`অন্য পথের গল্প....`
অব্যক্ত
তপন রায়চৌধুরী
লোকাল ট্রেনে হাওড়া থেকে বাড়ি ফিরছেন অরুণাংশু দত্ত। লম্বা সিটের একদম ধারে বসার জায়গা পেয়েছেন। ব্যাগ থেকে একটা ম্যাগাজিন বার করে পড়া শুরু করলেন। লিলুয়া স্টেশনে এক দঙ্গল লোক উঠল। ভিড়ে ভরে গেল ট্রেনটা। অরুণাংশুর সামনের সিটটাতে একেবারে মুখোমুখি এক ভদ্রমহিলা এসে বসলেন। ম্যাগাজিন থেকে মুখ সরিয়ে ভদ্রমহিলাকে দেখলেন একঝলক। খুব চেনা চেনা লাগছে। কিন্তু মনে করতে পারছেন না, কোথায় যেন দেখেছেন ভদ্রমহিলাকে। একজন ভদ্রমহিলার দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। অরুণাংশু আবার পড়াতে মন দিলেন। বেলুড়ের কাছাকাছি ট্রেন এসেছে এমন সময় ভদ্রমহিলা বলে উঠলেন, “আচ্ছা দাদা, একটা কথা বলব।“
ম্যাগাজিন থেকে মুখ সরিয়ে অরুণাংশু ভদ্রমহিলার দিকে তাকালেন। বললেন, “আমাকে বলছেন?”
“হ্যাঁ।“
“আপনি কি বিধান কলেজ থেকে পাশ করেছেন?”
স্বভাবতই উৎসুক হলেন অরুণাংশু। ম্যাগাজিনটা কোলের ওপর রেখে বললেন, “হ্যাঁ, কেন বলুন তো?“
“কোন ইয়ার পাসড আউট?”
“১৯৭১।“
“সাবজেক্ট কী ছিল?”
“পল সায়েন্স অনার্স।“
অরুণাংশু তখন প্রায় চিনে ফেলেছেন ভদ্রমহিলাকে। তবে একশোভাগ নিশ্চিত হতে পারছেন না। কিন্তু ভদ্রমহিলাই হেসে বললেন, “আপনি কি অরুণাংশু দত্ত?”
একগাল হেসে অরুণাংশু বললেন, “ইয়েস। আপনি তো নিশ্চয়ই সুভদ্রা বোস?”
“হ্যাঁ।“ হেসে ঘাড় নাড়লেন ভদ্রমহিলা।
তারপর কলেজ জীবনের নানা মধুর স্মৃতি শুরু হয়ে গেল তাদের মধ্যে। হকারের চিৎকার চেঁচামেচি, ভিড় এসব কিছুই যেন আর গায়ে লাগছে না।
ট্রেনের ভিড় ক্রমশ বাড়ছে। তাদের মুখোমুখি সিটদুটোর মাঝখানে লোকেরা এসে দাঁড়িয়েছে, যা হয় একটা লোকাল ট্রেনে। ওদের কথায় ছেদ পড়ল তখনকার মত। অরুণাংশু আবার পড়াতে মন দিলেন। কিন্তু মন যে আর ম্যাগাজিনে বসছে না!
২
সবেমাত্র তখন কলেজে ঢুকেছে অরুণাংশু। লম্বা ঢ্যাঙা চোয়াড়ে চেহারা, রং কালো, একেবারেই বিশেষত্বহীন এবং সর্বোপরি আর্থিকভাবে দুর্বল। হীনম্মন্যতার কারণে নিজেকে সবার থেকে তফাতে রাখতেই বরাবর পছন্দ করত সে। আর, সেই কারণেই কলেজের প্রথম দিন থেকেই ক্লাসরুমের শেষ দিকের বেঞ্চিগুলো ছিল তার খুব পছন্দের জায়গা।
শ্রীরামপুর রেল স্টেশন থেকে কিছুটা দূরে ছিল অরুণাংশুর বাড়ি। তিন-চারটে টিউশন বাবদ তখন তার তিরিশ টাকা মাসে আয়। সাইকেলে চেপে স্টেশন, সেখানে সাইকেল গ্যারেজ করে, তিন টাকার মান্থলি সম্বল করে কলেজ যাতায়াত।
পল সায়েন্স অনার্স ছিল প্রধান বিষয়। তবে নামেই অনার্স, কারণ, কলেজের নিয়মানুসারে প্রথম কয়েক মাস শুধুমাত্র পাস সাবজেক্টেরই ক্লাস হবে। তারপর একটা এলিমিনেশন টেস্ট হবে এবং তখনই নির্ধারিত হবে কোন কোন অনার্স বিষয়ে কারা কারা সুযোগ পেল। সেই নিয়মেই প্রথম কয়েকমাস ক্লাস হল শুধুমাত্র পাস বিষয়ের ওপর।
পাস সাবজেক্টের ক্লাসগুলোর সময় একটা বিশেষ ব্যাপার নজরে এল অরুণাংশুর। পাস অনার্স মিলিয়ে ছাপ্পান্ন জন ছাত্রছাত্রী। তার মধ্যে প্রায় সত্তর-আশি ভাগই মেয়ে। কোনো মেয়ের দিকে বিশেষভাবে তাকানো, কিংবা যেচে আলাপ করা তার সঙ্গে, এমন সাহস সে করেনি কোনোদিন। বরং নিজের কুরূপের কারণেই মেয়েদের থেকে সে শত হস্তে দূরে থাকত। তাছাড়া যে-কঠোর পারিবারিক আবহাওয়া বা অনুশাসনের মধ্যে সে বড় হয়েছে, কখনও কোনো মেয়ের সঙ্গে আলাপ, বন্ধুত্ব বা অন্যরকম সম্পর্ক হতে পারে, এসব সে স্বপ্নেও ভাবতে পারত না। কিন্তু বয়সজনিত চরিত্র তো এসবের ধার ধারে না। তাই এখানেও কিছুটা অন্যরকম হল। একটি মেয়ের দিকে তার চোখ চলে যেত বারবার। সে কমলিকা। শুধু অসাধারণ সুন্দরী বললে কম বলা হবে, সেইসঙ্গে এক নিটোল মনোরম ব্যক্তিত্ব প্রকাশ পেত তার চলাফেরা এবং কথাবার্তায়। কোনো ছেলে তার দিকে একবারের বেশি না তাকিয়ে থাকতে পারত না। উঁচু ক্লাসের ছেলেরা এমনকি ইউনিয়নের ছেলেরাও তাকে বেশ লোভাতুর দৃষ্টিতে দেখত। কমলিকা বুঝতে পারত সব, কিন্তু তার ব্যক্তিত্ব এমনই প্রখর ছিল যে কেউই সম্ভবত সাহস করে তার কাছে এগোতে সাহস করেনি।
কমলিকার সঙ্গে একটি মেয়ে সবসময় ছায়ার মতন থাকত। তার নাম সুভদ্রা। প্রায়ই দেখা যেত, ওরা দুজন ক্লাসে ঢুকত একসঙ্গে, আবার, ক্লাস শেষ হয়ে গেলে বেরিয়ে যেত একসঙ্গে। শুধু তাই নয়। ক্লাস চলাকালীন ওদের দুজনকে সবসময় পাশাপাশি বসতে দেখা যেত। অথচ অদ্ভুত ব্যাপার, কমলিকা যেখানে অপরূপ সুন্দরী, সুভদ্রা সেই তুলনায় একেবারেই সাদামাটা দেখতে। বাস্তবে বোধহয় এমনটাই হয় কিনা কে জানে।
অনার্সের প্রথম দিনের ক্লাস। অরুণাংশু যথারীতি শেষ বেঞ্চিতে। আর, এই শেষে থাকার সুবাদে সে দেখতে পাচ্ছিল সবাইকে, যদিও পেছনটাই। সবসমেত মোট আটাশ জন অনার্সের ছাত্রছাত্রী। তার মধ্যে চব্বিশজন মেয়ে, চারজন ছেলে। সামনের দিকে সব মেয়েরা বসে, আর, ছেলেদের মধ্যে সে ছাড়া বাকি তিনজনকে একটু কষ্ট করেই খুঁজে নিতে হল। অনার্সের ক্লাস ছিল দিনে দুটো কিংবা তিনটে কোনো বিশেষ ঘরে, বাকি সব পাসের ক্লাস। অরুণাংশু ঠিক করল, ক্লাস শেষ হওয়ামাত্র সে একরকম ছুটেই বেরিয়ে যাবে ক্লাস থেকে।
সেসময় কলেজে পড়াশুনার আবহাওয়া ছিল বেশ ভালোই। প্রাইভেট টিউশন বলে কোনো ব্যাপার ছিল না বললেই চলে। ছাত্রছাত্রীরা অধ্যাপকদের ক্লাস লেকচারের ওপরই সম্পূর্ণ নির্ভর করত। অনার্স ক্লাস তো বটেই, এমনকি পাসের কোনো ক্লাসও কেউ খুব একটা মিস করত না। বেশ মনে পড়ে, এস এস বলে একজন অধ্যাপক ছিলেন, সপ্তাহে দুটো ক্লাস ছিল তাঁর, তিনি প্রথম দিন যা পড়াতেন, পরের দিন প্রথম দশ-পনেরো মিনিট আগের দিনের পড়া ধরতেন, তারপর নতুন জিনিস পড়াতেন। কেউ ফাঁকি দিতে পারত না তাঁর ক্লাস। কারণ, রোল কল করার সময় তিনি রেজিস্টার দেখে নাম ধরে ডাকতেন এবং আগের দিন অনুপস্থিত থাকলে তিনি ‘অনুপস্থিতির যথাযথ কারণ জানতে চাইতেন। তখন মিথ্যে কথা বলে খুব একটা পার পাওয়া যেত না।
একটা দিনের কথা মনে পড়ে। পি সি এম স্যারের অনার্সের ক্লাস ছিল সেদিন। প্রথমেই বলে দিলেন তিনি, “আজ যা পড়াব তার ওপর তিনটে প্রশ্ন দেব, তোমরা পরের দিন সেগুলোর উত্তর লিখে নিয়ে আসবে।“
পি সি এম স্যারের ক্লাস ছিল সপ্তাহে দুদিন। যথারীতি সকলের উত্তরপত্র পরের দিন স্যারকে জমা দিতে হবে। সামনের সপ্তাহে স্যার এলেন ক্লাসে আটাশ জনের খাতা নিয়ে। এসেই প্রথমে রোলকল করে একবার সকলের দিকে তাকালেন। এটা স্যারের বরাবরের একটা অভ্যেস ছিল। রোলকল করার পরে কিছু বলার আগে বা পড়ানো শুরু করার আগে একবার দেখে নিতেন সবাইকে। তারপর লেকচার শুরু করতেন। সেদিনও এর ব্যতিক্রম ছিল না। সকলে টানটান বসে। স্যার খাতাগুলো নিয়ে এসেছেন, এবার কী বলবেন কে জানে!
হঠাৎ বলে উঠলেন, “অরুনাংশু দত্ত কে আছ, হাত তুলবে।“
অরুণাংশু তখন কাঁপতে শুরু করেছে। নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে আসছে! স্যার যে তারই নাম করলেন! ভয়ে ভয়ে হাত তুলল সে।
গম্ভীর গলায় স্যার বলে উঠলেন, “ওহ্ তুমি!”
বলার সঙ্গে সঙ্গে সকলের চোখ তখন ঘুরে অরুণাংশুর দিকে তাকিয়ে! সে কী করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। স্যার আবার বলে উঠলেন, “এখানে এসো।“
ক্লাসের শেষ বেঞ্চিতে সে। স্যারের কাছে পৌঁছতে গেলে অনেকটা পথ হেঁটে যেতে হবে। ক্লাসরুমের দুধারে সার সার বেঞ্চিতে ছেলেমেয়েরা বসা। মাঝখানে চওড়া পথ। অরুণাংশু উঠে দাঁড়াল আস্তে আস্তে। মনে হল, পাদুটো ভারি হয়ে গেছে তার। বোধহয় হাঁটতে পারবে না, এমনই অবস্থা! স্যার আবার বললেন, “কী হল? তোমাকে আসতে বললাম যে! কথা যায়নি কানে?”
“হ্যাঁ স্যার।“
অস্ফুটে বলল অরুণাংশু। স্যার সেটা শুনতে পেলেন কিনা জানি না। অরুণাংশু হাঁটতে শুরু করল। মনে হল, এত দীর্ঘ পথ এই প্রথম সে হাঁটছে জীবনে। সাতাশ জোড়া চোখ তখন তাকে জরিপ করছে বুঝতে পারছে। কোনোমতে একটা নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে স্যারের সামনে গিয়ে দাঁড়াল অরুণাংশু।
স্যার বললেন, “আমি যা যা বলেছি আগের দিন ক্লাসে, দাড়ি কমা পর্যন্ত, সবটাই তোমার খাতায় দেখছি। এটা কারুর খাতায় আমি পাইনি, একমাত্র তোমারটা ছাড়া। এটা কীভাবে করলে তুমি!”
ধড়ে কিছুটা প্রাণ এল অরুণাংশুর। খুব বিনীত ভাবে আস্তে বলল সে, “স্যার, আমি শর্ট হ্যান্ড জানি।“
উদ্ভাসিত স্যারের মুখ তখন। বললেন, “ও, তাই বুঝি! ভেরি গুড। আমার বিশ্বাস, তুমি খুব উন্নতি করবে জীবনে।“
স্যারের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে অরুণাংশু মাথা নীচু করে নিজের জায়গায় চলে গেল। কোনোদিকে না তাকিয়েও পরিষ্কার বুঝতে পারল, ক্লাসের সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে সপ্রশংস দৃষ্টিতে।
ক্লাস শেষ হল। স্বভাবতই প্রত্যেকদিনের মত সেদিনও ক্লাস ছেড়ে বেরোতে যাবে, এমন সময় পেছন থেকে শুনতে পেল মেয়েলি কণ্ঠস্বর, “শোনো।“
দাঁড়িয়ে গেল অরুণাংশু। কমলিকা! কী বলতে চায় ও? বিস্ময় চেপে রেখে বলল, “আমাকে বলছ?”
“হ্যাঁ। একটু কথা ছিল তোমার সঙ্গে।“
বরাবর মেয়েদের এড়িয়ে চলেছে সে। কোনোদিন কোনো মেয়ে এভাবে তাকে কিছু বলতে পারে, তাও কমলিকার মত মেয়ে, এটা ছিল তার ধারণার বাইরে। প্রায় কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল, “বলো।“
“একটু ওদিকটায় যাবে। বসে কথা বলা যাবে ওখানে।“
কলেজটা ছিল ঠিক গঙ্গার পাড়ে। কলেজ আর গঙ্গার মাঝখানে একটা কাঁটাতারের বেড়া। বেড়ার এপাশে অর্থাৎ কলেজ ক্যাম্পাসের মধ্যে সবুজ ঘাসের গালিচা পাতা আছে যেন। গঙ্গার হাওয়ায় উথাল পাথাল চারিদিক। অপূর্ব মনোরম পরিবেশ। কমলিকা ইঙ্গিত করল ওইদিকটাতেই।
একটা সৌজন্যমূলক দূরত্ব বজায় রেখে ওরা দুজন পাশাপাশি বসল। সামনে বিস্তীর্ণ জলরাশি। দুএকটা নৌকা দেখা যাচ্ছে দূরে। শান্ত পরিবেশ। কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর কমলিকা বলল, “একটা উপকার করবে আমার?”
বেশ অবাক অরুণাংশু প্রথমটায়। সে সাধারণের চেয়েও সাধারণ। সে কী উপকার করবে এই সুন্দরী মেয়েটার জন্য! একটু সামলে নিয়ে বলল, “কী উপকার?”
“তোমার নোটসের খাতাটা একটু দেবে আমাকে।“
মনে মনে ভাবল অরুণাংশু, এ তো সামান্য ব্যাপার। বলল, “ঠিক আছে। কোনো ব্যাপার নয়। এই নাও।“
অরুণাংশু দিয়ে দিল খাতাটা। তারপর কমলিকা বলল, “চল, ক্যান্টিনে যাই।“
অরুণাংশু ইতস্তত করছিল, ভাবছিল, এই তো বেশ আছি, আবার ক্যান্টিন কেন ... কমলিকা সম্ভবত খাওয়াবে আজ, কী দরকার এসবের, পরের দিন তাকে আবার খাওয়াতে হবে, নিজের পকেটের অবস্থা তো অরুণাংশু ভালোই জানে, ... তাই বুদ্ধি করে বলল, “না না, ক্যান্টিনে যাব না।“
“কেন?”
“আমার পেটের রোগ আছে। বাইরের খাবার তেমন স্যুট করে না।“
একটু হেসে কমলিকা বলল, “ও আচ্ছা।“
ফলে ওখানে বসেই সাধারণ কথাবার্তা হল। একসময় সে জিজ্ঞেস করল কমলিকাকে, “তোমার বাড়ি কোথায়?”
কমলিকা বলল, “হিন্দমোটর। তুমি কোথায় থাকো?“
“শ্রীরামপুর।“
এইরকম আরও দুচারটে সাধারণ কথাবার্তা হল – অরুণাংশুর বাড়িতে কে কে থাকেন, তারা ক’ভাই বোন, কমলিকার বাড়ির খবরাখবর জানা হয়ে গেল সেইসঙ্গে। এইভাবে তাদের আলাপ-পরিচয় হল এবং প্রায় প্রত্যেকদিনই তারা ওই জায়গাটায় বসে কথাবার্তা বলত, অরুণাংশু তার নোটসের খাতা কমলিকাকে দিত, ও এনে দিত খাতাটা পরের দিন।
একটা দিনের ঘটনা। অরুণাংশু কলেজ ক্যাম্পাসে ঢুকছে, এমন সময় তখনকার ইউনিয়নের জি-এস কাছে এসে বলল, “এই শোন বে!”
দাঁড়িয়ে গেল অরুণাংশু। জি-এস দাদা বলল, “তোর ওই মেয়েটার সঙ্গে কী সম্পর্ক রে?”
“কোন মেয়েটা?”
অরুণাংশু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। বেশ ভয় করছিল তার।
জি-এস দাদা অরুণাংশুর থুতনিটা ধরে নেড়েচেড়ে বলল, “কোন মেয়েটা! যেন ভাজা মাছটা উল্টে খেতে পারিস না!”
অরুণাংশু ভয়ে কুঁকড়ে আছে তখন। কিছুটা আন্দাজ করছিল, জি-এস দাদা কমলিকার কথা বলছে নিশ্চয়ই। কিন্তু সরাসরি ওর নাম করতে মন সায় দিচ্ছে না। যদি হিতে বিপরীত হয়! গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল ওর। ভয়ে ভয়ে বলল, “সত্যিই দাদা, বুঝতে পারছি না।“
“বেশ, আমিই বলছি। কমলিকা। তোদের ক্লাসে পড়ে।“
“ও আচ্ছা।“
“কী সম্পর্ক তোদের মধ্যে? ব্রেক টাইমে মাঝেমাঝেই তো তোদের ওই গঙ্গার ধারটায় দেখতে পাই। বেশ গপ্প মারিস দুজনে।“
“না না, ওই পড়াশুনা নিয়ে কথাবার্তা হয়।“
“অন্য কিছু নয় তো? কোনো ইন্টুমিন্টু?”
“না না।“
“দেখো চাদু, সেসব যেন না হয়। তাহলে কিন্তু ...“
কথাটা বলে ইউনিয়নের দাদাটা অরুণাংশুর থুতনিটা আরেকবার নেড়ে দিয়ে চলে গেল।
অরুণাংশু বুঝল, কমলিকা সকলেরই টার্গেট। যাই হোক, সেযাত্রা বেঁচে গেল অরুণাংশু। কারণ, কমলিকার সঙ্গে মেলামেশার জন্য তাকে মার খেতে হল না। তাছাড়া সত্যিই তো, কমলিকার সঙ্গে তো তার কোনো প্রেমের সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু তাই বলে এটা অস্বীকার করার উপায় নেই, কমলিকাকে তার ক্রমশ ভালো লাগতে শুরু করছিল। কলেজে যতক্ষণ থাকত, ক্লাস করত, ওর দিকে অরুণাংশুর চোখ চলে যেতই। ওর চলাফেরা, কথাবার্তা, সাজপোশাক, ব্যক্তিত্ব সবকিছুই মুগ্ধ করত অরুণাংশুকে। বাড়িতে ফিরে নানা কাজকর্মের মধ্যে ওর কথা মাঝেমাঝেই মনে হত। মনে হত, পরের দিনটা তাড়াতাড়ি চলে আসুক, কলেজে গেলেই তো ওকে আবার দেখতে পাওয়া যাবে, এইসব সুখচিন্তা নিয়ে অরুণাংশু ঘুমোত প্রত্যেকটা দিন।
কলেজে যাওয়ার সময় প্রত্যেকদিন একটু ভালো পোশাক পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সুন্দর করার চেষ্টা করত অরুণাংশু, যাতে করে কমলিকার চোখে নিজেকে সামান্য হলেও একটু আকর্ষণীয় রাখা যায়। কিন্তু কোনোভাবেই কখনও মুখ ফুটে কিংবা হাবেভাবে ওর প্রতি কোনোরকম দুর্বলতা প্রকাশ পাক, এটা সে ভেতর থেকে চাইতে পারত না। এর প্রধান কারণ, সে দেখতে ভালো নয়, কমলিকার পাশে নিজেকে নিতান্তই এলেবেলে মনে হত তার। সর্বোপরি তার কঠিন আর্থিক অবস্থা এবং কঠোর পারিবারিক অনুশাসন নিজেকে সংযত রাখতে বাধ্য করত। অথচ কমলিকাকে নিয়মিত নোটস দেওয়া, ব্রেক টাইমে কলেজ ক্যাম্পাসে পড়াশোনা ছাড়াও অন্যান্য সাধারণ গল্পগুজব, এসবেই দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল একরকম।
পার্ট ওয়ান পাশ করে অরুণাংশু একটা চাকরি পেল নর্থ বেঙ্গলে এবং আর্থিক কারণেই চাকরির অফারটা সে নেবে ঠিক করল। কিন্তু পড়াশুনার ইতি ঘটুক এখানেই, এটা সে চাইছিল না কোনোমতেই। ঘনশ্যামবাবু ছিলেন কলেজের অফিস ক্লার্ক। খুব ভালোবাসতেন অরুণাংশুকে। তাঁকে একদিন অরুণাংশু তার এই চাকরি পাওয়ার ব্যাপারটা বলল। সেইসঙ্গে খোলাখুলিভাবে তার পারিবারিক অবস্থার কথাও বলল ডিটেলে। ঘনশ্যামবাবু সবটা শুনে নিয়ে বললেন, “তুমি পনেরো দিনে একবার কলেজে আসতে পারবে তো?”
অরুণাংশু বলল, “হ্যাঁ।“
“তাহলে অ্যাটেন্ড্যান্সের ব্যাপারে তোমাকে ভাবতে হবে না। কিন্তু আরেকটা কাজ করতে হবে।“
“বলুন।“
“নোটস ইত্যাদির ব্যাপারে তোমার সাবজেক্টের অনার্সের তিনজন টিচারের সঙ্গে একটু কথা বলে রাখো।“
“তাই হবে।“
ঘনশ্যামবাবুকে যা যা বলেছিল অরুণাংশু, সবটাই সে তার অনার্সের শিক্ষকদের বলল। তাঁরাও সকলে উৎসাহ দিলেন তাকে এবং নোটস ইত্যাদি তাঁরা দেবেন, সে-ব্যাপারে নিশ্চিত করলেন তাকে। যথারীতি পুরো ব্যাপারটাতে উৎসাহিত হল অরুণাংশু। পড়াশুনাটাও থাকবে, চাকরি করতে পারবে – একটা নতুন দিগন্ত খুলে গেল অরুণাংশুর কাছে।
কমলিকাকে সবটা জানাল অরুণাংশু। সে শুনে বলল, “সেকী! তাহলে নোটসের কী হবে!”
হেসে বলল অরুণাংশু, “একজন ঠিক জুটে যাবে তোমার। কোনো চিন্তা কোরো না।“
কথাটা বলতে একটু খারাপ লাগছিল অরুণাংশুর। পনেরো দিন ওকে দেখতে পাবে না, কথাবার্তাও হবে না। বলা বাহুল্য, সেটা মোবাইলের যুগ নয়, এমনকি ল্যান্ড লাইনও লোকের ঘরে ঘরে সেভাবে পৌঁছয়নি। যোগাযোগের মাধ্যম বলতে পোস্টকার্ড কিংবা ইনল্যান্ড লেটার, যেটার অস্তিত্ব বা প্রয়োজন আজ লুপ্ত বলা যায়। তো যাই হোক, অরুণাংশুর তখন একটাই লক্ষ্য - নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে।
তবে কমলিকা ভেতরে ভেতরে কষ্ট পেল কিনা, সেসব কিছুই বুঝতে পারল না অরুণাংশু। হয়তো পেল কিংবা পেল না, যেটাই হোক, সম্ভবত ওর প্রবল ব্যক্তিত্ব তাকে কিছুই বুঝতে দেয়নি।
চাকরিতে জয়েন করল অরুণাংশু। পনেরো দিন বাদে যখন প্রথম ফিরে এল এবং কলেজে দেখা হল কমলিকার সঙ্গে, উচ্ছ্বসিত হয়ে কমলিকা বলল, “ও তুই এসেছিস, কবে এলি?”
তখন ‘তুমি’ থেকে ‘তুই’ এসে গেছে। অবশ্য মাঝে মাঝে ‘তুমি’ও যে একেবারে চলত না, তেমন নয়।
কমলিকার এরকম উচ্ছ্বাস অরুণাংশু এই প্রথম দেখল। অনার্সের ক্লাস শেষ করে ওরা কলেজ ক্যাম্পাসের মধ্যে সেই গঙ্গার ধারটায় গিয়ে বসল। চাকরি জীবন কেমন লাগছে, সেইসঙ্গে বাড়ির খবরাখবর, বিস্তারিত জানতে চাইল কমলিকা। সবটাই বলল অরুণাংশু। তারপর কমলিকা টিফিন বার করল ওর ব্যাগ থেকে। অরুণাংশুকে ওর ভাগ থেকে কিছুটা দিল। এটা আগেও অনেকবার করেছে ও, কিন্তু অরুণাংশু সবসময় নিত না। তবে ভদ্রতাবশত মাঝেমধ্যে নিত, হয়তো একটা মিষ্টি কিংবা স্যান্ডউইচ। কিন্তু সেবার নিল, নাহলে ওর উচ্ছ্বাস বা আনন্দকে অসম্মান করা হত।
আরও একটা জিনিস খেয়াল করল অরুণাংশু কমলিকার মধ্যে। এমনিতেই ও খুব রিজার্ভড টাইপের মেয়ে, কিন্তু এবার যেন ওর কথাবার্তায় এবং আচার ব্যবহারে তার মনে হল, অনেক বেশি আন্তরিক আগের তুলনায়। কথা বলছে একটু বেশি এবং পড়াশোনা ছাড়া নিজের অতি সাধারণ কথাও। যেন সবকিছু শুনিয়ে ও আনন্দ পেতে চাইছে। হয়তো এমন হতে পারে, সেদিনের পরে আবার সেই পনেরো-ষোলো দিন পরে দেখা হবে, সুতরাং জমে থাকা কথা যেন এখনই না বললে নয়।
এইভাবে পনেরো-বিশ দিন ব্যবধানে অরুণাংশুর নর্থ বেঙ্গল টু কলেজ এবং কলেজ টু নর্থ বেঙ্গল চলতে থাকল, সেইসঙ্গে পড়াশোন, আর কমলিকার সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ। দেখতে দেখতে পার্ট টু পরীক্ষার সময় চলে এল। কলেজে আর কোনো ক্লাস থাকল না।
পনেরো দিন বাদে পরীক্ষা শুরু। অরুণাংশু ২০-২২ দিনের ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে এল। কমলিকার সঙ্গে আগেই কথা হয়ে গিয়েছিল, তারা কলেজে আসবে তবুও।
সেটাই হল। নিয়মিত কলেজে আসা-যাওয়া চলতে থাকল। কখনো লাইব্রেরিতে, কখনও গঙ্গার ধারে মিট করা। কথা হত পড়াশুনা নিয়ে, কখনো-বা একটু অন্যরকম, তবে ভাব-ভালোবাসার কথা নয়। কিন্তু হাবেভাবে কমলিকা যেন অরুণাংশুর পাশে বসেই একটু ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করত। কিন্তু অরুণাংশু নিজেকে সংযত এবং সাবধানে রাখত।
একদিন বলল কমলিকা, “আচ্ছা অরুণাংশু, এই কলেজ শেষ হওয়ার পর আমাদের যোগাযোগটা থাকবে কী করে?”
একটু যেন অন্যরকম সুর সেদিন কমলিকার কথায়!
অরুণাংশু সটান বলল, “কলেজ শেষ হওয়ার পর আর যোগাযোগের কীসের দরকার? আমি তো একটা চাকরি করছি, সেটাই করব। তুই নিশ্চয়ই এম এ করবি, তারপর চাকরি করবি, তারপর বিয়ে, নতুন জীবনে ঢুকে যাবি।“
কথাগুলো বলেই ওর দিকে তাকাল অরুণাংশু। কেমন যেন বিবর্ণ দেখালো ওকে। কথাগুলো এভাবে বলা হবে, ও বোধহয় একেবারেই আশা করেনি।
ঠিক পরের দিন। কলেজে কমলিকার সঙ্গে যে-সময়ে দেখা হওয়ার কথা মোটামুটি সেই সময়ে অরুণাংশু হাজির। অপেক্ষা করছে কমলিকার জন্য লাইব্রেরিতে। প্রথম ওইখানে দেখা হয়, তারপর হয়তো গঙ্গার পাড়টায় যাওয়া হবে। অবশ্য সেটা নাও হতে পারে। কারণ, কোনো কোনো দিন লাইব্রেরিতেই পুরো সময়টাই কেটে যায়। পড়াশোনা বা অন্যান্য গল্পগুজবের মধ্য দিয়ে।
কিন্তু না, সে আসছে না। এত দেরি সে তো করে না কখনও! কিছু হল নাকি? প্রায় পনেরো মিনিট হয়ে গেল। হঠাৎ মনে অরুণাংশুর, গতকাল ও খুব আঘাত পেয়েছে, তাই বোধহয় ... ! তাহলে কি আজ ও আসবে না? এইসব ভাবনা চলছে ভেতরে, হঠাৎ সুভদ্রা ঢুকল লাইব্রেরিতে এবং অরুণাংশুর দিকেই আসতে দেখা গেল। কিন্তু ওকে ঠিক আশা করেনি অরুণাংশু এই সময়ে। যাই হোক, সামনে পরীক্ষা, আসতেই পারে লাইব্রেরিতে।
ঠিক অরুণাংশুর মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসে সুভদ্রা হেসে বলল, “কীরে? কেমন আছিস?”
“ভালো। তুই?”
“ভালো। কীরকম প্রিপেরেশন হচ্ছে?“
“চলছে একরকম।“
“কদিনের ছুটিতে এসেছিস?”
“পরীক্ষা শেষ হওয়া পর্যন্ত তো বটেই। তা’ তোর কীরকম প্রিপেরেশন?”
“ওই তো, চালিয়ে যাচ্ছি একরকম। শোন, ক্যান্টিনে যাবি? এখানে তো এইভাবে কথা বললে, এক্ষুনি এসে লাইব্রেরিয়ান বকা দেবে।“
মনে মনে হাসল অরুণাংশু, প্রায় তিনটে বছর তো কাটিয়ে দিল, ক্যান্টিনে একদিনও যাইনি সে ফুটো পকেটের কারণে। এখন তো চাকরি করছে, আজ তো যেতেই পারে ক্যান্টিনে। প্রথম প্রথম কমলিকা বারকয়েক বলেছিল ক্যান্টিনে যাওয়ার কথা, যায়নি ওই একই কারণে, আজ সুভদ্রার দৌলতে নাহয় ... বলেই ফেলল, “যেতে পারি ক্যান্টিনে, কিন্তু একটা শর্তে।“
সুভদ্রা হেসে বলল, “কী শর্ত?”
হেসে বলল অরুণাংশু, “আমি পে করব কিন্তু।“
সুভদ্রাও হাসল, বলল, “ও হ্যাঁ, তুই তো এখন চাকরি করিস ... চল, শর্ত মঞ্জুর।“
ক্যান্টিনে অরুণাংশু আর সুভদ্রা পাশাপাশি বসল। চা-শিঙ্গাড়ার অর্ডার দিল অরুণাংশু। সুভদ্রাই শুরু করল কথা, “দেখতে দেখতে তিনটে বছর কেটে গেল, না রে?”
“যা বলেছিস।“
“বেশ ভালোই ছিলাম একসঙ্গে। এরপর তো কোথায় কিভাবে সব ছিটকে যাব, কে জানে!”
“হ্যাঁ ঠিকই।“
“তুই তো তবু একটা চাকরিতে ঢুকেছিস, এরপর আরও উন্নতি করবি নিশ্চয়ই। আমাদের মেয়েদের জীবন বড়ো অনিশ্চিত রে!”
“তা কেন। তোরও তো একটা প্ল্যান আছে নিশ্চয়ই। এম এ করবি কি এরপর, নাকি অন্য কোনো প্ল্যান ...”
“এম এ! আগে পরীক্ষা দিই, রেজাল্ট বেরোক, অতসব ভাবতে পারি না আমি। তাছাড়া তোর আর কমলিকার মত ব্রিলিয়ান্ট তো আমি নই।“
অরুণাংশু চুপ করে থাকে।
সুভদ্রাই বলল, “তুই তো নিশ্চয়ই চাকরির সঙ্গে সঙ্গে এম এ-টাও চালিয়ে যাবি? তাই না?”
“না রে বাবা, এম এ করার কথা এখন ভাবছি না। চাকরিটা করছি মন দিয়ে, এটুকুই বলতে পারি।“
“কমলিকা? কমলিকা কী করবে?”
অরুণাংশু সমঝে নিল নিজেকে। সুভদ্রা হঠাৎ কমলিকার কথা জানতে চাইছে! ঘুরিয়ে বলল, “সে তো তুই ভালো বলতে পারবি। তুই তো ওর বেস্ট ফ্রেন্ড।”
“সে তো ঠিক আছে, তবে পড়াশোনার ব্যাপারে বা কেরিয়ারের ব্যাপারে তুই নিশ্চয়ই ওর মনের ইচ্ছেটা জানিস। কারণ, তোদের মধ্যে নিশ্চয়ই এসব নিয়ে আলোচনা হয়েছে!“
অরুণাংশু সতর্ক। এবারও তার সাবধানী উত্তর, “দ্যাখ, শেষ পর্যন্ত কে কী করবে, সেটা বলা ভারী শক্ত। তবে ও পড়াশুনায় ভালো, এখানেই নিশ্চয় ইতি টানবে না পড়াতে। অন্তত আমার তেমনটাই মনে হয়।“
“আচ্ছা, ওকে তোর কেমন লাগে?”
সুভদ্রার কথার সুর এবার যেন বেশ অন্যরকম লাগল। কেমন যেন একটা ভাবনা খেলে গেল অরুণাংশুর মধ্যে! কমলিকার আজকে আসার কথা, এলো না। সুভদ্রা এলো। কমলিকার গতকালের বিবর্ণ মুখের ছবিটা ভেসে উঠল। সুভদ্রা কি তাহলে কমলিকার দূত হয়ে এসেছে? কমলিকার প্রতি অরুণাংশুর মনোভাব জানতেই কি সুভদ্রার আসা? তবে এবারও ডিফেন্সিভ খেলল অরুণাংশু।
সুভদ্রার কথার উত্তরে হেসে বলল, “এই তোকে যেমন লাগে, ঠিক তেমন।“
“এটা ইয়ার্কির কথা। তুই এড়িয়ে যাচ্ছিস আমার প্রশ্নটা।“
“কী বলব বল? একসঙ্গে পড়েছি, দেখতে ভালো, পড়াশুনায় ভালো, নিজের একটা ব্যক্তিত্ব আছে, ওকে সবারই ভালো লাগবে। আলাদা করে কী বলব বল।“
“তবুও বিশেষ করে ...?”
“বিশেষ করে আবার কী! সব ভালোলাগাগুলো তো বলেই দিলাম।“
“তাও আর কিছু ...?”
অরুণাংশু বুঝতে পারল, বেশ ভালোই বুঝতে পারল, প্রশ্নগুলো সুভদ্রার হলেও আসলে এই সবটাই কমলিকার অন্তরের কাতর জিজ্ঞাসা। নিশ্চিতভাবে বুঝল সে, কমলিকা তার জীবনসঙ্গী হিসেবে তাকেই বেছে নিয়েছে, এখন শুধু বাজিয়ে নিতে চাইছে সুভদ্রার মাধ্যমে।
পরের দিন কমলিকা এলো যথারীতি। এবার কিছুটা অফেন্সিভ অরুণাংশু। সরাসরি বলল ওর চোখের দিকে তাকিয়ে, “গতকাল এলে না যে!”
“একটা কাজে আটকে গিয়েছিলাম।“
কথাটা বলতে গিয়ে একটু যেন অস্বস্তি হচ্ছিল ওর মধ্যে। অরুণাংশুর মনেই হচ্ছিল, এটা ও ঠিক বলছে না। তাছাড়া সুভদ্রার মাধ্যমে তার দিক থেকে পজিটিভ কোনো সাড়া পেল না, সেটাই বোধহয় ওর অস্বস্তির মাত্রা কিছুটা বাড়িয়ে দিয়েছিল! অরুণাংশু আর কিছু ঘাটাল না। শুধু বলল, “ও আচ্ছা।“
একটু যেন থমথমে আবহাওয়া। হাওয়া বাতাস চলছে না যেন। হঠাৎ স্তব্ধতা ভেঙে কমলিকা বলল, “তা কী ঠিক করলে?”
অরুণাংশু হকচকিয়ে গেল প্রথমটায়। তারপর সামলে নিয়ে বলল, “কী ব্যাপারে?”
“না, এর পরে?“
“ও আচ্ছা। এই তো, চাকরিটা করছি, বড় ফ্যামিলি আমাদের, দাদারা আছে, ভাই-বোনেরা আছে, ফ্যামিলিতে কন্ট্রিবিউশনের ব্যাপার আছে। যাই হোক, তুমি কী করবে?“
“ইচ্ছে তো ছিল অনেক কিছু ... দেখি ... ভাবছি ...”
অরুণাংশু ভালোই জানে, কমলিকা অত্যন্ত চাপা মেয়ে, অত্যন্ত রিজার্ভড। যে-ইচ্ছেটা ওর মনের মধ্যে ছিল, সেটা ও কিছুতেই মুখ ফুটে প্রকাশ করতে পারছিল না বা করবে না। কারণ, সেটা ওর প্রকৃতিবিরুদ্ধ কাজ হবে।
কলেজের উলটোদিকে একটা সিনেমা হল ছিল। উত্তম কুমারের একটা সিনেমা এসেছিল। কমলিকা বলে উঠল হঠাৎ, “একটা ভালো সিনেমা এসেছে আমাদের সিনেমা হলটাতে। যাবে?”
অরুণাংশুর মনে হল, সিনেমা দেখাটা কমলিকার মূল উদ্দেশ্য নয়, ও আরও কিছুটা সময় নিরিবিলি তার সঙ্গে কাটাতে চায়, কিছু বলতে চায় বা করতে চায়, এমন কিছু, যখন অরুণাংশুর এড়িয়ে যাওয়ার আর কোনো রাস্তা থাকবে না। মিথ্যে বলতে বাধ্য হল সে, “সেটা সম্ভব নয় বুঝলে। আমি অফিসের কিছু কাজ নিয়ে এসেছি, যেটা কমপ্লিট করে কাল আমাকে নর্থ বেঙ্গলে ফিরে যেতে হবে।“
কমলিকা হতাশ হল, স্পষ্ট বোঝা গেল। তবুও যথাসম্ভব স্বাভাবিক থেকে আরও কিছুক্ষণ এটা সেটা গল্প করে কাটাল ওরা। তারপর একদম শেষে কমলিকা বলল, “তাহলে আজই কি আমাদের শেষ দেখা?”
অরুণাংশু বলল, ”শেষ দেখা কেন হবে। তুমি একটা পোস্টকার্ডে কয়েক লাইন লিখে আমাকে পোস্ট করে দেবে। আমি চলে আসব। নাহলে যেদিন রেজাল্ট বেরোবে সেদিন তো আসবোই। দেখা হবে।“
তো যাই হোক, রেজাল্ট বেরোনোর আগে ওদের আর দেখা হয়নি। দেখা হল রেজাল্ট বেরোনোর দিন। ওরা পাশ করল ভালোভাবেই। কমলিকার সঙ্গে দেখা হল। অরুণাংশু বলল, “কনগ্র্যাচুলেশনস।“
উত্তরে ও-ও একই কথা বলল। তারপর কমলিকাই উদ্যোগী হয়ে বলল, “চলো, ওই গঙ্গার ধারটায় বসি।“
সেই চেনা জায়গাটায়। সুন্দর সবুজ ঘাসের গালিচা। গঙ্গার উথাল পাথাল হাওয়া। ওরা বসল পাশাপাশি। কিছুক্ষণ চুপচাপ। তারপর কমলিকাই বলল, “অরুণাংশু, একটা কথা বলব?”
কেমন একটা লাগল যেন কমলিকাকে। একটা ভীষণ আর্তি নিয়ে কথাগুলো বেরিয়ে এল ওর ভেতর থেকে। ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না অরুণাংশু, কী বলতে পারে কমলিকা! যতটা সম্ভব স্বাভাবিক স্বরেই বলল সে, “বলো।“
এবার একদৃষ্টে অরুণাংশুর দিকে তাকিয়ে কমলিকা বলে উঠল, “তোমার কাছে আমার একটা পাওনা ছিল।“
ভেতরটা ধক করে উঠল অরুণাংশুর। তবুও নিজেকে স্বাভাবিক রেখে কোনোমতে বলল সে, “বলো, কী পাওনা?”
কমলিকা মাথা নীচু করে ফেলেছে তখন। বেশ কুণ্ঠা নিয়ে বলল, “না, সে বলা যাবে না।“
অরুণাংশু বললা, “যা বাবা! এ আবার কী কথা। পাওনা আছে বলছ, অথচ বলা যাবে না! এটা কেমন কথা!“
মাথা নীচু অবস্থাতেই অস্ফুটে বলল কমলিকা, “বলছি তো বলা যাবে না। তুমি বুঝে নাও।“
অরুণাংশুর তখন প্রবল অস্বস্তি ভেতরে। বুঝতে পারছে, ও কী বলতে চাইছে। তবে বুঝল, এখনই এর একটা নিষ্পত্তি হওয়া দরকার। বলল, “তবে আমার তোমার কাছ থেকে কিছু পাওনা নেই।“
কমলিকা এবার সরাসরি তাকাল অরুণাংশুর দিকে। সে দৃষ্টি বড় বেদনার, বড় কষ্টের। কিন্তু অরুণাংশু জানে, তাকে ভেঙে পড়লে চলবে না। তাই সরাসরি চোখে চোখ রেখে বলল, “আসলে, আমি তোমার কাছ থেকে কিছু এক্সপেক্ট করি না।“
কমলিকা কিছুক্ষণ অরুণাংশুর দিকে তাকিয়ে রইল একভাবে। যেন কথাটা সে হজম করতে পারছে না। তারপর একরকম নিজেকে উজার করে ছেড়ে দিয়ে বলল, “অরুণাংশু, তুমি কী চাও বলো?”
একটু থমকে গেল অরুণাংশু কমলিকার কথায়, তারপর বলল, “আমি কিছু চাই বা চাইব তোমার কাছে, এরকম স্পর্ধা আমার নেই।“
কমলিকার কী হল জানি না, কয়েক মুহূর্ত শুধু একভাবে তাকিয়ে রইল অরুণাংশুর দিকে। আর, অরুণাংশুরও কী হল, সে চোখ সরাতে পারল না ওর দৃষ্টি থেকে। কেমন যেন হিপ্নোটাইজড সে! কমলিকা বলে উঠল, “অরুণাংশু, আমি সব বুঝতে পারছি, সবটা। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছি না।“
অরুণাংশু বলল, “ঠিক তাই। আমিও।“
তবুও যেন হাল ছাড়া যাবে না। কমলিকা আবার বলল, “কিন্তু অরুণাংশু, কোনোভাবেই কি কিছু করা যায় না?“
বলতে বাধ্য হল অরুণাংশু, “না গো। এই মুহূর্তে ‘না’-এর পাল্লাই যে বড় ভারি!”
ওইটাই ছিল ওদের শেষ মিটিং। বেশ কিছুদিন পর সুভদ্রার কাছ থেকে খবর পেয়েছিল অরুণাংশু, কমলিকার বিয়ে হয়ে গেছে।
৩
আজ চল্লিশ বছর বাদে যেন সিনেমার মতন ঘটনাগুলো মনে পড়ে গেল অরুণাংশুর। হঠাৎ যেন সংবিৎ ফিরল তার। একবার বাইরেটা দেখে নিল। উত্তরপাড়া ছেড়ে গেল ট্রেন। এমন সময় হঠাৎ কানে এল এক ভদ্রমহিলার কণ্ঠস্বর, “সুভদ্রা, চলি রে।“
অরুণাংশুর মনে হল, তারই পেছনদিকে অন্য এক ভদ্রমহিলা ছিলেন। তিনি সম্ভবত নেমে যাচ্ছেন পরের স্টেশনে। ভিড় ঠেলে তার দ্রুত চলে যাওয়ার কারণে সামান্য ভিড়ের চাপ অনুভব করল অরুণাংশু। কারণ, সে সিটের একেবারে ধারে বসেছিলা। কিরকম যেন খুব চেনা লাগল ভদ্রমহিলার গলা। কিন্তু দেখতে পেল না তাকে। সুভদ্রাকে বলেই ফেলল অরুণাংশু, “আচ্ছা, একটা কথা বলব?”
সুভদ্রা হেসে বলল, “হ্যাঁ, বলুন না।“
“যিনি চলে গেলেন, আপনার বন্ধু সম্ভবত, তাই না।“
“হ্যাঁ।“
“খুব চেনা লাগল গলাটা।“
হেসে বলল সুভদ্রা, “ও কমলিকা।“
অরুণাংশু বিস্মিত কন্ঠে প্রায় আর্তনাদ করে বলল, “তাই বুঝি! আমাকে বললেন না একবারও!”
সুভদ্রা মাথা নীছু করে হেসে বলল, “না বলে ভালোই করেছি।“
হিন্দমোটর স্টেশন এসে গেল। অরুণাংশু জানে, কমলিকা এখানেই থাকে। সে জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে কমলিকাকে খুঁজতে চেষ্টা করলাম আপ্রাণ। পেল না। কমলিকা হারিয়ে গেল ভিড়ের মধ্যে।
কোন্নগর স্টেশন আসছে। সুভদ্রা উঠে দাঁড়াল সিট ছেড়ে। ও নামবে এবার। হেসে বলল, “অরুণাংশু, যাচ্ছি।“
“হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক আছে।“
কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থাকল অরুণাংশু। ভেতরে ঝড়ের পূর্বাভাস। কমলিকা নিশ্চয়ই তাকে দেখেছে, কিন্তু দেখা দিল না। কেনই বা দেখা দেবে! সে যে তার ‘পাওনা’টা পায়নি। অভিমানী মেয়ে!
বড় অস্থির লাগছে যে! কিন্তু ... না না, কিছুতেই না, ঠিক থাকতে হবে অরুণাংশুকে! মনটাকে ঘুরোনোর জন্য ব্যাগ থেকে ম্যাগাজিনটা বার করতে গিয়েও করল না। একটা স্টেশন পর তাকেও যে এবার নামতে হবে।
No comments:
Post a Comment