মুক্তগদ্য
ভাষাহীনা ভাষার বেদনা’
অলকানন্দা দে
যবে থেকে পুরোনোকে ভেঙে নতুন সংস্কৃতির ব্যস্তসমস্ত স্টেশনে এসে পৌঁছেছি আমরা, তবে থেকেই পড়ার প্রতি আগ্রহ কমে গেছে আমাদের অবিশ্বাস্যভাবে। মুঠোয় ধারণ করা জগতটা কোন লেখা দেখলেই, সেটা গল্প হোক কবিতা হোক প্রতিবেদন হোক প্রবন্ধ হোক স্মৃতিকথা হোক বা ভ্রমণ কাহিনী, ভীষণ অনীহা দেখায় পড়তে জেনেশুনেই। মনেহয় এটাই ভাবে, এই এত বড় কথার পাঁচালি পড়ে শেষ করার ধৈর্য বা সময় কোথায়। যা বলার সংক্ষেপে বলো, ছোট করে বলো। এই ছোট হয়ে যাওয়া কথারা যে ভাব প্রকাশে একান্তই ব্যর্থ। এসে যায় আবার সেই ইন্টারনেট স্মার্টফোনের কথা। এখানে মাতৃভাষাকে কোণঠাসা করে এক জগাখিচুড়ি আয়োজনে যে কথোপকথন চলে তাতে মনে হয় আমরা জগতের সেরা দরিদ্র, ভাষাহারা। দশজনে যখন মশগুল হচ্ছে এই ভাঙাচোরা বাংলা ভাষার কথার মৌজে, তখন ভেতর থেকে এক চড়া হাঁক আসে, ‘আমি নিলামে উঠেছি দেখো বিস্মরণের শিরায় শিরায়!’ দুঃখটা ঘুরপাক খায় বাংলা ভাষার আদুড় অবস্থা দেখে!
পৃথিবীর এই স্মার্ট মঞ্চে কিন্তু ভাষা চর্চা এলাহিভাবে হতে পারতো। এখানে আমি মাতৃভাষার কথাই বলছি। পৃথিবীময় এই যোগাযোগের প্রসার ভাষাকে আরও প্রসাধনে সাজিয়ে পেশ করতে পারতো মানুষের সম্মুখে। কিন্তু না, এই ব্যবস্থা সবথেকে আগে যেটা হরণ করল তা হ’ল ধৈর্য। শর্টকাট পথ দেখাল যাবতীয় চিন্তাভাবনাদের এবং কথাদের। তাই লেখার মাধ্যমে কোনকিছু বলতে চাওয়া আশাকে গুঁড়ো করা আর কি। লেখা তার আওয়াজ হারিয়েছে এই রঙ্গিলা পৃথিবীর মঞ্চে। আগেই বললাম, পড়তে না চাওয়াটাই এখন স্বভাবী ধরে নিতে হবে। ভাষা আর মুখ খোলে না তাই। ছন্নছাড়া কাল বুঝি শপথ নিয়েছে ভাষাকে ভুলিয়েই ছাড়বে। সেই পথে এগোচ্ছি সকলে ত্যাগ করে শেকড়ের যা কিছু। এ অসুখ মন থেকে মনে স্নায়ু থেকে স্নায়ুতে ছড়িয়ে গেছে অতিমারীর মতোই। খুব প্রয়োজন একে রোধ করা। না হলে সংকেত ভাষার দাসত্ব করতে করতে ভাব বিনিময় বন্ধ হবে চিরতরে একদিন। এভাবে চলা তো সুস্থ হতে পারে না। বাংলা ভাষার শ্রীমুখ অভ্যর্থনার অভাবে ক্রমাগত একাকীত্বে ভোগে। মানুষের বর্ধমান অবহেলা প্রাণ নিতে পারে তার।
তবে পাঠক পরিবার কি একেবারেই মুছে গেল। না, তেমন তো নয়। না হলে লেখালেখি নিয়ে এখনো নাড়াচাড়া করছেন যাঁরা তাঁরা তাঁদের উৎসাহ ধরে রেখেছেন কিভাবে! আসলে তুলনায় এত অল্প যে কষ্ট হয় মানিয়ে নিতে। প্রতিদিন একটু একটু বই পড়া এই ধৈর্যকে ফিরিয়ে আনতে পারে নিশ্চিত। বই মনঃসংযোগ বাড়ায়, পড়ার প্রতি আগ্রহ বাড়িয়ে অভ্যাসকে গড়ে অবহেলা সরিয়ে। ‘পড়া’ কে ভালোবাসতে পারলে আলাদা মানসিক তৃপ্তি যা চিরসঙ্গী আমাদের। বিপন্ন মাতৃভাষার হাতদুটো ধরে তাকে মনের সদর অন্দরে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা বাংলার অস্তিত্বকে পতন বিমুখ করতে পারে। না হলে ধরিত্রীর ইতিহাসে শুকিয়ে যাওয়ার বড় ভয় আছে যা অপমান অভিমান ও লজ্জার।
No comments:
Post a Comment