Sunday, June 2, 2024


 

সম্পাদকের কথা 

প্রচ্ছদ ছবিটি এক পিতার।  শেকলে আবদ্ধ তিনি। এই শেকল শুধু সংসারের নয়। জীবনের। সমাজের। সব দিক থেকেই বাঁধন তার। 

তবু চেষ্টা অপরিসীম। আকাশ ছোঁওয়ার। 

কার জন্য? পরিবারের সবার জন্যই হয়ত। 

নিজের স্বপ্ন ওই ব্যাগে বন্দি। মুখ খোলা থাকলেও বেরিয়ে আসতে পারছে না। শুধু হাতের ওই খেলনা এরোপ্লেন উড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন তিনি । তার ইচ্ছেও হয়ত উড়বে খেলনাটি উড়লে। 

সেই ইচ্ছে, সেই স্বপ্ন, সেই দায়িত্ব, সেই কর্তব্য পালনে পথের ধুলোয় পর্যন্ত বসতে হয়েছে তাঁকে। তবু মুখ বিরক্তিহীন, অবিচল। 

কতদিন বাবাকে জিজ্ঞাসা করিনি আমরা, `তুমি খেয়েছ বাবা?` কতদিন বাবাকে বলিনি, `একটা গল্প বলবে বাবা?` আমরা সত্যিই বড্ড বড় হয়ে গেছি....এতটাই যে বাবার হাত ধরে বেড়াতে যেতে পারি না, এক মশারির তলায় বাবার সঙ্গে ঘুমোতে পারি না। বাবার সঙ্গে দূরত্ব বেড়েছে শুধু আমাদের। বড় হওয়ার এটাই অভিশাপ। 

অভিশপ্ত সেই জীবনেই বাবাকে স্পর্শ করবার একটু প্রচেষ্টা মুজনাইয়ের এই সংখ্যায়। 

যদিও জানি বাবাকে ধরা যায় না। বাবাদের ধরা যায় না। 

তারা এমন পাহাড় যা ডিঙোনো যায় না সাত জন্মেও।    



মুজনাই অনলাইন জ্যৈষ্ঠ  সংখ্যা ১৪৩১

 রেজিস্ট্রেশন নম্বর- S0008775 OF 2019-2020

হসপিটাল রোড 

কোচবিহার 

৭৩৬১০১

ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com (মাসিক অনলাইন)

ক্রোড়পত্রে ব্যবহৃত সংগৃহিত  ছবি- যামিনী রায়   

প্রকাশক- রীনা সাহা    

সম্পাদনা, প্রচ্ছদ, অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায় 

মুজনাই জ্যৈষ্ঠ  সংখ্যা ১৪৩১ 


এই সংখ্যায় আছেন যাঁরা 


নারায়ণ দত্ত, বেলা দে, ত্রিদিবেশ রায়, 

ডঃ কৃষ্ণ দেব, গৌতমেন্দু নন্দী, মণিদীপা নন্দী বিশ্বাস, 

সুতপা রায়,  অমলকৃষ্ণ রায়, পার্থ বন্দোপাধ্যায়,  অলোক কুমার গুহ, 

অনিতা নাগ, সুদীপ দত্ত, সুবীর সরকার,জয়তী ব্যানার্জি, 

কবিতা বণিক, শ্যামলেন্দ্র চক্রবর্তী,  উদয় সাহা, 

আকাশলীনা ঢোল, ঋতুপর্ণা ভট্টাচার্য, অলকানন্দা দে, 

রক্তিম লস্কর, মনোমিতা চক্রবর্তী, প্রীতিলতা চাকি নন্দী, 

রথীন পার্থ মণ্ডল, মৌসুমী চৌধুরী, সুজাতা কর, 

সম্রাজ্ঞী, পাঞ্চালি চক্রবর্তী, প্রতিভা পাল, 

মিষ্টু সরকার, রীতা দত্ত ভদ্র, দেবযানী ভট্টাচার্য, 

ভূমিকা ঘোষ, তপন মাইতি, দেবাশিস সাহা, শ্রাবণী সেনগুপ্ত, 

লীনা রায়, বিপ্লব গোস্বামী, সম্মিলিত দত্ত 




 অন্যচোখে 


একালের বাবা, সেকালের বাবা! 

ড. কৃষ্ণ দেব 


একালের বাবা'দের সঙ্গে আমাদের সময়ের বাবা'দের মনও মানসিকতার বিস্তর পার্থক্য ছিল। এক সময়ে জন্মনিয়ন্ত্রণের প্রচারে  'হামদো হামারা দো ' খুব জনপ্রিয় হয়েছিল, অনেকেই এই নীতি গ্রহণ করেছেন। যদিও এইসময়ের বাবা'রা  'আমাদের একটিই 'নীতি অনুসরণ করে চলছেন। এতসব সত্ত্বেও কোন হিসেব-নিকেশ ছাড়াই প্রকৃতিগত ভাবেই বোধহয় নারী-পুরুষের সমানুপাত দেখা যায়! আবার সবাই যে, 'আমাদের একটিই' নীতি নিয়ে চলেন এমনটা নয়, একশ্রেণীর বাবা প্রথম সুযোগেই যদি পুত্র সন্তান লাভ করেন, তাহলে অভিষ্ট পূরণ হয়েছে বলে দ্বিতীয় টির পথে পা বাড়ান না।এই বাবাদে'র কাছে 'ছেলে হচ্ছে অগ্রাধিকার'! আবার একশ্রেণীর বাবা আছেন, যাদের কন্যা সন্তান হলেই, দ্বিতীয় সুযোগ গ্রহণ করেন "পুত্র সন্তানের আকাঙ্ক্ষায়। আর আমাদের সেই কালের বাবা'রা অনেক সন্তানের জনক হতেন, কারণ তখন সমাজে সম্পদের প্রাচুর্য ছিল। ১০/১৫ টি মুখ সংসারে এলেও সে যুগে কিছু যায় আসতো না! 

১২৫ বছর আগে জন্ম নেওয়া এক পরিচিত বাবা'র গল্প শুনেছি,  যিনি একটি বিয়ে করেছিলেন, তাঁর সেই একমাত্র স্ত্রী ১৮ টি সন্তানের জননী হয়েছিলেন।

আমার এক মাসি এক- দেড় বছর অন্তর অন্তর আট'টি কন্যা সন্তান প্রসব করেছিলেন, একটি পুত্র সন্তান লাভের জন্য শিক্ষিত মেসো মশাই ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলেন ,অষ্টম কন্যার নাম রাখেন ইতি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মেসো মশাইয়ের ইচ্ছে পূরণ করতে নবম বারের জন্যে গর্ভধারণ করলেন মাসি। কিন্তু নবম বারেও মাসির কোল আলো করে জন্ম নিলো সমাপ্তি! গল্পটা এখানেই শেষ হতে পারতো, কিন্তু কিছু সময়ের ব্যবধানে একই দিনে মাসির কোলে আশ্রয় নিল একটি পুত্র সন্তান। কি ভাবছেন যমজ সন্তান! না। মাসি যখন হাসপাতালে সন্তান প্রসবের জন্য ভর্তি হয়েছিলেন, তখন তার পাশের শয্যায় আর এক প্রসূতি মা ভর্তি ছিলেন। তিনি ছিলেন ভিন রাজ্যের এক সেনা জওয়ানের স্ত্রী। সন্তান প্রসব করতে গিয়ে তার মৃত্যু হয়, কিন্তু বেঁচে যায় তার পুত্র সন্তানটি। ওই অবস্থায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় ওই ভিনদেশী সেনা জওয়ান কোন শর্ত ছাড়াই সদ্যোজাতকে মাসির হাতে তুলে দিয়েছিলেন। ফলে একই সাথে মাসির স্তন্য দুগ্ধ পান করে বড় হয়ে ওঠে আমার মাসতূতো ভাইটি।  আমার আর এক মাসির আবার উল্টো কাহিনী! কন্যা সন্তানের আকাঙ্খায় একের পর এক তিনি পুত্র সন্তান প্রসব করেন, যে সংখ্যাটা দাঁড়ায় আটে। সর্বশেষ মাসি আবার গর্ভধারণ করে যমজ কন্যা সন্তান প্রসব করেন!

আবার  পুত্র সন্তান কামনায় ব্যাকুল এক বাবার কাহিনী জানি, যার স্ত্রী ছয়টি কন্যা সন্তান প্রসব করেছিলেন। কিন্তু ওই মায়ের নিস্তার ছিল না, পুত্র সন্তান কামনায় ওই বাবা এক জ্যোতিষীর কাছে হত্যে দিলেন। জ্যোতিষী নিদান দিলেন স্ত্রী গর্ভধারণ করার সময় থেকেই সন্তান প্রসব করার সময় পর্যন্ত তাদের নিরামিষ ভোজন করতে হবে। গাদা গুচ্ছের তাবিজ, কবজ, মাদুলি বাবাদুলি সব তার গলায় লোটকে দিলেন। তার স্ত্রী গর্ভধারণ করলেন। গ্রাম শুদ্ধ মানুষকে নেমন্তন্ন করে সাধ ভক্ষণের আয়োজন করলেন। 

কঠোর কৃচ্ছসাধন শেষে সেই আকাঙ্ক্ষিত দিনটি এলো! বাড়ি শুদ্ধ লোক প্রসূতি কক্ষের বাইরে অপেক্ষা করছেন। সদ্যজাত'র ক্রন্দন  কর্ণগোচর হল, আনন্দে উজ্জল হল সকলের মুখমণ্ডল। যুদ্ধ শেষে যেন শান্তির সুবাতাস! সিস্টার কে দেখে এগিয়ে গেলেন সবাই, সিস্টার হাসিমুখে ওই বাবা'কে বললেন, মা ষষ্ঠীর কৃপায় আপনি যমজ কন্যা সন্তানের পিতা হয়েছেন! এই কাহিনী আর বৃদ্ধি করলাম না, এরপর কি হতে পারে সবাই  নিজের নিজের মত আন্দাজ করে নেবেন। 

আজকের দিনে একটি বা দুটি সন্তানের বাবা মায়েদের অসহায়তার কথাও মাঝে মাঝে শুনি। সব সব বাবা মায়েরা  তার সন্তান মানুষ হোক মনে মনে এ কামনা না করলেও, ছেলে ডাক্তার ,ইঞ্জিনিয়ার, আই এস, আই পি এস হোক এটা মনেপ্রাণে চান। ফলশ্রুতিতে ছেলে মানুষ হয়ে বিদেশে পাড়ি জমায়, সল্টলেকের অভিজাত ফ্ল্যাটে পড়ে থাকেন গর্বিত বাবা মা।  ইচ্ছে করলেই তো আর অতদূর থেকে বাড়িতে আসা যায় না! খোকাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করে তাদের। খোকা বলে যদি বেশি ইচ্ছে করে দেখতে তাহলে "হোয়াটসঅ্যাপ কল করো", এত বেশি ব্যাকুল হলে মুশকিল!

 কিন্তু দুধের স্বাদ কি আর ঘোলে মেলে! দূরত্ব বাড়ে। একদিন বুড়োবুড়ির চোখ দিয়ে জলের ধারা গড়িয়ে পড়ে। যুক্তিবাদী বাবা মাকে সান্তনা দেয়! হয়তো বিশ পঞ্চাশ লাখ টাকা জমা দিয়ে কোন বৃদ্ধাশ্রম বুক করে রাখতে পারে খোকা !এর চাইতে বেশি আর কি করবে তাদের খোকা! 

প্রশ্ন হল এত লেখাপড়া শিখিয়ে, ছেলেকে 'মানুষ তৈরি করে' যদি বৃদ্ধাশ্রমেই যেতে হয় বাবা মা'কে তাহলে বাবা-মায়ে'র  কৃচ্ছসাধনের মূল্য কি রইল? নতুন নতুন ব্যবসা পাতির দিগন্ত খুলে যাচ্ছে! বিভিন্ন ব্যবসার শ্রী বৃদ্ধির সঙ্গেই ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে 'বৃদ্ধাশ্রম' তৈরির ব্যবসাও!  আমার এই আলোচনা শুনে পাড়ার পাঁচু খুড়ো খেঁকিয়ে উঠলেন "এই জন্যই বলি বাচ্চাকাচ্চা বেশি হোক'তাহলে আর এই সমস্যা থাকবে না। পাঁচুখুড়োর এই যুক্তি এই ডিজিটাল যুগে কি কেউ মেনে নেবে ?

এই দেখো,  কথায় কথায় নিজের বাবার কথা বলতেই ভুলে গেলাম! আমরা ছিলাম সাত ভাই বোন। ছোটবেলায় আমার বাবা তাঁর মাকে হারিয়েছিলেন। ব্যবসা নিয়ে সদা ব্যস্ত বাবা'র ধর্ম মা গোপালদাসী বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছেই আমরা বলতে গেলে মানুষ হয়েছি! তাঁকে আমরা কর্তামা বলে ডাকতাম। কখনো বুঝতে পারিনি তিনি আমার বাবার নিজের মা নন। তিনি একজন মহীয়সী নারী ছিলেন, সে যুগে তিনি মেয়েদের একটি বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন, নিজে শিক্ষিকা ছিলেন। কর্তামার হাত ধরেই আমরা স্কুলে যেতাম। সকাল হতেই বাবা দোকানে চলে যেতেন । দুপুরবেলায় খেতে আসতেন। আর দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফিরতেন রাত সাড়ে নটা নাগাদ। 

ততক্ষণে হয়তো আমরা  ভাই বোনেরা ঘুমে কাতর হয়ে পড়তাম। দোতলা মাটির বাড়ি ছিল। অদুরে ছিল বিশাল দীঘি, দিঘির পাড়ে ঘন জঙ্গল। সন্ধ্যে হতেই শিয়ালের হুক্কা হুয়া ডাক শোনা যেত, আর রাত বাড়তেই হায়নার আনাগোনা। আমাদের  কারো হাসপাতালে জন্ম হয়নি, বাড়িতেই জন্মেছিলাম, ধাইমা নাড়ি কেটেছিল। মূল ঘর থেকে কিছুটা দূরে ছিল আঁতুর ঘর। হয়তো স্বাস্থ্যবিধি মেনেই আঁতুরঘর কে পৃথক রাখা হতো। সেই যুগে গ্রামবাংলায় হায়নার খুব উৎপাত ছিল। হায়না গভীর রাতে শিশুদের জঙ্গলে তুলে নিয়ে যেত, গলা ফুটো করে রক্ত খেত! আমাদের গ্রাম দেশে এক সময় আখছার এরকম ঘটনা ঘটতো । সন্তান প্রসব করলেই তার ঘ্রাণ  হায়নার নাকে চলে যেত। আমি যখন মায়ের কাছে ওই আঁতুড় ঘরে ছিলাম, তখন নাকি হায়না বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছিল  সেই ঘরে ঢুকে আমাকে তুলে নিতে! শুনেছি হায়না কাঁথা সহ আমাকে টানাটানিও করেছিল! মায়ের বাঁধায় ও চিৎকারে নিতে পারেনি! তাই বলি হায়নার হাত থেকে যখন বেঁচে ফিরেছি, তাহলে অন্তত সহজে আমার মৃত্যু হবে না! আমার বাবা সকালে উঠেই সেই অস্থায়ী ঘরের জানালা শক্তপোক্ত ভাবে বন্ধ করে দিয়েছিলেন। দুপুরবেলা বাবা বাড়িতে খেতে আসতেন, ঘন্টাদুয়েক বিশ্রাম নিয়েই দোকানে চলে যেতেন। দুপুর বেলা যখন বাবা বিশ্রাম নিতেন, আমাদের কাজ ছিল ছোট্ট ছোট্ট ঝিনুক দিয়ে বাবার পিঠের ঘামাচি মেরে দেওয়া। এর জন্য বরাদ্দ ছিল পাঁচ পয়সা, তখনকার দিনে এই পাঁচ পয়সার ভালই মূল্য ছিল, পয়সা পেলেই পাড়ার দোকানে গিয়ে চেনাচুর কিনে  আনতাম, আবার কখনো ধানের সাহায্যে বাবা'র পাকা চুল তুলে দিত আমার ছোট বোন কাবেরী। এই পাকা চুল তোলার জন্যেও পয়সা বরাদ্দ ছিল। 

আজকের যুগে ছেলে মেয়ের পরীক্ষা মানেই তো বাবা-মায়ের পরীক্ষা! পরীক্ষা তো নয়, যেন যুদ্ধ! আর আমাদের মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিকের সময় কখনোই বাবা-মায়েরা পরীক্ষা কেন্দ্রে ছোটেননি। স্কুলের স্যারদের কাছ থেকে নিয়মিত খবর নিতেন আমাদের পড়াশোনার। তবে বাবার একটা বদ গুন ছিল আমাদের নামে কোন অভিযোগ পেলে সত্যাসত্য যাচাই না করেই বেদম প্রহার করতেন। সেই সময় ছিল বেড়া চিতার গাছ, বেড়া চিতার শক্ত ডাল দিয়ে বহুবার বাবার হাতে মার খেয়েছি। সপ্তাহে একদিন বাবা কলকাতার বড় বাজারে যেতেন ব্যবসার কাজে। আমাদের বাড়ি থেকে কলকাতার  দূরত্ব ৮৫ কিলোমিটার হলেও, শৈশবে কলকাতায় যেতে পারিনি। আমাদের শিশু মনে কলকাতা ছিল যেন ভিন্ন গ্রহের কোন শহর! বাবা বরাবর কেএম দাশের জুতো ব্যবহার করতেন, আমৃত্যু তাকে সেভাবেই দেখেছি। ধবধবে ধুতি আর কলার লাগানো পাঞ্জাবি পড়তেন। রাত সাড়ে ন'টার ট্রেনে বাবা কলকাতা থেকে ফিরতেন। সকাল বেলায়  আমরা বাবার সেই জুতো উল্টিয়ে দেখার চেষ্টা করতাম কলকাতার মাটি জুতোর সঙ্গে লেগে আছে কিনা! অর্থাৎ কলকাতার মাটি  দেখতে কেমন! কিন্তু সেই কৈশোর কালে জুতোর নিচে কলকাতার মাটি কোনদিনই আমরা খুঁজে পাইনি।

সারাদিন সময় দিতে না পারলেও রাতের বেলায় খেতে বসে মায়ের কাছ থেকে সারা দিনের খোঁজখবর নিতেন। কার কি বই লাগবে, কার খাতা লাগবে, কার জামা বা প্যান্ট লাগবে, নির্দিষ্ট সময়ে সব কিছুই আমরা পেয়ে যেতাম। তবে আজকের দিনের ছেলেমেয়েরা যেভাবে গাদা গুচ্ছের খেলনা খুব সহজেই বাবার কাছ থেকে পেয়ে যায়, আমাদের সময় এমনটা ছিল না, তার মানে এই নয় যে আমরা অভাবগ্রস্ত ছিলাম! বা বাবার কিনে দেবার সামর্থ্য ছিল না! যদিও বাবা বলতেন প্রত্যেকের জীবনে অভাবের প্রয়োজন আছে, না চাইতেই যদি সব পাওয়া যায় তবে সে মানুষ হবে না! সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে হয়তো বাবার বলা এই কথা সঠিক বলে পরিগণিত হবে না, কিন্তু  বাবার কঠোর অনুশাসনে থেকে আমরা চেষ্টা করেছি মানুষ হতে। আমরা খুব খুশি হতাম পুজোর আগে যখন বাবা কলকাতা থেকে আমাদের জন্য ধুতি আর পাঞ্জাবি কিনে আনতেন, সেই নতুন ধুতি পাঞ্জাবির গন্ধ শুঁকতাম। পুজো পুজো গন্ধ ছিল যেন সেই জামা কাপড়ে! আর পেতাম ক্যাপ বন্দুক, সেইসঙ্গে কয়েক বাক্স গুলি। এটুকুতেই আমরা খুব খুশি ছিলাম। আর প্রতিটি পহেলা বৈশাখ আর বিজয় দশমীর দিন বাড়িতে বহু মানুষকে নেমন্তন্ন করে খাওয়াতেন বাবা। মনে আছে পহেলা বৈশাখের আগের রাতে বাড়ির বিরাট উঠোনের এক প্রান্তে ভিয়েন বসতো, কারিগরেরা রসগোল্লা আর বোদে তৈরি করতো, সকালে ভাজা হত ফুলকো লুচি। অত্যন্ত রাশভারী স্বভাবের হলেও বাবার অন্তর ছিল শিশুর মতোই কোমল।

যখন আমি পিএইচডি পেলাম, তখন সেই থিসিস পেপারের মোটা বইটা কপালে ঠেকিয়ে প্রণাম করেছিলেন।আর আমার যত রকম সংগ্রহ তার সবকিছুর অনুপ্রেরণা ছিলেন তিনি, বিশেষ করে মুদ্রা সংগ্রহের।


 


আজন্ম ঋণ যাঁর 


ভরসার আকাশে কখনও মেঘ কখনও রৌদ্র

গৌতমেন্দু নন্দী 


  "পিতা", 'জনক' 'বাবা"----‌আপাত ছোট্ট শব্দ বন্ধ হলেও এই  প্রতিশব্দ গুলো 'দায়িত্ব,' কর্তব্য' র মতো শব্দ-বন্ধের আচ্ছাদনে সীমা, পরিসীমা, ব্যাপকতা ও

গভীরতা নির্ণায়ক মানদন্ডের ঊর্ধ্বে । "পিতা" তাই নির্দিষ্ট অর্থে সীমাবদ্ধ নয়---কখনও বটবৃক্ষের ছায়া, কখনও অভাব, অনটন, দুঃখ-কষ্টের "গুমোট গরম"এ পালকের ভূমিকায় ঝড়ো বাতাসের মতো। বিপদ,আপদে তিনিই ত্রাতা, আঘাত,যন্ত্রণায়  তিনিই "সান্ত্বনা"। তাইতো পিতা মানে----
                 চিন্তাশীল,নিরুচ্চার উদ্বেগের এক মুখ
                 আপাত রাগী, গম্ভীর সামলে সুখ-দুখ।
 এবং পিতা মানে----
          চারদেয়ালের মাঝে কঠোর অনুশাসন
           উন্নত শির, অকুতোভয় হৃদয়ে তাঁর আসন।

    আমার পিতা আমার কাছে "বাবু" ছিলেন। তাঁকে  বাবা নয়, তাঁর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাঁকে "বাবু"ই বলে ডেকেছি।  "বাবা"দের আপাত গম্ভীর, কঠোর অনুশাসনের কোন বেড়াজাল, অযথা ভয়-ডরের অদৃশ্য কোন প্রাচীর  তিনি আমাদের ভাই-বোনদের সামনে কোনো দিনই তৈরি হোতে দেন নি। 
    
তিনি ছিলেন আপাদমস্তক সাহিত্যিক, সংস্কৃতিবান ব্যক্তিত্ব এবং রসবোধ ছিল উল্লেখযোগ্য। সংগীত জগতেও তাঁর সাবলীল বিচরণ। নিজের কথা ও সুরে বহু গানও রচনা করেছেন এবং গেয়েছেন। বিশিষ্ট ভাষাবিদ, আঠারোটি ভাষা জানা  প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্ব , সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার ও বিদ্যাসাগর পুরস্কার প্রাপ্ত প্রয়াত জ্যোতি ভূষণ চাকী ছিলেন সম্পর্কে আমার বাবার আপন ভাগ্নে আর আমার আপন পিসতুতো দাদা। দেশভাগের আগে  দিনাজপুরে আমার বাবাদের বাড়ি "নন্দী কুটির"এ জ্যোতি ভূষণ চাকীর জন্মের সূত্রে প্রায় পিঠাপিঠি আমার বাবা ও জ্যোতিদা অর্থাৎ মামা-ভাগ্নের বেড়ে ওঠা, খেলাধুলা ও সংস্কৃতি চর্চা। দিনাজপুরে সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন বাবা।          

দিনাজপুর কলেজে পড়াকালীন সাহিত্য পত্রিকা নিয়মিত সম্পাদনা করেছেন। সেই সময়ে প্রচুর গল্প, কবিতাও লিখেছেন। বাবার কাছে জ্যোতি ভূষণ চাকীর সংগীতের হাতেখড়ি। পরবর্তীকালে জ্যোতিদা আকাশবাণী কলকাতার একজন বিশিষ্ট গীতিকার ও সুরকার হয়ে উঠেছিলেন। জ্যোতিদার অনুজ সুপ্রকাশ চাকী সংগীত জগতে একজন প্রতিষ্ঠিত শিল্পী। 

           কালের কপোল তলে দেশভাগের পরে  সাম্প্রদায়িক বিভেদ যন্ত্রণা নিয়ে আমার পিতৃদেবকে চলে আসতে হয়  পূর্ব দিনাজপুর থেকে এপার বাংলার পশ্চিম দিনাজপুর জেলার সদর শহর বালুরঘাটে এবং ভাগ্যের চাকা তখন থেকেই বদলে গিয়ে শুরু হয় অভাব-অনটনের সংগ্রামী সাংসারিক জীবন। কিন্তু সাহিত্য, সংগীত চর্চা সেই আর্থিক প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও অটুট ছিল।
 
   মনে পড়ে সেই শৈশবে!  বাবা একদিন আমাকে সাইকেলের সিটের সামনে রডে বসিয়ে সাইকেল চালাতে চালাতে সুনির্মল বসুর লেখা ছন্দবদ্ধ কবিতা/ছড়া বলে চলেছেন--------
     "ক্রিং ক্রিং ক্রিং ক্রিং, সবে স'রে যাও না
 চড়িতেছি সাইকেল, দেখিতে কি পাও না?
 ঘাড়ে যদি পড়ে বাপু ,প্রাণ হবে অন্ত
 পথ মাঝে রবে পড়ে ছিরকুটে দন্ত....."

       পিতৃদেবের লেখা অসংখ্য ছড়া/কবিতায় সুনির্মল বসুর সেই "স্টাইল " আজ স্পষ্ট খুঁজে পাই। তাঁর রসবোধ ছিল তারিফ করার মতো।  একবার বাংলা নববর্ষের আগের রাতে আমাদের  এক আত্মীয়কে সপরিবারে নববর্ষের দিন দুপুরে খাওয়ার নিমন্ত্রণ করতে গিয়ে কাগজে লিখে দিলেন--

         " শুরু হবে কাল নতুন বর্ষ
           কেটে গেলে আজ রাত
         তোমরা সবাই এসো মোর গৃহে
            খেয়ো দুটো ডাল-ভাত..."

  এছাড়াও একসময় পাড়ায় নব বিবাহিত"দাদা-বৌদি" দের জন্য প্রায় নিয়মিত ছন্দ-ছড়ায় লিখে দিতেন হাস্যরস সমৃদ্ধ শুভেচ্ছা বার্তা।
        
অবিভক্ত দিনাজপুরে মালঞ্চ গ্রামের ধনী কন্যা আমার পিতৃদেবের মা, আমার ঠাকুমা রাধারানী নন্দী
ছিলেন একজন বিদুষী, যিনি গীতা ও পুরাণ নাকি মুখস্থ বলতে পারতেন। তাঁরই সুযোগ্য পুত্র আমার 
পিতা প্রয়াত পূর্ণেন্দু নন্দী। 

      দিনাজপুর থেকে ভাগ্নে জ্যোতি ভূষণ চাকীর  পিত্রালয় পাবনায় একসাথে যাতায়াতের সূত্রেই পাবনার গয়েশপুর গ্রামে এক পুকুর ঘাটে অপূর্ব সুন্দরী ষোড়শী কন্যাকে একদিন মুগ্ধ দৃষ্টি নিয়ে আবিষ্কার করেছিলেন আমার পিতৃদেব। সেই কন্যাই মধ্য চল্লিশে অকাল প্রয়াত আমার মা। সেই শোক সহ্য করতে না পেরে বাবাও প্রায় অকালে চলে গেছেন।
      
বাংলাদেশে শাহবাগ আন্দোলনের উত্তাল পরিস্থিতিকে উপেক্ষা করে ছুটে গিয়েছিলাম ঢাকা থেকে পাবনার গয়েশপুরের সেই পুকুর পাড়ে---সময়ের আগাছা-জঙ্গল ঘেরা সেই পুকুর পাড়ে, যেখানে দুটো সম্পর্কের সূচনা ও পরিণতি। সেই সময়কে খুঁজতেই ছুটে গিয়েছিলাম স্মৃতি বিজড়িত সেই নির্জনতায়।  ভারাক্রান্ত হৃদয়ে শুধুই জনক, জননীর পদচিহ্নের সাক্ষী হোতে। সেদিন অবচেতনে ক'ফোটা চোখের জল হয়তো মিশে গিয়েছিল পুকুরের জলে। ওর বাবাও প্রায় অকাল প্রয়াত ---মধ্য পঞ্চাশে।
           
আমার বাবার পিত্রালয় দিনাজপুরের সেই কাঞ্চন, পুনর্ভবা নদীর পাড়ে যেখানে দাঁড়িয়ে একসময় মামা-ভাগ্নে , আমার বাবা আর পিসতুতো দাদা জ্যোতি ভূষণ চাকী সূর্যাস্ত দেখতেন, স্মৃতির টানে হয়তো একদিন সেখানেও ছুটে যাব পিতৃদেবের  চরণ চিহ্ন খুঁজতে। 
     
বাবার স্মৃতি বিজড়িত তাঁর ঝকঝকে হাতের লেখার রবীন্দ্র সংগীতের সত্তর বছরের পুরনো খাতা এবং হাতে লেখা তাঁরই গল্পের সংকলন আজও আমার কাছে সযত্নে রক্ষিত আছে।
      
তাঁর সৃজনশীলতার প্রভাব ও আশীর্বাদ নিয়ে  আজও তাঁকেই অনুসরণ করে চলেছি। 

           পিতৃ তর্পনের কোন নির্দিষ্ট কাল থাকে কি?
 তাই সবসময় উচ্চারিত হোক ------
             " ওঁ , পিতা স্বর্গঃ পিতা ধর্মঃ
         এই  পিতাহি পরমং তপঃ
        পিতরি প্রীতিমাপন্নে প্রিয়ন্তে সর্বদেবতা..."


 

ঘিরে রেখেছেন তিনিই 


বাবা তোমাকে----

মণিদীপা নন্দী বিশ্বাস 

দেয়ালের তিন বাঁধানো ছবি দেখিয়ে বলেছিলে, এইতো ঈশ্বর। নেতাজী, রবীন্দ্রনাথ, স্বামী বিবেকানন্দ। আর কোন পুজোর দরকার নেই। সেইসব শুনে শুনে আরও এক বড় আকাশ ঢুকিয়ে নিয়েছিলাম বুকে। দুপুরের কাজ ছিল লেখার বাইরে আবৃত্তির জন্য কবিতা মুখস্থ করা আর কখনো বা নাটকের সংলাপ মুখস্থ করা, আর তোমার এঁকে দেওয়া স্কেচ মকশো করা চাইনিজ ইঙ্ক অথবা রঙ তুলিতে। তখনো প্যাস্টেল আসেনি হাতে। আর বলতে মন থেকে ছবি আঁক, এই দিলাম খাতা। বাঁধানো সুদৃশ্য খাতায় জলরঙে কত যে এঁকেছি! আমার আঁকা কাঁচা হাতের সরস্বতী অনেকগুলো বছর স্বপ্নের মত টাঙিয়ে রেখেছিলে তোমার সামনের দেয়ালে। খুশি হতাম অসম্ভব। ক্যালেন্ডারের চার হাতের সরস্বতী আর আমার আঁকা দেবীকে প্রণাম করে স্কুলে যেতাম। সেও তো শিখিয়েছিলে।

কি শেখাওনি তাই ভাবি বসে, এতগুলো বছর পেরিয়ে, একা এক্কেবারে নির্জন মনে। কবে আলাদা সত্তা হয়ে দাঁড়ালাম হিসেব পাইনে। 

হ্যাঁ বাবা, তোমাকেই বলছি, যৌথ বাড়ির সব জেঠতুতো দাদা দিদি জেনে গিয়েছিল এ মেয়েটা ছোটকাকার স্বপ্নের। অসম্ভব ভালবাসা আদর ছুঁয়ে ছিল বাড়ি ভরা। এ উঠোন ও উঠোন চার উঠোনের আনাচ কানাচ। 

লাল মেঝের সকলের ঠাকুর ঘরে সময়ে সময়ে কত উৎসব। সব ব্যবস্থা করে দিতে দূরে দাঁড়িয়ে। সবার আনন্দে তোমার ও চোখ ভাসতো। কখনো ঠাকুরের অঞ্জলি দিতে দেখিনি। কীর্তন মহোৎসব হত আমাদের বৈষ্ণব ঘেঁষা বাড়িতে। জেঠুর তত্ত্বাবধানে। কি আনন্দে কীর্তনের পদ পদকর্তা গান, সুর একাকার হয়ে যেত। গাঁদা ফুল দিয়ে চন্দন পরিয়ে দিতাম সেই কোন ছোট্টবেলা থেকে। শিখিয়েছিলে চালের গুঁড়ো য় আলপনা দেওয়ার সময় পেঁচা এঁকে কিভাবে প্রাণবন্ত করতে হয়। যা আজ ও করি। লক্ষ্মী পুজোয়, এখনো। প্রতি জন্মদিনে বই সম্ভার, তোমার উপহার সবার আগে। 

যাবতীয় বাঁচা গুলো টুকরো টুকরো করে দেখলে মিলিয়ে নিতে নিতে দেখি সব 'তুমি ময়' হয়ে আছে। ভাবনারা ছোটে তোমার পথেই। তোমার মত, তোমার মনের সঙ্গে বড় হয়ে উঠেও ঐ নি:স্বার্থ প্রাণ হতে পারলাম কই! সে উদার মনের কারিগর ঐ একজনকেই দেখেছি। ভেবেছি, এত গুণী বাবা আমার! তুমি হেসে বলতে, "jack of all trades master of none"

সে হাসির মধ্যে কষ্ট খুঁজে পেতাম। যা হতে পারতে, হয়নি। আর্ট কলেজ কলকাতায় ভর্তি হতে চেয়েছিলে, তখন পড়তে কৃষ্ণনগর কলেজে। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের এক ব্যাচ সিনিয়র। একসঙ্গে লিখছ। রূপাঞ্জলির মত পত্রিকায় দুজনের লেখা। স্বপ্ন ছিল, হলো না। সংসারের যৌথতার দাবীতে ফিরতে হল। যে শহরকে ভালবেসে শুধু নাটক কেন সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের সবটা দিয়েছ, দক্ষিণ উত্তর মেলবন্ধন ঘটিয়েছ ঐ রাজনগরে বসেই।সে শহরের নতুন প্রজন্ম তোমার সবটা জানলোই না! আসলে নিজের সম্পর্কে উদাসীনতা সবসময় ভালো নয়। তোমার বহু ইচ্ছেকে দিয়ে তৈরি করেছিলে আমাকে। আমিও কিছুই দিতে পারিনি। 'বাবা' নামটাই... আমাকে স্কুলের বাক্স গুছোনো, খাতাপত্র মলাট দিয়ে গুছিয়ে দেওয়া, প্রতিদিন উল্টে পাল্টে দেখা, সব নতুন ব ই বছরের প্রথমেই বাঁধিয়ে ঝকঝকে করে দেওয়া, অফিস ফেরত সব খুঁটিয়ে দেখা।... তোমাকে নিয়ে বলতে গেলে এক ইতিহাস যাপন। 

সন্ধের ঐ নাটক রিহার্সাল রুমের মধ্যিখানে বেড়ে উঠতে উঠতে দেখেছি তোমার কর্ম পরিচালনা, অভিনয় একের পর এক। আবার খেলার মাঠের ফুটবল, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টনে পদাধিকার বলেই একাত্মতা। বাড়ির চৌহদ্দিতে নামী সাহিত্যিক, অভিনেতা যেমন কলকাতা থেকে এসেছেন, থেকেছেন, খেলোয়াররা ও বাদ ছিলনা। এখনো চোখ বুজলে তোমার অফিস ঘরের সেই এক হাতে কাজ করা বিশেষ ভাবে সক্ষম পিওনকে দেখি। কিংবা তোমার আর এক কর্মচারী কলিমুল্লাহ মিঞা, যাঁকে কাকু ডাকি এখনো.. তোমার কথা বলতে গেলেই অঝোরে কাঁদেন যিনি, এত ভালবাসা দিয়েছ। 

জনসংযোগ আধিকারিকের কাজের ফাঁকে ঐ গণসংযোগ আর অদ্ভুত সুন্দর হাতের লেখার বিজ্ঞাপন গুলো হয়ে উঠেছে সাহিত্য আকর। সেসব নিয়ে লিখেছেন সাহিত্যিক অমিয় ভূষণ মজুমদারের ছেলে অধ্যাপক অম্লান জ্যোতি মজুমদার। অত্যন্ত ভালবাসতেন অমিয় ভূষণ মজুমদার। তাঁর রচনাবলীতেও  তোমার সঙ্গে সাক্ষাৎকার  বিষয় বিধৃত। 

আমার বাবা হয়েও তুমি সকলের। এত সৃষ্টি সব ছড়ানো। একখানা ছড়ার ব ই বেঁচে থাকতে করেছিলে। "স্বপ্নের নামে", ছোট্ট পাতলা একখানি মূল্যবান ছড়া সংকলন। পরে তোমার রেখে যাওয়া বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক কাগজের বহু নিবন্ধ নিয়ে'কোচবিহার প্রসঙ্গ', এগারোটি নাটকের সংকলন'নীরজ নাটক' প্রকাশ করেছি, সে তুমি দেখনি। এই মর্মবেদনা থেকে যাবে আজীবন। 

যেখানেই যাই, পুরোনো মানুষ দেখলেই বলেন "এক্কেবারে নীরজদা"। এই তো বাহির ভিতর তোমাকে নিয়ে চলেছি, চলব এভাবেই ছায়ার মত মায়ার মত যতদিন পারি। 

মুজনাই কে অনেক শুভেচ্ছা, ভালবাসা শৌভিককে, ইতিহাসের কথাটুকু দিয়ে এ শ্রদ্ধার্ঘ সামান্য হলেও সাজিয়ে দিতে পারলাম... 


 

অবশিষ্ট যা কিছু....


কক্ষান্তরে 
সুদীপ দত্ত 

তারপর যতই দিন চলে গিয়েছে, বাবার হাতের বাঁধন ততই শিথিল হয়ে এসেছে। অথচ, আমার হাত যখন মেঘহীন আকাশের মতো পরিষ্কার ছিল তখন, সেই হাত ধরে হেঁটে গিয়েছি কত পথ। কত দিন কত রাত্রি। কত মাস কত বছর।

দিন চলে গেলে সময় বদলে যায় । সময় তখন গিলে ফেলে অনেক কিছু।  শাল গাছের মতো দৃঢ় বাবাকে যেমন আস্তে আস্তে নুইয়ে পড়তে দেখেছি মাটির খুব কাছাকাছি। যেন আর একটু হলেই মাটি ছুঁয়ে ফেলা যায়। যেন আর একটু হলেই খোলা আকাশের নীচে নিশ্চিন্তে বন্ধ করে ফেলা যায় দুটো চোখ। সেই চোখে কোনও স্বপ্ন অবশিষ্ট থাকে কীনা জানা হয়নি।

জানা হয়নি, ঘাম ভেজা ভাঙাচোরা বাবার মুখ কোন স্বপ্ন নিয়ে শুধু বেঁচে থাকে। জানা হয়নি, বলাও হয়নি। সময় থেকে সময় হারিয়ে গেলে পরিধি বদলে যায়। যে হাত ধরে আমি শৈশব শেষে কৈশোর কাটিয়ে ক্রমশ ছুঁয়ে গিয়েছি নিজের পৃথিবীর পরিধি সেখানে, তারুণ্য উদ্ধত অহংকারে ঝকঝক করে ওঠে। ঝকঝক করে ওঠে কোনও তরুণীর মুখ। সমস্ত কথারা কথা বলে শুধু নিজস্বীকে কেন্দ্র করে।

বাবার ক্ষয়ে আসা দিনের কোনও ছবি সেখানে ধরা থাকে না। আবহমানের সেই আমিও হারিয়ে যেতে থাকে পরিধির ওপারে অনন্ত দীর্ঘ একটা সিঁড়ির ধাপে ধাপে। আকাশ ছোঁয়ার এই সিঁড়ি শুধু ওপরে ওঠার, শুধু বড় হওয়ার।

ক্রমশ ওপরে উঠতে উঠতে, ক্রমশ আকাশ ছুঁতে ছুঁতে আমার দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর ছায়ায় ক্রমশ আবছা হয়ে আসে বাবা। 

কক্ষ থেকে কক্ষে ঘুরতে ঘুরতে বাবা হওয়ার পথে এগোতে এগোতে, কখন যেন বাবা শব্দটাই তার মানে হারিয়ে ফেলে।


 

তিনি বৃদ্ধ হলেন....


বাবা আসলে বটবৃক্ষের ছায়া

সুবীর সরকার



১.

বাবা একটি আবহমান শব্দ।বাবা মানে অনেক ডালপালা ছড়ানো একটি মহাবৃক্ষ।বাবা আসলে

অদ্ভুত রকমের একটা ছায়া।হয়তো মায়া।আর সেই ছায়া আর মায়ার মাঝখানে একটা বলখেলার মাঠ।


২.

আমার বাবা জোতদারবাড়ির সন্তান।আমার বাবা ছিলেন সেই জোতদারবাড়ির একমাত্র শিক্ষিত।এম এ পাশ।শিক্ষকতা করতেন।

পাশাপাশি জোত ও জমি নিয়ে তার বিষয় আসক্তিও ছিল সাংঘাতিক।


৩.

বাল্য থেকেই আমি ছিলাম স্বাধীনচেতা।মুক্তমনা।ঘুরে বেড়াবার এক জীবন ছিল আমার।

সামন্তরক্ত শরীরে বহন করেও আমি ছিলাম সমস্ত কুসংস্কার,রীতিনীতির একেবারে বিপরীতে।

একটু বড় হয়ে আমি কোন পন নিয়ে বিয়ে করা বাড়িতে নিমন্ত্রণ খেতে যেতাম না।

আমি নিজেকে যুক্তিবাদের আলোয় চালিত করতে শিখে গিয়েছিলাম।


৪.

আমার বাবা আমাকে অসম্ভব ভালোবাসতেন।কিন্তু সেটা বাইরে থেকে বোঝা যেত না।

যখন পরিণত হলাম,যখন সরাসরি আমার মতামত ব্যক্ত করতে শিখলাম তখন বাবার সঙ্গে অদ্ভুত একটা বিরোধ এবং মনস্তাত্বিক দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে গেল আমার 

কেননা আমি আমাদের সামন্ততান্ত্রিক পরিমণ্ডলের সকল ভন্ডামি,যুক্তিহীন কর্মকাণ্ড,কুসংস্কার আর স্বৈরাচার থেকে সচেতন দূরত্বে অবস্থান করছি।


৫.

বাবা এসব মেনে নিতে পারেন নি।

আমি আমার বিয়েতে কোন পণ নেই নাই।

আমার বিয়েতে কোন বিবাহ আচার ছিল না।

ছিল না সিঁদুরদান।আমার স্ত্রী কোন বিবাহ চিন্হ ধারণ করেন নি।

জাস্ট রেজিস্ট্রি করা হয়েছিল।

আমার বাবা ও মা কিছুতেই এটা মেনে নিতে পারেন নি।

আমাদের বাড়ি ছেড়ে কিছুদিন ভাড়াবাড়িতে চলে যেতে হয়েছিল।

পরে অবশ্য বাবা ও মা এটাকে সহজভাবেই মেনে নিয়েছিলেন।


৬.

বাবার সঙ্গে যতই দূরত্ব থাকুক,চিন্তাভাবনায় বৈপরীত্য থাকুক বাবা কিন্তু বাবাই!

এটা আমি তীব্ররকম আজ বুঝি।অনুভব করি।

আমি যখন রাতে ঘুমই বারবার বাবা এসে আমাকে দেখে যান।

স্কুল থেকে দেরিতে এলে পম্পার কাছে খোঁজ নেন।

কিন্ত বাবার সঙ্গে চিরজীবনের একটা দূরত্ব আমার থেকেই গেল।

হয়তো ব্যক্তিত্বের সংঘাত।

হয়তো কেউ কারো কাছে সংকোচজনিত কারণেই যেতে পারবো না!

এটা হয়তো সামন্তরক্তের বৈশিষ্ট্য!


৭.

আমার বাবার বয়স এখন ৮৪।

তিনি এখন দ্বিতীয় শৈশবে।

এত এত কথা বলবার পরে এটুকুই বলি,আমার বাবা আমার কাছে আদ্যন্ত এক বটবৃক্ষের ছায়া!


 

নিবন্ধ 


পিতা 
জয়তী ব্যানার্জী

         
            ন সত্যম্ দান মনৌ
                    বা যজ্ঞাশ্চপ্ত দক্ষিণা: 
            তথা বল করা: সীতে!
                     যথা সেবা পিতুর্হিতা--
                    _____   রামায়ণ (অযোধ্যা কান্ড) .
        ব্যুৎপত্তিগত অর্থ: 
                   অর্থাৎ হে সীতে! পিতার সেবা করা এতই কল্যাণকর যে- তাহা সত্য, দান ,সম্মান ,প্রচুর দক্ষিণা সহ যজ্ঞ থেকেও বলকারী!
          হিন্দু শাস্ত্রমতে, যিনি জন্মদান, সম্প্রদান, রক্ষা ,আশ্রয়দান এবং অভিভাবক বা গুরু হিসেবে অধিষ্ঠিত হন--- এইসব অর্থে পঞ্চপিতা বা সপ্তপিতা বিবেচনা করা হয়। আবার যার  পরিকল্পনা কার্যক্রম আদর্শ কোন বিষয়ের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দান করে তিনিই পিতা। বিশেষ করে যার আদর্শিক নেতৃত্বে কোন জাতি গোষ্ঠী বা রাষ্ট্র স্বাধীকার এর মাধ্যমে স্বনামে প্রতিষ্ঠা পায়। পিতা --পরম পিতা  বা জগত পিতা।
         কবি বলেছেন_____
     "তুমি আমাদের পিতা, 
           তোমায় পিতা বলে যেন জানি, 
      তুমি কোরোনা কোরোনা রোষ"।
                
         পিতাই এক এবং অদ্বিতীয় পরম সত্তা। সমগ্র বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের পরম নিয়ন্ত্রক ।একেশ্বর বিশ্বাসী ধর্মে আরাধনার সত্তা।
            পিতা একজন পুরুষ অভিভাবক হিসেবে  বা যেকোনো ধরনের সন্তানের জনক হিসেবে সংজ্ঞায়িত হয়ে থাকেন ।তিনি যেকোনো সন্তানের পুরুষ জন্মদাতা। মাতা পিতার বিপরীত লিঙ্গ ।পিতার বিভিন্ন শব্দ হল অর্থাৎ প্রতিশব্দ হলো ---
      জনক ,আব্বা ,বাবা ,জন্মদাতা ইত্যাদি।
       সংসার প্রান্তরে আমাদের জীবনের চাকা গড়িয়ে চলে। কেন্দ্রগত শূন্যস্থানটিই যে চাকা নির্ভরতা সেই বোধটুকু যেন থাকে। সেইটাই হল বিশ্বাস--- যা চোখে দেখা যায় না. এটা এক আত্মগত অনুভূতি ।এই কেন্দ্রে আছে পিতা--- হিব্রু ভাষায় পিতা শব্দের অর্থ দরজা। এই সংসার নামক বস্তুতে একটা চাকা গড়িয়ে চলেছে। মাঝখানে একটা গোলাকার বেড়। সেখান থেকে চারপাশে ছড়িয়ে গেছে ত্রিশটি স্পোক বা দন্ড ।কেন্দ্রের ওই শূন্য গোলাকার অংশটাই কিন্তু সব---- চাকার সমস্ত আকার ,উৎস, শক্তির নির্ভর স্থল।
                ওই শক্তি না থাকলে যে চাকাটার ই কোন অস্তিত্ব থাকবে না, আর চাকাটা রয়েছে কিসের ওপর--- মাটিতে, যে মাটি থেকে কুম্ভকার তৈরি করেন বিশাল এক জ্বালা_____ ভেতরটা শূন্য, কিছুই নেই , অথচ ওই শূন্যস্থান টুকুই জ্বালার ;সব জ্বালার প্রয়োজনীয় অংশ। ওই শূন্যতা টুকুর জন্যই জ্বালার নির্মাণ। এখন একটা ঘর, তার একটা জানালা ।একটাই দরজা ,আবার জানালা একটা না বলে দুটো বলাই যায়। শূন্যস্থান অথচ ভয়ঙ্কর প্রয়োজনীয়। দরজা না থাকলে যেমন ঘরে ঢোকাও যাবে না, বেরোনো যাবে না। জানালা না থাকলে বাতাস আসবে না ।ঘর হয়ে যাবে কফিন।
        ওই শূন্যস্থান ই হল দর্শনের প্রেক্ষিতে শক্তি আর আমাদের আপামর জনসাধারণের কাছে তার পরিব্যপ্ত রূপই হল----
        পিতা স্বর্গ: পিতা ধর্ম:!
     এই যে নির্ভরতা এই যে বিশ্বাস___ এর একমাত্র আধারই বোধ হয় পিতা ।এই বিশ্বাস ভরসা যা চোখে দেখা যায় না--তা এক আত্মগত অনুভূতি। সংসার যে গাড়ির টায়ার---- ভেতরের বাতাস টুকুই তার শক্তি। ভাল্ভ খুলে দিলেই তা ফুস করে বেরিয়ে যাবে ।মিশে যাবে প্রকৃতিতে। সেই বিশ্বাস আর নির্ভরতা হলো সংসার রূপী জীবন টায়ারের বাতাস- চালিকাশক্তি। যে কিনা সংসারের অর্থাৎ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সকলকে ধরে রেখেছে। অথচ দিন শেষে তার প্রাপ্য অভিযোগ আর অভিযোগ।
           পিতা নামক ব্যক্তিত্বটাই কিন্তু একটা thankless job.. কারণ সব কিছুর মূলে থাকা সত্ত্বেও সে বুঝি নিঃস্ব ।সে যে রানার । রানার ছুটেছে তাই ঝুম ঝুম ঘন্টা বাজছে ....রানার ছুটেছে ...বুঝি ভোর হয় হয়...., তার কাঁধে টাকার বোঝা তবু সেটাকে যাবে না ধরা।
                তাইতো ঠাকুর শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবকে যদি আমরা পরমপিতা মানি তাহলে হয়তো পিতারূপী ব্যক্তিত্ব সংসারের হাল কিছুটা আত্মস্থ করতে পারবে। কারণ সে তো তখন উৎসর্গীকৃত ।একটা কথা আছে না "বাবারও বাবা আছে"----- সত্যি বোধ হয় তাই ,পিতা যে সংসারের লাঙ্গল ঘাড়ে তুলে নিয়েছেন তাকে শুধু তো মান্যতা নয়---- তার কাছে সমর্পণ। তার কাছে গিয়ে সাত্ত্বিক রঙে চুবিয়ে নিতে হবে মনকে ,যেখানে রজ:গুণের সিকি ভাগকেও প্রবেশ করতে দেওয়া যাবে না। সৎ অসতের নির্লিপ্ত পরপারে তার অবস্থান ।তাকে নিয়ে বিচার --সে তো ফুতকারে উড়ে যাওয়া ।তার মাধ্যমেই আমরা জ্ঞানের আলো জ্বালবো। বিষয় থেকে মতান্তরে অবিষয়ে প্রবেশ করব। 
          প্রাণ মন খুলে গাইবো 
          "ভবেরে ____সেই যে পরমানন্দ, যে জন জানে পরমানন্দ ময়ী রে...."
       পিতার স্বগোতোক্তি ---
        পুত্র যখন  পিতার হাত ধরে সেটা আলগা হতে পারে কিন্তু পিতা যে পুত্রের হাত ধরবে সে হাত কখনো আলগা হবে না।
         এই পিতাই তো 
         "পিতরি প্রীতি- মা পণ্ণে
           প্রীয় -ন্তে সর্বদেবতা"_____
                এ তো সেই উপনিষদের দর্শন অনুভূতি ,সত্য ,পথ ,লয় -বিলয়।
       "প্রনবো ধনু:শরো
       হাত্যা ব্রম্ভ অলক্ষ্য মুচ্যতে
      অপ্রমত্তেন বেদ্ধ বং 
         শরোবত্তর্ন্ময়ও ভবেত্"_____
         অর্থাৎ ব্রহ্মই হলো পরম পিতা।  ওম্কার ই ধনু, জীবাত্মা ই বাণ এবং ব্রম্ভ উক্ত বাণের লক্ষ্য ।অপ্রমত্ত হয়ে সেই লক্ষ্যকে  ভেদ করতে হবে, লক্ষ্যভেদের পর শবের মতোই তন্ময় হয়ে অর্থাৎ ব্রহ্মের সাথে একাত্মীভূত হতে হবে ।ব্রহ্মের অনুভূতি , ব্রহ্মের স্থিতি হলে কি হবে -----জ্ঞানী ঋষিদের কথায়, দুটো শিং বেরোবে কি? না দুটো চোখ বেরোবে---
                নতুন দৃষ্টির সঞ্চার হবে। সেই সঞ্চারিত আলোয় স্নাত পিতার দৃষ্টিতে থাকবে____ সন্তানের জন্য, জগতের জন্য, প্রেমের চোখ ;যে নতুন হৃদয়ের সঞ্চারনা হবে, তা হবে প্রেম পূর্ণ। গঠিত হবে এক আনন্দের শরীর। 'ভেঙে মোর ঘরের চাবি' যে অনন্ত আকাশে আমাকে ছো মেরে নিয়ে যাবে উদার মুক্তির পথে ।আমরা যে  হৃদয়ঙ্গম করতে পারব----
       আনন্দই ব্রহ্ম ,আর ব্রহ্মই যে কিনা পরম পিতা ।বিশাল আঁধার। যার ব্যাপ্তি ছড়িয়ে আছে দিগন্ত বিস্তৃত ।যেন----
        "আনন্দধারা বহিছে ভুবনে 
             দিন- রজনী কত অমৃতরস 
        উথলি যায় অনন্ত গগনে...."
            কিন্তু আজ যে আবার  happy mothers day, Happy fathers day,.... এর যুগ। তাই বলে কি আমরা শুধু একদিনই পিতাকে অভিভাবক হিসাবে সংজ্ঞায়িত করব? না তা কখনোই নয়.. পিতা আমাদের সাধারণ চোখে জন্মদাতা হলেও 
      যক্ষের প্রশ্নের উত্তরে যুধিষ্ঠির বলেছেন ____
       "মাতা গুরুতর ভূমে:
        খত্ পিতোত্তরা স্তথা"
অর্থাৎ, 
      মা পৃথিবীর থেকে ভারী কিন্তু পিতা আকাশ থেকেও উচ্চতর। 
                 
                      


 

নিবন্ধ 


পিতা  নোহ্ সি
  কবিতা বণিক


“ ওরে বাবা ! “  “ বাবা গো ! “  দুঃখে, কষ্টে, বিপদে- আপদে এই শব্দ কয়েটি  উচ্চারণ করেন না এমন মানুষ বিরল। কথায় আছে বাবা যদি সন্তানের হাত ধরে থাকে তবে সন্তানের পড়ে যাবার ভয় থাকে না।  পিতা বা  বাবার নিঃশব্দ স্নেহ, জীবন উজার করে ভালবাসা একমাত্র সন্তানই বুঝতে পারে। সন্তানকে সুখী দেখতে সন্তানের সুপ্রতিষ্ঠার জন্য বাবার চেয়ে বড় ভূমিকার কারও হয় না।  যদিও মা, বাবা মিলিত ভাবে করেন কিন্তু আসল চাবিকাঠি বাবার হাতেই  নিঃশব্দে ঘোরে। সিঙ্গল মাদার রাও খুব ভাল সন্তান তৈরি করেন ঠিকই। বাবার শূন্যস্হান  শিশু মনের গভীরে কিভাবে ক্রিয়া করে  তা  পরবর্তীতে সমাজ টের পায়।  সম্পূর্ণ রূপে শরীর , মনের পুষ্টি হয় না। কারন শিশুর কাছে বাবা ও মা দুজনই  মূল্যবান । দুজনকেই তার চাই। 
              আকাশকে পিতা বলে জানি। মাটি আমাদের মা। মাটিতে শুধু পা দুটো থাকে আমাদের।  আর পিতা সমস্ত  শরীর জুড়ে  জড়িয়ে থাকেন।  মাটির ওপরে যা কিছু শুন্য তাই আকাশ।  কারণ আকাশ অর্থে শূন্য । তার কোন আকার  নেই, রং নেই। শুধুই ব্যপ্তি।  আকাশের গায়ে কোন দাগ লাগে না। মাটি থেকে অনন্ত পর্যন্ত যে আকাশ তাকে বলি মহাকাশ।  আমরা শূন্য ঘট, পটের ভিতর টাকে বলি ঘটাকাশ, পটাকাশ। জীব , জন্তু, গাছপালা, ফাঁকা ঘটে, পটে , কলসীতে  সর্বত্রই  আকাশ আমাদের পিতৃস্নেহে জড়িয়ে রেখেছেন। তাঁর স্নেহে যে প্রাণের আনন্দানুভূতি, এই আনন্দস্বরূপ পরমপিতা  বা পরমাত্মার সাহায্যে সমস্ত জীবকুল জীবিত এবং কর্ম্যক্ষম।  
               আকাশ বা পিতা নিরহঙ্কার । তাঁর কোন চাহিদা নেই। তিনি না শুষ্ক না জলীয় । পিতৃ স্নেহস্পর্শে শুধুই আনন্দ দান করেন। “ রসো বৈ সঃ “  তিনি আনন্দ স্বরূপ। প্রতিদানে  তাঁর কোন  চাহিদা নেই। নির্মল স্বচ্ছ, দাগহীন আকাশ স্বরূপ  আমাদের পিতা। পিতারূপে যাকে সংসার জীবনে পাই সেখানেও নিঃশব্দে , নীরবে স্নেহের পরশ দিয়ে যান। জনক ছাড়া ও আত্মিক সম্বন্ধ স্হাপনে যিনি পিতা তাদের কাছে যে শিক্ষা, সাহায্য, আশীর্বাদ, সাহস পাই  তা জীবনের অমূল্য পাথেয়।  পিতার কোনরকম প্রত্যাশা হীন  স্নেহ আশীর্বাদ আমাদের জীবনের ভরসার স্হল।  কবির ভাষায়  পিতার সম্বন্ধে বলতে পারি            “ তুমি থাক , যেথায় সবাই
                    সহজে খুঁজিয়ে পায় নিজ নিজ ঠাঁই।।”
আমাদের সংসারে দেখি মা যখন নিজে দুরন্ত  সন্তানদের  শান্ত করতে পারেন না  তখন বাধ্য হন পিতার হাতে সঁপে দিতে।  পিতা সযত্নে সেই সন্তানকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনেন।  ভুলোক থেকে দ্যুলোক সবখানে এই নিয়ম প্রযোজ্য। মা সন্তুষ্ট হলে পিতা যেমন প্রসন্ন হন ঠিক তেমনি পিতা সন্তুষ্ট হলে  মা খুব প্রসন্না হন।  পিতা তাঁর সমস্ত গুণ উজার করে পুত্র বা শিষ্যের  মধ্যে সঞ্চারিত করেন ।  গুরুগৃহেও পিতৃতুল্য  গুরুর পরিচয়  পুত্রসম শিষ্যের গুণরাশির মাধ্যমে  অনেক বেশি হয়। পিতার পরিচয়ে যেমন পুত্রের পরিচয় হয়  তেমনি সুযোগ্য পুত্রের পরিচয়ে পিতার পরিচয় হয় খুব সম্মানের।  সংস্কৃতে একটা কথা আছে “ পুত্রাদিচ্ছেদ পরাজয়ম।” অর্থাৎ পুত্র বা শিষ্যের বিজয় যদি বাবা অথবা গুরুর পরাজয় হয় তা খুবই গৌরবের। শাস্ত্রের কথায়  “ পিতৃদেব ভব।” অর্থাৎ পিতাকে দেব স্বরূপ ভাববে।  আরও পাই। “ পিতা স্বর্গ পিতা ধর্ম /  পিতাহি পরমং তপঃ
পিতরী প্রীতিমাপন্নে / প্রিয়ন্তে সর্ব দেবতা! “ 
পিতা স্বর্গ, পিতাই ধর্ম, পিতাই পরম তপস্যা। পিতাকে সন্তুষ্ট  করলে সব দেবতারা সন্তুষ্ট হন।  
                  যজুর্বেদের একটি মন্ত্র —
ওঁ পিতা নোহ্ সি  পিতা নো বোধি নমস্তেস্তু। মা মা হিংসীঃ বিশ্বানি দেব  সবিতর্দুরানি  পরাসুব যদভদ্রং তন্ন আসুব ।  নমঃ শম্ভোবায় চ  ময়োদ্ভবায় চ  নমঃ  শঙ্করায় চ ময়োস্করায় চ  নমঃ শিবায় চ শিবতরায় চ  ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ
  ব্রহ্মোপসনার  মন্ত্র এটি।  অর্থাৎ  তুমি আমাদের পিতা, পিতার ন্যায় আমাদিগকে  জ্ঞান শিক্ষা দাও।  তোমাকে নমস্কার। আমাকে মোহ পাপ হইতে রক্ষা করো। আমাকে পরিত্যাগ করিও না।  আমাকে বিনাশ করিও না। হে দেব ! হে পিতা !  পাপ সকল মার্জনা করো।  যাহা কল্যাণ  তাহা আমাদের মধ্যে প্রেরণ করো।  তুমি যে সুখকর, কল্যাণকর, সুখ - কল্যাণের আকর । কল্যাণ ও কল্যাণতর।  তোমাকে নমস্কার।।
                  ধর্মের ঈশ্বর বা পিতা ভুবন সৃষ্টির পরে ছেড়ে যাননি ভুবনকে । উৎসের  সাথে সাদা সংপৃক্ত । তাই মহাবিশ্বের চেতনার আদি উৎসের  সঙ্গে  আমাদের সুর মেলাবার ক্ষমতা আমাদের প্রত্যেকেই আছে।  যখন মিলে যায় সেই সুর  সেই ইচ্ছে তখনই প্রতিভাত হয় অরূপের বাণী— যেন নির্বানহীন আলোকদীপ্ত তাঁরই ইচ্ছে খানি।


 

আমার ভিতর ও বাহিরে....


পিতা ও পুরান
শ্যামলেন্দ্র চক্রবর্তী

 

" পিতা স্বর্গ পিতা ধর্ম পিতাহি পরমম্তপঃ

  পিতরি প্রীতিমাপন্নে প্রিয়ন্তে সর্ব দেবতা ।।"

 
বার বাড়িতে আমাদের ঠাকুরঘর ছিল টিনের দোচালা । ছোটো , চার বাই চার হাত সাইজের , সেখানে অধিষ্ঠিত ছিল গৃহদেবতা রূপী শালগ্রাম শিলা ও শিবলিঙ্গ । বাবা রোজ দুইবেলা এই ঘরে আসন পেতে বসতেন , পুজো শেষ হলে পিতা ধর্ম পিতা স্বর্গ উচ্চারণ করতেন , যা আমরা কুড়ি পঁচিশ হাত দূরে বসে থেকেও কানে পেতাম ।

 এখনো সে উচ্চারণ কানে প্রতিধ্বনিত হয় , পিতার স্বর শুনতে পাই বলেই পিতা প্রসঙ্গে আসা ।

 তাসখেলার রাত-

এ পাড়া সন্ধ্যাবাতির পর থেকেই নিস্তব্ধ হতে শুরু করে , আওয়াজ বলতে , রান্নাঘর থেকে উঠে আসা ভাতের বগবগানি আর কখনো কড়াইয়ে তেলের সঙ্গে জলের তর্জন-গর্জন । আটটার পর হঠাৎ এক আধটা বাড়ির লোক জেগে থাকে বটে , তাদের বাচ্চাকাচ্চারা বই ঘাটাঘাটি করে জন্য। বাবা এই সুযোগে ধনী জেঠুর বাড়ির বারান্দায় কয়েক হাত তাস পিটিয়ে আসে। অথবা অন্যদের পেটানো দেখে মজা নেয়। তবে দশটা পর্যন্ত , কেননা এর পর জেঠু আর বাইরে খোলামেলা থাকবেন না। তিনি দরজার মুখে বসেন আর দোনলা বন্দুকটায় টোটা ভরিয়ে রেখে দেন বা পাশে হাঁটুর ছুঁয়ে আঙ্গুলের পাহারায়। কোনো কোনো রাতে কাছারী ঘরে যাত্রাগানের মহড়াও হয় , তাস গোটানো থাকে। সে রাত একটু গভীর হয়। সবাই উঠে গেলে বুড়াকাকা তাস তুলে , শতরঞ্চি ঝাড়া দিয়ে গুছিয়ে নিয়ে বাড়ি চলে যায়। এরা ধনী জেঠুর প্রজা। বাদবাকি খেলোয়াররা তখন বাড়ী মুখো । সবাই মিলে হাঁটতে থাকে সদর কাচা রাস্তা ধরে , এভারেডি তিন ব্যাটারি টর্চের আলো ফেলে । শ' খানেক গজ গেলে নুটুকাকা কমে , তারপর আরো শ' দুয়েক পর বাবা পৌঁছে যায় বাড়ীর কলতলায় , হাত পা ধুয়ে ঠাকুর ঘরে নারায়ণ শিলা শয়ান দিয়ে তবে ঘর। ঠাকুর ঘর থেকে বাবা বাঁশের দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকেছে যেই  , বাইরে ক্যাঁক আওয়াজ হল  শুনতে পেলাম। কিসের আওয়াজ? আমরা দুইভাই পিড়ি পেতে ভাত খাচ্ছিলাম , মা সামনে বসে দরজার দিকে পিঠ রেখে।  সবাই চমকে উঠে পিঠ খাড়া করে বসলাম , বাবা দরজা একটু ফাঁক করে বোঝার চেষ্টা করলো। বুঝতে বেশি সময় লাগেনি বাবার। অস্ফুটে তার উচ্চারণ কানে এল , ইস , কুকুরটাকে বাঘে নিয়ে গেল রে !

 

মার্বেলের থলি -

আমাদের একখানি সাদা কাপড়ের থলি ছিল। সর্ষের বীজের মিনিকিট মতো। আমরা দুই ভাই ওটাকে মার্বেলের ভান্ডার বানিয়ে ফেলেছি। এমন নেশা। শ' খানেক ছোটো বড় নানান সাইজের মার্বেল সব সময় আমাদের সঞ্চয়ে থাকতো।

গরমের দিন, স্কুল ছুটি।  বাবা বল্ল , সকাল সকাল ধনীবাড়ীর পাট খেত থেকে এক বস্তা ঘাস কেটে আনা।  মাঠে ঘাস-টাস কম। গোরুর পেট ভরে না, খিদে থাকলে দুধ কম। আমাদের বাড়ী থেকে উত্তরে আধা মাইলটাক গেলে একটি নদী আছে। মানে ছিল। নদীর পাড়ের জমিতে বিঘা বিঘা জমিতে পাটের আবাদ । ঘাসও তেমন কোমর সমান উঁচু। 

 
দাদা আর আমি একটি বস্তা আর কাস্তে নিয়ে বেরিয়ে গেলাম। সঙ্গে মার্বেলের থলি।

 চড়া রোদ । মাঝরাস্তায় শ্রীদামদের বাড়ির পাশে বড় বাঁশবন , সেখানে ঘন কালো ছায়া । ঠান্ডা জায়গা । ওখানে খেলা চলছে । বস্তার ভিতর কাস্তে রেখে আমরাও লেগে গেলাম । কোনদিক দিয়ে যে সময় চলে গেছে বুঝতেই পারিনি । হঠাৎ কে যেন যেন বল্ল , ঐ পালা , তোদের বাবা। দেখলাম বাবা আসছে লাঠি নিয়ে । মার্বেলের থলি ও ব্যাগ নিয়ে দে দৌড়, বাড়ীর দিকে। কলতলায় দুইভাই তাড়াতাড়ি গায়ে জল ঢেলে দিলাম। স্নান করবো। জানি, ভেজা গায়ে বাবা মারবে না কখনো। কোনোরকমে গা মুছেই রান্নাঘরের পিড়িতে। ভাত খাবো , খেতে বসলে শত্রুকেও বাধা দিতে  নেই, বাবার শিক্ষা।

 খেয়ে উঠে দাদা চলে গেল পায়খানায়, আমিও জমিতে আড়ালে গিয়ে প্যান্ট খুলে বসে থাকলাম। এদিকে বাবাকে তাসের আড্ডা টানছে । ধনী জেঠুর অস্ফুট ডাক। আমরা বসেই আছি, তো আছিই। এটাই একমাত্র বাঁচার রাস্তা, যে দোষ করেছি। বাবা ধৈর্য হারিয়ে চলে গেল আড্ডায়, শাসানি দিয়ে গেল, রাতে হবে। আমাদের ওভাবে বসে থাকার কাজও শেষ হল। রাতে বাবা বাড়ী ফিরতে ফিরতে দশটা হবে জানি। তখন আর পায় কে! শিবঠাকুরের ,তো চোখ ছোটো করে ঘুমে ঢুলতে শুরু করে দেবো, তাহলেই মারা তো দূর , তালপাতার বাতাস পাবো ঠান্ডা ঠান্ডা , বাবার হাতেই।

 

যাত্রাপালা -

বারোয়ারী দুর্গাপূজার মাস তিনেক আগে থেকেই শুরু হয় মহড়া । মুকুন্দদের দালানবাড়ির একটা বারান্দাঘরে। রোজ সন্ধ্যেয় সেখানে কুশীলবরা হাজির । সপ্তমী অষ্টমী নবমীর রাতে বাঁধা প্যান্ডেলে যাত্রাপালা । চারখানা কাঠের চৌকি , চারকোণাতে চারখানা পেট্রোম্যাক্স বাতি । বাঁশ দিয়ে ঘেরা একটা গলি সোজা সাজঘরের দিকে ।

বেশি হত মারকাটারি পালা, নবাব সিরাজউদ্দৌলা, শাহজাহান, কখনো সীতার বনবাস , কখনো বা দুঃশাসনের ঊরুভঙ্গ পালা। পুরুষ অভিনেতারাই , যারা একটু গায়ে গতরে, তারাই শাড়ি ব্লাউজ পরে সাজতো নারী , কেউ ঘসেটি বেগম , কেউ মেহেরুন্নিসা , কেউ মুমতাজ , কেউ সীতা বা শূর্পনখা , কেউ বা দ্রৌপদী বা গান্ধারী। বাবা গোলগাল চেহারার। মুখ্য নারী চরিত্র ছিল বাবার বাঁধা।

 আমাদের ছেলে ছোকড়াদের ব্যাপক কৌতুহল , মহড়া দেখবো। কিভাবে অভিনয় করে অভিনেতারা , কিভাবে হাসে নকল হাসি , কিভাবে মেয়েলি গলায় কথা বলে । আরো একটা বিষয়ে উৎসাহ আমাদের ছিল খুব । ব্লাউজের ভেতরের গোপন রহস্যটা কি! কী দিয়ে অমন ফোলায় বুক ! আমরা গোটা পাঁচেক বেপরোয়া ছেলেও তাই তৈরি। দরজার ফাঁক বা জানালার ফুটো দিয়ে ভেতরে কান্ডকারখানা দেখতে।

 দলটার নাম ছিল ভবানী অপেরা। ভবানী রেশন ডিলারের নাম। জয়বাংলার সময় যে কয়েকশো রিফিউজি খাস জায়গায় আশ্রয় পেয়েছিল তাদের খাদ্য বস্ত্র গুড়ো দুধ সাপ্লাই করে বেশ কামিয়েছে। গুড়ো দুধের বস্তা ফুটো করে আমরা খেতাম, তার কি অমৃত সমান স্বাদ! সে অবশ্য অন্য গল্প ।

 সেদিন সত্যিকারের এক মহিলা অভিনেত্রীও মহড়ায় হাজির , তাকে যে ছুকড়ি বলে সেটা পরে জেনেছিলাম । জনা দশেক পুরুষ অভিনেতার মাঝে একজন ছুকড়ি , তার ঢলাঢলি দেখলাম‌ , কোনো কোনো পুরুষ অভিনেতা মাথা নামিয়ে বসে , কেউ হাসছে , কারো চোখে লন্ঠনের আলোয় এক অন্য দৃষ্টি । ছুকড়ি কোমর খেলিয়ে বুক ঝাঁকিয়ে নাচছে , তুরু রু রু তুরু রু রু , তেরা মেরা পেয়ার শুরু । চোখে চকচক করছে প্রায় সবার । সোমরসে কিনা , জানি না । তবে বাবা তো সেসবের ধারে কাছে থাকে না ।

 আসরে বাবারা সবাই। বাবারা মানে বাবা এবং তার সঙ্গী সাথী । কৃষ্ণ হয় যে , সেই সুনীল নামে কোঁকড়া চুলের লম্বা লোকটি আমাদের দেখে ফেলেছে । তাড়া খেয়ে দৌঁড়ে পালালাম ।

 মাঠের গা ছুঁয়ে পাকা রাস্তা । সেখানে টাকমাথা এক শ্যাঁওড়া গাছ । নির্জন । রাত হলে ওপথ‌ একা কেউ মাড়াতে চায় না । গাছের নিচে আমরা চুপচাপ বসে রইলাম ।  কুশীলবরা ফিরছেন । শুনলাম নানান কথা , একজন বলছে , মাস্টারদা , এই ছুকড়ির পেছনে লাখ খরচা করার মানেই হয় না ।

 মাস্টারদা একটি জবাব দিয়েছিলেন বটে কিন্তু সেই বয়স তার মানে বোঝার মত ছিল না ।

রোজ সকালে আমরা বস্তা পেতে পড়তে বসি । বাবা ভোর থাকতেই কুশোকাকার বাড়ি থেকে গরম চিড়া নিয়ে আসে । সকালে ভাতটা বাবাই বসায় রোজ , মার অনেক কাজ , ঘর পোঁছা , লেপা , ঠাকুরঘর পরিস্কার করা । মা পরে এসে ডাল আলুভাজা করে দেয় , সেই খেয়ে আমরা দুইভাই স্কুল যাই । ভাত নামিয়ে বাবা গরম দুধ আর গরম চিড়া জামবাটিতে দেয় । রোজকার রুটিন ।

পরদিন বাবা বাটি হাতে ধরিয়ে দিয়ে আমার পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে বলে , গতকাল মুকুন্দর বাড়ী গেছিলি ? আর যাবি না , রিহার্সাল দেখলে যাত্রা দেখে মজা নেই । গলা কেমন যেন শান্ত আর ঠান্ডা মনে হল ।

ভয়ে কাঠ হয়ে বসে রইলাম । বাবা ইশারায় খেতে বলে চলে গেল । আর কখনো মহড়া দেখতে  যাওয়ার সাহস হয়নি ।