Friday, August 2, 2024


 

‘পথের শেষ কোথায়, শেষ কোথায়, কী আছে শেষে...`

পথ
অনিতা নাগ 

পথ দিয়ে কে যায় গো চলে
ডাক দিয়ে সে যায় 
আমার ঘরে থাকা দায়….

সামনে খোলা গীতবিতান।  কমলের চোখ আটকে গেলো এই গানের বাণীতে।একরাশ উদাস করা মনখারাপ ঘিরে ফেললো কমলিকাকে। কোন পথের কথা বলেছেন প্রাণের ঠাকুর? জীবনের পথ যে অন্তহীন। 

কমল, কমলিকা…..।  চমকে তাকায় কমলিকা। জানলা দিয়ে চোখ চলে যায় দূরে, আকাশ পানে। মা গো,  কতোদিন হয়ে গেলো তুমি আর কমল বলে ডাকো না। কতদূরে চলে গেছো তুমি। যে পথ দিয়ে চলে গেলে সে পথ কতো খুঁজি মা গো! তার হদিস পাই না। আপন মনেই বলে কমলিকা। 

জীবনে কতো যে পথ পেরিয়ে আসা।  ভাবতে বসলে সব কেমন একাকার হয়ে যায় কমলের। পথ, দুটো অক্ষর। অথচ তার ব্যাপ্তি অন্তহীন। কতো পথের বাঁক ঘুরে এগিয়ে চলা জীবনে। ছোটবেলার দিকে তাকালে কমল দেখতে পায় একতলা বাড়ীর গ্রীলের গেট পেরিয়ে যে পথ সোজা গিয়ে মিলেছে বড় রাস্তায়, নিত্য যাতায়াত সেই পথে। সেই পথ দিয়েই স্কুল, কলেজ যাওয়া। বাবা, মা'র সাথে ঘুরতে যাওয়াই হোক, বা অন্য যে কাজেই হোক, সেই পথই ছিলো জীবনের সেতুবন্ধন। বৃষ্টি হলে সেই পথ ভরে যেতো জলে। সেই থৈ থৈ জল পেরিয়ে যাতায়াত বর্ষাকালে। টুকরো টুকরো স্মৃতি ঘেরা এই পথ ধরেই এগিয়ে চলা জীবনে। কমল যেদিন বিয়ের পর বাড়ী ছেড়ে শ্বশুরবাড়ি গেলো,সে'দিন এই পথ তাকে পৌঁছে দিয়েছিলো জীবনের নতুন যাত্রাপথে। শুরু হয়েছিলো জীবনের নতুন পর্ব। সেই প্রথম কমল ওই পথকে আঁকড়ে ধরলো মনে মনে। অপেক্ষায় রইলো ঐ পথ দিয়ে কবে আবার যাবে তার বাড়ীতে, যেখানে রয়ে গেছে তার আপনজনেরা, রয়ে গেছে তার ফেলে আসা দিনগুলো। সেই প্রথম পথকে ভালোবাসা। তারপর বারবার পথ পাল্টেছে। কর্তার ছিলো বদলীর চাকরী। কতোবার ঠাঁই বদল হয়েছে। কখনো শহরের রাজপথ ছেড়ে গ্রামের মেঠো পথ,  কখনো পাথর বিছানো পথ। চড়াই,  উতরাই। তবে সব পথ এসে মিলে যেতো গৃহের দ্বারে।

মনে পড়ে উচ্চমাধ্যমিক এর পর মা বাবার সাথে কেদারবদ্রী গিয়েছিলো। গৌরী কুন্ড থেকে হেঁটে পৌঁছেছিলো কেদারনাথ। দু'পাশে নয়ন ভোলানো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কমলকে মুগ্ধ করেছিলো। অথচ কমলের মোটেই তীর্থযাত্রায় মন ছিলো না। বন্ধুরা যখন মুসৌরী, উটি, সিমলা, নৈনিতাল এ’ গিয়ে আনন্দ করছে, তখন কিনা কেদারবদ্রী! খুব রাগ হয়েছিলো কমলের। কিন্তু এই যাত্রায় তার প্রাপ্তির ঝোলা উপচে পড়ছে। মনে মনে আজও নতজানু তার বাবা মা'র কাছে। শেষের পথটুকু, যেটা পার করে পৌঁছে গিয়েছিলো দেবাদিদেব এর আবাসস্থলে,  সেই পথ আজো টানে কমলকে। বারবার ওই পথে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে। সব পথে তো ফেরা হয় না। তবু আশ্চর্য্য ভাবে ফিরেছিলো কমল ওই পথে। চৌত্রিশ বছর পর। দীর্ঘ সময়ে সেই পথ তখন আর আগের মতো ছিলো না। কমলেরও বয়স বেড়েছে। শক্তি কমেছে। অসুস্থতা উপেক্ষা করে ঘোড়ায় চড়ে পৌঁছেছিলো। যাত্রা পথের অনেকটাই তখন বদলে গেছে। দোকানপাট,  লোকজনের ভীড়ে দম বন্ধ হয়ে আসছিলো কমলের। কমল অনুভব করেছিলো যা হারিয়ে যায় তাকে যতই আগলে রাখতে চাও সময়ের স্রোতে সব ভেসে যায়। তবু সেই পথ আজও টানে কমলকে। কল্পনার পাখা মেলে সে পৌঁছে যায় ফেলে আসা ওই পথে। নিজেকে ছড়িয়ে দেয় ওই বিশালের পদপ্রান্তে। স্নিগ্ধ শীতল পরশে শরীর মন জুড়িয়ে যায়। মনে মনে বলে উঠে ‘ হে পূর্ণ, তব চরণের কাছে যাহা কিছু সব আছে আছে আছে’। পথের বাঁকে কমল সেই পূর্ণতাটুকু খুঁজে বেড়ায় আজও।

কমল শহরের মেয়ে। বিয়ের পর প্রবাসে প্রত্যন্ত জায়গায় থেকেছে। শেষের দিকে বড় শহরেও থেকেছে। তবে মন পড়ে থাকতো বাড়ীর ওই গলিপথের দিকে। যে পথ তাকে জীবনের যাত্রাপথে এগিয়ে দিয়েছিলো। সেই পথ দিয়েই বারবার ফিরে ফিরে এসেছে শিকড়ের টানে। সময়ের চাকায় জীবন এগিয়েছে। শিকড় ক্রমশঃ আলগা হয়েছে। প্রথমে বাবা, তারপর মা। হারিয়েছে দু’জনকেই। ওই গলিপথ দিয়েই কমলের বাবা, মা শেষ যাত্রায় চলে গেছেন।আর কখনো ফিরবেন না তারা। পথ থেকে যায়। শুধু ফেরার রাস্তা হারিয়ে যায়। কমল জানে ওই গলিপথ আজো তেমনই আছে। খুব ইচ্ছে করে ওই গলিপথ দিয়ে পৌঁছে যায় নিজের শিকড়ের কাছে। কিন্তু জটিল রাজপথ পেরিয়ে পৌঁছোতে পারেনা সেই গলিপথে। আপন মনের অলিন্দে আগলে রাখে সেই গলিপথকে। আনমনা কমলের দু'চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে বিন্দু বিন্দু জল। সামনে খোলা গীতবিতানকে আঁকড়ে ধরে। কান্না ভেজা গলায় গুনগুন করে  ‘পথের শেষ কোথায়, শেষ কোথায়, কী আছে শেষে/ এত কামনা, এত সাধনা কোথায়  মেশে”।।

No comments:

Post a Comment