহ পৃথিবীতে প্রায় ১০ হাজার প্রজাতির পাখির মধ্যে ১৮৫৫ প্রজাতির পাখিই (প্রায় ১৯%) পরিযায়ী। ভারত  উপমহাদেশে এই সময়ে ২ হাজার ১ শত প্রজাতির পাখি আছে। যাদের  মধ্যে প্রায় সাড়ে ৩ শত প্রজাতির পাখি শীতঋতু আগমনের পূর্বে হেমন্তঋতুর প্রায় মধ্যভাগে ভারতের উত্তরপ্রান্তে অবস্থিত বরফে ঢাকা বিশ্বের বৃহত্তম পর্বতশ্রেণি হিমালয়সহ অন্যান্য ছোটোখাটো পর্বতশ্রেণি অতিক্রম করে আমাদের দেশে উপস্থিত হয়। এসব পাখিদেরই আমরা পরিযায়ী পাখি,শীতের পাখি,অতিথি পাখি ইত্যাদি বিভিন্ন নামে অভিহিত করে থাকি। সাধারণভাবে পরিযায়ী পাখির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে লিখতে হয়,'শীতঋতুতে অস্থায়ী বসবাসের জন্য উষ্ণতর দেশে গমন করে এমন পাখি, পরিযায়ী পাখি।' এ দেশে মৃদু হাওয়ায় যে সময়ে শীতের আভাস দেখা দেয় সে সময়ে হাওর-বাঁওড়, খালবিল, চরাঞ্চালে নানা প্রজাতির পরিযায়ী পাখির দেখা মিলে। এসব পাখির অর্ধেকের বেশি  ইংল্যান্ডের নর্থ হ্যামশায়ার,সাইবেরিয়া,এন্টার্কটিকার শীতাধিক্য থেকে নিজেদের বাঁচাতে এবং আহারের খোঁজে  চলে আসে আমাদের দেশসহ অপরাপর কম শীতের দেশগুলোতে। তা ছাড়া মঙ্গোলিয়া, জিনজিয়াং, ভারত, নেপাল,পাকিস্থানসহ শীতপ্রধান অঞ্চল থেকেও আসে নানাপ্রজাতির পরিযায়ী পাখি। পরিযায়ী পাখি সাধারণত সেপ্টেম্বর,অক্টোবর ও নভেম্বরের দিকে আমাদের দেশে দলবেঁধে আসা শুরু করে। জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত এসব অতিথি পাখির কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে ওঠে সবুজ হলুদ ছায়াঘন রূপসী বাংলার নয়ন মনোমুগ্ধকর প্রকৃতি। অতঃপর এসব পরিযায়ী পাখিদের শুরু হয় নিজ দেশে ফেরার পালা। পাখি বিশেষজ্ঞদের মতে, ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি এ দুমাসে সবচেয়ে বেশি পাখি আসে আমাদের  বাংলাদেশে। স্বভাবগতভাবেই পাখিদের শরীরবিষয়ক অবয়ব অনেকটা দৃঢ়। পাখি সাধারণত ভূমি থেকে অর্থাৎ  ৬০০ থেকে ১৩০০ মিটার উপর দিয়ে উন্মুক্ত আকাশে উড়ে বেড়ায়। যেসব পাখি ছোট আকৃতির তাদের গতি  ঘণ্টায় প্রায় ৩০ কিলোমিটার। আর ২৪ ঘন্টায় অর্থাৎ দিন-রাত মিলিয়ে এসব  পাখি প্রায় ২৫০ কিলোমিটার উড়তে পারে।  অপরদিকে  যেসব পাখি বড় আকৃতির তারা ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার সামান্য পরিশ্রমেই  উড়তে পারে। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, এসব পরিযায়ী পাখি তাদের গমনের লক্ষ্যস্থল শতভাগই ঠিকভাবে নির্ধারণ করতে পারে। শীতঋতু  এলেই অতিথি পাখির মধুর গুঞ্জনধ্বনিতে দি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ  খ্যাত সুনামগঞ্জের  টাঙ্গুয়ার হাওরের  নয়কুড়ি  কান্দা, ছয়কুড়ি বিল মুখরিত  হয়ে  ওঠে। এ হাওরের কান্দা ও বিলে প্রায় ৫১ প্রজাতির পাখি বিচরণ করে। পরিযায়ী পাখিদের মধ্যে এ হাওরে আছে বিরল প্রজাতির প্যালাসেস ঈগল, বড় আকারের গ্রে কিংস্টর্ক । স্থানীয় জাতের মধ্যে নিয়মিত বিচরণ আছে শকুন, পানকৌড়ি, বেগুনি কালেম, ডাহুক, বালিহাঁস, গাঙচিল, বক, সারস, কাক, শঙ্খ চিল, পাতি কুট  ইত্যাদি পাখির । এছাড়া আছে বিপন্ন প্রজাতির পরিযায়ী পাখি কুড়ুল।  ২০১১ সালের পাখিগণনাতে এই হাওরে চটাইন্নার বিল ও তার খাল, রোয়া বিল, লেচুয়ামারা বিল, রুপাবই বিল, হাতির গাতা বিল, বেরবেরিয়া বিল, বাইল্লার ডুবি, তেকুন্না ও আন্না বিলে প্রায় ৪৭ প্রজাতির জলচর পাখি বা ওয়াটারফাউলের মোট ২৮,৮৭৬টি পাখি গণনা করা হয়। এ গণনাতে  অপরাপর পাখির পাশাপাশি নজরে আসে কুট,মরিচা ভুতিহাঁস,পিয়ংহাস; সাধারণ ভুতিহাঁস,পান্তামুখী বা শোভেলার, লালচে মাথা ভুতিহাঁস, লালশির, নীলশির, পাতিহাঁস, লেনজা, ডুবুরি, পানকৌড়ি ইত্যাদি পাখিও।
ওপরে বা পূর্বে লিখিত পাখিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক পাখি হচ্ছে জেন্ডা সিগলা ( জাডানিক) বা সরালী হাঁস। এসব হাঁস দলবেঁধে শিস দিতে দিতে উড়ে চলে এক বিল থেকে অন্য বিলে, এক হাওর থেকে অন্য হাওরে,  একদেশ দেশ থেকে অন্য দেশে। কালচে, বড় ও লম্বা গলার এ হাঁস দেখতে  অবিকল দেশীয় পাতিহাঁসের মত। টাঙ্গুয়ার হাওরপাড়ে বসবাসরত লোকজনকে  জিজ্ঞাসাবাদ করলে জানা যায়, সরালী হাঁস দিনের প্রথমভাগে  ও শেষভাগে দলবেঁধে হাওর জলে  সাঁতার কাটে ও মাছ ধরে।  দিনের হালকা মিষ্টি রোদ এদের খুব প্রিয়।  টাঙ্গুয়ার হাওর ছাড়াও দেশের অন্যতম উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, মিরপুর চিড়িয়াখানার লেক, বরিশালের দুর্গাসাগর, নীলফামারীর নীল সাগর, সিরাজগঞ্জের হুরা এসব পরিযায়ী বা অতিথি পাখিদের পছন্দের অবকাশ কেন্দ্র। মূলকথা,বাংলাদেশের যত জলাশয়াদি রয়েছে সবই যেন এসব পরিযায়ী, ভিনদেশী, অতিথি পাখিদের নিরাপদ অভয়ারণ্য। বেশ কয়েক বছর ধরে নিঝুম দ্বীপ, দুবলার, চরকুতুবদিয়া এলাকাতেও শীতের পাখিদের  বসতি গড়তে দেখা যাচ্ছে। নৈসর্গিক বিপর্যয় বা শত্রুভাবাপন্ন পরিবেশ  থেকে নিজেকে বাঁচানোর  জন্য  যেসব পাখি প্রতিবছর বহু সহস্র মাইল পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আসে বিপদহীন বাসস্হানের খোঁজে, যেসব পাখি খাদ্যের নিশ্চিত সন্ধান,  সন্তান জন্মদানের জন্য আপন করে বেছে নেয় বাংলার  সবুজ ছায়াঘন সুনির্মল প্রকৃতি, সেখানেও  বাজপাখির মত  প্রখর দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন শিকারির হাত থেকে বাঁচার সৌভাগ্য তাদের অনেক সময়ই হয় না। শিকারির  বন্দুকের গুলিতে অথবা শিকারির ফাঁদে প্রাণ হারাতে হয় নিজেদের অথবা তাদের স্বজনদের। প্রাণ হারানোর এমন আতঙ্ক সবসময় তাদের বিচলিত রাখে। বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামের দরিদ্র লোকজন অভাবের তাড়নায় পাখি শিকার করে শহরে, গ্রামে-গঞ্জের বাজারে কিংবা রাস্তা-ঘাটে বিক্রি করছে কিন্তু যারা কিনছে তারা শহরের  শিক্ষিত ও বিত্তশালী । এই যে অবাধে আমাদের দেশে পাখি শিকার ও ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে এসব কিন্তু আদতে প্রোটিনের চাহিদা মেটানোর জন্য নয়,শুধুমাত্র রুচির পরিবর্তনের জন্যই তারা নিজেরা শিকার করে অথবা কিনে নেয় নানারকমের পরিযায়ী পাখি। একটা লেনজা কিংবা একটা সরালী হাঁস-এ আর কতটুকুইবা মাংস হয়? এসব পরিযায়ী পাখি ব্যাতিরেকেও প্রোটিনের চাহিদা মেটানো কিংবা রুচির পরিবর্তন করা সম্ভব। এক্ষেত্রে মানুষের সচেতনতা ও নিসর্গের প্রতি অনুরাগই সবচেয়ে বেশি কাজে আসবে। পাখি শিকারের মত নিষ্ঠুর কাজ বন্ধ করতে হলে আমাদের গণসচেতনতা বাড়ানো খুবই জরুরি। এর জন্য পত্র-পত্রিকায় নিউজসহ রেডিও-টেলিভিশনে বিবিধ ডকুমেন্টারি প্রচার করা উচিত।
পরিযায়ী পাখির জন্য সরকারি হিসাব অনুযায়ী ১২টি অভয়াশ্রম থাকার কথা। কিন্তু বস্তুত অভয়াশ্রম বলতে যা বুঝায় তা আজ অবধি সম্পূর্ণরূপে গড়ে উঠেনি। ১৯৭৪ সালের বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী আইনের ২৬ ধারা অনুযায়ী  পাখি শিকার ও হত্যা দন্ডনীয় অপরাধ। শীতের শুরুতে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় অতিথি পাখি হত্যা, জাল ব্যবহার ও শিকার ইত্যাদির ক্ষেত্রে কিছু আইনগত কার্যকারিতা দেখায়। পরিতাপের বিষয়,কয়েকদিনের মধ্যেই এ তৎপরতায় ভাটা পড়ে। কিন্তু কেন এ তৎপরতায় এই ভাটা,এর ঠিক জবাব আমার জানা নেই।
পত্রিকাদি পাঠে জানা যায়,সবুজ হলুদ ছায়াঘন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দেশ, পাখির দেশ, গানের দেশ, কবিতার দেশ বাংলাদেশ পেয়েছে অতিথি পাখি সমৃদ্ধ অঞ্চল হিসেবে বিশেষ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। ফ্রেন্ডশীপ ইস্ট এশিয়ান-অস্ট্রেলিয়ান ফ্লাইওয়ে নামক অতিথি পাখি সংরক্ষণ ও গবেষক সংস্থা বাংলাদেশকে এ স্বীকৃতি দিয়েছে। এ সংস্থার একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়কে স্বীকৃতিমূলক সনদপত্র হস্তান্তর করে। সংস্থাটির দেয়া সনদ অনুযায়ী বাংলাদেশের টাঙ্গুয়ার হাওর, হাকালুকি হাওর, হাটল হাওর, নিঝুম দ্বীপ ও সোনাদিয়া-এই পাঁচটি এলাকা পরিযায়ী পাখিসমৃদ্ধ অঞ্চল। তাদের মতে, এসব এলাকায় বহুবছর ধরে পরিযায়ী পাখিরা নিরাপদে বাস করছে। তড়িৎ গতিতে এসব অঞ্চল সংরক্ষণে বিশেষ উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। কঠোর আইন অর্থাৎ সহজে শিথিল নয় এমন আইন প্রণয়নের পাশাপাশি গণসচেতনতা ও সৌন্দর্য পিপাসু দৃষ্টিভঙ্গিই বাঁচাতে পারে এসব পরিযায়ী পাখিদের। প্রকৃতির উপমাহীন উপটৌকন পরিযায়ী পাখি শুধু আমাদের সম্পদ নয়, সমগ্র পৃথিবীর সম্পদ। প্রকৃতির সৌন্দর্যবৃদ্ধিতে নিজেদের সৌন্দর্যবৃদ্ধিতে  এদেরকে বাঁচিয়ে রাখা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। প্রচণ্ড শৈত্যপ্রবাহ থেকে বাঁচতে উত্তরের যে সব পাখি আমাদের দেশে আশ্রয় নেয় তাদের এই দুঃসময়ের সুযোগ নেয়া নৈতিকতার পরিপন্থী। পরিশেষে দেশের সবমানুষকে বলতে চাই,আমাদের হরিৎ হরিদ্রা ছায়াঘন অমলিন প্রকৃতিতে এসব পরিযায়ী পাখি যেন পায় মেহমানের যত্ন-আত্তি ও নির্মল সুস্থিরতা, তাদের যেন যৎকিঞ্চিৎ অনিষ্টও  না হয়।  তারা  যেন নিজেদের জ্ঞাতি-কুটুম্ব বন্ধুবান্ধব পরিজনসহ স্বদেশে  সুস্থ ও সুন্দরভাবে ফিরে যেতে পারে এ সুযোগ তাদের দিতে হবে।


No comments:

Post a Comment