Friday, August 2, 2024


 

`কমলালেবু  রোদ মাখা পথ....`


সেই প্রিয় পথ

পর্ণা চক্রবর্তী


পথটা এখনো স্বপ্নে আসে। প্রায়ই আসে। দু চোখে জুড়ে ঘুম যখন বৃষ্টির মতো নামে ,আমি ভিজতে ভিজতে অতল জলের ভেতর ডুবতে থাকি, ঠিক তখনি পথটা হুস করে সে গহীন থেকে উঠে সামনে এসে দাঁড়ায়।

ঘুমের ভেতরে আমি জেগে উঠি। পথের কাছটিতে গিয়ে দাঁড়াই। সে  ঠিক তেমনি আছে যেমন ছিল তিরিশ বছর আগে। রোদবেলাতে দুপাশ জুড়ে  বড় বড় বৃক্ষরা তেমনি ছায়া ফেলে  রাখে পথ জুড়ে। সেই ছায়ায়  আলগোছে পড়ে থাকে চিকন  লাল,হলুদ ফুলেরা,  কিছু পাতাও থাকে ইতস্তত। অভ্যাস মতো পাতা কুড়াই, ফুল তুলে গন্ধ নিই ।গন্ধহীন ফুলগুলোতে নানা স্মৃতির আলগা সুবাস লেগে থাকে।

পুরনো অভ্যাস মেনে এলোমেলো পায়ে হাঁটতে থাকি। পথ আমার সাথে সাথে নিবিড় হয়ে হাঁটে। দুপাশের গাছের সারি আরও ঘন হয়।দমকা হাওয়ায় চারপাশে ফিসফিস শব্দ জেগে ওঠে। বাতাসে যেন কাদের  কানাকানি। আমি পথ হাঁটি আর পথ হাঁটে আমার সাথে। ছাতিম ফুলের সুবাস পাক খেতে খেতে সাথে চলে।  গাছের ফাঁকে দেখা যায় বিশাল বিশাল বাড়িগুলো। কোনোটা সাদা সোনালী রঙের ঝকঝকে। কোনোটা গায়ে বয়সের শ্যাওলা নিয়ে সবজে মলিন  হয়ে থাকে। কতগুলো বাড়ির বিরাট ছাদ, তাদের  লম্বা টানা  বারান্দার  থামগুলোতে জড়িয়ে থাকে  মাধবীলতার ঝাড়, তাতে সাদা গোলাপী ফুল ফুটে থাকে। বড় বড় জানলা দরজাতে ভারী ভারী সাদা হলুদ পর্দা ঝোলে। বাড়ির ভেতরে গ্রামোফোন বাজে।  তার অস্ফুট এক  সুর  ভেসে   এসে  গাছগুলোতে ধাক্কা খেয়ে  পথময় ছড়িয়ে যায়। আমি চুপ করে শুনি আর মগজে গেঁথে নিই। যখন একা থাকি, তখন ওই সুর গুনগুনিয়ে  মগজ ছাপিয়ে  আমার কানের কাছে এসে বাজতে থাকে নাকি বুকের ভেতর বাজে সে জানি না, কিন্তু নানা কাজে, অকাজে হাজার  ব্যস্ততার মধ্যেও  তখন ওই পথটাকে আমি  দেখতে পাই, মনে হয় আমরা দুজনেই দুজনকে দেখতে পাই স্পষ্ট।

রোজ নির্দিষ্ট  একটা সময় সেই পথ ধরে যেতাম  আবার সেই পথ ধরেই ফিরতাম। ওই একই পথ মাসের পর মাস,বছরের পর বছর ধরে হাঁটি তবুও সে এতটুকুও পুরনো হয় না। কিসের  এক নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে  ওই পথ ধরে চলা, কি যে এক ভালো লাগা ছিল ,একদিন না গেলে মন খারাপ হতো।  সকালে যাওয়ার সময় কমলালেবু  রোদ মেখে পথ আমার সঙ্গ নিত। বাতাসে শীতের আমেজ,  উত্তুরে হাওয়া আমার সবুজ ফুলহাতা সোয়েটারের ফাঁক দিয়ে ঢুকে কনকনে আবেশে জড়িয়ে ধরতো। বেশ লাগে তখন হঠাৎ করে শিহরিত হতে। বড় বাড়িগুলোর জানলা দরজা সব তখন  বন্ধ থাকে। নরম  রোদে ভরে থাকে ওদের  লম্বা টানা বারান্দা। মাঝে মাঝেই দেখি টুপি পরা একজন বৃদ্ধকে। পাঁশুটে রঙের জোব্বার মতো কেমন একটা পোশাক পরে বারান্দায়  দাঁড়িয়ে সাদা পেয়ালা থেকে চা খায়। কোনো কোনো দিন দেখি  নিচের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর  গলায় কাকে ডেকে বলছে , `তপন গাড়ি বের  করেছ?`
 
আমি চলতে চলতে মুখ তুলে দেখি লোকটাকে। সেও চায়ে চুমুক দিয়ে  আমার দিকে  তাকিয়ে মুখ  ভরে হাসে। তার  হাসিতে সকালের রোদ চুঁইয়ে নামে। আমিও হাসি, এমন হাসলে ভেতর ফুরফুরে লাগে। তখন আমি যেন উড়তে থাকি আর পথটাও হাঁটা ছেড়ে আমার সঙ্গ নেয়। আমরা কেউ কারুর নাম জানি না ,চিনি না কিন্তু  হাসিটাকে চিনি। এই পথ না হাঁটলে  হয়তো এমন  হাসি হাসা  যায় না। যদি কোনোদিন পরিচয় হতো তাহলে ওই বৃদ্ধ নিশ্চয় নিজের পরিচয় দিত ,পথের ধারের  হলদে বাড়ির বুড়ো আর আমি বলতাম পথ চলতি একটা মেয়ে।পথটাই ছিল আমাদের এক মাত্র পরিচয়। কিন্তু পথের কোনো নাম দেওয়া যায়নি। কারণ কোনো নামের ভেতর আঁটলোই না, এতটাই সে  অনন্ত ছিল বলে।

সোজা হেঁটে একটু যাওয়ার পর পথটা স্বেচ্ছাচারীর মতো এদিক ওদিক এঁকে বেঁকে গিয়ে ডানদিকে ঘুরেই একটা শ্যাওলা ধরা  পুরনো বাড়ির সামনে গিয়ে থামতো। বাড়িটার মরচে ধরা লোহার গেটের ফাঁক দিয়ে অযত্নে পড়ে থাকা বাগানটাকে  দেখতাম রোজ। ভাঙ্গা চোরা পাথরের পরীগুলো এদিক ওদিক পড়ে থাকে।  লতাপাতায় ঢেকে থাকে তাদের নগ্নতা।  ওদের শ্বেতশুভ্র মর্মর চেহারাগুলো মলিন হয়ে আছে  বহু বছরের অযত্নে। বাগানের মাঝখানে  একটা ফোয়ারা শুকনো বুক নিয়ে দাঁড়িয়ে  আছে একা। তার শরীরের জায়গায় জায়গায় ভাঙন ধরেছে।

খুব ইচ্ছে করে গেটটা খুলে ভেতরে যাই,ফোয়ারাটাকে ছুঁয়ে দেখি, পরীদের সাথে দুটো কথা বলি। কত কথা অবরুদ্ধ হয়ে  ওদের মনে জমে আছে কে জানে! কিন্তু হয় না। গেটে তালা ঝোলে। ভিতরে একটা সাদা ছাপ  কালো কুকুর ঘুরে বেড়ায় দেখি। একদিন  লাল গামছা পরে দড়ি পাকানো একটা চেহারা ঝোপঝাড় থেকে  বেরিয়ে এসে বললো, `কি চাই খুকু?`

লোকটার ভাবটা একদম ভালো লাগল না। পথ ডাকল, `চলো চলো।  এত থামলে পিছিয়ে পড়বে কিন্তু।`
পথ চলে, আমি চলি ওর সাথে।  এমনিতে পথটা নিরিবিলিই  থাকে। ক্বচিৎ  কদাচিৎ একটু বেশি লোক দেখা যায়।  যেমন মাধ্যমিকের পরীক্ষার সময়  দু একটা বাড়ির  রকে বসে থাকে  পরীক্ষার্থীদের বাবা মায়েরা। দুপুরবেলায় তাদের হাতে থাকে একটা  করে ডাব,  সাথে থাকে স্টিলের টিফিন কৌটো। বিকেলে তারাই আবার প্রশ্নপত্র খুলে  দেখে  আর নানান প্রশ্ন করতে করতে পথ চলে,  `সব ঠিক করে লিখেছিস? সাত নম্বরের এই প্রশ্নটার উত্তরটা কি লিখলি ?`
 
অংকের দিন  উদ্বেগ আর উত্তেজনা আরো বেড়ে যায়।  পথ তখন বেশ সরগরম হয়ে ওঠে। একবার পথটাকে খুব কাতর হতে দেখেছিলাম। কী কারণে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরছিলাম । সেদিন মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরিয়েছে। আশেপাশে কয়েকটা লোক গেজেট গেজেট বলে চিৎকার করছে। কাছের ইস্কুলটার সামনে অনেক ভীড়।  আমাকে  দেখে পথ ডাকল। গিয়ে  দেখি কতগুলো ছাত্র হাতে গেজেট নিয়ে রেজাল্ট দেখছে।  মিত্তিরদের রকে বসে আছে সাদা জামা নীল শার্ট পরা একটা ছেলে ।ছেলেটা দু হাতে মুখ ঢেকে ফুলে ফুলে কাঁদছে।  সেদিন পথটা  খুব বেশি স্তব্ধ হয়ে ছিল। আমি তখন একটু বড়ো।  কাস্তে হাতুড়ি আঁকা দেওয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। পথ সাথেই ছিল। বলল, `এবার বাড়ি যাও। আজকে আর কোনো কথা হবে না।`  

গেলাম না ।ছেলেটা তখনও কাঁদছিল। বন্ধুগুলো ওকে ঘিরে রেখেছিল।  খানিক পরে সবাই যখন চলে গেল, হঠাৎ করে  ভয়ঙ্কর একটা শূন্যতা পথটাকে গ্রাস করে নিল। আকাশে মেঘ জমল, গাছগুলো দমকা বাতাসে মরমর শব্দে দুলে উঠল । আমি  নির্জন পথের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে হাঁটলাম  একা একা। ওই নৈঃশব্দের ভেতরে  ফোঁপানীর মতো  একটা শব্দ হালকা জেগে রইল গোটা পথ জুড়ে।   

ফোয়ারা বাড়ির উল্টো দিকের কোণটাতে একটা বিশাল বটগাছের তলার বেদিটি বাঁধানো। সেখানে নানা আকারের পাথর,  দেবতা বলে দুবেলা পুজো পায় আর আমার মতো বালখিল্যরা পায় প্রসাদ। পূজারী লোকটি ভাল ছিল । বটের প্রলম্বিত শাখা প্রশাখার ছায়ায় একটা ছোটো চায়ের দোকান ছিল তার।  পুজো করে তেমন রোজগার হতো না বলে হয়তো বাকি সময়টাতে চা বিস্কুট বেচত। বড় বাড়িগুলোর ড্রাইভার দারোয়ান  থেকে  পথ চলা  কিছু মানুষ ছিল তার খদ্দের। আমাকে সে বাচ্চাকাল থেকে চেনে,তাই বালিকা যখন বাড়ি ফেরার পথ ধরে তখন মাঝে মাঝে নানখাটাই বিস্কুট জুটত পুরনো পরিচয়ের সুবাদে। পথ তখন খুব খুশি হয়ে  নদী হয়ে বইত আর আমাকে উজানে ঠেলে ঠেলে বড় রাস্তার মোড় অব্দি গিয়ে ছেড়ে আসতো। কিশোরী বেলায়   কখনও কখনও  একটু অন্যরকম  কিছু করার মজায়  ফেরার সময় চা বিস্কুট খেয়েছি বাইরে রাখা বেঞ্চিতে বসে নগদ মূল্য দিয়ে, কেউ জানত না। ওই সময় সে একটা রোমাঞ্চ ছিল বটে। দোকান তখন চালায় পূজারীর ছেলে, পূজারী স্বর্গে গেছে।

কোনদিন ফিরতে দেরি হলে দেখতাম বিকেলে রোদ পড়ে এলে পথের গায়ে  গাছেদের ছায়া নিবিড় হয়ে আসে। বাড়িগুলোতে আলো জ্বলে। কাদের রসুই ঘর থেকে খাবারের সুবাস ভাসে বাতাসে। পেটের ভেতর খিদে  মোচড় মারে। পথ ব্যস্ত হয়ে বলে তাড়াতাড়ি বাড়ি যাও। কোথাও আবার হাঁ করে কিছু দেখতে দাঁড়িয়ে যেও না যেন।  

আমি তাড়াতাড়ি হাঁটি। বড় রাস্তায় পড়ার আগে একবার মুখ ঘুরিয়ে পথটাকে দেখি। সাঁঝবেলায় পথের দুপাশে  লাইটপোস্ট গুলোতে আলো জ্বলে উঠেছে। বাড়িগুলোতেও জ্বেলেছে আলো । তাদের আলোর ছায়া,সন্ধ্যার অন্ধকারের সাথে মিশে আলোআঁধারির পথটাকে অদ্ভুত মায়াময়  করে তুলেছে।  

 বছর ঘোরে, ইস্কুল থেকে  কলেজ যাই। ও পথে আর যাওয়ার দরকার হয় না। তাই সময় পেলেই  কারণ ছাড়াই ওই পথ ধরে একটু  অলস হাঁটি। লম্বা  বারান্দাটায়  হাস্যমুখ কোনো বৃদ্ধকে আর দেখা যায় না।   তপন গাড়ি বের করেছ, বলে কোনো গমগমে গলা  আর কথা বলে ওঠে না। 

একদিন  দেখি খুব ভিড় হয়েছে। গোটা পথ জুড়ে  থিকথিক করছে লোক। ফোয়ারা বাড়িতে সিনেমার  শুটিং হচ্ছে। বিখ্যাত নায়ককে দেখার জন্য  এতো  ভিড় আর  চিৎকার।  আমি সেদিন আর পথ হাঁটি না,পথও  যেন চুপ করে বসে থাকে বিষণ্ন মুখে। এত ভিড় চিৎকার ওর ভালো লাগেনা। অপেক্ষা করে কখন শেষ হবে, কখন আবার  নিস্তব্ধতা ফিরে আসবে। আমার মন খারাপ হয়। এই জায়গাটা ছেড়ে কিছুদিন পর দূরে চলে যেতে হবে। কবে আবার দেখা হবে, আসা হবে কিনা জানি না।  

তারপর  কেটে যায়  অনেকগুলো বছর, পথের কাছে ফেরা আর হয় না। ইচ্ছে করে বড্ড ,একবার তাকে দেখে আসতে । ওই কৃষ্ণচূড়া , রাধাচূড়া,ছাতিম,বকুল ,শিমুলের  গাছগুলোর  গায়ের গন্ধ নিতে।
চায়ের ছোট্ট  দোকানটা ,বারান্দা বাড়ি, ফোয়ারা বাড়ির কাছে একটু গিয়ে দাঁড়াতে। 

শেষে একবার গেলাম অনেক ঝামেলা করে। কিন্তু পেলাম না । সেই পথকে কোথাও খুঁজে পেলাম না। চারপাশে নতুন সব ফ্ল্যাট, কফি শপ ,বুটিক শপ।   ওই বাড়িগুলো,গাছগুলোর কথা জিজ্ঞেস করলাম কতজনকে,  কেউ বলতেই পারল না । এমন কোনো পথ আদপে কোনোদিন ছিল কিনা  তাই নিয়ে সংশয় প্রকাশ করতে লাগল।

তাহলে সে পথ গেল কোথায়? তবে কি সে সত্যিই ছিল না? ওই বুড়োটা,চায়ের দোকান  সব মিথ্যে ছিল? আর ওই পরীদের বাড়ি, গাছেদের সারি সব  আমার ভ্রম? আমার ওমন  আনন্দময় পথ চলা ,ওই শিহরণ অমূল্য যত অনুভব  সব মিথ্যে,একটা বিরাট ফাঁকি?

নাকি সত্যই সে ছিল শুধু আমার জন্য? আমি খালি দেখতে পেতাম? তবে কি ওই অনন্ত  আমার সাথে লীলা খেলায় মেতেছিলেন আমার শৈশব থেকে কৈশোর অব্দি অমন একটা পথ  সৃষ্টি করে?  

উত্তর আসেনি কিন্তু পথ ফিরে এসেছে উত্তর হয়ে। আমার স্বপ্নে আসে, আমার চেতনায় থাকে আর  কী নিদ্রায় , কী জাগরুক অবস্থায় এক কথাই বলে,  চরৈবেতি, চলতে থাকো। আলোর পথ ,আনন্দের পথ সত্যের পথ চলো। সেই থেকে আমার চলা। গন্তব্য আছে, থাকুক। কিন্তু পথ চলতেই আনন্দ। তাই আমি পথ হাঁটি আর পথ  হাঁটে আমার সাথে ভেতরে।

No comments:

Post a Comment