Monday, February 20, 2023


  গল্প 


খেলাঘর 

অভিষিক্তা বসু 

 

স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষে  সর্বত্রই তখন গভীর  অচলাবস্থা । বাংলায় তখন কিছু দামাল তরুণ সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার জন্যে তৎকালীন  শাসক বর্গের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। প্রশাসন ও তখন কঠোর  দমন নীতি কে অস্ত্র করেছে। কত যে মায়ের কোল শূন্য হয়েছে বাংলায় তার অন্ত নেই, আবার কত মা… শুধুই তার  হঠাৎ নিরুদ্দেশ সন্তানের ঘরে ফেরার প্রত্যাশায়, অপেক্ষার বিনিদ্র নিশি যাপন করতে করতে  মৃত্যর কোলে ঢোলে পড়েছে। তবু সমাজে সাম্য আনতে সাম্যের লড়াই এ  মেতে উঠেছে এক দল বেপরোয়া । 

নিখিলেশ তখন সবে আঠারোর উন্মাদ গণ্ডীতে , সদ্য স্কুল ফাইনাল পাশ করে এ , সি কলেজে সাহিত্য বিভাগে ভর্তি হয়েছে। নিখিলেশের পরিবার শহরের অন্যতম বনেদী, অভিজাত, রক্ষণশীল  ব্রাহ্মণ পরিবার। সামাজিক অস্থিরতা তখন সমস্ত তরুণ সন্তানের মা-বাবার চোখের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। কলেজে- কলেজে তখন কিছু উঠতি জননেতা রাজনৈতিক ভাষণের মাধ্যমে যুব সমাজ কে আকর্ষণ করার চেষ্টায় রয়েছে। নিখিলেশের কলেজেও এর অন্যথা হয় নি। উত্তপ্ত শোণিতে তখন যেন জোয়ার এসেছে। মোহগ্রস্তের মতন সাহিত্য সমালোচনার মাঝেও তার মন ছুটে যেত   কলেজের মাঠে ভাষণ রত যুবনেতা প্রকাশ পাইনের বক্ত্যবের স্বচ্ছতায়। সমাজে তখন এই একদল যুবক ঘরছাড়া বাউন্ডুলের  তকমা এঁটে নিয়েছে।  নিখিলেশ ও এই প্রবল হাত ছানি থেকে নিজেকে বেশী দিন আড়াল করে রাখতে পারে নি। তার চোখেও তখন নতুন সমাজ গঠনের স্বপ্ন বিকাশ পেতে শুরু করেছে। কলেজের ক্লাস ফাঁকি দিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক মিটিং, মিছিলে তার আনাগোনা শুরু হয়। কলেজ তার কাছে ক্রমশ হয়ে ওঠে শুধুমাত্র ভ্রমনের স্থান।

 বরাবরের মেধাবী ছাত্র নিখিলেশ কপাল গুনে সাহিত্য বিভাগে  তার নাম খানা সে বছরের মতন টিকিয়ে রাখতে পারে। প্রথম বর্ষের রেজাল্টের দিন কলেজ ক্যম্পাসে আড্ডা দিতে গিয়ে তার নজর কাড়ে এক দল মেয়ের একটি জটলা। এর মধ্যে থেকে উচ্ছ্বসিত হালকা হলদে শাড়ি পড়া , লম্বা এক ঢাল কালো অলক রাশির ছটা , কানের পাশে কুঞ্চিত এক গোছা চুলের মাঝে উঁকি দেওয়া ছোট কানের দুল আর প্রবল ভাবে শরীরী ঝাঁকুনিতে আড্ডার মধ্যমণি হওয়া মেয়ে টি কে এক নজরে বেশ ভালো লেগে যায় নিখিলেশের। একটু খোঁজ খবর নিতেই জানতে পারে মেয়ে টি এবারের প্রথম বর্ষের ইতিহাস বিভাগের ছাত্রী। নাম অনামিকা পাণ্ডে। 

এক দিকে সদ্য নকশালী পৃষ্ঠায় নাম লেখানো নিখিলেশ দীক্ষা নিচ্ছে সমস্ত পিছুটান সময়ের স্রোতে ভাসিয়ে দেওয়ার, আর অন্যদিকে তার মনে নতুন করে অনামিকা নামক পিছুটান সৃষ্টি করছে, বুনে চলেছে কিছু রঙিন স্বপ্ন। গোষ্ঠীর মিটিং- মিছিলের মাঝেও এখন তার নিত্য আনাগোনা কলেজ প্রাঙ্গনেও। কলেজের নবীন বরণের দিন আলাপ পর্ব টি সারা হয়ে যায় নিখিলেশের সাথে অনামিকার।
সময়ের অগ্রগতির সাথেই আলাপের কাল সীমানা পেড়িয়ে ঘনিষ্ঠতা বারে দুজনের মধ্যে। কলেজের সমস্ত প্রেমিক যুগলের অন্যতম জুটি তখন নিখিলেশ- অনামিকা। ক্লাসের বেঞ্চ , লাইব্রেরীর টেবিল, তেতলার ছাদ এমনকি মাঠের দেবদারু গাছ ও তখন তাদের সদ্য অঙ্কুরিত প্রেমের সাক্ষী বহন করে চলেছে। অনামিকার প্রবল আকর্ষণে তখন কিছুটা শিথিল হয়েছে নিখিলেশের গোষ্ঠীর আড্ডা। বান্ধবীদের মারফত কখনও কখনও আদান-প্রদান হত প্রেমের আখরে ভরা অভিসারী চিঠি। 

বেশ ভালোই কাটছিল দিন গুলো। কিন্তু ওপর ওয়ালার বিচার  খণ্ডানো সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। কোনোমতে কলেজের ফাইনাল পরীক্ষা টা দিয়েই নিখিলেশ পাকাপাকি ভাবে রাজনৈতিক দলে জড়িয়ে পড়ে।  এখন শুধু বিপ্লবের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়া । অনামিকার প্রবল আকর্ষণ কখনও কখনও পথের অন্তরায় হলেও তাকে আমল দেয় নি সে। একটা সময় অনামিকাও বুঝে গিয়েছিল তার প্রেমিক পুরুষ টি অত সহজে ধরা দেবে না। এভাবেই তাকে সকলের সাথেই ভাগ করে নিতে হবে। 
অনামিকার ফাইনাল পরীক্ষার আগেই তার বাড়ির লোক তার জন্যে পাত্র খুঁজতে আরম্ভ করে। তার দাদারা জেনে গিয়েছিল তাদের এই সম্পর্কের কথা। তাদের মতন অবাঙালি রক্ষণশীল পরিবারে মেয়েদের উচ্চ শিক্ষাই অনেক বড় বিষয়, সেখানে কিনা প্রেম বিবাহ !! নৈব, নৈব চ। আনামিকার মুখে নিখিলেশ একদিন সব জানতে পারে। সে তার বাড়িতে মায়ের কাছে গিয়ে অনামিকা কে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। শুনেই নিখিলেশের মা মূর্ছিত প্রায় । ছেলে  বলে কিনা  শাল্গ্রাম শিলা স্থাপন করা ব্রাহ্মণ বাড়িতে ঐ অবাঙালি পরিবারের মেয়ে আসবে !!

 নিখিলেশের বাবার কানেও কথা টি গিয়ে পৌঁছালে তিনি কোনোভাবেই মত দেন না। এদিকে একদিন অনামিকার বাড়িতে  নিখিলেশ এসে উপস্থিত হয়। অনামিকার দাদারা তাকে প্রায় মারতে তেড়ে  আসে। দু পরিবার যেন কিছুতেই তাদের ভালবাসাকে স্বীকৃতি দিতে চায় না। অনামিকার বান্ধবীর হাতে পাঠানো চিঠির উল্লেখ মতন সেদিন গভীর রাতে নিখিলেশ শহর সংলগ্ন রেল স্টেশনে অপেক্ষা করে তার।   কিন্তু সামাজিক প্রতিরোধ  ও পারিবারিক সম্মান উপেক্ষা করে অনামিকা বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসার মতন কঠিন সিদ্ধান্ত ও নিতে পারে না।এক সময় নিখিলেশের অপেক্ষার মেয়াদ ফুরিয়ে যায়। শেষ ট্রেন টাও  স্টেশন ছেড়ে বেড়িয়ে যায়। জীবনের আর কোনও উদ্দেশ্য তার মনে আসে না। সে রাতেই সে সিদ্ধান্ত নেয় , আর নয় তার নিঃশ্বাসের শেষ বাষ্প টাও এবার সে উৎসর্গ করবে দেশের জন্যে। 

অনামিকার প্রতি প্রগাঢ় অভিমানে সে নিজেকে রাজনীতির কঠিন ও বেপরোয়া দিকে ঠেলে দিতে থাকে। প্রায় প্রতিদিনই খবরের কাগজের শিরোনামে তার বিভিন্ন দুঃসাহসিক কর্মকাণ্ডের কাহিনী প্রকাশিত হতে থাকে। কখনও পোশাকি নামে ,কখনও বা ছদ্ম নামে তার কার্যকলাপ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। নিখিলেশের বাবার সম্মানে আঘাত হানে ছেলের এমন কাজ কর্ম। প্রায়ই বাড়ি ফিরে বচসা শুরু হয়। ঘরছাড়া হয় নিখিলেশ। তারপর একবার এই ডাল তো আরেকবার এই ডাল, কখনও কখনও গা ঢাকা দিয়ে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে ঘুরে বেড়াতে থাকে সে। কখনও একলা হলে মনের কোনে ঝড় তোলে অনামিকার স্মৃতি। সেদিনের পর আর কোনোদিন খোঁজ করে নি সে তার। ক্রমে তার গায়েও সেঁটে গিয়েছে নকশালি তকমা। 

একটা সময় প্রশাসনের কঠোর দমন নীতি প্রয়োগের ফলে নকশাল আন্দোলন স্তিমিত হয়ে আসে। বহু তাজা রক্তে ভেসে যায় বাংলার রাজপথ। দীর্ঘ সময় ফেরার থাকতে থাকতে একটা সময় ক্লান্ত হয়ে পরে নিখিলেশ। তাকে  ধরা পড়তে হয় পুলিশের হাতে। বিচারে ১২ বছর তার সাজা হয়।  

১২ বছর সংশোধনাগারের আবহাওয়ায় তার একমাত্র সাথী ছিল অনামিকার স্মৃতি । এক মুহূর্তের জন্যও তাকে সে ভুলতে পারে না। শয়নে – স্বপনে – জাগরণে সব সময় তার সাথে কাটানো ভালবাসার মুহূর্তেরা তাকে বেঁচে থাকার  রসদ জুগিয়ে গিয়েছে। কখনও সে কারো কাছে জানতে চায় নি অনামিকা কেমন আছে। অথচ খুব সহজেই সে তার খোঁজ নিতে পারত। কারা জীবনের এই চার দেওয়ালের মাঝে ,সে খুব একটা কারোর সাথেই তেমন মেলামেশা করে না। ইতিমধ্যেই সে খবর পেয়েছে তার গ্রেপ্তারীর খবরে তার বাবা  কালের পথে   যাত্রা করেছে। স্বামীর মৃত্যু ও ছেলের হাজতবাস এর ধাক্কা তার মা ও সামলাতে পারে নি । বাবার মৃত্যুর মাস খানেকের  মধ্যে মা ও ইহলোক ত্যাগ করেন । কাগজে কলমে সে এখন সর্বহারা । নেই কোনও পিছুটান। এই ১২ বছরের জেল জীবনে কেউই তার খোঁজ রাখে নি। দলের ছেলেরা অনেকেই বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে গিয়েছে। কেউ কেউ আপোষ করে নিয়েছিল পুলিশের সাথে। তারা এখন ঘোরতর সংসারী । নিখিলেশের মতন মানুষের ছায়াও তারা মারায় না। কিন্তু , এত গুলো বছর শুধু একজন তার খোঁজ রেখে গিয়েছে। নিয়ম করে প্রতি মাসেই সে দেখা করে যেত। সে আর কেউ নয়, নিখিলেশের ছোট বেলার বন্ধু  প্রবাল। তার মাধ্যমেই সে তার বাবা- মা এর মৃত্যুর খবর টুকু পেয়েছে। বর্তমানে নিখিলেশের বাড়ির দেখা শোনার দায়িত্ব ও সে ঘাড় পেতে নিয়েছে। 

এমনই একদিন প্রবাল দেখা করতে আসে নিখিলেশের সাথে জেলে। সেদিন শুরু থেকেই নিখিলেশ ভীষন অন্যমনস্ক ছিল। কথায় কথায় প্রবাল জানায়, তার গ্রেপ্তারীর কিছুদিন পরই অনামিকার বাড়ি থেকে তাকে এক বড়োলোক পরিবারের ব্যাবসায়ি ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। এক দীর্ঘশ্বাস ঝড়ে পরে নিখিলেশের। অনামিকা এখন পরস্ত্রী । তার কথা ভাবা তা বোধ হয় অন্যায় হচ্ছে। খুব জানতে ইচ্ছে করে তার সেও কি কখনও এমন ভাবে কষ্ট পায়, যন্ত্রণায় কেঁদে ওঠে। নাকি সব ভুলে ধনী স্বামীর আহ্লাদে সে এখন মজে গিয়েছে। অনামিকা কে ভোলার তাগিদে সে যেন তার হৃদয়ের গভীরে আরও গভীরে ইমারত তৈরি করছে।

১২ বছরের মেয়াদ শেষ হবার আগেই এই ১০ বছরের গোড়ায় ছাড়া পায় নিখিলেশ তার জেল জীবনের সুখ্যাতির জন্যে।  সেদিন আগে থেকেই রিক্সা নিয়ে উপস্থিত ছিল প্রবাল জেলখানার বাইরে। একরকম জোর করে তাকে সে তার বাড়িতে নিয়ে যায়। পথে যেতে কত কিছুই যেন অচেনা মনে হয় নিখিলেশের। এক সময় অনামিকার বাপের বাড়ির পথ টাও অতিক্রম করে তারা।মনে ভেসে আসে জমাট বাঁধা মলিন স্মৃতি গুলো। পথের ধারে নোংরা ঘিঞ্জি বস্তি ,  উলঙ্গ পথ শিশুর হাহাকার  এসব কিছু দেখে কেমন যেন অস্থির হয়ে ওঠে তার মন। তারা তো এই সমাজের স্বপ্ন দেখে নি। তারা  তো সামাজিক সাম্য  আনতে চেয়েছিল। দশ বছরে তার চেনা শহর এত অচেনা হয়ে গেছে যে আজ যেন সে নিজেকেই চিনতে পারছে না। অথচ সমাজ গড়ার অঙ্গীকারে আজ তারাই সমাজের দাগী আসামী। এই সমস্ত ভাবতে ভাবতেই রিক্সা এসে থামে প্রবালের বাড়ির সামনে। 

‘ আমাকে তোর বাড়িতে নিয়ে এলি কেন প্রবাল। আমি তোদের সংসারের মতন মানানসই নই  একেবারেই ।‘ 
‘একদম কোনও কথা বলিস না নিখিল। আজ তুই ছাড়া পাবি শুনেই মা দুদিন আগে থেকেই বলে রেখেছে আমাকে তোকে যেন আমি প্রথমেই আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসি। মা কত কিছু রান্না করেছে তোর জন্যে তুই দেখবি চল ‘ ।
প্রবালের বাড়িতে প্রবেশ করতেই প্রবালের মা, এগিয়ে আসেন। 
নিখিলেশ , প্রণাম করলে , তাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন তিনি। ‘ বাবা , যে দেশ গড়তে তোমরা বিবাগী হলে সে দেশ তো উচ্ছনে গেছে। বড়লোক আরও বড়লোক হচ্ছে আর , গরিব আরও গরিব , আর মধ্যবিত্তের তো নাভিশ্বাস ‘ 
‘আঃ ! মা তুমি এই কি কথা নিয়ে পড়লে। ও কতদিন পর আমাদের বাড়িতে এলো ,ওকে একটু বিশ্রাম করতে দাও। ‘ 
নারে প্রবাল তুই ব্যস্ত হোস না, ১০ বছর তো বিশ্রামই করলাম।
‘ না না বাবা , তুমি একটু ভালো করে স্নান করে ভালো কাপড় পরে এসো তো দেখি। তারপর সেই ছোট্ট বেলার মতন তোমাদের দুই বন্ধুকে একসাথে পাত পেরে খাওয়াই।‘
‘ মাসিমা , আপনি ব্যস্ত হবেন না। আমি ঠিক আছি’।
প্রবালের পীড়াপীড়ি তেই এক প্রকার বাধ্য হয়ে নিখিলেশ স্নান সেরে প্রবালের দেওয়া পাজামা পাঞ্জাবী পরে এসে বারান্দায় বসলো। চারিদিকে চোখ ঘুরিয়ে দেখতে থাকলো সে। মধ্যবিত্তের বাড়ির উঠোন , ঘরের সাজসজ্জা সবেতেই এক পরম স্নেহশীল পরশ। যেন খুব যত্নে সব কিছু কে দুহাত দিয়ে আগলে রাখা। নিখলেশের হঠাৎ তার বাড়ির কথা মনে পড়ল। আজ না হয় এই বেলা সে প্রবালের বাড়ির অতিথি , কিন্তু তারও তো একটা বাড়ি আছে। কে জানে সেই বাড়ির কি দশা হয়েছে এত গুলো বছরে। এমন দশ – পাঁচ কথা ভাবতে ভাবতে প্রবাল এসে সামনে দাঁড়ালো। সঙ্গে একটি অল্প বয়সী বিবাহিত মহিলা। চেহারা মধ্যেই তার ব্যক্তিত্বের স্পষ্ট আভাস মেলে।
নিখিল, তোর সাথে আলাপ করিয়ে দিই, ইনি হচ্ছেন আমার সহধর্মিণী শীলা। তোকে আগে ওর কথা বলি নি,  ভেবেছিলাম একেবারে সাক্ষাতে তোকে চমকে দেবো। 
শীলা এগিয়ে এসে প্রণাম করতে  চাইলে নিখিলেশ প্রায় লাফ দিয়ে ওঠে। 
না না আমাকে প্রণাম করো না , বোন । প্রবাল এ তোর ভারী অন্যায়, আমাকে আগে বলবি তো। তোদের জন্যে তো কোনও উপহার আনা হয় নি আমার। 
শীলা বলে,’  দাদা , বোন বলে আপন করলেন আবার উপহারের কথা বলে পর করে দিলেন। আপনার মতন সাহসী মানুষের চরণ ধুলির থেকে বড় উপহার আর কি হতে পারে আমার মতন সামান্য নারীর কাছে। ‘ 
প্রবাল ঃ ‘  নে এবার জবাব দে। ‘ 
দুই বন্ধুতে আজ বহু বছর পর হা হা করে হেসে ওঠে। প্রবালের মা ঠাকুর ঘর থেকে তাদের এই হাসির দৃশ্য দেখছিলেন প্রাণ ভরে । 
দুপুরের খাওয়া দাওয়া, বিশ্রাম ইত্যাদির পর নিখিলেশ বলে – ‘ ভাই প্রবাল , এবার যে আমাকে যেতে হবে। আমার বাড়ির চাবি খানা দে দেখি এবার ‘ ।
হ্যাঁ,  যাবি  তো । তোকে তো আমি আটকে রাখতে পারবো না সে আমি জানি। অন্তত আজকের দিন টা থেকে যা।
নারে প্রবাল , তা হয় না।  
আচ্ছা চল , আমিও যাবো তোর সঙ্গে। তুই আসবি জেনেই আমি বাড়ির বাইরের জঙ্গল সব পরিস্কার করিয়ে রেখেছি। কিন্তু ভিতর টা করাতে পারি নি। তোদের বাড়ির ওত দামী দামী জিনিসপত্র। কোনটা খোয়া গেলে তখন , সেই ভয়ে আর …।
তুই যে এতদিন বাড়ি টাকে আগলে রাখলি এই বা কম কিসে রে প্রবাল। না হলে তো সাতে ভূতে ভোগ করতো । এত ইতস্তত করছিস কেন?   
বাড়ির উঠোন থেকে মাসিমা আর শীলা কে বিদায় জানিয়ে দুই বন্ধু রওনা দিল নিখিলেশের বাড়ির উদ্দ্যেশে। পথে যেতে কত চেনা- অচেনা মানুষ। কেউ বা হেসে এগিয়ে এল । আবার কেউ এড়িয়ে যেতে চাইল। উপেক্ষা আর ভালোবাসার সাজানো শব্দ গুলো এখন নিখিলেশ এখন  ভালই বোঝে। আধা  ভাঙা প্রাচীরের সাথে কোনও ক্রমে ঠেস দিয়ে আছে সুবিশাল গেট টি। এই গেট খানা নিখিলেশের বাবার জন্মের আগের তৈরি করা। গেটের  তালা খুলে ভেতরে ঢুকতেই দুটো ছোট্ট বিড়াল ছানা দৌড় দিয়ে পালালো  গোয়াল ঘরের ভেঙ্গে পড়া ঝুপড়ির আড়ালে। 
নিখিলেশ ঠাট্টা করে বলল, দেখ প্রবাল আমাকে দেখে অবলা প্রাণীও বোঝে জেল খাটা  আসামী।
কি যে আবোল তাবোল বলিস তুই । 

প্রবাল চলে গেলে নিখিলেশ  ধুলোবালি ঝাড়তে  ঝাড়তে এক প্রাচীন নস্টালজিয়ায় যেন ডুবে যাচ্ছিল। জমিদারীর পাঠ চলে গেলেও নিখিলেশের বাবা তার রাজকীয়তা বজায় রেখেছিলেন বেশ কিছু বছর। আভিজাত্যের গরিমার অতল স্পর্শ থেকে কখনও তিনি নীচের দিকে নামতেই পারেন নি। আর তার মা স্বামী আজ্ঞা কেই জীবনের শেষ ঠাঁই বলে মেনে নিতেন। অশিক্ষা আর কুসংস্কারের ঘেরাটোপ থেকে কখনও আলোর পথে হাঁটতেই পারেন নি । 

 অতীত স্মৃতির ঘোর কাটলো ওর ঘরের পাশে কাঁঠাল গাছে কোনও এক নিশাচর পাখির  ডাকে। প্রবালের বাড়ি থেকে আসার সময় মাসীমা রাতে খাবার সঙ্গে দিয়ে দিয়েছিলেন, সেখান থেকেই কিছুটা খেয়ে শুয়ে পড়ল নিখিলেশ । জীবনে এই প্রথম এই সুবিশাল বাড়িতে আজ সে সম্পূর্ণ একা।  এত খানি একা সে সেই সময়ও ছিল না যখন পুলিশের হাত  থেকে বাঁচতে এখানে ওখানে আত্ম গোপন করতে হত। তখন জীবনে একটা উদ্দেশ্য ছিল। আজ সে উদেশ্য ও নেই । তার জন্য ভাববার মতন আর একটি প্রাণীও অবশিষ্ট নেই। এসব সাত- পাঁচ ভাবতে ভাবতেই ক্লান্তি নেমে আসে দু চোখ দিয়ে। 

সকালে প্রায় বেশ বেলাতেই ঘুম ভাঙল নিখিলেশের। আজ সকাল টা তার কাছে কেমন যেন উদ্দেশ্যহীন । পাড়ার মোড়ের চা এর  দোকান থেকে চা খেয়ে , এলোমেলো ভাবেই ঘুরতে ঘুরতে এল, করলা নদী সংলগ্ন কিং সাহেবের ঘাটে ।  বহুদিন পর খোলা আকাশের নীচে ,মুক্ত বাতাসে কিছুটা সময় কাটিয়ে, হঠাৎ তার মনে হয় , সমাজে বাস করতে গেলে সংসারী না হলেও নিজের দু বেলা খাদ্য সংস্থানের জন্য অন্তত সামান্য উপার্জন তাকে করতে হবে। পুরোনো আমলের কিছু পরিচিত দোকানে সে হিসেব রক্ষকের কাজ খোঁজে। কম পারশ্রমিকের একটি কাজও সে পেয়ে যায়।  

 সকাল ১০ টা থেকে বিকেল ৫ টা অব্দি দোকানের হিসেব পত্র দেখেই বেশ দিন যাচ্ছে। খুব একটা কারোর সাথেই সে কথা বলে না। আপন মনে কাজ করে। দোকানের মালিক পক্ষও বেশ খুশি। কিন্তু সন্ধ্যার পর তার বড্ড একা লাগে। রোজ রোজ প্রবালের বাড়িতে যাওয়াটাও দৃষ্টি কটু  ব্যাপার। আসা যাওয়ার পথে সে প্রায়ই দেখে বহু শিশু শিক্ষা থেকে বিমুখ। একদিন একটি ছেলে কে ডেকে তাকে পড়াশোনার কথা বলতেই সে পাড়ার আরও পাঁচ- ছয় টা কচিকাচা কে নিয়ে এসে নিখিলেশের বাড়ির বারন্দায় উপস্থিত হয়। মাস খানেকের মধ্যে তারা বেশ আগ্রহের সাথেই অনেক কিছু শিখে যায়, যার ফলে তাদের গরিব মা-বাবা রাও বেশ আনন্দিত হয়। নিখিলেশের ও ভালোই লাগে অন্তত সমাজের কিছু কাজে তো সে নিজেকে উৎসর্গ করতে পারছে। তার সাধ্যমতন সে ওদের বই  -খাতা  সহ খাবার কিনে দেয়। খালি পেটে তো  শিক্ষা হয় না। ‘নতুন মাস্টার’  নামে  ইতিমধ্যে বেশ নিখিলেশের নাম ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। সন্ধ্যাকালীন এই পাঠশালায় কিছুদিনের মধ্যে আরও ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বেড়ে গেল। এভাবেই কেটে গেল প্রায় একটা বছর।

দোকানের কাজ মেটাতে আজ বেশ সন্ধ্যে হয়ে গেল। বাচ্চা গুলো বোধ হয় নিখিলের ফেরার অপেক্ষায় ব্যাস্ত হয়ে পড়েছে। বেশ জোরে পা চালিয়ে সে বাড়ির পথে, হেঁটে যাচ্ছিল। হঠাৎ , কানা  গলির মোড়ে অন্ধকারে কাঁথা মুড়ি দিয়ে কে যেন বসে আছে বলে মনে হল। আর ঠিক পাশেই একটি বাচ্চা মেয়ে , এই খুব জোর বছর পাঁচ- ছয়ের  একটি মেয়ে  বসে কাঁদছে। নিখিল একটু এগিয়ে এলো ওদের সামনে। বাচ্চা টিকে নাম জিজ্ঞ্যেস করতেই সে বলল তার নাম জুঁই । 

নামটা শুনেই নিখিল প্রায় বছর ১২ পেছনে ফিরে গেল । অনামিকার জুঁই ফুল খুব পছন্দের ছিল। জুঁই ততক্ষণে উঠে এসে , নিখিলেশের জামার কোনা ধরে বলছে ‘ আমাকে কিছু খেতে দাও না। আমার খুব খিদে পেয়েছে। ‘ কথা টা শুনে নিখিলেশ তাকে জিজ্ঞ্যেস করলো –
তুমি কার সাথে এখানে এসেছো? তোমার বাড়ি কোথায় ?
মেয়ে টি বলল , আমার মা এর খুব জ্বর । ঐ যে মা শুয়ে আছে।
নিখিলেশ দেখল, রাস্তার ধারে এক খানা চাদর মুড়ি দিয়ে কেউ শুয়ে আছে, মুখ খানা দেখা যাচ্ছে না। 
অনেক ডাকাডাকির পরও সারা না মিললে,   সে একটা রিক্সা ডাকে , তাদের বাড়ি নিয়ে যাবে বলে । রিক্সা ডেকে , যখন সেই মহিলা কে তুলবে বলে সে মুখের থেকে চাদর টা সরালো ,তখন পড়ন্ত গোধূলির আলোয় সে চমকে উঠলো। এতো , অনামিকা !! 
অনু !!
আর কিছু ভাবার মতন স্থিরতা তখন তার ছিল না। কোনও ক্রমে তাদের নিয়ে বাড়ি পৌঁছে,  সে দেখল তার ছাত্রছাত্রীরা বসে রয়েছে। তাদের মধ্যে একজন বড়ছেলে কে ডেকে নিখিল বলল-
বিশু  , ছুটে যা তো তোর প্রবাল কাকার বাড়ি , কাকিমা আর দিদিমা কে বল এখনি একবার আমার বাড়ি আসতে।    

কথা মতই বিশু ছুটল। সমস্ত বিবরণ দিয়ে   সে  শীলা ও প্রবালের মা কে নিয়ে এল। সে সময় প্রবালও বাড়িতেই ছিল। তিন জনেই ছুটে এসে,অজ্ঞান প্রায় অনামিকা কে দেখে তো স্তম্বিত হয়ে গেল। এরপর নিখিলের সেবা যত্নে  তাকে প্রাণে বাঁচানো গেলেও তার স্মৃতি শক্তি  ,বাক শক্তি হারিয়ে যায়। শরীরের নিম্ন ভাগ আড়ষ্ট হয়ে যায়। প্রবাল অনামিকার বাড়িতে খবর দিলে তারা জানায় , তাদের কাছে সে মৃত। 
সারা শরীরে অকথ্য  আত্যাচারের চিহ্ন স্পষ্ট, বুঝতে কারোরই কিছু বাকী থাকে না অদৃষ্টের খেলা। বোধ হীন অনামিকার দায়িত্ব ও ছোট্ট জুঁই বড় হতে থাকে তার আদরের নিখিল কাকুর কোলে- পিঠে চড়ে। অনামিকার জন্যে একটি লোক রেখে দেয় নিখিল। সারাদিনের পর এখন বাড়ি ফেরার একটা টান জন্মেছে তার। কিন্তু যার জন্য সে এতো গুলো বছর একটা নীরব তপস্যা করলো, আজ সে শুধু তার অবোধ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। অনেক কথা শোনার পর শুধুই একটা মৃদু হাসি, জোছনার আলোর মতই ম্লান। 

নিখিলেশের সবটা জুড়ে জুঁই বড় হতে থাকে। অনামিকার অধরা স্বপ্ন গুলো একটু একটু করে নিখিল পূরণ করতে থাকে। জুঁই এখন অষ্টাদশী । তার মনেও পরে না,কোন অতল অন্ধকার থেকে তারা উঠে এসেছিল এই ক্ষণ ভঙ্গুর দালানে। এখন এটাই তার চরম আশ্রয়।কখনও কোনও অভাব বোধ হতে দেয় নি নিখিলেশ। 

পড়ন্ত বিকেলের শেষ সূর্যের কিরণ টাও যখন দিগন্তে মিলিয়ে যাচ্ছে ,তখন ছাদের এক কোনে দাঁড়িয়ে নিখিলেশ একা একাই কথা বলে চলছে হুইল চেয়ারে বসা অনামিকার সাথে।  এই সময়টা তাদের একান্ত নিজস্ব। অনামিকা তো শ্রোতা মাত্র। আজ কখন জুঁই এসে দাঁড়িয়েছে নিখিলেশ তা টের পায় নি। নিখিলের অতীত স্মৃতির কিছু কথা জুঁই শুনে ফেলে। কৌতূহল জন্মে তার মনে। নিখিলেশ আসলে কে? সে দৌড়ে যায় প্রবালের বাড়ি। শীলা আজ আর কিছুই গোপন করতে পারে না। আদ্যপ্রান্ত সব শোনার পর এক গভীর শ্রদ্ধা নিয়ে সে ফিরে আসে। 

 এরপর ,  বেশ কয়েক বছর পর , জুঁই পড়াশোনার পর্ব চুকিয়ে কলেজের অধ্যাপিকা হিসেবে যোগ দেয়। এতদিন সে নিখিল কে বুঝতেও দেয় নি, তার জীবনের সমস্ত কাহিনী যে তার অজানা নয়। শীলাও ছিল প্রতিশ্রুতি বদ্ধ। মনে মনে জুঁই সেদিনই স্থির করেছিল নিখিলেশের এই আত্ম ত্যাগ কে সে বিফলে যেতে দেবে না।  

অনামিকার শরীর আজকাল একদম ভালো থাকে না। দিনের বেশির ভাগ সময় তাই নিখিলেশ তাই অনামিকার শিয়রে বসেই কাটায়। সন্ধ্যার পর জুঁই এসে বলল-
আজ একটা কথা তোমায় বলতেই হবে , কাকু। 
কি বল ?
 অন্তত এবার আমাকে তুমি তোমার সন্তান হওয়ার স্বীকৃতি ত টুকু দাও। মা ও হয় তো তাই চায়। 
জুঁই এর এই কথায় চমকে ওঠে নিখিলেশ। 
গোধূলির শেষ রশ্মি ডানায় মেখে শ্রান্ত পাখিরা তখন তাদের আশ্রয়ে ফিরছে। অনামিকার অনিঃশেষ দৃষ্টি তখন জানালার প্রান্তে গিয়ে স্থির । দু চোখের কোণে তখন বহু জন্মের  তৃপ্তির আশ্বাস। এভাবেই স্থির অবিচল দৃষ্টি নিয়ে মিলিয়ে যায় অনামিকার সাধের বাসনা কুসুম। 
জুঁই তার মায়ের প্রিয় গান খানিতে সুর দেয় – ‘ খেলা ঘোর বাঁধতে যে এসেছি …’।।   


 

 

 

 

 

 

 

 


No comments:

Post a Comment