`পায়ে হাঁটা সেই মাটির পথ.....`
দেশপ্রিয় পথ
গৌতমকুমার ভাদুড়ি
কলোনির রাস্তা
কিংবা নতুন সরণি - পথটির এরকম নাম হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে নামকরণ
আর হল না কিছুতেই। অবশ্য যখন এই পথের জন্ম হয় সেযুগে সরণি শব্দের প্রচলন তেমন করে চোখেও
পড়ত না।সুতরাং নামকরণে তৎকালীনসমকাল খুব চেপে বসেছিল।মুখে মুখে তাই কলোনির রাস্তা নামেই
পরিচয় ছিল সে রাস্তার।
কলোনি বলতে
অবশ্য হাতে গোনা দশটি পরিবারের বাস্তু ঠিকানা।তার মধ্যেও জ্ঞাতিগোষ্ঠির মিশেলটাই ছিল
প্রায় অর্ধেক, সুতরাং সর্বসাকুল্যে ছটি মাত্র পরিবার।বড়োদের মুখে শুনেছিলাম তাঁরা সকলেই
দেশভাগের শিকার। ওদেশে বাস্তুহারা হয়ে অনেকটা এক কাপড়েই তাঁরা উঠে এসেছিলেন তখনকার
জঙ্গলাকীর্ণ এই পরিত্যক্ত স্থানটিতে।কেউ বলার ছিল না বলে যে যেখানে পারলএকটা চালাঘর
বানিয়ে সংসার পেতে বসল।কঠোর পরিশ্রমী ছিলেন এই পরিবারগুলোর সদস্যরা।
লতাগুল্ম সাফ
করে ঘর তো বানানো হল কিন্তুজঙ্গল অতিক্রম করে সেসব বাড়িতে পৌঁছনো যে দুষ্কর।আলোচনায়
বসলেন পরিবারের কর্তারা। তখন এরকম পঞ্চায়েত-প্রধান এসবের কাজকর্ম কিছু ছিল না।উমেশবাবু
নামে এক মাতব্বর গোছের মানুষ গায়ে পড়েই সবাইকে সাহায্য করতে এগিয়ে যেতেন। এক্ষেত্রেও
তিনিই এলেন। সাব্যস্ত হল, দিনে যে যার কাজ করবে, সন্ধের পর সবাইকে লাগতে হবে রাস্তা
তৈরির কাজে। শুরু হল কর্মযজ্ঞ।কিন্তু সবই তো নিচু জমি, মাটি পাওয়া যে বড়ো সমস্যা। সবার
বুদ্ধিতে বড়ো রাস্তার ধার ঘেঁষে একটা নর্দমা খুঁড়ে সেই মাটি দিয়ে খানিকটা কাজ হল। সমস্তটা
মিলিয়ে একশো মিটারের মতো সেই রাস্তা। কিন্তু বৃষ্টির প্রকোপ দেখা দিল এরই মধ্যে। আর
তখনকার দিনে বর্ষাকাল মানে তো কবে যে সূর্য উঠবে কেউ জানে না।অতএব বছরের বাকি সময়টা
একহাঁটু কাদা ভেঙে সকলে যাতায়াত করতে বাধ্য হলেন। বর্ষা ফুরোতেই আবার নতুন উদ্যমে শুরু
হল রাস্তা তৈরির কাজ। উমেশবাবু দু তিনজন মজুরেরও ব্যবস্থা করে দিলেন।কলোনিবাসীরা মরণপণ
চেষ্টায় দিনরাত্রি ভুলে স্বেচ্ছা শ্রমদানে ব্যস্ত। ছোট একটা ডোবা ছিল। কে একজন প্রস্তাব
দিলেন সেটিকে পুকুর বানানো হলে সেই মাটি দিয়ে রাস্তার কাজ অনায়াসে হতে পারে। কাজের
উৎসাহ আরও বেড়ে গেল। সারারাতও কাজ করতে রাজি সকলে।পথের খোঁজে মরিয়া একদল মানুষ উঠে
পড়ে লেগেছেন যেন।
কাজের সবটা
সময় নিজেদের মধ্যেই গল্প চলে। এঁরা সকলেই এসেছিলেন ঢাকামৈমনসিংহ জেলা থেকে। বিপ্লবীদের
গল্পকথাই সকলের মুখে তখন-নেতাজি, মাস্টারদা সূর্যসেন, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন,গান্ধীজী
সবাইকেই কেউ না কেউ চাক্ষুষ দেখেছেন।ফেলে আসা দেশের গল্প বলার সময় এঁদেরই কথা উঠে আসে।কিন্তু
এঁদের নামে তো অনেক রাস্তাঘাট তৈরি হয়েছে, হবেও ভবিষ্যতে। নতুন কিছু নাম দিলে কেমন
হয়?
তখন যতীন্দ্র
মোহন সেনগুপ্তের কথা সবার মুখে মুখে।চট্টগ্রামের এই মানুষটি নিজে ব্যারিস্টার।বিপ্লবীদের
হয়ে কত যে মামলা লড়েছেন, সমস্তই বিনা পারিশ্রমিকে। উল্টে নিজেই ব্যাঙ্ক থেকেঋণ নিয়ে
বিপ্লবীদের সাহায্য করেছেন।মানুষের জন্য করতে গিয়েই কারাবাস করতে হয়েছে তাঁকে বহুবার,মারাও
গেছেন জেলখানাতেই।ততদিনে দেশপ্রিয় নামে পরিচিত হয়ে উঠেছেন যতীন্দ্রমোহন। সবাই ঠিক করলেন
তাঁদের নিজে হাতে তৈরি এই কলোনির নাম হবে দেশপ্রিয় কলোনি আর এই রাস্তা পরিচিত হবে দেশপ্রিয়পথ
নামে।
রাস্তা গড়ে
উঠল, মাটির রাস্তা হোক তবু সকলের খুব প্রিয়।সকলের ভালোবাসা আছে তার প্রতিটি মাটির গাঁথনিতে।তখনও
পাকারাস্তা ধারণাটি গ্রামে প্রবেশ করেনি। মাটির রাস্তাতেই ঘাসের চাপড়া বসিয়ে তাকে মজবুত
করে তোলা হল।বর্ষায় একটু কাদা হয় ঠিকই কিন্তু নিজেদের হাতে তৈরি রাস্তায় একটু কাদা
থাকলেই বা কী?সকলের বড়ো প্রিয় সেই রাস্তা- দেশপ্রিয় পথ, বড়ো রাস্তার চাইতেও তার প্রতি
সকলের আকর্ষণ বহুগুণ বেশি।রাস্তার একধারে পুকুর অন্যধারে কুল পেয়ারা কামরাঙার ফলন্ত
গাছ। প্রত্যেক বাড়িতেই ঠাকুরপুজোর ফুল পাবার জন্য জবা আর গাঁদাফুলের বিপুল আয়োজন।আমরা
লঙ্কাজবার মধু খেতে বিকেল হতেই ছুটে যেতাম সেই রাস্তায়।
একটু যখন বুঝতে
শিখেছি তখন দেখতাম ছোটপিসি আর তার সাত আটটি বন্ধু বিকেল হতেই জড়ো হত সেই রাস্তায় ।বেশ
সেজেগুজেই বেরোত তারা।একটু বাদেই দেখতামপাটাকুড়ার ওদিক থেকে দুজন তিনজন সুন্দর যুবক
অকারণ সাইকেল চালিয়ে সেই রাস্তার মাহাত্ম্যঅন্বেষণে বেরিয়েছে।একজনের নাম ছিল মলয়দা,
আর একজন বুঝি বিপ্লবকাকু।এ পাড়ার দু চারজন দাদার সঙ্গে তাদের দারুণ ওঠাবসা, বুঝি একসাথে
পড়াশোনাও করে।সেই অজুহাতে তাদের দৈনিকই আসতে হত এদিকটায়।আরবিশাল বড়োরাস্তা ফেলে তারা
ওই দেশপ্রিয় পথেই বারবার সাইকেল চালিয়ে শেষপ্রান্ত পর্যন্ত যাবে, খানিকক্ষণ এমাথা ওমাথা
করেসন্ধের মুখে বেরিয়ে আসবে।তারা সবাই সিগারেট খেয়ে গোল গোল করে ধোঁয়া ছাড়ত,আমরা সেটা
দেখতেই ঘুরঘুর করতাম।
আমাদের পিসি
ও পিসির বন্ধুনিরাও বিকেল হলে আর ঘরে থাকতে পারত না। সেজেগুজে তারাও কেন যেন দেশপ্রিয়
পথের শেষপ্রান্তে গিয়ে জটলা করত। অনেকের হাতে বইও থাকত। তখন লাইব্রেরি ছিল না, ওভাবেই
নিজেদের মধ্যে বই দেওয়া নেওয়া চলত।কানাঘুষো শুনতাম যে সেসব বইয়ের ভেতরে নাকি চিঠি পাচার
হত। আরও অনেকদিন পর, তখন আমরাও স্কুল পাশ করে মৃদু বখাটে হয়ে উঠেছি, একবার মাস-পিটিশন
হচ্ছিল যে এখানে পোস্ট অফিসের একটা লেটার বক্স বসালে খুব উপকার হয়। একজন বয়োজ্যেষ্ঠ
রসিক মানুষ সে আলোচনায়মন্তব্য করেছিলেন, দেশপ্রিয় পথের জন্য কোনও লেটারবক্স দরকার নেই-
এখানকার ছেলেমেয়েরা পোস্ট অফিসের কাজটা নিজেরাই করে নিতে পারে।সবাই হো হো করে হেসে
উঠেছিল।
এখনও সে রাস্তা
পাকা হয়নি,মাঝে মাঝেই সংস্কারের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। সেদিনের বিকেলগুলোও আর নেই। এখন বাৎসরিক
কালী-শীতলা পুজোর দিনটিতেই যা লোকের ভিড়। সেদিনের পেয়ারা কামরাঙার নবীন প্রজন্মরা এখন
রাস্তা পাহারা দেয়। ডাল ভেঙে ফল ছিঁড়বে সে ভয় তাদের নেই।বুড়িপিসি মানুপিসিরা ,মলয়দা
বিপ্লবকাকুরা কে কোথায় হারিয়ে গেছে কে খবর রাখে। তাদেরই বড়ো প্রিয় পথ ছিল এই পায়ে হাঁটা
মাটির রাস্তা –সেদিনের দেশপ্রিয় পথ।
No comments:
Post a Comment