কুহেলিকা
স্বাগতম দে
স্বাগতম দে
বান্ধবীর বোনের জন্মদিন থেকে বাড়ি ফিরছি । মানিকতলা বাসস্টান্ডে চাটার্ড বাসটা থেকে নেমেছি সবে । ঘড়িতে সময় দেখলাম - কাঁটায় কাঁটায় পৌনে এগারোটা । রাস্তার দু’পাশের দোকানগুলোও ঝাঁপ ফেলে দিয়েছে । নির্জন চারিদিক । মাঝে মাঝে দু' একটা প্রাইভেট গাড়ি ছুটে যাচ্ছে । পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম একটু । নাহ্, যা ভেবেছি ঠিক তাই । না রিকশা স্ট্যান্ডে কোনো রিকশা আছে , না টোটো স্ট্যান্ডে কোনো টোটো ।
শুনশান রাস্তা । রিকশা বা টোটোর জন্য আর কোনো অপেক্ষা করব না । হাঁটাই লাগাব যখন ভাবছি তখন হঠাৎ করে কোথা থেকে যেন একটা রিকশা সামনে এসে দাঁড়াল ।
"বাবু যাবেন ?" , জিজ্ঞেস করল রিকশাওয়ালা ।
আমি যেন হাতে চাঁদ পেলাম, এহেনাবস্থা ।
জিজ্ঞাসা করলাম, "ব্রাহ্মণ পাড়া যাবে ?"
"যাব বাবু । বসুন ।", বলল রিকশাওয়ালা ।
আমিও সত্তর উঠে পড়লাম রিকশায় । "ভাগ্যিস তুমি এলে, নইলে এতটা রাস্তা আমাকে হেঁটেই যেতে হত ।"
"চন্দ্রভিলায় একজনকে নামিয়েই ফিরছিলাম । আপনাকে দেখে এসে দাঁড়ালাম ।"
"ভালোই করেছ , নাও চলো ।"
রিকশাচালক প্যাডেলে চাপ দেয় ।
পৌষ মাস চলছে । গত ক'দিন ধরে সন্ধ্যে থেকে কুয়াশার চাদরে ঢেকে গেছে এই দক্ষিণবঙ্গের হালিশহর নামের একটি মফসসল শহর । আজও তার ব্যতিক্রম নেই । ঘন কুহেলিকায় চতুর্দিক সাদায় সাদা হয়ে গেছে । তেমনি কনকনে ঠান্ডাও বইছে বাইরে । আমি ভালো করে গায়ে চাদরটা জড়িয়ে নিই ।
বাসস্ট্যান্ডকে বাঁ-পাশে রেখে নতুনপট্টির রাস্তা ধরল রিকশাওয়ালা । রিকশা চলেছে অতি মন্থর গতিতে । আর একটু এগোতেই বুঝতে পারলাম । রিকশা টানতে কষ্ট হচ্ছে চালকের । অতি কষ্টে যেন প্যাডেলে চাপ দিচ্ছে । আর অস্ফুট একটা গোঙানির শব্দ বেরিয়ে আসছে লোকটার গলা থেকে ।
" কী হল, শরীর খারাপ লাগছে ?" , জিজ্ঞাসা করলাম আমি ।
"কিচ্ছু না বাবু" , অতি ধীর গতিতে প্যাডেলে চাপ দিতে দিতে অস্ফুট স্বরে বলল লোকটা । রিকশা চলতে থাকে ওইভাবেই, অতি মন্থর গতিতেই ।
মানিকতলা বাসস্ট্যান্ড থেকে মোটামুটি বারো মিনিট লাগে আমার বাড়ি যেতে । কিন্তু সেই বারো মিনিটের রাস্তা কুড়ি মিনিট পার করে রিকশা এসে দাঁড়াল আমার বাড়ির সামনে । বিরক্তমুখে রিকশা থেকে নেমে মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করে রিকশাওয়ালার দিকে ভালো করে তাকালাম ।
শীর্ণ চেহারার মানুষটার মুখে-চোখে অসুস্থতার ছাপ ।
ভাড়াটা এগিয়ে দিয়ে বলি, "তোমার কি শরীর খারাপ নাকি ?"
"না বাবু, তেমন কিছু নয়, একটু জ্বর জ্বর মতন হয়েছে ।"
হঠাৎ কি মনে হল জানি না , লোকটার কপালে হাত দিতেই সচকিতে উঠলাম ।
"তোমার গায়ে তো ভালো জ্বর, এই নিয়ে রিকশা চালাচ্ছ , তাও শীতের রাতে , কীভাবে ? "
এবার আমার চোখে চোখ রেখে লোকটা বলল , "আমার একটা মাত্তর মেয়ে বাবু । নাম - বিতাসা ।"
আমি বললাম, "বিতাসা কি ?"
"বিতাসা মাঝি, ছয়ের কেলাস থেকে এবারে পেথ্থোম হয়ে সাতের কেলাসে উঠেছে বাবু । আজই রেজাল বেরিয়েছে । বাবু, না মেয়েটাকে খাওয়াতে পারি, না মেয়েটাকে ভালো কিছু দিতে পারি । যদিও ও কোনোদিন কিচ্ছুটি চায় না মুখ ফুটে । ও খুব বোঝে ওর বাপের কষ্ট ।"
,বলে দু'চোখের জল মোছে রিকশাওয়ালা ।
আমিও ওর কাঁধে হাত রাখি । নিজেকে সামলে নিয়ে আবার বলতে শুরু করে রিকশাওয়ালা, "পোতি বছর ওর সব বন্ধুরা কোথায় কোথায় বেড়াতে যায় । মেয়ে গল্প শোনে ওদের কাছে, ও-ও তো ছোটো, ওরও মন চায় যেতে ।
তাই এবার আমি ঠিক করেছি বাবু , সামনের শুক্কুর বার তো বড়োদিন , সেদিন ওকে বেড়াতে নিয়ে যাব কলকেতে । আমার তো অতো খেমতা নেই দূরে নিয়ে গে পাহাড়, সাগর দেখানোর । তাই বাবু ঠিক করেছি , কলকেতেয় নিয়ে গে শুক্কুর , শনি আর রোববার ঘুরিয়ে সব দেখাব ওকে - চিড়িয়াখানা, জাদুঘর, কালীঘাট, ভিকটোরী, হাওড়া ব্রিজ, আর কী সব আছে দেখাব । শুনেছি বড়োদিনের সময় নাকি কলকেতেয় খুব জাঁক হয় । তা বাবু এসবের জন্য তো টাকা চাই । মাঝে তো আর দু'দিন বাকি বাবু । জ্বরেরে কষ্ট একটু আছে বটে বাবু কিন্তু মেয়ের মুখে হাসি ফোটাতে আমি এর চেয়েও হাজার গুণ কষ্ট সহ্য করতে রাজি ।"
টানা কথাগুলো বলতেই হাঁপাচ্ছিল লোকটা । একটু থেমে , "না, বাবু যাই ।"
বলতে বলতেই লোকটা রিকশায় চড়ে বসল এবং আলতো করে প্যাডেলে চাপ দিল ।
"যদি আর কোনো লোক দেখতে পাই" - বলতে বলতে শীতের রাতে ঘন কুহেলিকার মধ্যে যেন হারিয়ে গেল লোকটা ।
মুজনাই অনলাইন মাঘ সংখ্যা ১৪২৬
রেজিস্ট্রেশন নাম্বার- S0008775 OF 2019-2020
ঠিকানা- হসপিটাল রোড, কোচবিহার, ৭৩৬১০১
প্রকাশক- রীনা সাহা
সম্পাদনা, অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায়
মুজনাই অনলাইন মাঘ সংখ্যা ১৪২৬
No comments:
Post a Comment