স্মৃতির বিদ্যালয়
বিপ্লব তালুকদার
বিদ্যালয়ের স্মৃতিকথা লিখতে বসে জীবনের এই মধ্যগগনে অনেক কিছুই আবছা হয়ে আসে স্বাভাবিকভাবেই, তবু তারমধ্যেই মনের মণিকোঠায় যা কিছু মনিমানিক্য আছে বিদ্যানিকেতনের এবং জীবনের সম্ভবত সবচেয়ে সুখী সময়ের —তারই কিছুটা তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
বাবার চাকরিসূত্রে বদলির জন্য আমাদেরও বাবার সঙ্গে জলপাইগুড়ি জেলার বিভিন্ন স্থানে সংসার পাততে হয়, বদল হয় যাপনেরও। কোচবিহারে জন্ম, তারপর ধূপগুড়ি থেকে শুরু করে ফালাকাটা হয়ে শেষমেশ বাপ-ঠাকুর্দার ভিটে ময়নাগুড়িতে এসে থিতু হওয়া কৈশোর ও যৌবনের দোড়গোড়ায়। সেই সূত্রে বিদ্যালয় জীবনের শুরুটা হয়েছিল ধূপগুড়ির বৈরাতিগুড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, এবং সেই সময়পর্ব ছিল অতি স্বল্প। ফলতঃ তার কিছুই আজ আর মনে নেই। যেটুকু মনে আছে,তা খুব একটা গুছিয়ে লেখাও সম্ভব না। আবছা হয়ে সেটুকু বরং ঐ জীবনখাতার প্রথম পাতাগুলোতেই রয়ে যাক।
বদলির নিয়মে আমাদের পরের গন্তব্য ফালাকাটা শহর— তখনও শহরের তকমা সেভাবে তার গায়ে বসেনি। নতুন শহরে এসে প্রথমে ভর্তি হয়েছিলাম পোস্ট-অফিস পাড়ার এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, সেই স্কুল ছিল আমাদের ভাড়াবাড়ির কাছেই। তাই বাবা নিশ্চিন্ত থাকতে সেখানেই ভর্তি করে দেন। সেখানে কিছুদিন থাকার পর ভর্তি হই ফালাকাটা নিম্ন বুনিয়াদি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এইখান থেকে স্কুলজীবন বলতে যে ঘুরনচরকির মতো রঙিন জীবনের একটা গুরুতর অংশ বোঝানো যায়, তার দুরন্ত সূচনাই বলা চলে। আর এখানেই পড়াশোনার পাশাপাশি সখ্যতা তৈরি হয় আমার বয়সী ছেলেগুলোর সঙ্গে, যাদের আজকের দিনেও ‘বন্ধু’ বলতে আত্মবিশ্বাস স্পষ্ট থাকে গলায়। ওই বিদ্যালয় এবং সেখানে জীবন জুড়ে এতো স্মৃতি ছড়িয়ে আছে ইতিউতি, যে তার সবটা লেখা গেলে বুঝি বা একটা বই হয়েই যায়! প্রসঙ্গত, মাস্টারমশাইদের আমরা ‘দাদা’ বলে সম্বোধন করতাম। সেখানেই পেয়েছিলাম প্রধান শিক্ষক হিসেবে বড়দাকে ( অপরেশ ভৌমিক), পেয়েছি সেজদাকে, পেয়েছি রাঙ্গাদাকে—যিনি রেগে গেলে কপালে চক দিয়ে তিলক কেটে দিতেন। দিদিমণি হিসেবে পেয়েছিলাম শেফালী দিদিমনি ,প্রীতি দিদিমনিকে। প্রত্যেকেই ব্যক্তিত্বে পূর্ণ আর স্নেহশীল,স্নেহশীলা শিক্ষক -শিক্ষিকা হিসেবে আমাদের অভিভাবক -অভিভাবিকাসম। আমাদের জীবন পথের প্রথম কাঁচা মাটির পথ যেন পার করে দিয়েছিলেন স্নেহ -শাসনের মেলবন্ধনে।
সেখানে প্রাইমারি স্কুল, হাই স্কুল এবং বালিকা বিদ্যালয়— তিনটি স্কুলই ছিলো একদম পাশাপাশি। ঐ যে বলছিলাম, সেসময় দেখা হয়েছিল যাদের সঙ্গে, যাদের এত বছর পরেও বন্ধু বলে বিশ্বাস করি। সেই নামগুলোর মধ্যে রয়েছে শৌভিক, ঋত্বিক,প্রণব, পুটন, বাপির মতো বন্ধুরা। লিখতে বসে মনে পড়ল, একবার কীসের জন্য যেন ইনজেকশন দিতে স্কুলে ডাক্তারবাবুরা এসেছিলেন, সেকথা শুনে আমার তো প্রাণপাখি ওখানেই পারলে খাঁচা ছেড়ে ফুরুৎ! ভয়ে তখন স্কুলেই বইপত্তর ফেলে এক ছুটে সোজা বাড়ি! সেই এক কান্ড! এখানে আরেকটা মজার কথা বলি, আমার মেয়ে যখন স্কুলে পড়ছে , তাদের স্কুলেও কোনো টীকা থুড়ি ইঞ্জেকশন দিতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। সূঁচের ভয়ে কন্যেটি আমার পালানোর পথ না পেয়ে টিফিনের ঘরেই কোন এক অব্যবহৃত ড্রামের ভেতর ঢুকে লুকিয়ে বসেছিল এই খবরে। বাবার যোগ্য উত্তরসূরী বটে— ভেবেছিলাম এই কান্ড শুনে! যাইহোক, অন্য গল্পে যাই। আমাদের সময় মিড-ডে মিল ছিলো না। হঠাৎ হঠাৎ সয়াবিনের খিচুড়ি রান্না হতো, যা ছিল কিনা অমৃতসম। ছিলো না বসবার বেঞ্চ, মাটিতে আসন পেতে বসতাম দল বেঁধে। কিন্তু এইসব তখন অপ্রাপ্তি মনে হয়নি কখনো, বরং স্কুল না যেতে পারলে মন একেবারে অস্থির হয়ে উঠত!
সময় ফুরিয়ে এসে এরপর প্রাইমারি শেষ করে ভর্তি হলাম ফালাকাটা হাই স্কুলে। নবীন কিশোর, নবীন প্রাণের উচ্ছ্বাসে সবকিছুতেই তখন আনন্দে আত্মহারা। হাইস্কুলে পড়াকালীন মজার দিন ছিল বটে একেকখানি। স্কুলের পাশেই বসত মেলা-সার্কাস— আশির দশকের প্রাক্কালে বিনোদনের অন্যতম লোভনীয় বিষয়! স্কুলে গিয়ে চোখ,মন দুটোই পড়ে থাকত সেই সার্কাস বা মেলার মাঠে। অবশ্য খুব বেশিক্ষণ সেই অবস্থা থাকতনা মোটেই! মনোযোগের দাওয়াই ছিলো চন্ডি স্যারের পিটি ক্লাস কিম্বা পন্ডিত স্যারের সেই বেতের ভয়ে আর কিছু না হোক, যতটুকু সম্ভব হিন্দি লেখাটা লিখে রাখা। অফ ক্লাসে, দীপক সার্কাসের জোকাররা কেমন করে হাঁটেন সার্কাস চলাকালীন, তা নিয়ে ক্লাসে আবার সবার প্রতিযোগিতা হতো। আর ফার্স্ট হয়ে রথীন পেতো কাঠপেন্সিল পুরস্কার। ছবিগুলো ভাবলেও বিশ্বাস হয়না, জীবন এতটাই সহজ ছিল! স্কুলের বন্ধুদের সাথে টিফিন ভাগ করে খাওয়ার যে আনন্দটা যেন আজও চোখে ভাসে। আমাদের ছেলেবেলা ম্যাগি-চাউমিন-পাস্তার নয়। সেসবের নাম শুনেইছি কত পরে। বাড়ি থেকে স্টিলের বাক্সে পাঠাতো রুটি-লুচি, চিঁড়ের পোলাও, সুজি, ফলমূল এইসব। তবে হাইস্কুলে পড়বার সুযোগ আর সেখানে বেশিদিন হয়নি, কারণ বাবার আবার বদলি সূত্রে ময়নাগুড়ি চলে আসার খবর এলো। রয়ে গেল প্রাইমারি ও হাই স্কুলের সোনালী রূপালী জীবন, থেকে গেল দিদিমণি-মাস্টারমশাইদের শাসন-আদর, ফেলে এলাম বন্ধুদের, ফেলে এলাম স্কুলফেরত খেলাধুলো করে এসে ঘামে ভিজে বাড়ি ফিরে হ্যারিকেনের আলোয় পড়তে বসা ছোট্ট ছেলের মুখ,মা ভেজে আনত মুড়ি-বাদাম। ফেলে এলাম সার্কাসের মাঠ, উপহারের কাঠপেন্সিল। বুঝি জীবন তখন রবিঠাকুরের লেখার মতো, “হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোথাও, অন্য কোনোখানে…”
এরপর চলে আসি ময়নাগুড়িতে।
অর্থাৎ আমাদের পৈতৃক বাড়ি যেখানে। একান্নবর্তী পরিবারের সঙ্গ পাওয়ার শুরু এইসময় থেকেই। জীবনের এক নতুন মোড়ে বাঁক নিলাম এখানেই।
ভর্তি হলাম ময়নাগুড়ি হাইস্কুলে, কালো প্যান্ট -সাদা শার্ট। কিন্তু এই স্কুলে একটা বলার মতো ব্যাপার ছিল যে, বেশিরভাগ শিক্ষকমশাইরা ছিলেন আমার বড় কাকার সহপাঠী, বাবার বিশেষ পরিচিত এবং ছোটকাকুর শিক্ষক। কাজেই একটু বেচাল দেখলেই তা অভিযোগ আকারে বাড়ি পৌঁছে যেতে সময় লাগত না। মানে বাড়ি অব্দিও পৌঁছতে হতনা তেমন হলে, রাস্তাঘাটেই বাবা-কাকাদের সঙ্গে স্যারদের সাক্ষাতে সর্বনাশের ঘন্টা বেজেই যেত। আর যেহেতু তখন বয়সে একটু বড়, কাজেই ল্যাজটাও বড়ো স্বাভাবিকভাবেই। বয়সের প্রশ্রয়ে খানিকটা বেপরোয়াও বটে! সুতরাং দুষ্টুমির অন্ত নেই, ফূর্তির প্রাণ যেন সবসময়ই খেলা,আড্ডা, বন্ধুদের নিয়েই ভরে আছে।
মনে পড়ে দপ্তরিকাকু যখন নোটিস খাতা নিয়ে ক্লাসে আসতেন, ধরেই নিতাম ঠিক ছুটির নোটিস! দীননাথ স্যারের সেই ‘প’ এর উচ্চারণ ‘ফ’ এবং সেই সূত্রে “ফুর্বো পাকিস্তান”এর (পূর্ব পাকিস্তান)গল্প আর শীতকালে ধুতির ওপর কালো কোট কোনোদিন ভোলার নয়। ছিলেন জয়ন্ত স্যার, যিনি আজীবন স্কুলের ড্রেসকোড মেনে চলতেন। এই ব্যক্তিত্বগুলো এতটাই প্রভাব ফেলেছিল মনে,যে এত বছরেও তা স্পষ্ট মনে পড়ে যায়।
আজ এই মাঝবয়সে স্কুলের সেইসব কথা লিখতে বসে কেন জানি চোখের কোণ চিকচিক করে ওঠে। বন্ধুরা সবখানেই হৃদয়ের সমান কাছে। যোগাযোগের অভাবে অনেকেই ছিটকে গেছে। শিক্ষক -শিক্ষিকারা অনেকেই ইহলোক ত্যাগ করেছেন, অকালে চলে গেছে অনেক বন্ধুও। ব্যস্ততায় সোশ্যাল মিডিয়ার সূত্রের ওপরেই ভরসা রাখি। গেট-টুগেদার হয়, ফোনালাপ চলে, সংসার -সন্তানের ভবিষ্যৎ আলোচনা, বাজারে সব্জির দাম কম না বেশি, সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতি আলোচনা করতে করতে কার সুগার ধরা পড়েছে, কার ছেলে বিদেশে পড়তে যাচ্ছে, কার মেয়ের সামনেই বিয়ে, কার এত বছরে বয়সে নতুন প্রতিভা বিকাশের রাস্তা এগিয়ে যাচ্ছে — এই নিয়ে জীবন কেটে যায়। কিন্তু আলোচনার বিষয় বেশিরভাগ দিনে অন্তত একবার হলেও সেই স্কুলের কথা। ফালাকাটা হোক বা ময়নাগুড়ি — বিদ্যালয়ই তো সেই আশ্রয়, যেখানে জীবনের একেকটা ধাপ পেরিয়ে আজ মধ্য পঞ্চাশেও যার জন্য স্মৃতির বাক্স খুললে ছুটির পর ফাঁকা মাঠে উড়ে যাওয়া ধুলোর গন্ধ পাই, মনে পড়ে ব্ল্যাকবোর্ডে সাদা চকে লেখা বীজগণিতের সূত্র, কোন এক বন্ধু স্কুল ছুটির পর যাবে তার বান্ধবীর সঙ্গে দেখা করতে, কিন্তু সঙ্গে সাইকেল বাহিনী নিয়ে পাহারা দিতে চলেছে বাকি বন্ধুরা। আমাদের সময় স্কুলের শেষ দিনে শার্টের পেছনে বন্ধুদের সই আর ফেয়ারওয়েল মেসেজ লেখার ধারণাটা ছিলনা। থাকলে বুঝি বড় ভালো হত। এখন স্মৃতি ধরে রাখা সহজ, আমাদের স্মৃতিগুলো ঐ বন্ধুদের সঙ্গে গল্পে, মনের ভেতরে আর রয়েছে স্কুলের ইট-কাঠ-পাথরগুলোতে। রিইউনিয়ন আমার প্রিয় উৎসবের একটি— আক্ষরিক অর্থেই। এ লেখার শুরুতেই বলেছিলাম, সম্ভবত জীবনের সবচেয়ে সুখী সময় স্কুলবেলা। তাই জটিল, ক্লান্ত জীবনে মাঝেমধ্যে সেই স্কুলের সোনালী বিকেলগুলো মনে করি, সাইকেলে ছুটে যাওয়া বাড়ির পথটুকু মনে করি, পরীক্ষার ভয়গুলো মনে করি, মনে করি রোল নম্বর লেখা অ্যাটেনডেন্স খাতাটা। চারপাশের জীবনের ক্যাকোফোনিতে ক্লাসরুমে চিৎকার চেঁচামেচি করতে করতে হঠাৎ স্যার এসে পড়ায় যে পিনড্রপ সাইলেন্স মোড অন হয়ে যেত ক্লাসে সেই শান্তির আবহটাকে মনে করি। চোখ বুজে আসে, স্পষ্ট শুনতে পাই, “রোল নম্বর ৭… বিপ্লব, কাল স্কুলে আসিসনি কেন?”
ভালো থাকুক স্কুল, এমন বেঁধে বেঁধে থাকি বন্ধুরা, মজবুত থাক স্মৃতির বিদ্যালয়ের দেওয়াল। এটুকুই চাওয়া!
No comments:
Post a Comment