Tuesday, July 2, 2024


 

স্মৃতির বিদ্যালয়

বেলা দে

দেবালয় শিবালয় আমরা মন্দির বলে জানি। আমার কাছে শিক্ষালয় মানে তেমনি এক মন্দির, মা স্কুল যাবার কালে বলতো চটি খুলে মা সরস্বতীকে প্রনাম করে যা,মায়ের কথামতো প্রনাম মন্ত্র " সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যে কমললোচনে_বলে রওনা দিতাম।

সেটা ওভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছিল,আমাদের সময় তো কিন্টারগাডেন স্কুল জন্ম নেয়নি, মায়ের কাছে বসে
রান্নাঘরে প্রথম শিশুশিক্ষা পাঠ শুরু সেদিক থেকে  মা আমার প্রথম শিক্ষাগুরু। তখন তিনের শৈশব। 
প্রথাগত বিদ্যার শুরু পাঁচ বছরে ফালাকাটা জুনিয়র গার্লসে, প্রধান শিক্ষক শ্যামলাল ঘোষ, অন্যান্য সব
দিদিমনি বিভা দি,আরতি ঘোষ,গীতাদি। গীতাদি খুব রাগী দিদিমনি আমি ভরে চুপসে থেকেছি সর্বক্ষণ কখন  কি বলে, সবসময় গম্ভীরমুখে থাকতেন, হাসি নেই  আমি একটু ভ্যাবলা গোছের ছোট থেকে, মুখে হাত দিয়ে থাকতাম আর প্রতিদিন বকা শুনতাম। বাবার হাত ধরে প্রাইমারি পর্যন্ত স্কুলে গেছি,বাবা ফাইভ থেকে এইট পর্যন্ত ক্লাশ নিত, আমি ফোরে পড়তে বাবা অবসর নিয়েছেন,পরবর্তীতে প্রতিবেশী বন্ধুদের সাথেই যাতায়াত। ফালাকাটা শহরকে দুভাগে ভাগ  করে বয়ে যাওয়া নদী সাপটানা পেরিয়ে আমাদের  বিদ্যালয়ে যেতে হতো কোনো সাঁকো ছিল না। প্রতি বর্ষায় নদীর রূপ ভয়ংকর হয়ে উঠেছে দুকুল ছাপিয়ে জল উঠে গেছে সেই সাথে উঠে এসেছে হিংস্র  জলজ প্রাণী, একবার পাড়ায় মানিক বোসের বাড়ির কাছে ঘরিয়াল ভেসে এসে থমকে দাঁড়িয়ে ছিল, লোকে লোকারণ্য ওদিকে আর খেলতে যাইনি কতদিন ভয়ে রাতঘুম গেছে উবে ওই রাস্তাতেই স্কুল মারাত্মক ভয় পেয়েছি। বর্ষাকালে পুরাতন চৌধুরীর  ব্রিজ হয়ে ঘুরপথে স্কুলে গেছি। একটু উঁচু ক্লাশে উঠে স্কুলে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করিয়েছে আরতিদি পপিদি। রবীন্দ্র জয়ন্তী, নজরুল ইসলামের জন্মদিন  সে দিনগুলোর আনন্দ ভোলার নয়। আমার বাবার পর হেড মিস্ট্রেস হয়ে এসেছেন জ্যোতির্ময়ী দিদিমনি, তিনি চলে গেলে এসেছেন মায়া বোস। বড় ভালো বাসতেন আমাকে। যেবার গ্রাজুয়েশন করলাম দেখা করে প্রনাম করার পর বলেন "বেলু চাকরি করবি এই স্কুলে" ভূগোল টিচারের খুব প্রয়োজন " পাশে রত্না ছিল সেই বলে দিয়েছে দিদিমনি আর সাতদিন পরে ওর বিয়ে, বলেন সেকি রে এইটুকু বয়সে। আমার তখন কুড়ি হয়নি। যাক সে কথা আগের কথা বলা হয়নি। আমরা পাঁচ সহপাঠী আমি, অঞ্জলি পাল চৌধুরী, রত্না ব্রহ্ম, বিদ্যাবতী লালা, সাবিত্রী বাজপেয়ী ছিলাম স্কুলে  বরাবর ফ্রাষ্ট ব্রেঞ্চার, মেধাগত দিক থেকেও পরপর আমি ছাড়া। আমি সাত থেকে দশে। বিদ্যাবতীকে ধরেছি ফোরে। তবু্ও বন্ধুত্ব ছিল প্রগাঢ় অটুট সে  আটি ভাঙে কার সাধ্যি। এবার জুনিয়র গার্লস ছেড়ে পাঁচজনা ভর্তি হলাম ফালাকাটা উচ্চ বিদ্যালয়ে, কো এড স্কুল, ছেলেদের শ্রেণিকক্ষ আলাদা।নতুন স্কুল নতুন স্কুলের শিক্ষকেরা নতুন অভিজ্ঞতা বেশ লাগছিল। এমনিতেই নওল কিশোরীবেলা সবেতেই  আনন্দ, মূল সড়কের পাশে বিদ্যালয় পরিবেশও
মনোরম  মন ভরে নিয়েছি নতুনত্বর আস্বাদ। প্রত্যুষে পাখিদের সাথে জেগে উঠে প্রচন্ড অনিচ্ছায় রোজ
ঘুমচোখ কচলেই রওনা হওয়া। শীতরাতের ওম বিছানা ছেড়ে শীতবুড়ির কামড় খেতে খেতে স্কুলের
পথ ধরা তার মধ্যে সাপটানার পা ভেজা হিমজল। ক্লাসটিচার হর চক্রবর্তী স্যার আমার এমনিতেই মহাভয়ের তন্মধ্যে ওই দীঘল চেহারার ধারালো উজ্জ্বল দুটি চোখের চাউনি আমাকে এমনিতেই আধমরা করে দিয়েছে ভয়ে আমি নিষ্প্রভ অঙ্কাতঙ্কে প্রথম পিরিয়ড অনাসৃষ্টি অঙ্ক তাকেই নিতে হল। প্রায়শই স্কুলে ঢুকতে দেরি শীতবেলায়, রত্নার থেকে জেনেছে  আমার ঘুম ভাঙতে দেরির কথা ওমনি বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে বলেছে" মহারানী আপনি বাইরে থাকুন" রত্না ভিতরে আয়। হরস্যার আমার প্রতিবেশী ছিল,  জন্ম থেকে দেখেছেন।  ডাকনামেই ডাকতেন,  আমার বড়দার বন্ধু, মৃত্যুর আগে দাদাকে বলেছিল মহারানীকে অনেকদিন দেখিনি ও এলে একবার বলিস, আর দেখা হল না।  বাংলার প্রমথ \ চৌধুরী স্যার আমার খুব প্রিয় মানুষ  ছিলেন কারণ আমি বাংলায় ক্লাশ টপার। আমার লেখা রচনা, ব্যাখ্যা সবাইকে দেখাতেন ক্লাসে।  একবার স্পোর্টস এ হিটে চান্স পাইনি বন্ধুরা পেয়েছে আমি হাঁপুস নয়নে কাঁদছি প্রমথ স্যার  এসে বলেন মেমোরি টেস্ট খেলায় নাম দে তুই পাবিই আমি জানি, পেয়েছিলাম বলে স্যারকে  প্রনাম করতে গেলে বলেন পাগলি একটা। পড়তে 
পড়তে আমার বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের পর স্কুলে সার্টিফিকেট আনতে গেলে স্যার বলেন পাগলি তুই
এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে করে ফেললি?  সে তো জানেনা আমার কোনোই হাত ছিল না। আমি বোর্ডের পরীক্ষা দেব সেবার এসেছেন প্রধান শিক্ষক নীরোদ বরন রায় সুতরাং তার সম্পর্কে বলার মতো  কিছু না থাকলেও সপরিবারে আমাদের পাড়াতে  ছিলেন প্রথমটায়, তাঁর সম্পর্কে কোনও দিনই কূমন্তব্য শোনা যায়নি ফালাকাটা শহরে অথবা পড়ুয়াদের মুখে।দেবতুল্য মানুষ ছিলেন। আমার সাথে  ব্যক্তিগতভাবে আলাপ ছিল তাঁর,  স্নেহ করতেন খুব গুরুগম্ভীর হৃষিকেশ স্যারের ইংরেজি গ্রামারের পাখিপড়া আজও পোক্ত রেখেছে আমাকে যা আমার সন্তানের লেখাপড়ায় কাজে লাগিয়েছি। পড়া আদায় করে তবেই ছেড়েছেন, ঘন্টা পড়ে  যাচ্ছে যাক,পরবর্তী ক্লাসের শিক্ষক এসে দাঁড়িয়ে থেকেছেন সে হুশ নেই, এমন নি:সার্থ শিক্ষক কোথাও মেলে না যা আমরা পেয়েছি। নেই কোনো  লেনদেন হিসাব নিকাশ সম্পর্ক শুধু গড়েপিটে ভালো ছাত্র করে তোলার অঙ্গীকার। মানবিক চৈতন্য দেওয়ার আদর্শিক টিচার। স্কুল জীবনের  শিক্ষকদের কোনো দিন মোছা যায় না সরস স্মৃতি  থেকে। এইজন্যই বিদ্যালয়যাপন শ্রেষ্ঠ সমস্ত জীবনরেখায়।সেদিন বিদ্যুৎহীন জনপদ ফালাকাটা,  এক ঝড়ের সকালে অন্ধকার নেমে আসে স্কুলে  ক্লাশরূমে, মোমবাতি নিভে যাচ্ছে হরস্যারের ক্লাশ কি করেন স্যার সবাইকে একটা করে কবিতা বলতে বলেন আমরা ফার্স্ট বেঞ্চার পঞ্চনন্দিনী আমার থেকে শুরু হল " গগনে গরজে মেঘ-----আমি একেলা, ব্যাস সব ভুলে গেছি। কান ধরে দাড়ানোর হুকুম হল বিদ্যাবতী গড়্গড়িয়ে বললো সবটা। পিছনের সারিরা হেসে কুটিপাটি হর চক্রবর্তী স্যারের এই অভিনবত্বে, অঙ্কের বদলে কবিতা। এই হল আমার আমাদের মাষ্টার মশাইরা, ফাঁকির জায়গা রাখেনি।  সহপাঠীরা সব আয়নার মতো সেটে আছে চোখের  সামনে, ঝগড়া বিবাদ বিচ্ছেদ সব ছাড়িয়ে অন্তরের টান, আজ স্বামী সংসার নানা পেশায় জড়িত হয়ে কে যে কোথায় ছড়িয়ে খোঁজ রাখা হয়না, 1st ব্রেঞ্চারের একজন সাবিত্রী বাজপেয়ী বিয়ের পরে খুদে দুটি পুত্র কন্যা রেখে কর্কট ব্যাধিতে আমাদের ব্রেঞ্চ ফাঁকা করে দিয়ে লাক্ষ্ণৌতে দেহ রেখে গেছে। সাবিত্রী তোকে খুব মিস করি রে, ফিরে আয়।

বিদ্যালয়ে ঢুকেই প্রেয়ার লাইন "সমুখে তুঙ্গ তুষারে মৌলি`` আজও শান্তি দেব ঘোষের সুর ঝংকার
কর্ণকুহরে বেজে চলে। গানের প্রত্যেকটা কলিতে উত্তুরে ডুয়ার্স প্রকৃতির অনুপম সৌন্দর্য্য ভরা ফালাকাটা শহরের পাজরে ছায়াপুষ্ট আমাদের স্মৃতি ঘেরা বিদ্যালয় " ফালাকাটা উচ্চ বিদ্যালয় "
প্রার্থনা সংগীতের মাধুর্যে কার্তিক মুখুটি স্যারও রামধনু রঙ মাখিয়েছিল।

No comments:

Post a Comment