আন্তর্জাতিক কবিতায় বাঁকবদল & বাংলা কবিতায় তার প্রভাব ও সমকালীন সময়ে রবীন্দ্রকাব্য
-------------------------------------------------------------------
বিশ্বকবিতার শুরু ও সভ্যতার সাপেক্ষে তার মূল পর্যায় এবং কবিতার শুরুর দিনগুলি (পর্ব - ৫)
:
:
বিষয়টি শুরু করার আগে, বরং ১টা গল্প ছোটো করে বলা যাক।এক প্রকৃতি-প্রেমিক ভদ্রলোক পাহাড়ে উঠতে গিয়ে হঠাৎ পড়ে গিয়ে, একটি স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি হলেন।প্লাস্টার করার পর, বেশ কিছুদিন পর থেকেই ওনার মনখারাপ।কারণ, কেবিনে উনি একা এবং একঘেয়ে শুয়ে থাকা ছাড়া, কোনো কাজ নেই।তিনি ঠিকমতো ঘুমতে পারেন না, ব্যথায় কষ্ট পান।ফলে স্বাস্থ্যেরও উন্নতি আর এগোয় না।এরকমই এক অবস্থায়, আরেকটি রুগী তাঁর প্রতিবেশী হয়ে পাশের বেডে আসেন।কথাবার্তায় জানা যায়, রুগীটির মাথা ব্যথার অসুখ।দুজনেই এক ঘরে, সুতরাং গল্প হতেহতে তাঁরা দুজনেই অল্প সময়েই বন্ধু হয়ে যান।দ্বিতীয় ভদ্রলোকের মাথার কাছে, একটা জানলা ছিলো।তিনি সেই জানলা দিয়ে মাঝেমাঝে চোখে দেখা দৃশ্যগুলি, প্রথম ভদ্রলোককে গল্পের মতোন করে বলেন।দূরে একটা গাছ / বিকেলে পাখিরা এসে বসেছে / গাছের তলায় একটা জলাশয় / সেখানে একজোড়া তরুন-তরুনী বসে আছে / তাদের পরস্পরের হাত পরস্পরের হাতে / ইত্যাদি।প্রকৃতি প্রেমিক ভদ্রলোক এসব শুনে আনন্দিত হন।দেখা যায়, তিনি সুস্থ হয়ে উঠছেন দ্রুত।এভাবে চলতে চলতে, একদিন রাতে দ্বিতীয় ভদ্রলোকের মাথায় অতিরিক্ত যন্ত্রণা হওয়ায়, তাঁকে ওটিতে নিয়ে যাওয়া হয়।সকালে উঠে, প্রথম ভদ্রলোকটি তাঁকে দেখতে না পেয়ে খুব বিস্মিত হন।বেলায় ডাক্তার এলে, যখন উনি ডাক্তারকে দ্বিতীয় ভদ্রলোকের কথা জিজ্ঞেস করেন : জানতে পারেন, দ্বিতীয় ভদ্রলোকটি মাথায় রক্তক্ষরনের অসুখে ভুগছিলেন এবং তা এতোটাই মারাত্মক ছিলো যে বিগত ৩মাস ধরে তিনি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন।আগের দিন রাতে, তাঁর অপারেশন হয় এবং তিনি সেখানে মারা গেছেন।একথা শুনে প্রথম ভদ্রলোক আরো বিস্মিত হয়ে যান এবং ভাবতে থাকেন, একজন অন্ধ মানুষ জানলায় চোখ রেখে কিভাবে বানিয়ে বানিয়ে অতো দৃশ্যের গল্প বলতে পারেন।
ওপরের গল্পের মতো এরকম ঘটনাও আছে যে, এক জিনিয়াস ফিল্ম ডিরেক্টর অসুস্থ অবস্থায়, নাম করা নায়ককে পরবর্তী ছবির স্ক্রিপ্ট শুনিয়ে, হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গেছেন।নায়কটি পরিচালককে হাসপাতালে ভর্তি করে, বাড়ি ফিরে আসেন এবং বিস্মিত হয়ে যান পরিচালকটির রেখে যাওয়া হাতের স্ক্রিপ্টটি দেখে, কারণ সেগুলো ছিলো কয়েকটি সাদা কাগজের পাতা।
আসলে, গল্পগুলো যার ওপর দাঁড়িয়ে আছে তা হলো কল্পনাশক্তির প্রবণতা।কোভিড্ শুধু নয়, সভ্যতার শুরু থেকেই যেকোনো দুর্যোগে মানুষ বেঁচে আছে সৃজনশক্তির ওপর নির্ভর করে।যার নেপথ্যে রয়েছে কল্পনা প্রবণতা।সহজ কথায়, আজ যা হচ্ছে তা দেখাটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং এই দেখাটির নেপথ্যে থাকা চালিকাশক্তিকে অনুভব করে, তার সাপেক্ষে দেখা ভবিষ্যৎ দৃশ্যটির রূপকল্প গড়ে তোলা, অর্থাৎ কী ঘটতে পারে তার অনুমান।শিল্প কখনোই কোনো কিছু execute করতে পারে না।অতএব, শিল্পীর কোনোদিন executer হবার দায় নেই।আর কবিতা যেহেতু highest absurd form of the art, তার নির্মাণ প্রভাবটিও সর্বদা অদৃশ্য ও আত্মিক অভিমুখীন।তবে, যাঁরা executer তাঁরা যে চালিকাশক্তির হদিশ কবিতা থেকেই পেয়ে থাকেন, এর উদাহরণ পৃথিবীর প্রতিটি জিনিয়াসের জীবনপঞ্জিতে পাওয়া যায়।আমরা বলতেই পারি, কবিতা হলো এমন একটা কল্পনাপ্রবণতা যা, সেই অন্তর্মুখী চালিকাশক্তির প্রেরণা।তবে, একথাও ঠিক কেবলমাত্র কল্পনাশক্তি থাকলেই যে, সেই প্রেরণাটির তা প্রকাশিত চালক হতে পারবে, তার ঠিক নেই।এর জন্য চাই কল্পনাশক্তির নিরন্তর চর্চা, যাপনে এবং মননে।আর তা করার জন্য দরকার, ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে প্রতিনিয়ত ঘটে চলাগুলোর ওপর প্রকৃত পর্যবেক্ষণ।যা একজন গবেষক পালন করে যান আজীবন।যে পথের নির্মিতি খোঁজেন সন্ন্যাসী।
গুহামানুষ যখোন সর্বপ্রথম 'লেখনী' ব্যবহার করলো, কেউ কি জানতো : একটি বিন্দু থেকেই চিত্র (painting) / অক্ষরমালা থেকে সাহিত্য (literature) / চলচ্চিত্র (cinema) / ইত্যাদি দৃশ্যশ্রাব্য মাধ্যমগুলি বিকশিত হয়ে উঠবে, এমনকি স্বর থেকে বিকশিত হবে লয়/সুর, পরে সুর ও সাহিত্য মিলে সঙ্গীত।পরবর্তী পর্যায়ে ~ দখলদারি বিষয়টিকে আয়ত্তাধীন করার পর, অবশ্য যে অধিকারতন্ত্র / ইত্যাদির সৃষ্টি হয়, তা যদিও অস্বীকার্য নয়।তবুও, বিকাশের স্তরটির গতানুগতিক ধারাটিকে, কোনোরকমের বাহ্যিক প্রভাবমুক্ত হয়েও যুক্তিগ্রাহ্যরূপে ব্যাখ্যা / বিশ্লেষণ করার চেষ্টা যে একেবারেই করা যাবে না, এমনটাও নয়।
কবিতা বিকাশের বিভিন্ন স্তরগুলিকে মোটামুটিভাবে আমরা আপাততো পাঁচটি (৫টি) পর্যায়ে রাখতে পারি।তা অনেকটা এরকম : (১) আদি পর্ব (গুহাচিত্র থেকে রেঁনেসা যুগ), (২) মধ্য পর্ব (রেনেসাঁ পরবর্তী থেকে শিল্প বিপ্লব), (৩) উত্তর পর্ব (শিল্প বিপ্লব থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ), (৪) উত্তরোত্তর পর্ব (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পর্ব থেকে প্রাক তথ্যপ্রযুক্তি আবিষ্কার), (৫) তথ্যপ্রযুক্তি পর্ব।এবার আসুন, আরো একটু সুবিধার্থে বরং সালের নিরিখে বর্ণিত সময়গুলোকে সাজানো যাক।তা অনেকটা এরকম : (১) আদি পর্ব (শুরু থেকে আনুমানিক ১৬০০ খ্রীষ্টাব্দ), (২) মধ্য পর্ব (১৬০০ খ্রীষ্টাব্দ থেকে আনুমানিক ১৮৫০ খ্রীষ্টাব্দ), (৩) উত্তর পর্ব (১৮৫০ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৯৫০ খ্রীষ্টাব্দ), (৪) উত্তরোত্তর পর্ব (১৯৫০ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৯৮০ খ্রীষ্টাব্দ), (৫) তথ্যপ্রযুক্তি পর্ব (১৯৮০ খ্রীষ্টাব্দ থেকে চলছে)।যদিও, এসব তথ্যতারিখ নিয়ে বহু বিতর্ক আছে, তা সত্ত্বেও একটা সুনির্দিষ্ট গ্রাফিকাল রূপ ছাড়া এগোনো কঠিন।
কবিতার আদিপর্ব সম্পর্কে আলোচনা করার আগে, উপরে বর্ণিত ক্রমপঞ্জিটি নিয়ে একটি বিশেষ ক্ষেত্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে ~ আদি পর্ব বা মধ্য পর্বে কবিতার বিকাশ যতোটা সময় নিয়ে ঘটেছে, পরবর্তী দুই পর্যায়ে কিন্তু তার বিকাশহার অনেক বেশি।অর্থাৎ, শুরুর দিক থেকে যতো এগিয়েছে ~ কবিতার বিকাশ ঘটেছে, অতি দ্রুত হারে।শেষ পর্বটিতে (তথ্যপ্রযুক্তি পর্ব) যদিও, এই দ্রুততাহার কিছুটা কম মনে হচ্ছে : কথাটি কিন্তু একেবারেই আপেক্ষিক।কারণ, বেশ কিছু উপপর্বে বিভক্ত রয়েছে এই পর্বের সময়কাল।তবে সেগুলো এখনিই লিপিবদ্ধ করছি না।আদি পর্বের সাথে, আরো কিছু আলোচনা করা সমান্তরালভাবে আবশ্যিক, সেগুলি হলো : লিখন মাধ্যমের বিবর্তন এবং আদিযুগের কয়েকটি মহাসভ্যতা।আসলে, প্রযুক্তি যেভাবে সময়ের সাপেক্ষে যাপনকে প্রভাবিত করে, অতএব সেহেতু যাপন সংক্রান্ত যাবতীয় মাধ্যমগুলিরও স্বভাব পরিবর্তন সুনিশ্চিত।আর, কবিতা যেহেতু যাপন সম্পর্কিত একটি দৃশ্যশ্রাব্য প্রকাশভঙ্গী, সেহেতু এটি যে প্রত্যক্ষভাবে প্রযুক্তি ফ্যাক্টরটির ওপর নির্ভরশীল ~ তার কিছুটা সাময়িক প্রমাণ, বিকাশের দ্রুততাহার থেকেই যুক্তিযুক্তভাবে পাওয়া যাচ্ছে।তবে, এই বিষয়গুলির আরো বিশ্লেষণ নিয়ে সামনের পর্বে সরাসরি।শিরোনাম দিতেই পারি "কবিতার শুরু, পৃথিবীর প্রথম কবিতা ও কবি"
শব্দরূপ : রাহুল গাঙ্গুলী
No comments:
Post a Comment