জীবন তরী
নন্দিনী চৌধুরী
সকাল সাতটা বাজে। রেডিও থেকে ভেসে আসছিল "বর্তমান সমাজে প্রতিবেশীর সাথে দূরত্ব বাড়ার কারণ" বিষয়ে আলোচনা।ঘুম ভেঙে গিয়েছিল আমার। সত্যিই তো, ছোটবেলার পাশের বাড়ির দিদার মতো আজ তো আর কেউ বলে না, "চালতার আচাড় বানিয়েছি,খেয়ে দেখিস তো কেমন হয়েছে।"ফেলে আসা দিনের কথা ভাবতে ভাবতে জানলার বাইৱে চোখ রাখতেই দেখলাম,দূর আকাশ ভেঙে বৃষ্টি আসছে।চারদিক আবছা অন্ধকারে ছেয়ে গেছে।হুড়মুড়িয়ে সেলিমদের কালো ছাগলটার পিছু পিছু তিনটে বাচ্চা চা বাগানের পাকদন্ডি দিয়ে বাড়ির দিকে ছুটছে।আমি উঠে পড়ি। কেবলমাত্র বৃষ্টির কারণে স্কুল বাদ দেওয়া যাবে না। অভাব পীড়িত, জীবনের মৌলিক চাহিদা থেকে বঞ্চিত অনেক গুলো ছোট ছোট বাচ্চা স্কুলের আঙ্গিনায় জমা হবে। ওদের জন্য আমি অনেক কষ্টকে স্বীকার করতে পারি। তৈরি হয়ে বেড়িয়ে পড়ি স্কুলের যাবার জন্য।বৃষ্টি পড়ছে। আকাশ গম্ভীর মুখ করে জল ঝরিয়ে চলেছে। মাঝে মাঝে আকাশের শরীর জুড়ে খেলে যাচ্ছে বিদ্যুৎ-এর সোনালী আলোর আঁকিবুঁকি। আমি দ্রুত পা চালাতে শুরু করি। হাওয়াই চটির জল ছিটছে শরীরে আমার। ছাতা বেঁকে যাচ্ছে। কাঁধ থেকে ব্যাগটা বারবার পড়ে যেতে চাইছে। অাধ-ভেজা শাড়ি নিয়ে আমি যখন স্কুলেৱ বারান্দায় পা রাখলাম ঠিক তখনই একসাথে কতগুলো কচি কন্ঠ বলে উঠল "গুড মর্নিং ম্যাম"। যেন একসাথে আনন্দে ছটফট করতে করতে এক ঝঁক পাখী উড়ে গেল আষাঢ়ের বৃষ্টিভেজা গোমড়ামুখো আকাশে। আমার মনে বৃষ্টির সাত সুর ঝনঝনিয়ে বেজে উঠল। দূরে তাকিয়ে দেখলাম চা বাগান, শালবন, নদীর পাড়ের নাম না জানা গুল্মলতাদের ভিজিয়ে দিয়ে বৃষ্টি পড়ছে অঝোর ধারায়। ঝাপসা হয়ে গেছে চারিদিক। জানলা দিয়ে বৃষ্টির ছাট এসে লাগছে আমার চোখে মুখে। গীর্জায় বাজছে "পাপ ছমা মিলি এ ধরম ডোঙা মে। হায় রে ধরম ডোঙা চলে লাগল ধীরে ধীরে" অর্থাৎ "আমাদের জীবন তরীতে পাপ ক্ষমা দুই ই স্থান পায়। পাপ কে ক্ষমা করে এই জীবন তরী ধীরে ধীরে এগিয়ে যায়।" দূর থেকে ছাতা মাথায় সাদা সুটান পরে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছেন ফাদার পিটার পাপ্পু।
(মুজনাই অনলাইন আষাঢ় সংখ্যা)
No comments:
Post a Comment