`কেডস ভিজেছিল পথে একদিন....`
স্মৃতির পথখানি
জয়িতা সরকার
শহরের অলিগলির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া কিংবা ওই রাস্তাটা কোথায় শেষ হয়েছে তার হদিশ পেতে বাবা আর আমি নিয়ম করে বেড়িয়ে পড়তাম রোজ বিকেলে। সেই সুবাদে মাত্র তিন বছর বয়সেই কলেজ পাড়ার এ গলি, সে গলি থেকে তিস্তা উদ্যানের রাস্তা সবটাই ছিল মনের গণ্ডির মধ্যে। নতুন নতুন রাস্তা চেনা আমার কাছে কেমন একটা নেশার মত, ছেলেবেলার সেই অভ্যেস আজও বয়ে চলেছি। আসলে রাস্তা তো শুধু গন্তব্যে পৌঁছে দেয় না, প্রতি পদক্ষেপে কতশত গল্প তৈরি হয় জানা-অজানা পথ ধরে। কত ভাঙ্গাগড়া স্মৃতির চিহ্ন ছড়িয়ে থাকে পথের দু-ধারে। পাল্টে যাওয়া সময়ের সাক্ষী হয়ে থাকে ওই রাস্তা। নতুন পথিকের প্রথম আলাপের আলতো ছোঁয়া বেঁচে থাকে ওই পিচ গলা পথে। রাস্তার সঙ্গে আমার সখ্যতা বরাবরের। বাবার সঙ্গে সাইকেলে চেপে জল শহরের নানা অলিগলিতে ঘুরে বেড়ানো ছোট্ট মনে যে রাস্তা প্রথম দাগ কাটে, তা ছিল আমার প্রথম স্কুলের পথ খানি। তবে প্রথম প্রিয় রাস্তার আসল নামটা ধরে তাকে সম্বোধন করা হয়ে ওঠে না আজও, আমার কাছে ওটা শিশু নিকেতনের গলি।
স্মৃতির সরণী বেয়ে যা খুঁজে পেলাম তাতে স্কুল বাড়ির আকার আকৃতির খুব বেশি পরিবর্তন না হলেও রাস্তার বদল হয়েছে খানিকটা, আশেপাশে নতুন বিল্ডিং মাথা উঁচিয়ে আছে এখন। মনের সিন্দুকে যত্নে রাখা রাস্তার পাশে চালতা গাছটা আছে কিনা জানা নেই, আসলে ওই পথে পা বাড়ায়নি অনেকদিন। ছুটির পরেই বরফ হাতে মা-কে পেছনে ফেলে ছুটে গিয়ে চালতা খোঁজা ছিল ওই পথের মূল আকর্ষণ। ছোট্ট গলি দিয়ে বেড়িয়ে স্টেট ব্যাঙ্কের সামনে দিয়ে আসতেই চোখে পড়ত শহরের নামজাদা স্কুলের প্রধান গেট। লাল সাদা বড় বাড়ি পেড়িয়ে যেতে যেতে মন বলত, ভালবাসার এই পথের গণ্ডি বৃহত্তর আর চিরস্থায়ী করতে হলে গেটের ওপারে পৌঁছতে হবে। যদিও শিশু মন তখনও বোঝেনি চিরস্থায়ী বলে আদতে কিছু হয়না।
রাস্তাকে ভালোবেসে জীবনের বারো বছর ওই পথকেই বেছে নেওয়ার সৌভাগ্য কড়া নেড়েছিল ১৯৯৩ এ। শিশু নিকেতনের গলি ছাড়িয়ে উঠে এলাম ক্লাব রোডের বড় বাড়িটিতে। রাস্তা হল রোজকার গল্পের লেখক। সাদা ফ্রক থেকে শাড়ি, ভাল রেজাল্ট থেকে কেমিষ্ট্রি গুলিয়ে যাওয়া অনুঘটকের অন্যনাম। পেন ফ্রেন্ড-র চিঠি থেকে ভালোলাগার প্রথম অনুভূতি। ফুচকা-আলুকাবলি থেকে কুল মাখা সবটা মিলিয়ে শহরের ওই রাস্তাটা জীবনের প্রতি বাঁকে নতুন করে ভাল থাকার মন্ত্র শিখিয়েছিল। মন খারাপের বর্ষায় কিংবা শরতের প্রথম সাদা মেঘে আজও বেঁচে থাকার রসদ ক্লাব রোডের পড়ন্ত বিকেলে একঝাঁক কিশোরীবেলার হট্টগোল।
বাড়ি থেকে স্কুল যাওয়ার পথটা যেকোনো এক্সপ্রেসওয়ে কে হারিয়ে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত আজও। পাহাড়ের পাকদণ্ডীর প্রতিবাঁকে নতুন কিছু দেখা কিংবা জঙ্গলের শিহরণ জাগানো রোমাঞ্চকর পথ যতই সুন্দর হোক, জীবনের স্মৃতিমধুর এই পথ তাদের হারিয়ে দেবে অনায়াসেই। আসলে বৃহত্তর পৃথিবীর সব পথে পা বাড়াতেই শিখিয়েছিল ক্লাব রোড। খিলখিলিয়ে হেসে ওঠা কিংবা মন খারাপে চোখের জলের সাক্ষ্য যে বয়ে নিয়ে চলেছে তার প্রতি এমন ভালবাসা থাকাটাই স্বাভাবিক। আসলে অনুভূতি, আবেগ , আবদার আর একটা দীর্ঘ গল্পের রূপকার হল জল শহরের ক্লাব রোড।
রাস্তার এপাড় থেকে ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা বন্ধুর জন্য উদ্দেশ্যহীন চিৎকার, বর্ষায় সামান্য জল জমার হদিশ পেলেই রিকশা কাকুর ওপর চোটপাট দেখিয়ে কেডস ভেজানোর নির্ভেজাল আনন্দগুলো আটকে আছে হেড পোস্ট অফিস,এফ ডি আই স্কুল কিংবা জিলা পরিষদের এধার ওধারে। স্কুল অফিস ঘেরা এই রাস্তাটা ছিল দিনের বেলার সবচেয়ে প্রাণচঞ্চল জায়গা। রাত বাড়তেই তার রূপ পাল্টে যেত অনেকটাই। দিনের কলতান তখন নিস্তব্ধ নিশ্চুপ। নতুন ভোর, স্কুলমুখী কচিকাঁচা আর ব্যস্তবাগীশ অফিস কর্তাদের জন্য অপেক্ষা করত সেই চৌরাস্তা। প্রথম পরিচয়ের থেকে অনেকটা ভোলবদল করেছে এই পথ। আশেপাশের বাড়িগুলিতে আধুনিকতার থাবায় ফ্ল্যাটেদের ছড়াছড়ি। রাস্তাও যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সেজেছে লাল-সবুজ আলোকসজ্জায়। প্রথম পরিচয়ের সময় এসব আলোর সম্মতির প্রয়োজন ছিল না। আসলে হয়ত আমাদের মত রাস্তাও তখন ছোট ছিল।
চেনা রাস্তার প্রথম পরিবর্তন চোখে পড়েছিল পোস্ট অফিসের সামনের চৌরাস্তায় যেদিন রানার মূর্তি বসানো হল। তারপরই স্কুলে ঢোকার সামনেই বসল গান্ধীজির মূর্তি। পরিচিত পথগুলো নিজেদের সাজিয়ে গুছিয়ে পরিবর্তনের পথে পা বাড়াল। হঠাৎ একদিন পাল্টে গেল জিলা পরিষদের পুরনো ভবনের আদল, ঝা চকচকে হয়ে উঠল রাম ঘোষের মিস্টির দোকানটাও। সময়ের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতেই পথ-পথচারী আর চারপাশটা পাল্টে গেলেও স্মৃতিরেখায় আজও উজ্জ্বল ক্লাব রোড ও তার সহযোগীদের উপস্থিতি।
No comments:
Post a Comment