জ্ঞানের সাগর ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় ও তাঁর অমর সৃষ্টি "বর্ণপরিচয়"
বটু কৃষ্ণ হালদার
উনবিংশ শতকের একজন বিশিষ্ট বাঙালি শিক্ষাবিদ সমাজ সংস্কারক ও গদ্যকার এর নাম ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়।সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি অগাধ পান্ডিত্যের জন্য প্রথম জীবনে বিদ্যাসাগর উপাধি লাভ করেন। সংস্কৃতি ছাড়া বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় বিশেষ ব্যুৎপত্তি ছিল তাঁর।তিনি প্রথম বাংলা লিপি সংস্কার করে তাকে আরো যুক্তি বহ ও অপর বোধ্য করে তোলেন। বাংলা গদ্যের প্রথম রূপকার ছিলেন।তার অপার পান্ডিত্যের জন্য বাংলা গদ্য সাহিত্যের প্রথম শিল্পী বলে উল্লেখ করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
ডক্টরঅমিতকুমার বন্দোপাধ্যায় লিখেছেন, "বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় এর পূর্বেও ছাপা অক্ষরে এই জাতীয় কিছু কিছু পুস্তিকা বাজারে চলতো"।ডক্টর বন্দ্যোপাধ্যায় প্রসঙ্গে রাধাকান্ত দেব রচিত "বাংলা শিক্ষা গ্রন্থ", এবং স্কুল বুক সোসাইটি হতে প্রকাশিত "বর্ণমালা প্রথম ভাগ" ও"বর্ণমালা দ্বিতীয় ভাগ" মদনমোহন তর্কালঙ্কার রচিত শিশু শিক্ষা গ্রন্থ গুলির নাম করেছেন।তবে এই পুস্তিকা গুলি তেমন কোনো বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেনি। পরে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কর্তৃক রচিত একটি বাংলা বর্ণ শিক্ষার প্রাইমারি বা প্রাথমিক পুস্তক হল "বর্ণপরিচয়"। যা বাংলা সাহিত্যের আকর বা অমূল্য সম্পদ হিসেবে উঠে আসে।এই বর্ণপরিচয় এর দুটি ভাগ প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৫৫ সালে।দুই পয়সা মূল্যের ক্ষীণকায় পুস্তিকা প্রকাশ বাংলা শিক্ষা জগতের ছিল এক যুগান্তকারী সৃষ্টি।এই পুস্তিকায় বিদ্যাসাগর মহাশয় বাংলা বর্ণমালাকে সংস্কৃত ভাষায় অযৌক্তিক শাসনের বেড়াজাল থেকে মুক্ত করেন এবং যুক্তি ও বাস্তববোধের প্রয়োগে এই বর্ণমালার সংস্কার সাধনের প্রবৃত্ত হন।এই অমূল্য সম্পদ বিদ্যাসাগর মহাশয়ের মৃত্যুর এত বছর পরেও জনপ্রিয়তা বিন্দুমাত্র হ্রাস পায়নি। ডক্টর বন্দোপাধ্যায় লিখেছেন শোনা যায় প্যারীচরণ সরকার এবং বিদ্যাসাগর মহাশয় একদা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন ইংরেজি ও বাংলা বর্ণ শিক্ষার প্রাথমিক পুস্তিকা রচনা করবেন। তদানুসারে প্যারীচরণ "first book of reading"এবং বিদ্যাসাগর মহাশয় "বর্ণপরিচয়" প্রথম ভাগ প্রকাশ করেন।বিহারীলাল সরকারের রচনা থেকে জানা যায় মফস্বলে স্কুল পরিদর্শনে যাওয়ার সময়"পালকীতে বসেই পথেই বর্ণপরিচয় এর পাণ্ডুলিপি রচনা করেছিলেন ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়।১৮৫৫ সালে বর্ণপরিচয়"প্রথম ভাগ"এবং সেই বছরের জুন মাসে "দ্বিতীয় ভাগ" প্রকাশ পায়। বিহারীলাল আরো বলেছেন বর্ণপরিচয় প্রথম প্রকাশ ফলপ্রসূ হয়নি। হতাশ হয়ে পড়েন ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়। কিন্তু জনসমাজের চাহিদা অনুসারে দিনে দিনে শিক্ষা জগতের মূল আকর হয়ে দাঁড়ায় বই দুটি।প্যারীচরণ এর ইংরেজি গ্রন্থখানি ও বাঙ্গালী সমাজের দীর্ঘকালের আদরের বস্তু ছিল।তবে বর্তমানে আধুনিকীকরণের যুগে গ্রন্থটি শিক্ষা মূল্য অবশিষ্ট নেই।তবে বিদ্যাসাগর মহাশয় গ্রন্থটি আজও বাঙালি সমাজের শিশুদের বাংলা শিক্ষার প্রথম সহায়ক হিসেবে রয়ে গেছে।এরপর আবারও প্রায় ১২৫ বছরের উর্ধ্বে কেবল স্বরবর্ণ মালা থেকে"৯"(লি) ও ব্যঞ্জন বর্ণমালা থেকে "অন্তস্থ ব"বাদ গিয়েছে। হলে বলা যায় আধুনিক বর্ণমালার মূল রূপকার ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়।তার বর্ণপরিচয় শিশুদের উপযোগী সহজবোধ্য ও সংক্ষিপ্ত বাক্য দিয়ে পাঠ রচনা করা হয়েছে।এর মধ্যে রয়েছে সহজবোধ্য বাক্যের ছোট ছোট প্রাঞ্জল গদ্য রচনা শৈলী।এ বিষয়টির মধ্যে দিয়ে শিশুরা দুর্বোধ্য শব্দ মুখস্থ করার পরিবর্তে সহজলভ্য শব্দ শিখছে ও স্বাচ্ছন্দ্য বাংলা গদ্য রচনার সঙ্গে পরিচিত হয়।এভাবে সহজ সাবলীল ও আধুনিক বাংলা গদ্যের পথ প্রশস্ত করে ছিলেন বিদ্যাসাগর মহাশয় শিক্ষিত বাঙ্গালীদের জন্য। ইতিপূর্বে যতিচিহ্নের বিষয়ে সচেতনতা ও প্রয়োগের নৈপুণ্য দেখা যায়নি।বিদ্যাসাগর মহাশয় এর এসব সাবলীল স্বাচ্ছন্দ্যবোধ যতিচিহ্নের ব্যবহার লক্ষণীয়। বর্ণপরিচয় এর ১৯ সংখ্যা থেকে উদাহরণ টানা যায়"গোপাল যখন পড়িতে যায়,পথে খেলা করে না, সকলের আগে পাঠশালায় যায়,পাঠশালায় গিয়া আপনার জায়গায় বসিয়া বই খুলিয়া পড়তে থাকে,যখন গুরুমহাশয় নতুন পড়া দেন,মন দিয়া শুনে"। যতি চিহ্নের বিষয়ে তাঁর বিশেষ সচেতনতা কথা ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে মন্তব্য করেছেন"তাহার সংস্কারকামী মনের বিশেষ পরিচয় পাওয়া যায় তাহার বিরাম চিহ্নের প্রয়োগের ক্রম বাহুল্য দেখিয়া"।
মুজনাই অনলাইন মাঘ সংখ্যা ১৪২৬
রেজিস্ট্রেশন নাম্বার- S0008775 OF 2019-2020
ঠিকানা- হসপিটাল রোড, কোচবিহার, ৭৩৬১০১
প্রকাশক- রীনা সাহা
সম্পাদনা, অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায়
মুজনাই অনলাইন মাঘ সংখ্যা ১৪২৬
No comments:
Post a Comment