Friday, August 2, 2024


 

`নতুন পথে নতুন চিঠির খোঁজ....`


এলোমেলো ঠাটের ভৈরবী

      মনীষিতা নন্দী 

তোর্ষা ভেদ ক'রে সূর্য নামছে পাটে। সবুজ বাঁধ জুড়ে খেলা করে যায় বিকেল শেষের কমলা আভা। ছাদ ঘেঁষা কদম গাছ থেকে কয়েকটা ফুল পড়েছে এদিক ওদিক। এই ফুল ওর খুব পছন্দের। প্রথমে লম্বা নিঃশ্বাসে গন্ধটা ভেতরে নিতে হ'বে যতটা সম্ভব। তারপর ওই গোল অংশটা থেকে সাদা সাদা রোয়াঁ গুলো গুছিয়ে আলাদা ক'রে আস্তে আস্তে শেষ হলুদ ডিমের কুসুমের মত অংশটায় পৌঁছনো। এরকম আরও কত না খেলা! সবুজ ঘাস, পাতা, লুচিপাতাকে ইঁটগোলানো মশলার জলে ভিজিয়ে নতুন রেসিপির বাহারি সজ্জা। পুরো ছাদ, পাকা উঠোন জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে সংসার। পুতুলের ঘরবাড়ী। সন্ধ্যে হ'লে সাইকেলের সামনে বসে আর তার থেকে একটু বড় হ'লে লুনা নামের ভটভটিতে চড়ে মামামণির সাথে অনির্বাণ কিংবা স্নেহাশিস মামাদের বাড়ী। ঘুম ভাঙতেই ঘুলঘুলি থেকে এক মুঠো সাদা সকালের উঁকিঝুঁকি। মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত আনন্দে মোড়া সকাল, গভীর নিঃশ্বাসের শুরু থেকে শেষ, যতবারই এ'প্রান্ত থেকে ও' প্রান্ত কিংবা ও' ধার থেকে এ'ধারে পাড়ি জমানো যাক না কেন, সবটুকু জুড়েই শুধু আনন্দ, আনন্দ আর কেবলই আনন্দ! বাঁধনছাড়া, অকারণ। সকাল দুপুর ছেয়ে দিদার হাতের মুসুর ডাল ফোড়নের গন্ধ। পুজোর সময় বাবার কোলে চেপে, গুনে গুনে, ভীড় ঠেলে সব ঠাকুর দেখে শেষ করা, নিউটাউন ক্লাবের মোটা গোঁফওয়ালা টেকো অসুর দেখতে যাবার ভরপুর বায়না, পায়ে বাবার দেওয়া সোনালি পুঁথি বসানো নতুন লাল পাম্পশু, গায়ে মায়ের দেওয়া নীল ভেলভেট জামা, খেলে বেড়ায় পুতুল মেয়ে। ষষ্ঠী সন্ধ্যায় পুরোনো স্কুলঘরে হারমোনিয়ামে "খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে বিরাট শিশু আনমনে", অষ্টমী সকালে কুমারী পুজোর ঠেলাঠেলিতে চেপটে, দুপুর বেলা সঙ্গী সাথী সদলবলে পাত পেড়ে দিদার হাতের পোলাও মাংস সুঘ্রাণ, দশমীতে মায়েদের সিঁদুর রাঙা মুখ, মা দুর্গার সন্দেশ ঠাসা লালচে মুখে আঠালো কান্না, একাদশীর ঢালা খিচুড়ি পিকনিক .... মেঘ হয়ে জমে থাকে দলা পাকিয়ে রোজ, প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তের সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত। তোর্ষা পাড়ের জলহাওয়া বুকে একলা দাঁড়িয়ে এই আলতো ছেলেবেলা। মহালয়া ভোরে মহিষাসুরমর্দিনীর ভৈরবী - মালকোষ সুরে ভিজতে ভিজতে হাউসিং - এর হলদে বারান্দা থেকে রিক্সা চেপে সোজা পোষ্ট অফিস মোড় কিংবা শান্তিপাড়া বাসস্ট্যান্ড। এই বাস ধরার ভোরে ঘুম থেকে তড়াক ক'রে লাফিয়ে ওঠা যায়, একচুল ক্লান্তিও ধারে পাশে উঁকি দিতে ভয়ে সিঁটিয়ে থাকে অন্য ঘরে। ক্রমশঃ ময়নাগুড়ি, ধূপগুড়ি, বিন্নাগুড়ি, ফালাকাটা হয়ে নানা দিকে ঘুরে, ঘড়াং ঘড়াং শব্দ ক'রে তোর্ষা ব্রিজ পেরিয়ে বাস চলে। এই ঘড়াং শব্দ আর ভেতর ঘরের লাফালাফি, একই ছন্দে - লয়ে - তালে মাতন জাগায়। আরও বেশ কয়েক বছর পর শিলতোর্ষা ব্রিজ পার হয়ে অবশেষে কোচবিহার। রাজ বাড়ীর বিরাট গেট পেরিয়ে সাগরদিঘীর কাছেই ক্ষুদিরাম স্ট্যাচুর সামনে এসে থামে বাস। কখনও বা মরা পোড়া দিঘীতে। রাজবাড়ীর কাছের হলদে কোয়ার্টার গুলো পেরোনোর সময় প্রতিবারই এই সারির ভেতর দিয়ে ছোটদাদুর ঘর আর সাদা তুলোয় মোড়ানো সদ্যোজাত রিখি, মানে ছোটদাদুর মেয়ের খুব ছোট্ট চেহারাটা খুঁজে নেবার বৃথা চেষ্টা। প্রতিটা রাস্তা প্রতিটা ডাইনে বামের পর্যায়ক্রম, সাগরদিঘির পাড় ঘেঁষে, দিদার অফিস, ছোটদাদুর অফিস, মায়ের স্কুল বাড়ী, কামান, ক্ষুদিরাম, জেলাশাসকের দপ্তর, দেবীবাড়ী, তরুণ দলের পুজো, ম্যাগাজিন, ঢালা খিচুড়ি, বর্ষায় ঘরে ঢুকে যাওয়া জল, তোর্ষা বাঁধ, রান্নার গন্ধ, এ ঘর থেকে ও ঘরে ছুটে তেল হলুদের নেমন্তন্ন, ছোটমাসীর ঠাকুর ঘরের পানের দোক্তা মাখা ধূপগন্ধ, মদনমোহন বাড়ী, রবার গাছের পাতা খেতে আসা দাদুর চারপেয়ে ছাগলছানা, রান্নাবাটি, পুতুলের দুপুর একই রঙের ছবি হয়ে বেজে যায় বুকের দরজার ক্যানভাসে। সন্ধ্যে নামলে বোনের বেসুরো গলার "এতদিন যে বসে ছিলেম" অথবা, "কহ ভাই কহ রে, একাচোরা শহরে, বদ্যিরা কেন কেউ আলুভাতে খায়না.... আকাশের গায়ে নাকি টক টক গন্ধ" আবার সকাল সকাল মামামণির রেকর্ড প্লেয়ারে গমগমে গলার টুকরো শ্রীকান্ত, "মুকুট প'রে বসে আছো সিংহাসনে,/ রাজ্য জুড়ে সবাই তোমায় ভীষণ মানে, /যখন তখন যাকে তাকে, / পাঠাও তুমি নির্বাসনে,/ নিজেও তুমি বন্দী, /সেটা ক'জন জানে রাজা?" সে স্বপ্নমাখা অলিগলি আর চাইলেও ছুঁয়ে দেখা যায়না। এখন জীবন জুড়ে ছড়িয়ে আছে কত না ধূসর খয়েরী লালমাটি পথ। কিছু কিছু পাথুরে পথে বারবার ফিরে যেতে হয়। বড্ড ধূসর কেজো যাত্রা। ভালোবাসাহীন, অনুভূতিহীন অভ্যাসের জলে মাখা। দীর্ঘ সময় ধরে বাধ্য হেঁটে চলা সেই পথেই। ভালো না লাগার ফোয়ারায় ভিজতে ভিজতে, কপাল জুড়ে, চোখের কোণে, চুলের ফাঁকে তৈরি হয় নতুন মোড়, নতুন বাঁকের পথ। কোঁচকানো চামড়ায় ধূসর যন্ত্রণার ঢক্কানিনাদ। আয়না জানান দেয় বিতৃষ্ণ সুর। মামাবাড়ীর সকাল - দুপুর - সন্ধ্যে - রাতগুলো ঘিরে থাকে ধ্বস্ত দিনে, ব্যথার তপ্ত কামড়ে চুম্বক হয়ে। শুধু একটুও বড় হ'তে না চেয়েও অস্থির বেড়ে যাওয়ার তালে তাল মেলানোর অভিনয় যাপনে, দূর থেকে ভেসে আসে সেই অপেক্ষা ছন্দপতনের সুর ...... "বাবা, তোর্ষা ব্রিজ আসতে আর কতক্ষণ ..." ... একটু একটু ক'রে জঙ ধরছে সবুজ বাড়ীর গেটটায়। আর কয়েক পা এগোলেই একটা কালো অন্ধকারে বড় হবার খাম ডুবিয়ে, নতুন পথে নতুন চিঠির খোঁজ। আর্তনাদে বাজতে থাকে, বেজেই চলে, "বাবা, কতক্ষণ? কখন আসবে, বলোনা, বাবা ....."
পুড়ে যায় বড় হ'বার সবটুকু খড়কুটো স্বর। আস্ফালন।
" আজ কি মুছিল চিহ্ন তাহার,/ ফুটিল বনের তৃণ...." ?।

No comments:

Post a Comment