আজ সকাল থেকে নন্দীর শরীর খানা ভালো নেই। তার উপর হাল্কা গলা ব্যাথা ও কাশি। গায়ের তাপমাত্রা সেরকম বাড়াবাড়ি কিছু না হলেও সাবধানের মার নেই তাই দেবাদিদেব মহাদেবের আদেশে নন্দীকে কৈলাস পর্বতের একধারে হোম কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছে। এমনিতেই কৈলাসে ঠাণ্ডা তার উপর মর্তে যা চলছে, এক্কেবারে যাচ্ছেতাই অবস্থা। এবার স্বর্গে এই অবস্থা হলে তো বেজায় মুস্কিল।
মর্ত্যের মানুষ পটল তুল্ললে স্বর্গে আসে কিন্তু স্বর্গের বাসিন্দাদের কিছু একটা ভালো মন্দ হয়ে গেলে তারা কোথায় যাবেন।আর তাছাড়া স্বর্গের বাসিন্দাদের সংখ্যাতো আর কম নয়,তেত্রিশ কোটি।
আর হেলথ স্টাফ কজন, মাত্র দু জন। দুজন
অশ্বিনীকুমার। তাদের দুজনেরি বয়স হয়েছে আর দীর্ঘকাল ওই পোষ্টে নতুন কোন নিয়োগ নেই।
তারা আর কত দেবতার চিকিৎসা করবেন।তাছাড়া চিকিৎসা পদ্ধতির তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি অথচ ব্যধি তো আর থেমে নেই।
তাই শেষ পর্যন্ত মর্ত্যের দেব মন্দিরের দরজা বন্ধ হতেই স্বর্গেও লক ডাউন ঘোষনা করলেন দেব রাজ ইন্দ্র।
এখন দেবতারা সব কর্ম হারিয়ে বেকার, হাতে এখন বিশেষ কাজ কর্ম নেই।
মর্ত্যের মানুষ তাদের এই দুর্দিনে নিজেদেরই বাঁচাতে ব্যাস্ত, দেব ভক্তি তো দূরস্থ।
তাই এই অবস্থায় দেবতাদের চুপটি করে ঘরে বসে থাকা ছাড়া আর উপায় নেই।
অমরাবতীতে ইন্দ্রের সভা পর্যন্ত বাতিল হয়েছে।
সোমরস এর যোগান অপ্রতুল।যেটুকু স্টক ছিলো তা ক্রমে নিঃশেষ এর দিকে। ভক্তের দল নৈবিদ্য, উপাচার, আহুতি বন্ধ করায় দেবধামে ঘরে ঘরে আর্থিক অনটন।
ইন্দ্রের দেওয়া ত্রানে কোন রকমে দিনপাত করছেন তারা। তাকিয়ে আছেন কবে আবার কাজ ফিরে যাবেন।
এ মত অবস্থা আমোদ প্রমোদ শোভা পায় না। তাই গন্ধর্ব দের গান এবং অপ্সরা দের নাচ ছাড়া স্বর্গের চারদিক যেন শ্মশানের নিঃস্তব্ধতা।
এদিকে রম্ভা,মেনকা প্রভৃতি অপ্সরাদের বিনা ডায়েটিং এ ওয়েট বেড়ে যাচ্ছে দিন দিন।
তাদের আর সেই তন্বী চেহারা নেই।
ঘরে বসে তারা স্বর্গের টিকটকে নৃত্য রস পরিবেশন করলেও ঘর থেকে নট নড়নচড়ন।
পুরন্দরের রাজ্যে সবাই লক ডাউন ঠিক মতো মেনে চলছেন কিনা তার জন্য বায়ুর দেবতা পবন কে দায়িত্ব দিয়ে রেখেছেন দেবরাজ।
কারন তিনিই তো একমাত্র সর্বত্রগামী।
তবে ইন্দ্রের নির্দেশ সবাই যে অক্ষরে অক্ষরে পালন করছেন এমনটাও নয়। দু এক জন ফাঁক গলে ঠিক বেরিয়ে পড়ছেন নানা অছিলায়।
যেমন দেবর্ষি নারদ। দু এক দিন তিনি বেশ গম্ভীর মুখে বাড়িতেই হরিনাম করে কাটিয়ে দিলেন কিন্তু দিন তিনেক যেতে না যেতে তাঁর উশখুশ শুরু হলো।
ওই যে কথায় বলে না, পায়ের তলায় সর্ষে।
ঘরেতে কি তার মন টেকে। সারাক্ষণ এ ঘরে ওর ঘরে উঁকি মারা যার অভ্যেস তার কি ঘরের ভিতর থাকতে ভালো লাগে।
শেষে যখন বাইরে বেরোতে না পরে যখন বুক পেট আইঢাই করে গেলো গেলো অবস্থা তখন আর থাকতে পারলেন না ব্রহ্মার মানস পুত্র।
ব্যাস অমনি ঢেঁকি বাগিয়ে চলে গেলেন মর্ত্যে আড্ডা দিতে। আর যাবিতো যাবি সোজা গিয়ে পৌঁছালেন নয়াদিল্লীর রেড জোনের একটা বিষ্ণু মন্দিরে। চত্বরের দিকে ঢুঁ মারতেই তার উপর হানা দিলো অদৃশ্য বীজাণু। সেটি নিজের শরীরে বহন করে সোজা হাজির হলেন বিষ্ণুলোক ঘুরে কৈলাসে।
বেচারা নন্দী তখন বিশাল খলে বসে বাবার সিদ্ধি কুটছিলো। সামনে সিদ্ধির পুখুর ভরে আছে।
মুখে অবশ্য মাস্ক ছিলো নন্দীর তবুও নারদমহাপ্রভুর তা ছিলো না। তার নাকি মাস্ক পরতে ভীষণ আপত্তি। মুখে মাস্ক চড়ালে হরিনাম জপে কষ্ট হয়।
তিনি এসেছিলেন শিব দর্শনে কিন্তু যবে থেকে মর্ত্যে করোনার দাপট বেড়েছে এবং মন্দিরের দরজা সব বন্ধ, ভোলে বাবা বাইরের কারোর সাথে বিশেষ দেখা করেন না।
যাই হোক দু চার কথা নন্দীর সাথে বলে নিজেদের মধ্যে কুশল বিনিময়ের পর বিদায় নিলেন নারদ মুনি। তার ঠিক দিন দুয়েক পরে নারদের করোনা সংক্রমণ ধরা দিলো।
স্বর্গের প্রথম কোভিড পজেটিভ বলে সনাক্ত হলেন দেবর্ষি।
আর তার পর থেকেই সমগ্র স্বর্গ জুড়ে স্বর্গবাসী দের মধ্যে সর্বক্ষণের একটা আতঙ্ক।
সকলের শরীর কেমন যেন শুধুতেই জ্বর জ্বর ভাব হতে শুরু করলো। একটু হাঁচি হলেও পাশের দেবতারা দশ হাত দূরে পালায়।
বার বার ফালতু পেশেন্ট দেখে অশ্বিনীকুমাররা যত না ক্লান্ত তার থেকে বেশি বিরক্ত, অথচ দেব কর্মচারী রূপে ডিউটিতে না এসেও উপায় নেই। দেবরাজ একশ শতাংশ হাজিরার ফরমান জারি করেছেন।
আবার বিষ্ণুলোকে বিষ্ণু সোশাল ডিস্টেন্সিং এর জেরে তক্ষক নাগের নীচে যোগনিদ্রায় যেতেই পারছেন না। তার কোমর, সারা শরীর জুড়ে টন টনানি ভাব। কিছুতেই অন্য কোথাও শুয়ে সেই আরাম পাচ্ছে না।
ক্ষনে ক্ষনে ডাক পড়ছে লক্ষ্মীর, কিন্তু তিনিও আর বাতের ব্যাথার মালিশে নারাজ। বাজারে মন্দা তাই তার মান্থলি ইনকামে টান পড়েছে।
তবে স্বর্গের চেয়ে মর্ত্যের শ্রীক্ষেত্রে থাকা জগন্নাথ প্রভুর অবস্থা কিছুটা মন্দের ভালো।
যেহেতু তার হাত এবং পা নেই তাই সেগুলি বার বার সাবান দিয়ে ধোয়ার ঝামেলাও নেই। তবে ভক্ত বিনে তিনি যে খুব একটা সুখে আছেন তা বলা যায় না।এদিকে রত্রযাত্রাও অনিশ্চিত।
তবে এই মরসুমে যার কাজের পরিমান বহুগুন বেড়ে গেছে, তিনি হলেন স্বয়ং যম।
তার আর নাওয়া খাওয়ার সময় নেই, মহাচন্দ্র আর কালপুরুষ মানুষ ধরে ধরে আনছে তো আনছেই, যেন তার শেষ নেই।
এবং এনেই কি আর শান্তি আছে।
যম লোকে আসা নতুন আত্মা, মানুষ্যকুল থেকে যম লোকে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আশংকা প্রবল।
আগত আত্মাদের থার্মাল স্ক্রিনিং করে, চৌদ্দ দিন আইসোলেশনে রেখে তবেই তাদের বিচারের খাতা খুলতে হচ্ছে। ফলে দেরি হচ্ছে বিচার প্রক্রিয়াতে অন্যদিকে নশ্বর আত্মাদের এই কটা দিন যে জামাই খাতির করতে হচ্ছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
কারণ কে যে পুণ্যবান আর কে যে পাপী তা চিত্রগুপ্তের খাতা না উলটানো অবধি বোঝার উপায় নেই। তাই যমের ফান্ড থেকে বিস্তর টাকা খরচা হচ্ছে। তিনিও তিতিবিরক্ত
এদিকে কৈলাশের অবস্থা যে খুব একটা ভালো তা বলা যায় না। নন্দী হোম কোয়ারেন্টিনে যাবার পর , ভৃঙ্গী লক ডাউনের জেরে কাজে আসছে না। তাই মা দুর্গার মাথা পাগল হবার জোগাড়।
তার উপর আবার তার দশ হাত । হাত ধুতে ধুতে তার প্রায় সারাটা দিন কেটে যাচ্ছে। ওদিকে কার্তিক-গণেশের স্কুলে তালা। তারা সারা দিন তারা কৈলাস মাথায় তুলে রেখেছে।এদিকে আবার শুটিং বন্ধ থাকায় স্বর্গের টিভি সিরিয়ালে নতুন কোন প্রোগ্রাম নেই।
ওদিকে আবার স্কুল কলেজ বন্ধ থাকায় স্বরস্বতীরাও মুখ ভার।তার বাহন হাঁস টাকেও কাছে এনে যে একটু আদর করবেন তার উপায় নেই।
তবে সবচেয়ে বেশি সমস্যা দেবাদিদেব কে নিয়ে। তিনি আবার শ্মশানের বাসিন্দা। স্যানিটাইজেশনের নাম গন্ধ নেই।
তবে যবে থেকে করোনার লাশ শ্মশানে পুড়তে শুরু করেছে তিনি সেখানেও যেতে পারচ্ছেন না, পাছে তিনি তার থেকে সংক্রমিত হন।
আবার বাড়িতে থাকলেও মহা জ্বালা। সারাক্ষণ হর-পার্বতির খিটিরমিটির লেগেই আছে।
শেষে কিনা মহারূদ্র কে ঘর সাফাইয়ের কাছে মহামায়া লাগিয়ে দেন সেই ভয়ে তিনি অস্থির।
নন্দী ছাড়া তার গাঁজা-কল্কে কে আর তোয়াজ করে দেবে। সেই রকম এই লক ডাউনে তার গিন্নীর তিতীক্ষ মেজাজ যেন সব সময় সপ্তমে চড়ে আছে ।
এমন টা নয় যে ভোলা মহেশ্বর কাজে ফাঁকি দেন, কিন্তু যেহেতু তিনি ভোলে বাবা তাই কাজ গুলো বেশির ভাগই ভুলে ভরা।
যেমন সেদিন কৈলাশ চত্বরের সাফাই করতে গিয়ে মুছো খুঁজে না পেয়ে ভুলে নিজের ব্রাঘ্যাসন টি দিয়ে মুছে ফেল্ললেন চারিদিক।
আবার সংক্রমণের ভয়ে কোথায় যে তার মাথার চাঁদ খানা খুলে রেখেছিলেন বেমালুম ভুলে গেলেন।
সেটি খুঁজে পেতে বিস্তর কাঠ-খড় পোড়াতে হল তাকে।
ওদিকে গাঁজা-সিদ্ধির তেষ্টায় তার প্রাণ ওষ্ঠাগত । অথচ ছেলে মেয়েদের সামনে নেশাভাঙ করা যায় না।
এই সব নিয়ে স্বর্গের এক্কেবারে যাচ্ছেতাই অবস্থা।
এ অবস্থা চিরকাল চল্ললে পিথিবির পাশাপাশি দেবতাদের সগগো লোক রসাতলে যাবে।
অতএব দেবতারা স্বয়ং বিষ্ণুর অভিভাবকত্বে প্রজাপ্রতি ব্রহ্মার স্মরনাপন্ন হলেন। কারন যদি এর কোন প্রতিকার থাকে তবে কেবল ব্রহ্মা জানেন গোপন কম্ম টি।
কিন্ত ব্রহ্মার অবস্থা তখন তথৈবচ।
চার মুখ নিয়ে তিনি বেশ সমস্যায় পড়েছেন। তার চতুর্মুখে মাস্ক পরতে গিয়ে তার একেবারে নাজেহাল অবস্থা। কেনার খরচা টাও খুব একটা কম নয়। সাবান স্যানিটাইজারের খরচ টা না হয় ছেড়েই দেওয়া গেল।
অতএব দেবগণের আলোচনা শেষে সকলের কাছে কোন উপায় না দেখে দেবতারা মহামায়ার স্মরনাপন্ন হলেন।
আবির্ভূতা হলেন দেবী।
প্রথমে এসেই তিনি সকলের চারিদিকে লক্ষন গণ্ডি নিজে হাতে টেনে, এই মর্মে ঢ্যাঁড়া দেওয়ার বন্দোবস্ত করলেন যে,যদি কেউ এই সমস্যার সমাধান করতে পারে তাকে অমৃতের ভাগ দেওয়া হবে।
দলে দলে অসুর,তপস্বী,ভুত,প্রেত,গান্ধর্ব,দেবতা সকলে ঢ্যাঁরা শুনে এসে হাজির হলেন কৈলাশে।
কৈলাশে কারন সেখানেই ঠান্ডা বেশি।
ত্রি-দেব মাস্ক আর পিপিই পরে বসে গেলেন ইন্টার্ভিউ নিতে। কত রকমের টোটকা,তন্ত্র,মন্ত্র,কালোজাদু,জড়িবুটি নিয়ে তার হাজির হলেন কিন্তু সমস্যা যেই কে সেই।
শেষ এক বৃদ্ধ এসে হাজির হলেন দেব বৃন্দের সামনে। সকলে তখন নিজেদের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে।
দেবরাজ ইন্দ্র তো বলেই ফেল্ললেন
-এত বড় রথী মহারথী, এমনকি দেব শক্তি পর্যন্ত হার মানলো, তুমি কে হে বাপু? যে এ রোগের নিরাময় তোমার হাতে?
বৃদ্ধ তখন সকলকে নমস্কার জানিয়ে অল্প মৃদ্যু হেসে উত্তর দিলেন
- আমি বিজ্ঞান এর সাধক প্রভু,আমি সেই মনুষ্য জাতির প্রতিনিধি, যারা যুগ যুগান্ত ধরে সমস্ত প্রতিকূলতা যে হারিয়ে এগিয়ে চলেছে দুর্বার গতিতে।
আমি জাতির প্রতিনিধি যারা অন্ধকারে জ্ঞানের আলোক জ্বেলে আঁধার কাটিয়ে তোলে।
এর পর মানুষ আর বিজ্ঞানের অক্লান্ত পরিশ্রমে আবিষ্কৃত হলো করোনার বধের অস্ত্র। হার মানলো অপরাজেয় ব্যাধি।
স্বস্তি ফিরে এলো দেবলোকে। চেনা ছন্দ ফিরে এলো তাদের সাধের মর্ত্যে।
মন্দিরের দরজা উন্মুক্ত হলো সকলের জন্য।
আবার কাজ ফিরে পেলেন দেবতারা
মর্ত্যের মানুষ সুস্থ হয়ে দেব মন্দিরে ছুটলেন দেবতাদের মাহাত্ম্য এর গুণকীর্তন করতে। আবার তার মেতে উঠলেন দেবতাদের উৎসব নিয়ে।
বিজ্ঞান তখনো নির্বিকার। সে তখন পুরস্কারের অর্থসরূপ অমৃত্যের কথা বেমালুম ভুলে গেছেন।
আর দেবতারা স্বস্তির নিশ্বাস ফেল্ললেন, মনে মনে ভাবলেন ভ্যাগিস অমৃতের কথা মনে নেই
"অমৃতস্য পুত্রাঃ" দের।।
(মুজনাই অনলাইন আষাঢ় সংখ্যা)