মুক্তগদ্য
বাংলা ও বাঙালি
দেবর্ষি সরকার
তুমি না হয় একটু থামো।
থামোই না। অতশত কঠিন উচ্চারণ এবং কঠিন এর ইতিহাস শুনতে চাই না। তুমি কোথা হতে আসলে ও কোথা তোমার জন্ম তা জেনে আমাদের লাভ কি?
না। তুমি একটিবার ভেবে বলোতো, কত ইতিহাস কোন কাজে আসে আমাদের?
ওইযে দূরে মহিলাটি দেখতে পাচ্ছ গ্রামীণ,আঢ়পৌরে,কোলে তার শাকের বোঝা। সেই বোঝা নিয়ে বিক্রির আশায় পথ চলেছে। সেই নারী কি অত ইতিহাসে যানে তোমার? ইতিহাস জেনে কি তার পেট ভরবে? কক্ষনো না।
ও আবার একটি পাঁচ ছয় বছরের শিশুকেও দেখতে পাচ্ছি তার কোলে। আহা, কি জীর্ণ, কতটা রোগা পাট কাঠির মত শরীর টি। ইস্, কতদিন ওই না হয় আধপেটা খেয়ে আছে। সে তো কেবল ক্ষিদে কান্না পেলে মা মা বলে চেঁচামেচি করে আর কান্না করে। সে কি তোমার ইতিহাস জানে! সে ইতিহাস জেনে তার শরীরে হাতি বাস করবে তুমি বলো?
আবার ওই দিকে চাও তো। হ্যাঁ হ্যাঁ ওই দিকে। দেখো কতগুলো দিনমজুর কাঠফাটা রোদ্রের মধ্যে নিজেদের শরীরের ঘাম মাথা থেকে পায়ে ফেলে দিনরাত খেটে চলেছে ।দেখো তাদের দিকে চেয়ে ওই অভাবের শরীরে কোন অংশে তুমি তোমার ইতিহাসের ছাপ দেখতে পাচ্ছ! পাচ্ছ দেখতে! এ জন্মে পাবেনা।
ওই তো মাঠে কতগুলি শ্রমিক আলু তুলছে। তাদের বাচ্চাগুলো হয়তো এসে কাজ হাতে নিয়েছে। কিছু উপরি পয়সা কামানোর আশায়। তাদেরকে জিজ্ঞেস করো তো তারা তোমার ইতিহাস জানে নাকি ।শুনতে পেলে বলো আমাকে।
এবার এদিকে এসো। হ্যাঁ এদিকে, ওইযে সামনে দেখতে পাচ্ছ কতগুলি বৃদ্ধগোছের ও না না পুরুষ মরদোও তো আছে কতগুলো। দেখতে পাচ্ছ না তারা তাস পেটাচ্ছে আর থেকে থেকে চিৎকার করে উঠছে। এদের মধ্যে গিয়ে জিজ্ঞেস করো তো কজন তোমার সুগভীর ইতিহাস জানে! বলতে পারবে না, মোটেও না।
ওই যে দেখতে পাচ্ছো সামনে নিসন্তান ,স্বামীহীন দরিদ্র মহিলাটি অনবরত কেঁদেই চলেছে, তার স্বামী কাল বেঘোর ট্রেনে কাটা পড়েছে। স্বামী জীবিত থাকা অবস্থায় সে ছিল তাদের পরিবারের একমাত্র সহায় ও সম্বল। সারা জীবন মুখবুজে অভাবে দিন কাটিয়ে, আধপেটা খেয়ে বা কোনদিন না খেয়ে তার দিন কেটেছে। আর বর্তমানে স্বামী মারা যাওয়ার পর তার জীবনের দুঃখ আরো অতিরঞ্জিত হয়ে উঠেছে। তাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করো তো সে তোমার ইতিহাস কতটা জানে বলতে পারবে না। বুঝলে তো বলতে পারবেনা।
যদি তোমার খুব ইচ্ছে হয় নিজের ইতিহাস শুনবার তাহলে দৌড়ে চলে যাও ওই সামনের বিলাসবহুল বাড়িটাতে। ঘরে ঢুকেই দেখতে পারবে ঠান্ডা ঘরে এক মস্ত বই পাহাড়ের মধ্যে একটি মানুষ মুখ খুঁজে বসে আছে। সামনে তার সারি সারি বই এবং কিছু বই খোলা অবস্থায় পরে রয়েছে। অর্থ আছে, সুখ আছে, বিলাসিতা আছে ,প্রেম আছে, খাওয়ার যথেষ্ট যোগান আছে ,তাই তার কোন চিন্তা আছে বলে মনে হয় না ।সারাটা দিন পাহাড় ধ্বংস করে চলেছে। তাকে জিজ্ঞেস করো তোমার ইতিহাস দেখে চোখ বন্ধ করে অনর্গল বলে দেবে। সেসময় দেখবে তার মোবাইলটি তোমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে সে বলবে ,আমি যা বলছি তা ভিডিও বন্দি করে রাখুন। পরে সেই ভিডিওটি গণমাধ্যমে দেখিয়ে সে পরিচিতি ও নাম কামাবার বৃথা চেষ্টা করবে ।নিজের পাল্লাকে কেবল সে ভারি করতে পারে ,তার চেয়ে বেশি কিছু নয়।
আমি বলি ওদিকে যেও না। কখনো ভুলেও যেও না। জন্ম লগন হতে চিরটা কাল তুমি ছিলে অতি শান্ত ,স্নিগ্ধ ,সরল,সবল নিরহংকারী মানুষ। ওদিকে গেলে যান্ত্রিকতা ও স্বার্থপরতার কাটা তোমার বুকে ,শরীরে বিধে বসবে। ওদিক থেকে নিজেকে সবসময় সামলে রাখবে ভাই।
তার চেয়ে বরং এদিকে এসো। এই যে দেখতে পাচ্ছো হাতের আঙ্গুলগুলো সেগুলোই তোমার ইতিহাস ঠিক ঠাক ভাবে জানে। এইযে পায়ের নিচের সবুজ ঘাস গুলোকে দেখতে পাচ্ছো এদের জিজ্ঞেস করো নিজের ইতিহাস দেখবে একটা দমকা বাতাস দম করে এসে এদেরকে মাথা ধরিয়ে ঝাঁকিয়ে দেবে। ঘাসগুলি এইভাবে তোমাকে জানান দেবে যে তারাও তোমার গরিমার ইতিহাস সম্পূর্ণ অবগত।
যে দমকা বাতাসটি তোমার চুলগুলোকে এলোমেলো করে দিয়ে গেল সেও হয়তো তোমার জন্মের সময় ঠিক এমনটি ছিল। সেও হয়তো ওই স্থানটিতে উপস্থিত ছিল যখন তোমার জন্ম হয়েছে, সে জানে তোমার ইতিহাস। সামনে যে ওই যে স্রোতস্বিনী নদী দেখতে পাচ্ছো সেই নদীটাও জানে তোমার জন্মের ইতিহাস ।গিয়ে জিজ্ঞেস করো, শুনতে পাবে।
আরোও যদি শুনতে হয় চলো উত্তরে যাই। সেখানে আছে গগনভেদি অসংখ্য পাহাড় পর্বত।
সেই পাহাড়কে না হয় জিজ্ঞেস কোরো জন্মের ইতিহাস । ওই পাহাড়ে যখন উঠবে তখন দেখতে পাবে সাদা তুলোর মত শুভ্র মেঘ তোমার ,আমার শরীর ছুঁয়ে যাবে, তাদেরকে তখন না হয় জিজ্ঞেস কোরো নিজের ইতিহাস, সেও বলে দেবে ইতিহাসের বৃত্তান্ত।কারণ তার তো কোনো চিন্তাই নেই। মাথাহীন ব্যক্তির আবার মাথাব্যথা!
আর যদি বলো ভালোবাসা তবে বলি ঠান্ডা ঘরে বিলাসিতায় জীবন কাটিয়ে ভালোবাসা কখনো আসে না ভাই। বহুকাল আগে আমি তখন ছিলাম না সত্যি তবে পরে যা জেনেছি, যা শুনেছি তাতে করে বলতে পারি তুমি যখন প্রায় মরেই যাচ্ছিলে তখন কোন বিলাসবহুল ব্যক্তি নিজের চৌপদি থেকে মুখ সরিয়ে কোমর বেঁধে তোমাকে উদ্ধার করতে আসেনি। বলতে পারবে তাদের পরিচয়! পারবে না। তখন এসেছিল ওই শাক বিক্রি করা মহিলাটি, তোমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল ঐ দিন মজুর গুলো , তোমাকে সাহস যুগিয়েছিল আলুক্ষেতে কাজ করা শ্রমিক গুলো ,তাস পেটানো মানুষগুলোও তোমাকে উদ্ধার করতে এসেছিল কোমর বেঁধে। এসব মানুষের রক্ষক হয়ে তখন কাজ করেছিল চারপাশের পঞ্চভূত।
এরা সাধারণ মানুষ, খেটে খাওয়া মানুষ সবাই। দিন গেলে যাদের খাওয়ার জোগাড়ের চিন্তায় ভাঙা খাটে শুয়ে ঘুম উড়ে যায় তারা সেই সকল মানুষ।
ওই সাহেব সমান লোকদের সামনে যারা সারাদিন বইয়ের পাতায় মুখ গুজে বসে থাকে তাদের চোখে যারা "গ্রামীন," "গেয়ো ভূত," "অসহ্য," "পীড়িত," "দাস ," "জানোয়ার সমান," "ছোটলোক," "মানুষের কোন ধর্মই যাদের মধ্যে নেই","অসভ্য," "অশিক্ষিত"তারাই আপনার আসল বন্ধু। নিজেদের নামটা হয়তো তারা লিখতে পারেনা তবে তোমার নামটা তারা বুকে ভরসা নিয়ে উচ্চারণ করতে পারে দিনরাত।
এই আমরাই তোমার প্রকৃত মর্ম বুঝতে পারব ভাই। আর কেও নয়। তুমি আমাদের সাথে থাকো আমরাও তোমার সাথে থাকবো সবসময়। তোমার মর্ম আর কেউ বুঝতে পারবে না ,এ কথা ফলাও করে বলতে পারি। আমরা আমাদের চেতনা দিয়ে তাদের বন্ধদরজায় হানা দেব, তাদের শরীরের প্রত্যেক লোমকূপে পৌঁছে দেবো জয়ের আনন্দ। তাদেরকেও মাথায় আমরা পরাবো স্বরবর্ণ এবং ব্যঞ্জনবর্ণের গাঁথা মালা, তাদের হাতে তুলে দেব বর্ণ পরিচয়ের পুস্তক খানি।
চলো যাওয়া যাক।
No comments:
Post a Comment