Sunday, July 2, 2017








সম্পাদকের কথা





এই সংখ্যায় লিখেছেন যাঁরা- 
নবনীতা সান্যাল, কাকলি ভদ্র, মৌসুমী  চৌধুরী, রাখী বসাক,  সোমনাথ গুহ সমীরণ চক্রবর্ত্তী, কুমকুম ঘোষ, কণিকা দাস,  মন্দিরা  ঘোষ, উদয় সাহা, কৌশিক কুমার 
রায়, দেবাশিস  বর্ধন, স্বাগতা রায়, শম্পা চক্রবর্তী,  পবন বর্মন,  দেবপ্রিয়া সরকার, সুপ্রীতি বর্মন,  শিবু,  নিশীথ বরণ চৌধুরী, মাম্পি রায়, আশিস চৌধুরী


সম্পাদনা, অলঙ্করণ ও বিন্যাস-
শৌভিক রায়









মুক্ত গদ্য


 বৃষ্টি সাঁকো
নবনীতা সান্যাল

শহর কাঁপিয়ে সেদিন ভোর ভোর সে কী বৃষ্টি! !সাতসকালে মেঘার মুখ ভার দেখেও গাড়িটা শেষমেশ বের করে রাস্তায় নামায়  সুরজ । সুরজ ছেত্রী । ওদের বংশের কেউ গাড়ি চালায় নি কখনো । সুরজ চালায়, ভালো খারাপের ওপরে এটা তার পেটের ভাতের জোগান দেয় । এটা সত্যি । আর  'সচ  কে উপর কূছ ভি নেহি ।'এটা বিশ্বাস করে সে ।এছাড়া আর কোন কাজ সে করতে পারতো কিনা সেসব নিয়েও ভাবতে ইচ্ছা হয় না  । তবে কেউ তো ভাবেই ....যেমন মেঘা ।ও শহরে থাকতে চায়, বড়ো মকান চায়, আরও কত কী... আজকের দিনটা মেঘার মতো চুপসে আছে যেন ।শহর  জেগে ওঠে নি এখনও ।কিন্তু  সুরজ কে রের হতেই হবে । 
রাস্তায় নেমে আবার হল মেঘার কথাকলি ।কাল রাতে মেঘা নেমেছে নীচে, আর নেমেছে তো নেমেছে বারিষ নিয়ে যেন নেমেছে । আজ ভাড়া টাডা কী করে যে পাবে ?মেঘা আজকাল ভারি সুন্দর কথা বলছে, মেঘা ওকে বলছে সত্যিটা সুরজ যেন ওর বাড়িতে বলে দেয় ।সুরজ ছেত্রী বলতে পারছে না, বলতে পারবে কোনদিন সে ভরসা ও নিজেই করে না ।কিন্তু অনেক টাকা দরকার, সেটা শুধু জানে ।মেঘার একটা ছোট অপারেশন করতে হবে ।অপারেশন ছোট কিন্তু টাকাটা অনেক বেশি অন্তত সুরজ এর  কাছে ।কাউকে বলতে পারে না, অথচ সময় খরচ হয়ে যাচ্ছে শুধু শুধু ।বডড রাগ হয় ।কিন্তু রাগ হলেও প্রকাশ করতে পারে না সে ।ধীরে ধীরে থিতিয়ে যায় তিরতির থিরথির।আগে মেঘা সোহাগ করে বলতো 'সুরজ সাহাব কো গুসসা কিউ নেহি আতা ' সত্যি তো সুরজ বড়ো বেশি চাপা , কিছুই প্রকাশ করতে পারে না ।না রাগ না দুঃখ, না আনন্দ ।চুপচাপ গাড়ি চালায় সুরজ ছেত্রী ।একরাশ বিরক্তি নিয়ে পাশে বসে আছে মেঘা ।সওয়ারী মিলছে না, অন্য দিন হলে মেঘাই শোরগোল তুলত,  আজ সে বড়ো চুপ ।বৃষ্টি আরও জোরদার হবে মনে হচ্ছে । অথচ কালকের বাহারি কমলা রোদটা ছিল চমৎকার, সুরজ ভাবে ।মেঘাকে আজ বৃষ্টি ধোয়া বাহারি ফুল মনে হচ্ছে ।ও কেন নেমেছে জানে সুরজ ।কিন্তু ডাক্তার বারবার বলেছেন ছোট্ট অপারেশন টার কথা ।'ফির খুলকে মিললো ইয়ার । জি জান মিল যায়  তুমহারা।'সুরজ ভেবেছিল আজ শহর থেকে একটু কামাই করবে কিছু মস্তি , আজ যখন মেঘা আছে, আনন্দে থাকবে ভরপুর ।কিন্তু ভোর ভোর মায়ের ফোনটা ধাক্কা দিয়ে সুরজ কে নামিয়ে আনল রাস্তায় ।মেঘার সঙ্গে দুএক চোট আবার চুপচাপ দুজন । সত্যি কী আজব লেড়কি ।কাউকে না জানিয়ে নেমেছে সমতলে ।মা বিরক্ত ।এ মেয়ের সবই অদ্ভুত ।নির্বিকার, নিজের মতো চলে , কারোর কথা শোনে না, কারোর সঙ্গে বনে না ।ধরম করমে মতি নেই ।এ মেয়ে কে নিয়ে আদৌ সংসার হবে তো সুরজের? কাচচা বাচ্চা হল না ।মায়ের  কথা আর দীর্ঘশ্বাস  সাইরেনের মত একটানা   ঘুরে বেড়ায় সুরজের মস্তিষ্কের মধ্যে ।
হঠাৎই মনে পড়ে এমনই অকাল বৃষ্টি দিনে এক উত্তাল সময়ে মিছিলে হাঁটার সময় মেঘাকে দেখেছিল সে ।কী এক আবেগের  মধ্যে চলেছিল দিন ।সেই মেয়েটার হৈ হৈ জীবন জড়িয়ে গেল সুরজের সঙ্গে ।শেরপা হওয়া হল না সুরজের ।হাতে  ঘুরল স্টিয়ারিঙে। হঠাৎই রাস্তায় গাড়ি থেকে নেমে চা খেতে গিয়ে মনে হয় সেসব ।চা খেতে খেতে গল্প শোনে ধ্বস নামতে পারে ।বিশ্বাস হয় না সুরজের ।কিছু দূরে আবার থামে গাড়ি ।পাহাড়ী ঝোরা কে উন্মাদ মনে হয় সুরজের ।ওর পাশে দাঁড়িয়ে পাগলা ঝোরায মণণত করে মেঘা ।ফাকা রাস্তায় আশ্লেষে মেঘাকে জড়িয়ে ধরে সুরজ ।মাথার মধ্যে ঘুরপাক খায় খুলকে মিললো কথাটা , ছোট্ট অপারেশন কথাটিকে পাশ কাটিয়ে সুরজ ছেত্রী ফিরে যাওয়ার কথা ভাবে।বৃষ্টি আরও জোরদার হয়, ।সামনের রাস্তা ঝাপসা হয়ে আসে ।মেঘার গলায় গান আসে, । বৃষ্টি অনেক সেতু নির্মাণের কাজও যে করতে পারে সেটা ওরা  প্রথম বুঝতে পারে ,। একটা সাঁকো তৈরি হচ্ছে , আবছা হলে ও সেটা  থেকে যাবে, আর এ দৌত্যে বৃষ্টি অনিবার্য হয়ে উঠতে থাকে ।







একটি চিঠি
কাকলি ভদ্র

কুমুদিনী,
        কেমন আছ তুমি?জানো তো আজ খুব ইচ্ছে করছে তোমাকে নিয়ে একটা কবিতা লিখি।দিনটা কিন্তু মোটেই কবিতা লেখার মতো  রোমান্টিক নয়।ভ্যাপসা গরম...ঘামে শরীর  চ্যাপচ্যাপে ....মাথার ওপর ফ্যানের   ঘটরঘটর আর্তনাদ।জানো তো কুমু....একটা সময় তুমি চাইতে আমি আমি চেম্বারে বসি...পসার করি...আমি কিন্তু জানতাম ডাক্তারী আমাকে দ্বারা হবে না।শুধু বিশ বিশ্বাস হারাতে না তুমি। আমি পারি নি কুমু....আমি পারবোও  না।আচ্ছা তুমি কি সেই আগের মতোই আছো?তুমি তো রূপকথার রাজকন্যের মতো পৃথিবীর সব রূপ রঙ নিয়ে চলে গেছো কোন সুদূরের অরূপরতন দেশে।সেখান থেকে আবার ডেকে আনার ক্ষমতা আমার নেই ।আমি শুধু বসে আছি নীলকণ্ঠ হয়ে......বিষণ্ণতার বিষ হৃদয়ে ধারণ করে।ঘরের ধূসর আলোয় আলমারীর তাকে রাখা  ঘুঙুরটা চিক্ চিক্ করছে।ওগুলো আমি কাছেই রেখেছি।চোখের আড়াল করি নি।বাতাসের আন্দোলনে যখন ওটা রিনি ঝিনি  রিনি ঝিনি  বেজে ওঠে আমি যেন তোমার ছোঁয়া পাই।এভাবেই আমি তোমার ভিতর বাহিরে নিবিড় ছোঁয়ায় বেঁচে আছি... হমম্...বেঁচেই আছি!তোমার মনে আছে  "গহন কুসুম কুঞ্জ মাঝে" নাচটা আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে দেখিয়েছিলে?আর ঐ যে সেদিন রবীন্দ্র মঞ্চে নাচলে ..."কুঞ্জ পথে সখী, ক্যায়সে যাওব"? কি যেন তার প্রথম লাইনটা?হ্যাঁ হ্যাঁ,মনে পড়েছে..."শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটা!"অপূর্ব সে নাচ!পায়ের ছন্দে যেন জাদু ছড়ায় ।রাগ তাল ছন্দে ঠিকরে বেরোচ্ছিল তোমার লাস্য।ঠিক যেন "মায়ামৃগ বিতরি কস্তুরী"!অথচ আমার অভাবী সংসারের চাপে পড়ে তুমি নাচটাকেই অবহেলা করতে শুরু করলে।আমার কোনো কথাকে তুমি পাত্তাই দিতে না।আর  সেদিন যখন আমার মুখে আবীরার নাচের কপট প্রশংসা শুনে তোমার কি রাগ !তুমি খাবার ফেলেই উঠে গিয়েছিলে।আমার সঙ্গে কথাই বন্ধ করে দিলে অভিমানে?হা হা হা...আমি কি বুঝি নি ভেবেছো?কুমু.... আমার জীবনপাত্রের যে মাধুরী উছলে পড়েছে।তুমি তার মূল্যের পরিমাণ জান?আমিও জানি না গো। জানি না কবে হবে এই গোপন ব্যথার নীরব রাতের অবসান।তুমিতো বেশ সুখেই আছ ঐ হিজলের কুঞ্জবনে....সাদা কফিনে  শুয়ে।আর আমি???
       আজ এটুকুই থাক কুমু।দেখলে তো কুমু...সেই বৃষ্টি এলো ঝিরঝিরিয়ে....শীত শীত আমেজ... বাতাসে কদম্বফুলের  মৃদুমন্দ সুবাস ...তবুও  কবিতা লেখা আজ আর হলো না।শুধুই আঁকিবুকি কেটে গেলাম কাগজ কলমে।হয়তো লিখবো কোনো একদিন।আমার মনের দুয়ারের পরতে পরতে যে তোমাকেই ধরে রেখেছি। রবিবুড়ো ওই যে বলেছিলেন..... "মধুর
মরণে পূর্ণ করিয়া সঁপিয়া যাব প্রাণ চরণে"!
        তুমি ভালো থেকো। 
                ইতি 
            তোমার কানহা







বৃষ্টি যাপন ..........
মৌসুমী  চৌধুরী


 বাঁধ-ভাঙ্গা উথালপাথাল শ্রাবণধারা। সাথে বাতাসের দামালপণা। এক আকাশ বৃষ্টি মাথায় করে কাকভেজা হয়ে  স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে এলো অদিতি। রেইনি-ডে ঘোষণা হয়ে ছুটি হয়ে গেলো। এই "রেইনি-ডে",শব্দটির সাথে প্রত্যেকেরই  ছোটবেলা যেন ওতোপ্রতোভাবে জড়িত থাকে। তাই রেইনি-ডে হলে আজও ছাত্রদের সাথে তারও মনটা খুশিতে নেচে ওঠে। জামাকাপড় ছেড়ে চন্দ্রর মাকে এক কাপ কফি দিতে বলে গীতবিতান হাতে  বারান্দায় এসে বসলো সে। বাইরে তখন অঝোর ধারায় বৃষ্টির মেঘমল্লার রাগ। ধুয়ে যাচ্ছে চরাচর। অনেকদিনের কাঠফাটা গরমের পর দূরের আম, কামিনী, নিম, পেয়ারা গাছগুলো যেন মেতেছে আনন্দের ধারা স্নানে। "টি.টি.টাওয়ার" এর মাথায় এক জোড়া প্রেমিক-প্রেমিকা  কাক ভিজে চলেছে মনের খুশিতে। একমনে দেখতে থাকে অদিতি। চন্দ্রর মার ডাকে সম্বিত ফিরে পায়। "রাতে কি খিচুরি হবে বৌদি?সাথে ডিমভাজা - পাঁপরভাজা?",ধূমায়িত কফি মাগটি হাতে ধরিয়ে জিজ্ঞেস করে চন্দ্রর মা। চন্দ্রর মাকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে অদিতি গরম কফিতে ঠোঁট ছুঁইয়ে  গীতবিতানের পাতায় ডুবে যায়। একান্ত যাপনে গীতবিতান পড়তে তার খুব ভালো লাগে। মনের একটা আশ্রয় খুঁজে পায়......
.........."আজ আকাশের মনের কথা ঝরো ঝরো বাজে/সারা প্রহর আমার বুকের মাঝে।।/দিঘির কালো জলের 'পরে মেঘের ছায়া ঘনিয়ে ধরে, /বাতাস বহে যুগান্তরের প্রাচীন বেদনা যে/সারা প্রহর আমার বুকের মাঝে।।" এমন বাঁধনহারা বাদল দিনের অনুষঙ্গেই ধেয়ে আসে সেদিনের সেই বেদনাময় স্মৃতি। গভীর এক অপরাধবোধ আজও অদিতিকে  কুরেকুরে খায়। তার ভেতরে যেন তীব্র রক্তক্ষরণ ঘটায়.......
               সেদিনও ছিলো এমনই এক পাগলপারা বাদল দিন। তিন দিন থেকে আকাশটা যেন ফুটো হয়ে গিয়েছিলো। সকাল থেকে রাত পর্য্যন্ত অদিতিদের টিনের চালে বৃ্ষ্টির জগঝম্প উদ্দাম নাচন। চারিদিকে নদীগুলো ফুঁসছিলো। প্রশাসন থেকে জারি করা হয়েছিলো রেড এলার্ট। তৃতীয় দিন সকাল থেকে বৃষ্টিটা খানিক ধরেছিলো। যদিও রিমঝিম সুর তুলেই যাচ্ছিলো তখনও। রাস্তা-ঘাটেও ছাতা মাথায় লোকেদের গুটি গুটি দেখা গেলো। ছাত্রছাত্রীরাও স্কুল -কলেজমুখী। কাজেই অদিতিও কলেজে রওনা দিলো। স্কুল -বেলা থেকে আরম্ভ করে কলেজ- বেলা সব সময় তারা ভোলা কাকুর রিক্সা করে যেতো।  সে আর বোন। বাবার বলা থাকতো। কড়া পাহারায় ভোলাকাকু নিয়ে যেতেন, আবার  ফিরিয়ে দিয়ে যেতেন।   এছাড়া, কখনও  রাতে  ট্রেন ধরতে হলে ভোলাকাকু। কাক ভোরে ট্রেন ধরতে হলে ভোলাকাকু। বাবা ভোলাকাকুকে খুব ভরসা করতেন।  ভোলাকাকুদের সঙ্গে যেন গড়ে উঠেছিলো তাদের পরম আত্মীয়তা ভোলাকাকুরা থাকতেন বাঁধের পাড়ে দু'কামরার এক চালা ঘরে। কাকীমা, দুই মেয়ে, পাঁচ বছরের বিল্টুকে নিয়ে ছিলো ওদের সংসার।
                 সেদিন অদিতিকে কলেজে নামিয়ে দিয়ে ভোলাকাকু বললেন, "আগে হয়ে গেলেও যাবি না। আমি এসে নিয়ে যাবো। চারদিকের অবস্হা ভালো না। বাঁধ কানায় কানায় ভরে গেছে।" কলেজে সেদিন উপস্হিতির হার ছিল বেশ কম। অনার্সের ক্লাসটা নিলেন ডি.কে.এম।তারপরই হৈ হৈ কান্ড! কলেজের নিচের তলায় অফিস রুমে জল ঢুকছে হু হু করে। কলেজের ক্লার্ক, ফোর্থ স্টাফেরা সবাই মিলে  ফাইলপত্র দোতালায় তুলছেন। আশেপাশের নীচু এলাকার লোকেরা তাদের গরু-ছাগল নিয়ে কলেজে আসছে আশ্রয় নিতে। মালা, কাকলী, দেবিকা, রীতাদের বাড়ী থেকে লোক এসে ওদের নিয়ে গেলো। অদিতি হঠাৎ দেখলো রিক্সা নিয়ে হন্ত-দন্ত করে আসছেন ভোলা কাকু, "শীগগীর চল, বাঁধ ভাঙ্গা জল ঢুকছে শহরে..... "। অদিতি আঁতকে উঠে বললো, "তাহলে তোমাদের ঘর কি হবে? তুমি নিতে এলে কেন কাকু? আমি তো এখানেই থাকতে পারতাম..... "। কাকু বললেন, "আর থাকতে হবে না। বেশি বুঝিস না। ভালোয় ভালোয় বাড়ি চল দেখি। " বাড়িতে ফেরার পথে অদিতি দেখছিলো  রিক্সার চাকা অর্ধেক জলে ডুবে যাচ্ছে। তাকে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে ভোলা কাকু তাড়াতাড়ি চলে গেলেন। দুদিন কেউ কারও খবর নিতে পারলো না। সারা শহর জলবন্দি। বাবা বাড়িতে ছিলেন না। বাবার কর্মস্থলে তাদের যে বাড়ি ছিলো সেখানেই ছিলেন তিনি। মা বোনেদের সহ তাকে নিয়ে পাশের বাড়ির দোতালায় দু'দিন  কাটালেন..... পাড়ার আরও অনেকে সেখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। দুদিন পরে জল নামলে সবাই ফিরে গেলো যে যার বাড়িতে। সবার ঘরেই পলি জমেছে পুরু হয়ে। বাড়িতে আসার পর ঘরের অবস্হা দেখে কান্না পেয়ে গিয়েছিলো অদিতির। তাঁর বইয়ে ঠাসা কাঠের বুক -সেল্ফটা জলের তোড়ে উল্টে ভেসে ভেসে ঘরের মাঝখানে চলে এসেছে।যাইহোক  তারা সবাই মিলে ঘর পরিস্কার করতে লেগে গেলো।আর ঠিক সেই সময়ই ভোলা - কাকুর  বড় মেয়ে মীনু চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে এসে হাজির। জানালো সেই ভয়ংকর ঘটনাটা। ভোলাকাকু যখন অদিতিকে আনতে কলেজে গিয়েছিলো তখন হঠাৎ বাঁধ ভেঙ্গে যায়। জলের স্রোতে ভেসে যাওয়া ঘরের জিনিস কিছু বাঁচাতে চেষ্টা করেছিলেন কাকীমা। চারদিকে ত্রাহি ত্রাহি রব...... ঘর থেকে বেড়িয়ে কাছের স্কুল বাড়িটিতে আশ্রয় নিতে গিয়ে  জলের তোড়ে ভেসে গেছে তাদের ভাই বিল্টু। পাড়ার ছেলেরা খুব বাঁচানোর চেষ্টা করেও পারে নি। তারপর যে যার প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টায় এতই ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিলো যে, বিল্টু মুহূর্তেই মিশে গেছে রাক্ষুসে অতল জলোচ্ছ্বাসে। জল নেমে যেতে স্থানীয় পুলিশ ওর দেহ খুঁজেই  চলেছে,এখনও পায় নি ....... স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো অদিতি,ভোলাকাকু  তাকে আনতে না গেলে হয়তো বিল্টু এভাবে ভেসে যেতো না।হয়তো..... বিল্টুর মৃত্যুর জন্য নিজেকেই  আজও দায়ী মনেহয় অদিতির । তীব্র অপরাধবোধে আজও তাড়িত হয় সে। বৃষ্টির রিমঝিম নুপুরে ছোট্ট বিল্টুর কান্না শুনতে পায়। বৃষ্টি ধারার সাথে সাথে আজও ভেসে আসে ভোলাকাকুর কর্তব্য নিষ্ঠা আর স্বার্থ ত্যাগের কথা। বৃষ্টিধারায় মিশে যেতে থাকে অদিতির ভেতরে আজীবন বয়ে যাওয়া নোনা নদীটি.......। 
             টুংটাং কলিংবেলের শব্দে চমকে ওঠে অদিতি.......! বাইরে অন্ধকার নেমে এসেছে। বৃষ্টিটা একটু ধরেছে মনে হয়। কামিনী ফুলের গাছটা সুগন্ধ ছড়াচ্ছে।গাছের তলাটা সাদা হয়ে গেছে ফুলের পাপড়ি ঝরে পড়ে। রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছে  ডিম ভাজার গন্ধ। চন্দ্রর মায়ের দরজা খুলে দেবার শব্দ পেলো। বোধহয় অতীন ফিরে এলো.......জীবন এভাবে  কেটে যাচ্ছে।কেটে যায়......  ঋতুচক্রের আবর্তনে বয়স বেড়েছে ভোলাকাকুর। কিন্তু প্রতি বর্ষাতেই তিনি নাকি বিল্টুর  ফিরে আসার অপেক্ষা করেন......চিৎকার করে বিল্টুর নাম ধরে ডাকতে থাকেন। গত পূজোর ছুটিতে অদিতি ভোলাকাকুকে দেখতে গিয়েছিলো, বহরমপুর মেন্টাল অ্যাসাইলামে। নাঃ,তাকে চিনতে পারেন নি তিনি! বড়ই সেন্সেটিভ ছিলেন মানুষটা। সেন্সেটিভ মানুষদের কষ্ট খুব! বাইরে আবার ঝেঁপে বৃষ্টি এলো আকাশ ভেঙ্গে........







বর্ষা স্বপ্ন
রাখী বসাক

ফুটোফাটা রাস্তায় জমে থাকা বর্ষার জলে বৃষ্টি পায়ে,পায়ে পৌঁছে যাওয়া স্কুলের ঘরে।হোক না স্কুলের ঘরগুলি ফাঁকা স্যাঁত স্যাঁতে তবুও বর্ষার জল মেখে কামিনী,মাধবীলতার হাত ধরে দুলতে,দুলতে স্কুলে আসা।কখনও ক্লাসের ফাঁকে জোট বেঁধে গল্প করা,আবার কখনও দলছুট হয়ে আনমনে জানালার শিক ধরে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকা।স্কুলের ঘন্টার সাথে সাথে নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বাড়ির পথে যাওয়া।মাঝ পথে বৃষ্টিতে লুটোপুটি করে নিজেকে নতুন করে পাওয়া।বাড়ি গিয়ে মায়ের কাছে যতই খাই বকুনি তবুও মনের মাঝে লুকিয়ে রাখা নূপুর পরা বৃষ্টির থৈ,থৈ নাচন।রাতের বেলায় লন্ঠনের ক্ষীন আলোয় নক্সী কাঁথা বুকে জড়িয়ে ব্যাঙ্গের গ্যাঙ্গর,গ্যাঙ্গর কান্না শুনে ঘুমের হাত ধরা।স্বপ্নেও ভেসে আসে ছোট্টছোট্ট রঙ্গিন কাগজের ডিঙ্গি,যাতে করে ভাসিয়ে দেই আমার মনের টুকরো,টুকরো স্বপ্নগুলি।









কবিতা






  বৃষ্টি     
 সোমনাথ গুহ  

এখন আর বৃষ্টি হয় না আগের মতো
কেমন যেন বদলে গেছে সব
অনেক রাত্রির গল্প গুলো এভাবেই হারায়
আমাদের মেঘলা দিনের সরু পথ

এখন আর বৃষ্টি হয় না আগের মতো
চোখের আড়ালেই হারায় মন
ঢেউ কেটে কেটে যায় কাগজের নৌকো
ভিজে যায় আমাদের আয়োজন

এখন আর বৃষ্টি হয় না আগের মতো
দেখা হয় শুধু মাঝেমাঝে
মেঘেদের বাড়ি ঘেঁষে থাকে ছেড়া ছাতা
জলের ঝাপটা লাগে চশমার কাঁচে










দুটি কবিতা 
সমীরণ চক্রবর্ত্তী

"বৃষ্টি ভেজা তারার মালা"
     


আকাশে আজ
আকাশে আজ মেঘের ভেলা
আকাশে আজ হাওয়ার সাথে মেঘের খেলা।

মেঘ জমেছে
মেঘ জমেছে আমার মনে
মেঘ জমেছে তোমার বাড়ির ঈশান কোনে।

বৃষ্টি হবে
বৃষ্টি হবে শহর জুড়ে
বৃষ্টি হবে ঝমঝমিয়ে সকাল সন্ধ্যে রাত-দুপুরে।

ভিজিয়ে দেবে
ভিজিয়ে দেবে তপ্ত দিনের আকুলতা
ভিজিয়ে দেবে আমার প্রিয়ার চোখের পাতা।

শীতল হবে
শীতল হবে দহন জ্বালা
শীতল হবে রাতের আকাশ কণ্ঠে পরে বৃষ্টি ভেজা তারার মালা।




"ভেজা স্মৃতি"
            


       ••• ১ •••
মুষলধারে বৃষ্টি এসে
        ভিজিয়ে দিয়ে গেল
যৌবনের স্মৃতিগুলো
        মুক্ত ডানা পেল।

       ••• ২ •••
বৃষ্টিস্নাত তুমি আমি
        একটি ছাতার তলে
বৃষ্টি জানি এমন দিনে
        অনেক কথাই বলে।

রিমঝিমঝিম বৃষ্টি মেখে
        হেঁটেছি অনেকক্ষণ
তোমার চোখেই খুঁজে পেলাম
        ভালোবাসার জন।

চিকন শাড়ি জলে ভেজা
        জল থৈ থৈ মাঠ
তুমিই সেদিন শিখিয়েছিলে
        প্রেমের প্রথম পাঠ।

জাপটে ধরে প্রথম চুমু
        এঁকে ছিলে ঠোঁটে
আকাশ জুড়ে এক লহমায়
        হাজার তারা ফোটে।

উষ্ণতায় থরথর
        তোমার ছোঁয়া পেয়ে
মনটা আমার উদাস হল
        মেঘমল্লার গেয়ে।

         ••• ৩ •••
মনে পড়ে প্রিয়তমা
        সেই দিনটার কথা
জানি, তুমি আজও ভাবো
        নিভৃতে পাও ব্যথা।

আজও তুমি এমনি ভেজো
        চিকন শাড়ি পরে?
আজ শ্রাবণের অঝোর ধারায়
        খুব জানতে ইচ্ছে করে।









 শহরে বর্ষা 
কুমকুম ঘোষ

দামাল হাওয়ার ডাকে
কয়েকটা ক্লান্ত পাতা ..আর একা কদমফুলটা....
ধেয়ে এলো...
ঠিক চৌরাস্তার বাঁকে...

বারুদ-ঠাসা বুকে...অকারণ পুলকে
চেনা দৃশ্যটা...
মুহূর্তে গেল পালটে :

লালবাতির নিষেধকে তুড়ি মেরে
মেঘ.....এগিয়ে গেল..
ঐ পারে....বৃষ্টির দিকে
মুচকি হেসে ট্রাফিক সার্জেন্ট 
বিনতির ভঙ্গীতে আর্তনাদ করে উঠলো........"দাঁড়াও"

কেউ কোথ্থাও নেই
বেবাক উধাও।।

শুধু অঝোর রূপকথার এই চেনা গল্পটা
আঁকা থাকলো ব্যস্ত এক সাঁঝবেলাতে....
তৃষিত রাজপথের...নিভৃত নীরবিন্দুতে ।।










যাপনের বৃষ্টি
 কণিকা দাস

মন খারাপের ঝাঁপিটা খুলতেই
একঝাঁক বৃষ্টি--- আহা!
অসময়ের বোবা কান্না সামলে নিয়ে
এক অনন্ত ভালোলাগা
হৃদয় গভীরে অপার শীতলতা! 
মেঘমালার সাতরঙা শাড়িটা জড়িয়ে 
নেওয়ার সাধ অনেক দিনের
তারপর শূণ্যে ভেসে যাওয়া------
অপূর্ণতার সীমারেখা ভেদ করে
চিরদিন জেগে থাকি সেই
পার্থিব দিনটির অপেক্ষায়।
অস্থির মনের অবগাহন শেষে
বৃষ্টি ধরা দেয় সীমাহীন পূর্ণতায়
অতীতের সব তিক্ততা ধুয়ে মুছে

নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন প্রতিটি বৃষ্টিযাপনে।









বৃষ্টি  হবার ইচ্ছে বারোমাস
       মন্দিরা  ঘোষ


এখন আমার ঠাণ্ডা ঘরে বাস
পায়রা হবার ইচ্ছে  অনায়াস

বৃষ্টি আমার সাজুক দূর্বাঘাসে
আমার চোখে নকশিকাঁথার মাঠ।
রঙিন  সুতোর গল্পরা সব
ওঠে বসে বেড়ায় হাসে
থামার কথায় কান্নাকাটির হাট।
আমার মনে তোমার পরবাস। 

সাজানো সব আলমারির  ভাঁজে
তোমার মনের জলপরীদের বাস।
মেঘবালিকার মায়ায়  মায়ায়
ডানায় নামে অন্ধকারের রাত। 
বুকের ভিতর পরশ পাথর
তোমার আছে বৃষ্টি  অবকাশ।

এখন আমার ঠান্ডা ঘরে বাস
বৃষ্টি হবার ইচ্ছে বারোমাস।









চিঠি
উদয় সাহা

মনে আছে,জুন মাসের প্রথম থেকে বিনিময়
আমি তখনও নেট দিই নি ছিল ফলাফলে সংশয়
তোমায় শুধু শুনতে পেতাম, দেখা হয়নি তখনও
চিঠিগুলো যত্নে আছে।স্লেট দুর্ভেদ্য এখনো
বরফ এখনও গালে মাখো ভালোবাসার তাপে?
তোমার দেওয়া কল্কি পাঞ্জাবিটা ঢিলে হয় মাপে
জুন গড়িয়ে জুলাই এলো।নেমে এলো বর্ষা
চোখে ভাসে শিফন শাড়ি, গাল দুটো ফরসা
ঝরে যায় রিনিঝিনি চিত্তে আমার সেরোটোনিন
আরো একটু বেশী হলেই আমি গ্যালারিতে বিলীন
অগাস্ট এসে স্মিত হাসে আবেগ নিয়ে চোখে
বর্ষণে ঢেউ উথলে ওঠে,রস ঘন হয় আখে
তোমার তখন পাকা বাড়ি দু'তলার ছাদ
আমার ওই টিনের চাল...নোয়াতে পারিনি কাঁধ
বাসে আগুন, জলকামান, বসতি ভাঙচুর
বৃষ্টি এসে তরঙ্গ স্থলে বাজিয়ে যায় সন্তুর....










রূপ বদল

কৌশিক কুমার রায়


তোমায় যেদিন প্রথম দেখেছি ....
সেই ছাইরঙা আলয়ে প্রেমের কবিতা লিখতে l
কণায় কণায় আকর্ষন,একাত্ব হয়ে যাওয়া ;
যেন ধরার পানে অকৃত্তিম ভালোবাসা l
শুনেছি তোমার রোমহর্ষক গান ,
আহা , কি শ্রুতিমধুর ছন্দটান !
চোঁখে ছোঁয়া লাগে আলোর ঝলকানি ;
এক পলকে মোনালিসাও হার মানে l
তোমায় যেদিন দেখেছি মুজনাই-এর জলে....
ক্লান্ত শরীরী বাঁকে নীলাবরন l
শুনেছি কল্ কল্ শব্দ তরঙ্গে ,
শিহরন ওঠে  বন্যের অঙ্গে l
আহা , কি অপরূপ শোভা তোমার !
তোমাতে খুজেছি প্রেমের কবিতা আবার l
তোমায় যেদিন দেখেছি সাগর তলে....
আঁচল সরিয়ে খোলা চুলে ভাসতে ,
ঐ দিগন্তে আসমানে বিলীন হতে l
আহা , কি মনোমুগ্ধকর বাতাবরন !
মনে সুনামির ঢেউ ওঠে....












বৃষ্টির দিন
দেবাশিস  বর্ধন

বৃষ্টির দিন, বৃষ্টি পড়ছে...
কখনো ঝিরিঝিরি...কখনো মুষলধারে...
ঘরের জানলা দিয়ে দেখছি...
বৃষ্টির শব্দ হচ্ছে...
মাটির ভিজে গন্ধ আসছে...
ভিজতে ইচ্ছে করছে...
যেভাবে ভিজে যাচ্ছে...
গাছ-পালা, মাঠ-ঘাট, দোকান-পাট...
পিচের রাস্তা...লাইট পোস্ট...
ঠিক সেভাবে না হলেও
অল্প ভিজতেই পারি...
না; না; সর্দির ধাত
একদম নেই...
গা ম্যাজম্যাজ করলে, আছেই তো
প্যারাসিটামল...
জ্বর, মাথা-ধরা কমে যাবে নিমেষে...
শুধু তুমি নেই পাশে...
থাকলে
অনেকদিন পর পাশাপাশি
ভিজতেম দাঁড়িয়ে...
তুমি ছাতা আনতে বলতে ,আমাকে...
আর
আমি, ঘরে থাকা একমাত্র ছাতাটিকে
রাখতাম লুকিয়ে...
কিছুক্ষণ ভিজে যাওয়ার পর...
তুমি
দৌড়ে চলে যেতে ঘরে...
লাজুক মুখে...
ভিজলে, সত্যি...
সুন্দর লাগে তোমাকে...

বৃষ্টি এখনও পড়ছে...
ঝিরিঝিরি...
মাঝেমাঝে...জোরে... 










কবিতা- 
স্বাগতা রায়

১.ছাতিম

এলাকা জুড়ে বর্ষা কাল
কেবল ছাতিম তলাতে বৃষ্টি নামে না বড় !
এই খানেতেই খানিক বাদে শুকনো ছাতা রাখা হবে
বড় দুঃখ তার !
ভিজতে গেলে পাতা গুলো বাধা দেয় বাঁধ হয়ে.
নরম ফুলে বর্ষা নেমে ছুঁয়ে দিলেই সন্ধ্যা নামে
বর্ষা পীড়িত কাঁচা পাঁপড়ি গুলো জানে না -অনধিকার প্রবেশ নিষিদ্ধ এই নিষিদ্ধ পল্লী তে


২.ভেজা ভয়


হঠাৎ যদি বৃষ্টি নামে ঝমঝমিয়ে
একটা ভেজা ভয় দরজা দিয়ে বসে থাকে মনের ভিতর.
হাত বাড়ালেই বৃষ্টিফোটা ফোঁটা ফুলের বুকে দোলে !
ঠান্ডা কিছু ভিজে মাটি জানিয়ে দেয় ভয়ের সাথী !
বাজ পড়লে কড়কড়িয়ে ছুট্টো ধূসর মাঠ পেরিয়ে
বীজ ভিজে যায় মনের মাটির
সুপ্ত কিছু স্বপ্ন গভীর
গাভীর মত চড়ে আর স্থবির কথা বলে
ভেজা ভয় !
স্বপ্ন নয় !
অক্ষ -আকাশ- ধরা রয় !










ইচ্ছাপূরণ 
শম্পা চক্রবর্তী 


মনকে ডেকে প্রশ্ন করে চোখ,
বরষা দিনে যেমন চেয়েছিলে,
কৃষ্ণ কালো মেঘ,বৃষ্টি-ভেজা গা আর,
উথাল হাওয়ার মিষ্টি দুষ্টুমি?
মনের ঘরে খুশী,
বাড়তি পেলে সবার ঠোঁটে ই হাসি,
অনেক পেলাম, বললো হেসে মন
সবুজ ঘেরা জলের ঢালু পাড়ে 
শালিক খোঁটে কলমি শাকের ডগা।
নাম না জানা কতো ফুলের ঢল,
জলের নীচে মাছের লুকোচুরি,
হঠাৎ করে গাছের দোলা ভুলে,
মাছরাঙা দের ঢেউ-ছোঁয়া খুনসুটি।
বৃষ্টি নাচে পাতার সংগে মিশে।
কিছুক্ষণের জলসা পেলাম যেন! 
গানের ভাষা নাই বা বুঝলো কেউ!
মেঘ সরিয়ে রোদের আবির্ভাবে
কিশোরী মেয়ের বাঁধ না মানা হাসি
গুমোট গরম এসেই বিদায় নেয়।
ঈশান কোণে আবার ঘন কালো
ঠান্ডা হাওয়ায় আবার পোষাক ওড়ে।

চোখের কোণা আলতো প্রশ্ন করে,
হাতে ছিল অন্য হাতের ছোঁওয়া?

মনই বোঝে, ভীড়ের থেকে সরে
মাঝে মাঝে একলা হতে হয়,
সবতো পেলে, নিজের সংগে থেকে।
এক দুপুরে আর কত কি চাও?










দুটি কবিতা
পবন বর্মন 

চুমুর প্যাঁক্
      
গাঢ় মেঘের বোনা ফসল বৃষ্টি
লম্বায় যাই হোক
এক হাত বা এক মানুষ
বৃষ্টির ফসল
পুকুর ভরে ভরেছে গ্রাম বাংলা
উতাল শরীর নগরের ভরা যৌবন
দৃষ্টির সেলফিতে জল আর জল
মেঘ হাসছে চুমুর প্যাঁক্ করে
চুমুর প্যাঁক্ ডেকে আনছে বর্ষা
মেঘের কাশি
  
আকাশ থেকে বৃষ্টি খসতেই
ব্যাঙেরা মিছিল করে বর্ষা নেমেছে  ,
আজ আমাদের গান গাওয়ার দিন !
খাল বিল নদী নালা সব গর্ভবতী ,
কালো বাদলাগুলো আচমকা এসে
কাশিগুলো ছেড়ে গেছে !
খর রোদের তাপে সব রুপ রোগাটে ছিল
বৃষ্টি খসতেই সব সতেজ , একদম তাজা !

কত বীজ ঢাকনা মেলে অঙ্কুরিত
কত চারা শরীর শেকে পরিপুষ্ট !












বিরহিণীর বর্ষা যাপন
দেবপ্রিয়া সরকার

এক আষাঢ়ের ভরদুপুরে
চুল এলিয়ে ছাদের 'পরে
রইলো বসে তন্বী একা
চোখ দুটি তার লোহিত বরণ
মুখ খানিও বিষাদ মাখা l

তার প্রিয়তম এক প্রবাসী
বিরহ ব্যথায় মন উদাসী
হয়নি দেখা, নেইকো কথন
রোদন ভরা প্রণয় যাপন
শোনায় কারে বেদন গাথা? ভাবছে বসে তন্বী একা l

হঠাৎ ভীষণ আঁধার করে
মেঘ ঘনালো আকাশ জুড়ে
বৃষ্টি নূপুর দুই চরণে
বর্ষা এলো মনভুবনে
তার দেহ-মন উজাড় করে ভিজলো সেথা তন্বী একা l

বিষন্নতা উধাও হলো
বৃষ্টি ফোঁটার রূপ ধরে আজ
তার প্রণয়ীর পরশ এলো
সিক্ত হলো, স্নিগ্ধ হলো
বর্ষাধারায় তন্বী একা l

আনলো প্রেমের বার্তা অপার
দূত হয়ে ফের মেঘ মল্লার ........



     





অবগাহনে শশব্যস্ত তিলোত্তমা।
সুপ্রীতি বর্মন।

একচিলতে ছাদ মোর গাঁয়ে বৃষ্টিভেজা সৌরভ মরা গাঙে বানভাসি।
পরিত্যক্ত অভিমানী জমাটি ধুম্র মেঘের ঘনঘটা।
অব্যক্ত বেদনার অস্তরীভূত শিলা জীবাশ্মে শুধু তুমি আমি।
অপাংক্তেয় কনা কনা নির পিছুটানে ধাবিত উচ্ছ্বলিত।
স্তব্ধ পাথেয় শিরা উপশিরা আগমনী সহসা।
প্রচ্ছন্ন নুড়ির টানে জলের বেগ অপ্রতিরোধ্য।
প্রত্যাশা রঙিল বসন্ত রামধনু প্রচ্ছদে বৃষ্টিশূন্য চারদেওয়াল।
দোহে ভাসাই আলিঙ্গনে মরাগাঙে পাল বাঁধা মোর দোয়ারে।
থৈ কুলকিনারা অজানা প্রশ্ন নিরীখে, সুন্দরী তিলোত্তমা বিদগ্ধ হৃদয়ে।
বর্ষনের চুম্বনে অবগাহনে ব্যস্ত থরে থরে সিক্ত ওষ্ঠের পিপাসা।
সকল কিছুর উন্মোচনে ভাসতে লেগেছে কে দেখবে তার মরন।
গুরুগম্ভীর গর্জনে অভিমানী মেঘবালিকা
অভিযোগের ঘ্যাঁনর ঘ্যাঁনর দিয়েছে জুড়ে।
হিসেবী তোলা জল উদব্যস্ত কোলাহল আরো ভরো, আরো ভরো
অভাবের মনকষাকষি পূর্নতা সমীপে অপরিমেয় স্রোত।
গভীরতার কোটরে জমানো অন্ধকার
সমুদ্রের তীর ছুঁয়ে অলেখ্য ঝর্না,
বদ্ধ সুখী ঘরের লৌহকপাট ভঙ্গুর,
দূর্বার বানভাসি গতি ছেলেখেলা করবো করবো বেশ করেছি।
অনিশ্চয়তার দোলাচালে সুন্দরী তিলোত্তমার অবগাহন।
সহসা চমকিত বিদ্যুৎ শিহরিত কম্পিত কায়া
সন্ধ্যামনির তমনিশায় চলছে কোন সিনেমাটোগ্রাফি।








একটি বর্ষামুখর সকাল                                                 
                শিবু


অনেকদিন বাদে বৃষ্টির ক্ষিদে পেয়েছে !

দেখ এক সকালের মধ্যেই কেমন

এক হাঁটু মাঠ-ঘাট-রাস্তা গিলে ফেলল

ধীরে ধীরে কোমর ছাপিয়ে বিছানায়

শুধু জল আর জল.........

আবাসনের জানলায় জানলায় তার অভুক্ত বাতাস ঢুকে পড়ে

চুরি করে আনে আলুদমের গন্ধ তুলনাহীনার হাত হতে

আকাশও সাজিয়ে দিয়েছে ফুলকো লুচির মত মেঘ

বৃষ্টির পাতে ।

বেলা এগারোটা বেজে গেল বারোটাও বেজে যাবে এমনি করে

শিশু কন্যাটি এখনো অঘোর ঘুমে, হয়ত আর একটি

বৃষ্টির স্বপ্ন দেখছে !



                       অন্য কোন দেশে অন্য কোন বেশে !
ঘুম ভাঙাই না ইচ্ছে করেই, ক্ষিধে তো ওর ও পেয়েছে, তবুও

দেখ কি সুন্দর পাশ ফিরে দু’হাতের তালু’তে মাথা রেখে শুয়ে আছে

                                                     স্বপ্নাবেশে।

কাল বিকেলের ডাহুকটি আবার বেরিয়ে এসেছে মাঠের জলে গুটি গুটি পায়ে

এক ঝাঁক নীলগাই উঁকি মারে দূরের ঝোপের আড়াল হতে।

এক ঝাঁক পাখি ডানা ভিজিয়ে উড়ে যায় এক পাড়া হতে অন্য পাড়া !

তবুও একটি একলা ঘুঘু বিদ্যুৎের তারে বসে ভিজতেই থাকে, 

ভিজতেই থাকে

আর শ্রাবণী সেনের কণ্ঠে একটার পর একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে যায়।















অব্যক্ত বর্ষণ
                      
 নিশীথ বরণ চৌধুরী

নিদাঘের তপ্ত দহনে অতীষ্ট জীবন
ঋতুরাণী বর্ষার অভিমানে হয় আগমন।
আকাশে কালো কালো মেঘ দেখে মনে হয়
বিরাট এক পাখি তার ছায়ায় পৃথিবীকে ঢেকে রয়।
তৃষ্ণার্ত মাটির বুকে ঝরে পড়ে বারি পরিপূর্ণ ধারায়,
নদ নদীর অন্তহীন দৌড় পূর্ণ জলোচ্ছ্বাসে,
আসঙ্গ লিপ্সায় ধেয়ে যায় মোহনার বুকে সুখের সঙ্গমে।

গুরু গম্ভীর গর্জন তোলে অরণ্যে শিহরণ,
       নব তৃন দলে উৎসবের আবাহন,
 ধরিত্রীর বুকে সবুজের আহ্বানে প্রাণের সঞ্চরণ।
  সগৌরবে কৃষক ভাই ফসল বোনার ডাকে
  আগামী গ্রাসচ্ছাদনের আশা বাঁধে বুকে।
 আনন্দে বিকশিত কদম ,কেয়া , জুঁই, কামিনী
সর্বত্র প্রাণ আর উচ্ছ্বাসে বর্ষা অভিমানিনী।
  অবিচ্ছিন্ন ধারায় অশ্রু ঝরে মাটির বুকে
   কখনও মুষলধারে, কখনও ঝির ঝির শব্দে।

   উদাস মনে ভেসে আসে নদীর কুলুধ্বনি,
    কখনও পাতার মর্মর কিঙ্কিনী।
  তাল আর নারকেল গাছ দাঁড়িয়ে হাওয়ায় দুলে,
বন্ধনহীন ওরা ,একে অপরের গায়ে গড়িয়ে পড়ে।
 আমার চোখে স্নিগ্ধতার কাজল পরিয়ে,
   মাঠে ঘাটে সর্বত্রই প্রাণের হিল্লোল বহিয়ে,
   জল ও বাতাসের স্বর মিলেমিশে একাকার।
  আপন মনে তুমিও কি আমার ভাবনাতে নির্বিকার?

   সকাল থেকেই বৃষ্টির পালা শুরু,
     শীতল বায়ুতে তপ্ত দহন মরু।
  এমনও বাদল দিনে সংশয় হীন মন চিন্তাশূণ্য,
      এক অব্যক্ত অনুভূতি হৃদয় করে পূর্ণ।
 হর্ষে বিষাদে অনামিক অনুভূতির উপর দাঁড়িয়ে,
     স্মৃতির দর্পণে চমকিত বিদুৎ আবেগে,
       হারানো অতীত দেখা দিয়ে যায় মিলিয়ে।
       রেখে যায় শুধু অব্যক্ত অনুভূতির রেশ,
        ভুলে যায় ক্লান্তি, ক্লেদ আর ক্লেশ।











বরিষ_ধরা
মাম্পি রায়


 খোলা আকাশ পড়ল আঁকা
              মসি মাখা মেঘে ঢাকা
                   উদাসী হাওয়ার নাচন লাগে
                           এ মন আঙিনায়

শিখন তাহার কেকা তানে
     পেখম মেলে কাতর প্রাণে
            অঝোর ধারে বর্ষা রানী
                   আবেগ জুড়ে ধায়

মেঘবালিকার আঁচল তলে
         সুরজ হল বাধা
  ধরিত্রী আজ বর্ষাঋতুর
      বারি ধারায় বাঁধা।।

ব্যাঙ্গমা তার ছাতার নীচে
        সুর বেঁধেছে আপন ধাঁচে।।
              অঝোর ধারে বৃষ্টি পড়ে
                   কচু পাতায় জল ধরে।
                          টিনের চালায় শব্দ করে
                            বৃষ্টি এল স্বজোর জোড়ে।।

টিপ_টিপ, টুপ_টুপ
ছলাৎছল_ছুপা_ছুপ।

আম,জাম টুকব ওলো
    বৃষ্টি _ মুখর ক্ষণে,
দামিনীর ওই দমকা ভরা
    অমোঘ বর্ষণে।।

জল ঝরছে ঝর_ঝরিয়ে
           গাছের পাতা বেয়ে,
              টুপ_টুপাটুপ আওয়াজ ভারি
                  লাগছে মধুর কানে।।
                       ফুল ফুটেছে, ফুল ফুটেছে 
                             ওই পদ্ম দিঘীর ঘাটে
                                  ভানু মামা ডুব দিয়েছে
                                      সূয্যি গেছে পাটে।।

আজ রাঙা মাটি হল পিছেল
       বর্ষা রানীর ধারায়
       চতুর্দিক শীতল হল
        বৃষ্টিভেজা হাওয়ায়।।

বর্ষা রানী আজ সারাদিন 
         স্বজোর ধারে ঝরবে
সে যে পণ করেছে, নিজের কাছে
সবার এ মন ভরবে।।

মাঝি ভায়া পাল 
তুলেছে, হাল ধরেছে
         বাইবে তরী বৈঠা হাতে
                  খেয়া ঘাটে;,,
   ভানু মামা ডুব দিয়েছে
                         সূয্যি গেছে পাটে।







       
 বাদল বাউল
আশিস চৌধুরী

আবার আষাঢ় এলো
তবে বড় দেরি হ'ল তার
মেঘের গুরুগুরু আওয়াজ শুনে
বারান্দায় আরাম কেদারা নিয়ে
বসেছিল যারা
না পেয়ে তার দেখা
তারাও গাইতে শুরু ক'রেছিল
'তোমার দেখা নাইরে, তোমার দেখা নাই' ব'লে


বর্ষায় ভরসা নেই আর
এখন সে ঠিক সময়ে আসে না
ইদানিং বড় অভিমানী হয়েছে সে
আগে এতটা ছিল না


তাই অনেক কাকুতি মিনতি চারদিকে
কত আবাহন, কত যজ্ঞ
কোথাও আবার ব্যাঙের বিবাহ
এ সবই তার মান ভাঙানোর জন্য


শেষমেশ তিনি এলেন
একতারা হাতে নিয়ে
'বাদল-বাউল বাজায় রে একতারা-
সারা বেলা ধ'রে ঝরোঝরো ঝরো ধারা।'   







No comments:

Post a Comment