স্কুলে সরস্বতী পুজোর দিনগুলো আজও মিস করি
বটু কৃষ্ণ হালদার
সালটা ছিল ১৯৯৯,আমি তখন নবম শ্রেণীতে পড়ি আর তুমি অষ্টম।সেবার স্কুলের পুজোর প্রধান দায়িত্ব ছিল আমার সঙ্গে কয়েক জন সহপাঠী ।কয়েক দিন আগে থেকে প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। ঠাকুর আনতে যাওয়া, প্যান্ডেল তৈরি,পুরুত মশাইকে নেমন্তন্ন,ফুল তোলা,মালা গাঁথা,পূজার বাজার,পাশের কলেজ ও স্কুল গুলো তে নিমন্ত্রণ করা থেকে শুরু করে সব কিছু ভাগ করে দায়িত্ব দেওয়ার কাজ ও আমার ছিল।পূজার দিন খুব ভোরে স্নান সেরে বেরিয়ে পড়লাম স্কুলে।সব কিছু দেখে নিতে শুরু করলাম।ধীরে ধীরে বেলা বাড়তে থাকল।ঠাকুর থেকে পুরু ত মশাই সহ সব আয়োজন প্রায় শেষের পথে।বাকি ছিল শুধু প্যান্ডেলের সামনে ফুল মালা সাজানো। খুব মনোযোগ সহকারে সেই কাজ করছিলাম চেয়ারের ওপরে উঠে।চারিদিক হাঁক ডাক লেগেছিল।দারুণ গ্রাস করেছে সবাইকে।পূজা শুরু হতে কিছুটা সময় বাকি ছিল।তবুও অনেকে আসতে শুরু করেছিল উদ্দেশ্য পুষ্পাঞ্জলি দেওয়া।অনেকে না বলতেই হাত লাগাতে শুরু করেছিল।আমি মাইক ওয়ালা কে গান চালাতে বললাম।জিজ্ঞেস করল কি গান চালাব।বললাম হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এর তুমি এলে অনেক দিনের পরে যেন বৃষ্টি এলো এই গান টা চালাও।এই গান টা আমার খুব প্রিয়। যখন মন খারাপ করে তখন একা একা শুনে। মাইকওয়ালা দাদা বললো, খুব শখ দেখছি ছেলের। পূজার দিন বৃষ্টি এলো ভালো লাগবে তো। এই শুনে সবাই হেসে লুটো লুটি।গান চলতে থাকলো আমি কাজে মন দিলাম। কিছুক্ষণ পর একটু আর ঘোরাতেই পিছনের রাস্তা দিয়ে দেখি তুমি এলে। বৃষ্টি না আসুক তুমি কিন্তু সেদিন এসেছিলে খোলা চুলে হলুদ লাল পেড়ে শাড়ি পড়ে। দুই চোখ জুড়ে ছিল কাজলের ঝলকানি। পা জুড়ে ছিল আলতার সীমারেখা।ইটের রাস্তা দিয়ে মনে হল লাল পরী এসেছিল সেদিন। ঘাড় ঘুরিয়ে নেব তার উপায় ছিল না। আচমকা মাথা ঘুরে চেয়ার থেকে পড়ে যেতেই দাঁত বার করে হি হি করে হাসতে শুরু করলে। আমি লজ্জা পেয়ে উঠে দ্রুত দৌড়ে প্যান্ডেলের সামনে থেকে স্কুলের মধ্যে ঢুকে গেলাম। ইতিমধ্যে মাইকে প্রচার শুরু হল পুষ্পাঞ্জলি দেওয়া শুরু হবে। আমি ভয়ে ভয়ে ওর পাশে দাঁড়ালাম। সবার মত আমিও হাতে ফুল নিয়ে তৈরি হলাম পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার জন্য। পুষ্পাঞ্জলি দেওয়া শেষ হলে ওকে বললাম তোমার সঙ্গে একটু কথা আছে স্কুলের পিছন দিকে যাবে? ও বলল কি কথা এখানেই বল। আমি বললাম ওখানেই বলব বলে চলে গেলাম। স্কুলের পিছনে পেয়ারা গাছে ডাল ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম আর বুকের ভিতর হৃদপিণ্ড টা জোরে জোরে লাফাতে শুরু করল। যদি কিছু বলি ও বলে দেয় এই ভয়টা ভীষণ রকম করছিল। কার মধ্যে ও এসে দাঁড়ালো আমার কাছে বলল কি বলবে তাড়াতাড়ি বলো? আমি বাবার পরা সাদা পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ ওর হাতে দিলাম। ও বলল এটা কি লেখা আছে,আমি নেব না।আমি বললাম এখানে খুলবে না বাড়িতে গিয়ে খুলবে।ও নিল,সেই কাগজটাকে দুমড়ে মুচড়ে হাতের মধ্যে নিয়ে দৌড় মারলো।চিঠিটা নিয়েছিল বলে আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠেছিলাম।তুমি এলে অনেক দিনের পরে যেন বৃষ্টি হলো গানটা মনে মনে গাইতে গাইতে প্যান্ডেলের সামনে চলে গেলাম। ঐদিন আর বাড়ি ফিরিনি। সারারাত প্যান্ডেলে আমি আর বন্ধুরা খুব হইচই নাচানাচি করলাম। সকালে বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায় নটা বেজে গেছে। বাড়ির সামনে যেতে বুকটা ধড়া স করে নেচে উঠলো। চোখে ঝমনি ভাবটা পুরোপুরি কেটে গেল। দেখলাম বাবা হাতে লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাশে ওর বাবা। ঠাকুমা,মা জেঠিরা, বাবাকে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছিল। আমাকে দেখে বাবা ডাকলেন শুয়োর এদিকে আয়। অগত্যা উপায় নেই গুটি গুটি পায়ে বাবার সামনে দাঁড়াতে চুলের মুঠি ধরে বলল চিঠি লেখার শখ হয়েছে। এমনিতে চিঠি লেখাটা শুন্য পেয়েছিস। তাহলে এই চিঠি লিখলে কি করে।সব বানান ভুল মনে হয়। আবার অংকে ফেল করেছিস হিসাব পত্র ঠিকমতো শিখিসনি। চিঠি লিখে ফেললি? বলেই হাতের লাঠিটা দিয়ে কাজ শুরু করে দিল। সবাই কাকুতি মিনতি করেও কোন লাভ নেই দেখে আমিও চুপচাপ মার খেয়ে নিলাম। ওর বাবার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল একটা কথাও বলল না। এমন ভাব ভাব করে দাঁড়িয়ে আছে মনে হয় আমি ওনার মেয়েকে বিয়ে করে নিয়েছি। মনে মনে ভাবলাম হয়তো বাধা দেবে। আরে বাবা একটা চিঠি তো লিখেছি।তাতে কোন মহাভারত অশুদ্ধ হয়েছে বলি। বাবা লাঠি ফেলে দিয়ে কাঁধে গামছা ফেলে মাঠের দিকে চলে গেল। ওর বাবাও স্থান ত্যাগ করল। দেখে মনে হল অনেক পুরানো রাগ আমার উপর মিটিয়ে নিয়েছে। ওর বাবা চলে যাওয়ার পর আমার চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগলো। ঠাকুমা গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে পুকুরে নিয়ে গেল। আমি স্নান সেরে জামা কাপড় ছেড়ে সোজা বিছানাতে উঠে পড়লাম। কয়েকদিন স্কুলে যায়নি। পরে ওর দিকে মুখ তুলে তাকাতে পারতাম না। বহু বছর কেটে গেছে ও আর আমি এখন দুই সীমান্তের নাবিক। বহু বছর পর গ্রামের বাড়িতে একবার ওর সঙ্গে মুখোমুখি হতেই আমি কাটিয়ে পালারে যাচ্ছিলাম। মনে হলো কেউ আমাকে ডাকছে ভীষণ ফিরতে দেখি ও দাঁড়িয়ে আছে। আমি সামনের দিকে এগিয়ে যেতে বল কেমন আছো? ভালো,জিজ্ঞেস করলাম তুমি কেমন আছো? প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়ে বলল সেদিনের জন্য আমি খুব দুঃখিত।তখন অতটা বুঝতে পারিনি।ক্ষমা চাইবার সুযোগ হয়ে ওঠেনি। তোমার কাছে ক্ষমা চেয়ে মনটা আজ খুব হালকা হলো।এত বছর ধরে এই অপরাধ বোধ আমি বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি।পারলে ক্ষমা করে দিও। আমি বললাম সে সব তো কবে কার কথা। আমি ভুলে গেছি, তুমিও ভুলে যাও শুধু তুমি ভালো থেকো। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,তুমিও ভালো থেকো চললাম, আবার দেখা হবে।
No comments:
Post a Comment