মুজনাই
অনলাইন চৈত্র সংখ্যা ১৪৩০
সম্পাদকের কথা
সামান্য সময়। একটি ঘূর্ণিঝড়। মুহুর্তে তছনছ বিস্তীর্ণ এলাকা। বিধ্বস্ত মানব জীবন। বর্ষশেষে কেউই ভাবিনি এরকম একটি ভয়াবহ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হবে আমাদের। মুজনাই সমবেদনা ও সহমর্মিতা জানায় এই ঝড়ে যাঁরা সব হারিয়েছেন তাঁদেরকে। মুজনাই তার বিপুল সংখ্যক পাঠক ও শুভানুধ্যায়ীদের কাছে আবেদন রাখে এই মানুষগুলির পাশে দাঁড়াতে।
ইতিমধ্যেই সারা দেশে সাধারণ নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। বাংলা নববর্ষের শুরু থেকেই মাসাধিক কাল ছবি নতুন সরকার নির্বাচনের প্রক্রিয়া। জনমত নিয়ে যাঁরা আসবেন, তাঁদের অগ্রিম শুভেচ্ছা জানায় মুজনাই। একই সঙ্গে আশা করে দেশের সার্বিক উন্নতির। আগামীদিনে মুছে যাক ধনী-নির্ধনের ব্যাপক পার্থক্য, প্রকৃত শিক্ষার আলোয় আলোকিত হোক প্রান্তিক স্তরের শিশুরা, নিরন্নের মুখে উঠুক সুষম আহার। নতুন বছরের কাছেও চাওয়া এটুকু।
বছর শেষের সঙ্গে সঙ্গে অবসান যা কিছু জীর্ণ, স্থবির ও পুরোনো। নব ভাবনায় নব দিনে উদ্ভাসিত হোক আমাদের সবার অন্তর। ভাল থাকি সবাই মিলে।
মুজনাই অনলাইন চৈত্র সংখ্যা ১৪৩০
রেজিস্ট্রেশন নম্বর- S0008775 OF 2019-2020
৭৩৬১০১
ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com (মাসিক অনলাইন)
প্রকাশক- রীনা সাহা
সম্পাদনা, প্রচ্ছদ, অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায়
মুজনাই অনলাইন চৈত্র সংখ্যা ১৪৩০
এই সংখ্যায় আছেন যাঁরা
উমেশ শর্মা, বেলা দে, শ্যামলী সেনগুপ্ত,
গৌতমেন্দু নন্দী, শ্রাবণী সেনগুপ্ত, পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়,
প্রতিভা পাল, দেবযানী সেনগুপ্ত , দেবদত্তা লাহিড়ী ,
ঋতুপর্ণা ভট্টাচার্য, জয়তী ব্যানার্জী ,অশোক কুমার ঠাকুর,
লীনা রায়, লিপিকর, শর্মিষ্ঠা,
সঞ্জয় এস. সাহা, স্বপন কুমার দত্ত, রীনা মজুমদার,
অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী, হেমন্ত সরখেল,
নবী হোসেন নবীন, মজনু মিয়া, রেজাউল করিম রোমেল,
পাপু মজুমদার , সারণ ভাদুড়ী , চিত্রাক্ষী রায়,
আকাশলীনা ঢোল, অর্পিতা রায় আসোয়ার
ক্রোড়পত্র
হাত বাড়াও ভাই
উমেশ শর্মা
হাত বাড়াও ভাই
শাসক তুমি শোষক তুমি
শুষছো গোটা দুনিয়াটাই।
শতকরা একজন তুমি
বাকি জনগণ
ভোট লুটে তুমিই রাজা
(আমরা) প্রজা সারাক্ষণ।
হাত বাড়াও ভাই
নতুন বছরে হও না তুমি
নতুন হাতেম তাই।
কিছু কথা বাকি রয়ে গেল...
শ্যামলী সেনগুপ্ত
কী যেন কথা ছিল
বলব বলব করে
ফিরেছে দিন
কত যে গোধূলী বেলা
আলতা রঙিন আকাশ
দেখে দেখে ভেবেছি
এবার বলি
ও আকাশে সিপিয়া রং
সন্ধেটি আরও ঘন
বলব বলে সবে দু'ঠোঁট জড়ো
তখন একলা কাক
সপাটে ঝাপটে পাখা
আকাশ পেরলো
চমকে সেদিকে চাওয়া
সেখানেই থেমে যাওয়া
ঠোঁট দুটি খোলা
আর দৃষ্টি অবাক
রাত্রি নেমেছে দেখে
নোনাবালিজল মেখে
ফিরে আসার
সেই স্মৃতিটুকু থাক।
গল্পের হালখাতা
বেলা দে
রাত এসে কখন যেন
ঝুপ করে দাঁড়িয়ে পড়ে পাশে
সাধের বাগিচায় সার, জল দিতে দিতে
টেরই পাইনি দিবাকর নিশিঘুমে ডুবেছে,
পাইনের মগডাল থেকে ঝিঁঝিঁ পোকার
রেওয়াজি গান।
পাহাড় ছুঁয়ে সন্ধ্যা নেমে আসে
সমতলের তুলসী উঠান,
গল্পের ছেড়া ঝুলি হাতড়ে
বের করে ফেলি বিগতকালের পান্ডুলিপি,
কী হবে ওগুলো স্মৃতিঝোলায় পাথর করে।
তার চেয়ে বরং ভাসিয়ে আসি স্রোতস্বিনী জলে
চিরতরে ডুবে যাক কালের অতলে।
নতুন দিনের আলোয় আবার
শুরু হোক গল্পের হালখাতা।
বর্ষ শেষের প্রত্যাশা
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়
একটা করে দিন ফুরিয়ে যায় আর সেই সাথে সাথে একটা করে বছর গড়িয়ে যায়।
অমরত্ব লাভের আশায় প্রতি মুহূর্তে ফুরিয়ে যাওয়া জীবনের, এক একটা দিন কমার সাথে সাথে, জীবন থেকে আনন্দ, আল্লাদ, আশা আকাঙখার অনুভূতি গুলো ক্রমশ অবলুপ্তি ঘটে চলেছে। তবু্ও আশাই তো জীবনে বেঁচে থাকার একমাত্র রসদ। আশাই নবীন প্রবীণ সবাই কে একসুত্রে বাঁধতে সহায়তা করে। বর্ষ শেষে তবুও অজানা কোনো এক কারণে মনটা ভালো হয়ে যায়।
কলেজ জীবনের এক ঘনিষ্ট বন্ধু জানতে চাইতো, আগামী নতুন সালটা চোদ্দ'শ কত? একথা অস্বীকার করবার কোন উপায় নেই যে আমরা বাংলা ক্যালেন্ডারের পয়লা বৈশাখ এবং ২৫ শে বৈশাখ বাদে অন্য তারিখ গুলো সম্পর্কে আমরা অনেকেই খোঁজ খবর রাখি না।
আশা থেকেই প্রত্যাশার জন্ম হয়। প্রত্যাশা বা স্বপ্ন দেখার কোন সীমা না থাকলেও মনে প্রাণে চাই, অতিমারির মত ভয়ংকর দিন যেন আমাদের আর না দেখতে হয়। আমরা অনেকেই ঈশ্বর বিশ্বাসী। করোনা ভাইরাস মানুষের সৃষ্টি তাই এ বিষয়ে ঈশ্বরকে অযথা দোষারোপ না করাই শ্রেয়।
বর্ষশেষের সর্বপ্রথম প্রত্যাশা হওয়া উচিৎ মানুষের মূল্যবোধের বিকাশ। এই প্রজন্মের মূল্যবোধ তলানিতে এসে ঠেকেছে। এরা গুরুজন বা ঈশ্বর, কাউকেই ভয় পায় না। জলপাইগুড়ির মতো সংস্কৃতিমনস্ক শহরে হোলি উৎসবে চার কোটি টাকার মদ বিক্রি হয়েছে। সংবাদপত্রে সে খবর বড় করে ছাপা হলেও, বইমেলায় কত বই বিক্রি হয়েছে, সে তথ্য কখনোই সংবাদ হয় না। এ বিষয়ে সরকার বা প্রসাশন এর দায় অস্বীকার করবার কোন উপায় নেই। নারী ধর্ষণ, খুন, অশ্লীলতার বিষয় গুলো জিরো টলারেন্স হওয়া একান্ত ভাবে কামনা করি।
পরিশেষে ভারতবর্ষের মতো গনতান্ত্রিক দেশে, গনতন্ত্র শব্দটাই পরিহাসের বিষয় হয়ে পড়েছে। এই বিষয় নিয়ে এখনই সদর্থক ভাবনা না ভাবলে ভবিষ্যতে গৃহযুদ্ধের আকার নিতে পারে, সেই অশনি সংকেতের কথা বর্ষশেষে না উচ্চারিত হওয়াই ভালো।
বর্ষশেষ ও বর্ষশুরুর ভাবনা
ঋতুপর্ণা ভট্টাচার্য
বর্ষশেষ আর বর্ষশুরুর সন্ধিক্ষণ এক ক্রান্তিকাল। এমন সময়ে সাধারণত প্রতি বছরই যে চিরাচরিত স্বাভাবিক ভাবনাগুলো মনে নাড়া দিয়ে থাকে, যেমন, গত বছরটির তুলনায় এ বছরে যেন আরও একটু এগোতে পারি, তা সে ব্যক্তিগত সামাজিক কি কাজের জগৎ যে পরিসরেই হোক না কেন, অথবা, গত বছরে জীবনে যে ইচ্ছাকৃত এবং অনিচ্ছাকৃত ভুল ভ্রান্তি ত্রুটিগুলো ঘটে গেছে, এ বছরে যেন কোনমতেই আর তার পুনরাবৃত্তি না হয়! এ বছরে হয়তো নতুন রকমের কোনও ভুল করতে পারি, কিন্তু পুরনো ভুলের থেকে শিক্ষা নিয়ে এই নতুন ভুলটি যেন তিলেকমাত্র হলেও গুণগত দিক দিয়ে গতবারের চেয়ে একটুখানি এগিয়ে থাকে! হাজার হোক, তিল তিল করে সামনের দিকে এগিয়ে চলার নামই তো জীবন!
আজকাল চারিদিকে থেকে থেকেই দমকা চৈতি হাওয়ার ঝাপটা মনে করিয়ে দিচ্ছে আরও একটা গোটা বছর শেষমেষ পেরিয়েই গেল! ক’দিন বাদেই নববর্ষ! পুরনো সব অপ্রাপ্তি অক্ষমতা অসাফল্যের মনখারাপকে পেছনে ফেলে নতুন আশায় বুক বেঁধে আবারও একবার সামনের দিকে তাকানোর পালা। ব্যক্তিগত দিক দিয়ে দেখতে গেলে গত বছরটা দু’হাত ভরে অনেকটা যেমন দিয়েওছে, তেমনই এক ঝটকায় আশাতীতভাবে একান্ত এক প্রিয়জনের অসময়ের মৃত্যুর মতো অনেক বেশি কিছু জীবন থেকে ছিনিয়েও নিয়েছে। এটাই যদিও জীবন, তবুও এ যেন কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না! মুশকিল হল ঈশ্বরের ইচ্ছের ওপর তো জোর চলে না, তাই কোনও কোনও ক্ষতি অপূরণীয় হলেও শেষ অবধি জীবনের সাথে একরকম সমঝোতা করে নিতেই হয়। পাওয়া আর হারানোর দাঁড়িপাল্লার নির্দয় হিসেবটা তাই এবার বছরশেষে এসে বড্ড বেশি করে চোখে আঙ্গুল দিয়ে যেন জীবনের সেই চিরকালীন অনিত্যতাকেই আবারও মনে করিয়ে দিয়ে গেল। তবে জীবনের যাবতীয় কষ্ট গ্লানি শূন্যতা থেকে বেড়িয়ে আসার একমাত্র উপায় বোধহয় আবার সেই জীবনেই ফেরা। এবং সেই অমোঘ শর্তেই নানা কাজ অকাজের ব্যস্ততায় ডুবে থাকতে থাকতে চৈত্রের মাঝামাঝি হঠাৎই একদিন সুযোগ এসে গেল পাহাড়ে যাবার। এমনিতেই সমতলে একটানা বেশিদিন থাকলে নিজের ভেতরেই হাঁফিয়ে উঠি আমি, এবং পাহাড়ে যাওয়ার অজুহাত খুঁজতে থাকি ফাঁক পেলেই, তবে এবারে সেই একান্ত মানসিক তাগিদের সাথে সাথে একটুখানি কাজেরও যোগাযোগ ঘটে গেল। কাজটি ছোট এবং দুপুরের দিকে, ফলে দিনের প্রথম ভাগের অনেকটাই আমার হাতে। এসব ক্ষেত্রে আমি ইচ্ছে করেই নিজস্ব গাড়ির বদলে শিলিগুড়ি জংশনে গিয়ে শেয়ারের গাড়িতে করে পাহাড়ে যেতেই বেশি আগ্রহী। কত নতুন মুখ দেখা যায়, কত নতুন গল্প শোনা যায়, কত নতুন স্মৃতি জমে ওঠে! এবং, এবারেও দেখলাম এ নিয়মের ব্যতিক্রম হল না। গাড়ির যাত্রীরা একান্তে বা নিজেদের মধ্যে মশগুল থাকলেও এ যাত্রাপথের এক আশ্চর্য আবিষ্কার আমাদের শেয়ার গাড়ির পাইলট মহাশয় স্বয়ং, কোঁকড়ানো সদা হাস্যময় মুখের পঞ্চাশোর্ধ প্রাণোচ্ছল যুবক প্রধানজী! কি ভীষণরকম ক্লান্তিহীন, আমুদে, আর, জীবনমুখী মানুষটা! ব্যক্তিগত সাংসারিক হাজারো সমস্যা, রোজকার এই মাকুর মতোন একঘেয়ে জীবনের ঘানি টেনে চলা আর প্রতিদিন পাহাড়ে ওঠানামার দারুণ ধকল সামলেও অনিশ্চিত সামান্য একটা নিয়মিত রোজগার, কোনও কিছুই তাঁর মুখের অনাবিল শিশুসুলভ হাসিটা কেড়ে নিতে পারেনি! আগে দু দুবার গাড়ির কুলার খারাপ হয়ে যাওয়ার পর আর না কেনায় এখন জল ঢেলে ঠান্ডা করে করে গাড়ি চালাতে হয়। তাতেও নো পরোয়া। পাহাড়ি রাস্তার ধারের কোনও একটা খাবার দোকানের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে জল নেবার সময়ে আবার অক্লেশে তাদের রান্নাঘরেও ঢুকে যান প্রধানজী তাঁর সহযাত্রীদের জন্য চা কফি বানাতে। মুখের মিল থাকার দরুণ আবার এই আমাকেই নেপালি ভেবে খানিকক্ষণ তড়বড়িয়ে নেপালি বলার পর ওনার ভুল ভাঙিয়ে দিতে হেসেই অস্থির। ভাষাটি না জানার অক্ষমতা আমি বারবার মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করে নেবার পরও নিজে থেকেই জোর করে সারা রাস্তা আমাকে নেপালি শেখানোর কি আশ্চর্য নির্মল উৎসাহ! আবার কোনও দিন যদি ওঁর গাড়িতে আসি সেজন্যে ওনার ফোন নম্বর নিতে গেলেই পাল্টা দেখি আমার নামটি উনি সেভ করে নিলেন থাপা বৌদি বলে! নইলে নাকি মনে থাকবে না! সময়মতো দার্জিলিঙ পৌঁছে ওঁকে ছেড়ে দেওয়ার পর বারবার শুধু একটা কথাই মনে হচ্ছিল, যেতে যেতে এ বছরটা একটা বেশ আশ্চর্য শিক্ষা দিয়ে গেল কিন্তু! এই সময়ের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দৈনন্দিনতার দারুণ জটিলতার মধ্যেও কিছু মানুষ কি অদ্ভুত জাদুবলে তাদের ভেতরের সরল শিশুমনটাকে বাঁচিয়ে রেখেছে! কতটা পারব জানিনা, তবে সময়বিশেষে অন্তত তাঁদের মতোন সহজ থাকার চেষ্টাটুকু আগামীতে নিশ্চয়ই করব, প্রধানজীকে বিদায় জানাবার আগে এই ছোট্ট প্রতিজ্ঞাটা নিজের সাথেই নিজে করে ফেললাম হঠাৎই। ভালোর শক্তি বোধহয় এতটাই যা বহুদিনের জমে থাকা বিপুল খারাপের পলিকেও খুব সহজেই ধুইয়ে নিয়ে যেতে পারে!
দার্জিলিঙের কাজ সেরে একটু ঘুরে টুরে বাড়ি ফেরার পথে একবার কার্শিয়াং ট্যুরিস্ট লজে ঢুকলাম বিকেলের জলযোগ সারতে। বেশি কিছু নয়, এক ঝলকে মেনুকার্ডে চোখ বুলিয়ে এক প্লেট ফিশ ফিঙ্গারের অর্ডার করলাম ঝটপট। রবিবার হওয়ায় সন্ধ্যে হলেও রেস্টুরেন্টে ভিড় বেশ ভালোই। অথচ সে তুলনায় বেয়ারার সংখ্যা একটু অপ্রতুল মনে হল আজ। মূল শহরের প্রধান রাস্তার ঠিক ওপরেই এই পুরনো আমলের সম্পূর্ণ কাঠের তৈরি নয়নাভিরাম লজটি সরকারি তত্ত্বাবধানে হওয়ায় দৈনিক ঘরভাড়া যথেষ্ট সন্তোষজনক, ফলে লোকসমাগম বছরভর। এই রাস্তা দিয়ে গেলে মাঝেমধ্যেই এখানে নেমে একটু আধটু জলযোগ করার অভ্যাস আমার বহুদিনের। তবে আজ দেখলাম স্বাভাবিকের থেকে একটু বেশিই দেরি হচ্ছে এদের সার্ভ করতে। অস্থির হয়ে প্রায় মিনিট পঁয়তাল্লিশ পর তাই বেয়ারাকে ডেকে চেপে ধরতেই সত্যিটা জানতে পারলাম। আভ্যন্তরীণ কিছু অসুবিধার কারণে গত দেড়দিন ধরে বাজার করতে পারেনি এরা, তাই মাছ নেই ফ্রীজে! অগত্যা বাধ্য হয়ে চিকেন ফিঙ্গারের ব্যবস্থা করছে। আমি তো হতবাক! ব্যাপারটা আমাকে জানাবে তো! এতক্ষণ বসে আছি! বিরক্ত হয়ে দু’কথা শুনিয়ে উঠে যাব যাব করছি, হঠাৎই আমার উল্টোদিকের টেবিল থেকে এক ভদ্রলোক উঠে এলেন। হাতে ওনাদের ওখানে সদ্য সার্ভ করা একটা ফ্রায়েড চিকেন মোমোর ডিশ। কাছে এসে আমাকে সম্পূর্ণ আশ্চর্য করে দিয়ে স্নেহভরা গলায় বলে উঠলেন,“ আপনার অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে বুঝতে পারছি। তবে আমরা তো এখানে ক’দিন ধরে আছি, তাই অবস্থাটা জানি। কোনমতে চালাচ্ছে। কাল সোমবার আবার বাজার হবে। যতক্ষণ আপনার ডিশটা না আসে আপনি আমাদেরটা একটু টেস্ট করুন। এদের মোমোটাও খুব ভাল!”
এরপর আর রাগ করে থাকা অসম্ভব। ভদ্রলোক ও ওনার সঙ্গীদের সাথে বেশ আলাপ হয়ে গেল। ওনারাও শিলিগুড়ির লোক। প্রায় সপ্তাহান্তেই এখানে আসেন সময় কাটাতে। গল্প করতে করতেই প্রায় মিনিট দশেক পরে আমার চিকেন ফিঙ্গারের ডিশ এলে ওনাদেরও অফার করলাম। সানন্দে গ্রহণ করে তারিফ করলেন মুক্তকণ্ঠে। অতঃপর সবার থেকে বিদায় নিয়ে বেড়িয়ে এসে বাড়ির পথ ধরলাম আমি। মনে তখনও এক অদ্ভুত ভালোলাগার রেশ বিন বিন করছে। আর হ্যাঁ, আরেকটি কথা না বললেই নয়, যেহেতু আমার পছন্দের ডিশটি ওরা আমাকে তখন সার্ভ করতে পারেনি, তাই চিকেন ফিঙ্গারের ডিশটি ছিল কমপ্লিমেন্টারি! বর্ষশেষের মাত্র একটা সন্ধ্যের ঘটনা, কিন্তু সেটুকুই অভাবিতভাবে শিখিয়ে দিয়ে গেল চারপাশের এত অন্ধকারের মধ্যেও কোথাও কোথাও স্বাভাবিক মানবতাবোধ আর সৌজন্যবোধ আজও কি অমলিনভাবে বেঁচে রয়েছে! পুরনোকে ছেড়ে নতুনে পা রাখার প্রাক্কালে এর চেয়ে বেশি আশার ব্যাপার আর কিই বা হতে পারে!
ফিরতি পথে কার্শিয়াং পাহাড় থেকে নামতে নামতে হঠাৎ দূরে উল্টোদিকের পাহাড়ে চোখ পড়তেই আবারও সেই খণ্ড দৃশ্যগুলো চোখে পড়ল। রাতের নিকষ কালো ভেদ করে কুচি কুচি পাহাড়ি ঘরবাড়ির চিকচিকে আলোর পাশাপাশিই কিছু জায়গায় প্রবল চৈতি হাওয়ার দাপটে লেগেছে ভয়ংকর আগুন। আজকাল অবশ্য বনবিভাগ থেকেই নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় এ আগুন লাগানো হয় যাতে পুরো পাহাড়ে না আগুন লেগে যায়! লেলিহান সেই দাবানলের উন্মত্ত শিখা পাহাড়ি জঙ্গুলে গাছের গায়ে ঘষা খেয়ে উড়ে উড়ে ছড়িয়ে পড়ছে দূর থেকে দূরে। অদ্ভুত সুন্দর অথচ ভয়াল এই ছবি যেন সত্যিই সব পুরনোকে অগ্নিতাপে ভষ্মীভূত করে নতুনকে আহ্বান জানানোরই ঐশ্বরিক প্রতীক। কিছু কিছু দৃশ্য কত গভীর অনুভূতি কি সহজেই না ব্যক্ত করে দেয়! বৎসরান্তে এবার সব পুরনো যাক নিঃশেষে ছাই হয়ে উড়ে, হে নতুন বছর, স্বাগত!
দিন পুরাতন, দিন নতুন
দেবদত্তা লাহিড়ী
দিন পুরাতন চলে যায় তবু দিন নতুন আসে কই। নতুনের মাঝে পুরাতন যে জড়িয়ে থাকে তাকে অস্বীকার করতে পারি কই। আমরা নতুন এলো নতুন এলো বলে বরণ ডালা যে সাজাই তার মধ্যেই অপেক্ষায় থাকি আশায় থাকি যা পুরনো দিনে ঘটেনি তা ঘটুক বলে। তালে অভূতপূর্ব লাভের লোভ ও যে ভূতপূর্ব কে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রাখে । একটু পেছনে ঘুরে তাকিয়ে দেখা যাক দেখি। কাঁচা বয়সে তাকিয়ে থাকার হত কেবল সামনে। অজস্র পর্দা সন্মুখে , যেন সরাতে পারলেই আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ। একের পর এক পরিচয়, পথ হাঁটা, দিনগত পাপক্ষয় বা সৃষ্টিতে মগ্নতা। সব ই চারা গাছের মত বেড়ে ওঠে যা পূর্বে বপন করা হয়েছে তাকে কেন্দ্র করে। যে বীজ বুনবো তার ফল পাবো বলে। ক্রমে যে বৃক্ষ বিকশিত হয়, ছায়া দেয়, বাতাস দেয় বেঁচে থাকার রসদ সরবরাহ করে। বছর বছর অপেক্ষা নতুন ফলনের। তবু জীবন বৃক্ষ যেন একখানি ই নয় কি? সেই তো আরো বেড়ে ওঠে, একদিন বুড়িয়ে যায়। মন জমি আবাদ করে যা জীবনভর তার হিসেব নেবার পালা আসে। সে নতুনের জয়গান গায় শিকড় বেঁধে নিয়ে। এক একটা সময় আসে যখন নতুন বন্ধুত্ব আর ভালো লাগেনা। অথবা হওয়া হয়ে ওঠেনা। জমি উর্বরতা হারায় যে। পরিণত মস্তিষ্ক, ঝড় ঝাপটায় ব্যতিব্যস্ত মন জায়গা জুড়ে থাকে অবিশ্বাস। বলেন তো যারা প্রথম প্রেম ভোলেন নি, তারা ভুলতে পারেন না কেন। প্রয়োজনের ছিলনা । ওই জমি আর ফেরত পাওয়া হয়না আজীবন।দিন যত নতুন হতে থাকে, যত বেশি নতুন দিনের সংখ্যা খাতায় জমিয়ে ফেলি তত আমরা পুরনো হই। যা কিছু হারাই, পেছনে ফেলে আসি আসলে ফেলে আসা হয়না কিছুই। আঁকড়ে ধরা পুরাতন সাথে নিয়েই নতুন আশায় মাতি। নতুন ও পুরাতন দিন সব ভালো হোক।
চৈত্র-বেলার গান
দেবযানী সেনগুপ্ত
হলুদ পাখির ডানায় এলো
চৈত্র অলস দুপুর!
অনেক চড়াই- কিচির- মিচির
ধুলোয় আরাম স্নান,
ক্লান্ত ঘুঘু একঘেয়ে ডাক
বছর শেষের বেলা।
কাঠ-ঠোকরার ঠকঠকে সুর
একটি দুটি কাক,
একা কোকিল ডেকেই চলে
সঙ্গী বিহীন আজ,
ঝরা পাতার রিক্ত ডালে
অসীম শূন্যতা ।
পায়ের নিচে শুকনো পাতায়
মুকুল ঝরা আম ,
চোখের কোনে একটু কাঁপন
নস্টালজিক মন।
সব পেয়েও সব হারানো
চৈত্র বেলার গান।।
চৈত্রের খরতা
মজনু মিয়া
রুদ্রের বারুদ রূপ, ঝরা পাতারা মরমরে
ঘর্ষণে ঘর্ষণে আগুন জ্বলে উঠে কখনো।
ভয়াবহ দুর্ঘটনার শিকার হয় বসতবাড়ি ও
জীবিকার অন্বেষনে তৈরী ব্যাবসা দোকান।
চৈত্রের ঘামে ভেজা শরীর, মন মস্তিষ্ক কে
উত্তাপ করে রাখে। কচি পাতার সংসার
নবরূপে সাজায় প্রকৃতি তার আপন রূপে।
কচি ধানের খেতে বাতাস নাচে মন হাসে।
পার্বণের উৎসবকথা গাঁথা চৈত্র মাস জানি,
পরাতনের বিদায় বিরহ নিয়মমাফিক চলে।
নতুন কে বরণের টানটান উত্তেজনা বহে-
সাজ সাজ রব চারদিকে,, নবাগমনের বার্তা।
শেষ লগ্নে
আকাশলীনা ঢোল
পলাশগুলি ঝরে যাচ্ছে একটি -দুটি-
তিনটি করে -
কৃষ্ণচূড়ার লালেও এখন বিষণ্ণতার ছোঁয়া,
চৈত্রের এই প্রহর শেষের রাঙা
আলোতেও, কেমন ঔদাসীন্যের ছাপ,
বছরের শেষ লগ্নে উত্তাপকে স্বাগত
জানাতে কেবল প্রস্ফুটিত আমের মুকুলগুলি।
মাঝে মধ্যেই সন্ধ্যাকালে কালবৈশাখীর হানা -
ধুলোর কণায় মিশতে থাকে
বৃষ্টি ভেজা গন্ধ,
বর্ষবরণের প্রস্তুতিতে হঠাৎ মনে পড়ে,
মন কেমন করা অতীত স্মৃতি -
'পয়লা বৈশাখ '।
শেষ লগ্নে ক্লান্ত কোকিল
ডাকছে শ্রান্ত স্বরে,
প্রখর হয়ে উঠছে আরও
দীর্ঘ দিনের রৌদ্র।
হে নূতন!
অর্পিতা রায় আসোয়ার
হে নূতন! তোমায় আবারও স্মরি সব ব্যথা ভুলে।
তোমায় আবাহন করি জীর্ণ মনের জানালা খুলে।।
হে নূতন!তুমি আনো এ ভগ্ন হৃদয়ে দৃঢ়তা।
নবপ্রলয়ে দূর করো যত মন -দীনতা।।
হে নূতন!তোমার বৈশাখী সাজে আনো
নবচেতনা।
তবনবচেতনায় হই যেন মোরা মুক্ত মনা।।
হে নূতন!তুমি দূর করো যত পুরাতন জরা-গ্লানি।
নির্মল করো, শাশ্বত করো তব নববর্ষ ধ্বনি।।
সময়ের সংলাপ
প্রতিভা পাল
নদীর ধারারেখ প্রবাহের মতো
অতীত-আগামীর কথোপকথনে
সংঘাত নেই কোনও।
বিক্ষুব্ধ স্মৃতির আনাচে-কানাচে
কেবল কিছু পিছুটান, কিছু অস্ফুট উচ্চারণ!
শান্ত স্রোতের মতো নীরব তবু 'আজ'
তার নির্নিমেষ চাহনিতে,
দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দৈনন্দিন যাবতীয়
যত্ন নিয়ে সময়ের সংলাপ লিখে চলে
জীবনের অভিনয়ে!
নদী মোহনায় সমাপ্তি ও সূচনার সন্ধি যেমন
চৈতী হাওয়ায় কালবৈশাখী মিলেমিশে গেলে
বসন্ত-বৈশাখ নির্দ্বিধায় আঁকে সমাবর্তন !
বছরভর অপেক্ষাগুলোর
কেবল কিছু আক্ষেপ, কিছু আবেগ
স্তূপীকৃত হয় বসন্তমনে,
সময়ের সংলাপ তবু লেখা হয়
নতুন বছরের আয়োজনে.....
প্রবন্ধ
শতবর্ষের আলোকে অমিয়ভূষণ মজুমদার
সঞ্জয় এস. সাহা
১৯১৮ সালের ২২ শে মার্চ, কোচবিহার শহরে মাতুলালয় জন্মগ্রহণ করেছিলেন অমিয়ভূষণ মজুমদার। পিতার নাম অনন্তভূষণ মজুমদার, মাতা ছিলেন জ্যোতিবিন্দু দেবী। পৈতৃক নিবাস ছিল পাবনা জেলায় সারা থানায় পাকুরিয়া গ্রামে। তাঁর সাহিত্যচর্চা শুরু হয়েছিল মা- দিদিমার কাছে রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণের গল্প শুনে। লেখাপড়ায় তার বাবা সেকেলের ছিলেন। তাকে কলকাতায় ভর্তি হয়ে অসুস্থতার কারণে ফিরে আসতে হয়। ইংরেজি অনার্স নিয়ে ভর্তি হন কোচবিহারের ভিক্টোরিয়া কলেজে । অল্প বয়সেই চাকরিতে যোগ দেন। বাইশ বছর বয়সে বিবাহ করেন গৌরীদেবীকে। স্ত্রীর ভূমিকা তাঁর জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। অমিয়ভূষণের সাহিত্য রচনার প্রধান উৎসাহদাতা ছিলেন তিনি এবং সমস্ত লেখার প্রথম পাঠিকাও তিনি। নিজের সাহিত্য সৃষ্টির সম্পর্ক অমনীয় পোষণ বলতেন, "আমি কি উপন্যাস লিখতে চাই তা এখনও লেখা হয়নি। অর্থাৎ আমি যাকে উপন্যাস বলে স্বীকার করতে কুণ্ঠিত হবো না তেমন উপন্যাস লেখার চেষ্টা করে থাকি। হয়তো তা কোনদিনও লেখা হবে না, লেখা হলেও ছাপা হবে না, কিন্তু সেগুলি আমার জাগ্রত ও নিদ্রার আনন্দ। এই আনন্দ ছাড়া আমার চলে না, এমন নেশা ধরেছে যখন লিখি না তখন ছবি আঁকি। আমার ছবি কোন exhibition - এ পাঠাবো কিনা তাও জানিনা। কিন্তু তুলির টানে। ফলকে রং তুললে মনে হয় মস্তিষ্কে সহস্রদল পদ্ম থেকে মধুস্রাব হচ্ছে। আমার যে উপন্যাস ছাপা হবে তা লিখতেও এমন হয়।"
সঞ্জয় ভট্টাচার্যের "পূর্বাশা" পত্রিকায় প্রথম অমিয়ভূষণ মজুমদারের গল্প প্রকাশিত হয়। এছাড়া "চতুরঙ্গ", "গণবার্তা", "ক্রান্তি" পত্রিকায় তিনি লেখা পাঠান। ১৯৫৭ সালে "গড় শ্রীখন্ড" তার প্রথম উপন্যাস। এই উপন্যাসটি ১৩৬০ সাল থেকে ফাল্গুন-চৈত্র ১৩৬১ পর্যন্ত ধারাবাহিক ভাবে "পূর্বাশা" পত্রিকায় কালপর্বে প্রকাশিত হয়। এটি ধারাবাহিক প্রকাশকালে লেখক পরিচিতি হিসেবে সঞ্জয় ভট্টাচার্য সম্পাদকীয় মন্তব্য করলেন, " তরুণ সাহিত্যিকদের মধ্যে শ্রীযুক্ত অমিয়ভূষণ মজুমদারই এমন একজন লেখক যিনি বহুবিধ কোণ থেকে জীবনকে দেখতে জানেন । তাঁর রচিত গল্প ইতিপূর্বে সাহিত্য পিপাসুদের তৃপ্তি দান করেছে। 'গড় শ্রীখন্ড' তাঁর প্রথম উপন্যাস আমাদের আশা আছে-- এ রচনাটি তাঁকে বাংলা উপন্যাসের আসরে একটি সম্মানের আসন দান করবে ।" এই ভবিষ্যৎ বাণী যে কতটা সত্য তা আজ বলার অপেক্ষা রাখে না। একে একে তাঁর উপন্যাস গুলি হল--''নয়ন তারা'', "দুখিয়ার কুঠি", "নির্বাস", "মধু সাধুখা", "রাজনগর","ফ্রাইডে আইল্যান্ড অথবা নরমাংস ভক্ষণ ও তাহার পর" , "মহিষকুড়ার উপকথা", "বিশ্বমিত্তিরের পৃথিবী", "সোদাল", "মাপচক হরিণ", "হলোং মানসাই উপকথা", "চাঁদবেনে" প্রভৃতি। তিনি অসংখ্য ছোট গল্প লিখেছিলেন । তাদের মধ্যে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছে "প্রমীলার বিয়ে", "তাঁতি বউ", "সুনীতি", "দীপিতার ঘরে রাত্রি", "দুলারহিনদের উপকথা", "সাদা মাকড়সা", "অধ্যাপক মোহিত স্যানের উপাখ্যান", "শীলতার দ্বীপ", "সাইমিয়া ক্যাসিয়া" প্রকৃতি গল্প যেন তাঁর ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশন।
অমিয়ভূষণ মজুমদারের প্রধান পরিচয় তাঁর কথাসাহিত্যিক হিসেবেই। 'গড় শ্রীখন্ড', 'রাজনগর', 'মহিষকুড়ার উপকথা', বা 'ফ্রাইডে আইল্যান্ড'-- এর মতো ভিন্ন পথের সৃষ্টির জন্যই পাঠকের কাছে আজও সমাদৃত। তবু একথাও নিঃসন্দেহে বলা যায় তিনি সাহিত্যিক হিসেবে বাঙালির কাছে যথেষ্টই উপেক্ষিত। বাঙালি আর বিস্মৃতি শব্দ দুটি প্রায়শ হাত-ধরাধরি করে চলে, তা যে সম্পূর্ণ সত্য, এ কথা বলা হয়তো একটু বাহুল্য হয়ে যাবে, তবু অনেক প্রতিভাবান ব্যক্তি পান না তাঁর যথাযথ সম্মান, আবার অনেকক্ষেত্রেই তা বর্ষিত হয় অযোগ্য কারও উপর। এর কোন ধরাবাঁধা ফর্মুলা নেই। অমিয়ভূষণ মজুমদার বহু পুরস্কার পাওয়া সত্ত্বেও অনাদৃত । তবু কোনও উপলক্ষ এলে, অল্প কয়েকজন হলেও উৎসাহিত হয়ে ওঠেন, মলিন আলোকচিত্র থেকে সরানো হয় ধুলোর আস্তরণ। অমিয়ভূষণ মজুমদারের শতবর্ষ তেমনই এক আয়োজন-সম্ভাবনার মুহূর্ত। তাঁর "প্রবন্ধসংগ্রহ" ধরে নেওয়া যায়, সেই উদযাপনেরই ফসল । ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত হয়েছিল এগারোটি প্রবন্ধ নিয়ে একটি সংকলন---"লিখনে কি ঘটে", প্রকাশক আনন্দ পাবলিশার্স, পরে তা ঠাঁই পায় অমিয়ভূষণ মজুমদারের "রচনাসংগ্রহ" -তে । আলোচ্য সংগ্রহ -তে সেইসব প্রবন্ধের পাশাপাশি রয়েছে অগ্রস্থিত প্রবন্ধ এবং কিছু চিঠিও, যা ভাবনার গভীরতা এবং মৌলিকতায় হয়ে উঠেছে প্রবন্ধ। শিল্প-সাহিত্যই অমিয়ভূষণ মজুমদারের প্রবন্ধের মূল বিষয়, কিছু নিবন্ধন আত্মজৈবনিক। অবশ্য সাহিত্যভাবনাতেও স্বাভাবিকভাবেই এসেছে নিজস্ব বক্তব্য। রাজনৈতিক মতামতও স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেছেন লেখক।
সতীমায়ের মেলা
শ্রাবণী সেনগুপ্ত
নদীয়া জেলার চাকদহ থানার ঘোষপাড়া গ্রামে দোল পূর্ণিমাতে অনুষ্ঠিত উৎসব ও মেলা হচ্ছে সতী মায়ের মেলা। এই মেলা প্রায় ২০০ বছরের পুরনো। প্রায় কুড়ি বিঘা জমির উপরে এই মেলা বসে। হুগলি বর্ধমান কলকাতা নদীয়া মেদিনীপুর বাংলাদেশ ২৪ পরগনা বাঁকুড়া পুরুলিয়া প্রভৃতি জায়গা থেকে প্রায় পঞ্চাশ হাজার মানুষের ভিড় হয়। পূর্ব রেলপথের শিয়ালদহ রানাঘাট শাখায় কাঁচরাপাড়া স্টেশন থেকে 8 কিলোমিটার দূরে ঘোষপাড়া বৈষ্ণব সমাজের কর্তাভজা সম্প্রদায়ের প্রধান কেন্দ্র অর্থভাজা সম্প্রদায়ের প্রবর্তক আউজা দেহ রক্ষা করার পর তার ২২ জন মন্ত্র শিষ্যের মধ্যে ঘোষপাড়ার রামশরণ পাল গুরুপদ লাভ করেন। এখনো রামশরণের বংশধররাই এই সম্প্রদায়ের পরিচালক। রামশরণের সহধর্মিনী কর্তাভজা সম্প্রদায়ের কাছে সতীমা নামে খ্যাত হয়। ভক্তদের কাছে সতী বা পরমা প্রকৃতি যোগমায়া। সতীমার পুণ্য স্মৃতি স্মরণ করতে প্রতি বছর দোল পূর্ণিমায় ঘোষপাড়া সতীমার উৎসব ও মেলা অনুষ্ঠিত হয়।
সতীমার কোন মন্দির বা মূর্তি নেই। কর্তা রামশরণের আদি ভিটায় ভক্তগণের কাছে অতি পবিত্র বলে বিবেচিত। ভিটায় সতীমার সিদ্ধিলা ক্ষেত্র ডালিমতলা, রামশরণ ও পরবর্তী কর্তাদের কুটির, তাদের ব্যবহার শয্যা ও অন্যান্য দ্রব্যাদি বর্তমান। কর্তামা সতীমার বাসগৃহ এবং তার সমাধিস্থান অবস্থিত। ভিটার পিছনে হিমসাগর নামে এক বৃহৎ অগভীর দিঘির জল ভক্তদের কাছে অতি পবিত্র ও সর্ব রোগ ঘরে ভক্তরা ডালিম গাছের ডালে ঢিল বা মাটির ঘর বেঁধে মানসিক করে থাকে। এবং গাছ তলায় সতীমার উদ্দেশ্যে চিঁড়ে মুড়কি, বাতাসা ,কদমা ও চিনির মঠের ডালা নিবেদন করেন।
দোলের আগের রাত থেকে উৎসব শুরু হয়। সারারাত ধরে চলে। দোলের দিন খুব সকালে '' অনুষ্ঠিত হয়। তারপর ভক্তদের মধ্যে দোল খেলা শুরু হয় এই দোল খেলায় কেবল আবিরই ব্যবহৃত হয় এবং জাতি ধর্ম নির্বিশেষে হিন্দু মুসলমান সকলেই এই দোল উৎসবের অংশগ্রহণ করেন কর্তাভজা দলের অনুগামীরা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে কীর্তন গান করেন, প্রসাদ বিতরণের পর এই দিনে উৎসব শেষ হয়।
সতীমার উৎসব উপলক্ষে এখানকার আমবাগানে সপ্তাহব্যাপী এক বিরাট মেলা বসে। মেলাটি ঘোষপাড়ার মেলা নামে প্রসিদ্ধ। এখানকার আম বাগানে সৃষ্টি সম্বন্ধে শোনা যায় যে যেসব দূরাগত যাত্রী বংশ পরম্পরায় এই উৎসবে আসতেন তারা গাছের ছায়ায় প্রাণ লাভের জন্য একটি করে আমগাছ রোপন পড়ে যেতেন। তাদের পরিবার পরিজনেরা আজো মেলায় এলে নিজের নিজের নির্দিষ্ট বৃক্ষতলেই অবস্থান করেন। এখানেই রান্নাবান্না ও খাওয়া-দাওয়া করে থাকে। যদি কোন গাছ মরে যায় তাহলে সেই জায়গায় তারা আরেকটি চারা রোপণ করে যান। মেলায় বিভিন্ন ধরনের লোক আসে সতী মায়ের মহিমা কীর্তন করতে। রোগগ্রস্তরা ডালিম তলার মাটি মেখে হিমশায়রের জলে স্নান করে দন্ডি কাটেন ।সাধারণ দর্শনার্থীরা আসেন মেলা দেখতে, সন্ন্যাসীর দল উপার্জনের আশায় আসে। মেলায় প্রাচীনকাল থেকেই লক্ষ্য করা গেছে মহিলাদের সংখ্যা পুরুষদের চাইতে বেশি। গাগঞ্জে সংস্কার আচ্ছন্ন মহিলারা সন্তান কামনা মুখ সন্তানের মুখে কথা ফোটানো রোগব্যাধির প্রতিকার ইত্যাদির উদ্দেশ্যে ভিড় করেন। বিকৃত মস্তিষ্ক সন্তানহীনা ,রোগগ্রস্ত, বোবা অন্ধ ,খোঁড়া, বৃদ্ধ ,নারী পুরুষ সকলে দন্ডী কাটেন। বোবা ছেলের মায়ের দন্ডী কাটা শরীরের ওপর বোবা ছেলেকে শুইয়ে দেওয়া হয়। বোবা ছেলেকে মন্দিরের পান্ডারা চড় মারতে মারতে বলে' কথা বল কথা বল। মা বল বল মা'। লোকো বিশ্বাস ডালিম তলার মাটি মেখে হিমশায়ারে স্নান করলে সতীমার কৃপায় সন্তানহীনা মায়ের সন্তান হয়, বোবা কথা বলে, অন্ধদৃষ্টি পায় খোঁড়া চলৎশক্তি পায় নিরাময় হয়। ভক্ত ও উপাসকরা পরম বিশ্বাসে সতীমার সমাধিতে নোয়া সিঁদুর দেয়।
কিংবদন্তি আছে এক পান বরজে কুড়িয়ে পাওয়া শিশু পরবর্তীকালে সাধনার সিদ্ধিলাভ করে আউলচাঁদ নামে খ্যাত হন। লোকবিশ্বাস তিনি নবদ্বীপের নিমাই। বিষ্ণুপ্রিয়ার অভিশাপে তাঁর মর্ত্যলীলা। 'কৃষ্ণচন্দ্র গৌর চন্দ্র আউলে চন্দ্র তিনিই এক একে তিন'। নানা রকম অলৌকিক ক্রিয়াকাণ্ডে তিনি পারঙ্গম ছিলেন। একবার তিনি কমন্ডলুতে গঙ্গাকে ভরে দিলেন। রামচরণ পালের মুমূর সুশ্রী সরস্বতী দেবীকে বাঁচিয়েছিলেন তার কমন্ডলুর জলে। একবার একটি মরা গরুর গায়ে হাত বুলিয়ে তিনি গরুটিকে জীবন দিয়েছিলেন। এই গরুটির মালিক ছিলেন রামশরণ বাবু এত উপকারে কৃতজ্ঞ রামশরণ ও সরস্বতী যখন আউলচাঁদ কে স্থায়ীভাবে কামনা করেন, তখন আউলচাঁদ তাদের পুত্ররূপে জন্মাবার অঙ্গীকার করেন। পরবর্তীকালে সরস্বতী দেবীর গর্ভে আসেন দুলাল চাঁদ তিনিও আবার বলা হয় দুলাল চাদি নদের নিমাই আর সরস্বতী দেবী শচীমাতার অবতার সতী মা। এই সতীমা কর্তাভজা সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব করতেন। আজও লোকে তাই পরম আবেগে বলে 'কলিকালে বলে দুলাল চাঁদের জয়/ হিমসায়রে স্নান করিলে মরা মানুষ জ্যান্ত হয়/ জয় সতী মা, জয় মা।'
এই মেলার অন্যতম আকর্ষণ আউল বাউলের গান মেলায় সমবেত বাউলেরা ছোট ছোট আসরে বিভক্ত হয়ে সারা রাত গান করে থাকেন। বেশ কয়েক বছর আগে আমার একবার এই মেলা প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সেই সময় আমাদের সঙ্গে ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ফাদার দ্যাঁতিয়েন । সেই সময় প্রচুর মহিলা বাউল এর দেখা পেয়েছিলাম। সারারাত ধরে বাউল গান শুনে সমৃদ্ধ হয়েছিলাম। আজও সতী মায়ের মেলা স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত।
অবসাদ সমস্যাতে স্বামীজি
জয়তী ব্যানার্জী
প্রতিদিন প্রতিনিয়ত প্রকৃতিকে জয় করার খেলায় নেশাগ্রস্ত আমরা প্রায় সবাই। মহাবিশ্বের এই আদিগন্ত দিগ্বিদিক্ পরিমণ্ডলকে অতিক্রম করে আজ ব্রহ্মাণ্ডেও প্রসারিত হচ্ছে মানবতার পদচারণা। নিজেকে সফলভাবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াসে নিযুক্ত সবাই। অজস্র নিরন্তর চেষ্টার মধ্যে কখনো পাওয়া যায় অমৃত, কখনো বা গরল। সফলতা থেকেই অনুপ্রেরণা তৈরি হয়। ব্যর্থতা প্রসব করে নৈরাশ্য অবসাদ বা ডিপ্রেশন। অবসাদ মানুষকে ক্রমশ মৃত্যুর সঙ্গে করমর্দন এ বাধ্য করে, যেটা বর্তমান সমাজের একটা প্রজ্জ্বল্যমান সমস্যা। তবে হতাশাগ্রস্ত মানুষটিও পারে তার এই মানসিক সংকট থেকে মুক্ত হতে।
আকাশে বাতাসে ভেসে ওঠে
যা আসে আসুক
যা হবার হোক
যাহা চলে যায় মুছে যায় যাক
গেয়ে যায় দ্যুলোক ভুলোক
প্রতিটি পলকের রাগিনী----
অবসাদ সমস্যাটির সমাধানে সফল ভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে বিজ্ঞান। সমস্যাটির প্রকৃতি লক্ষণ সন্ধানে শিক্ষার্থীর সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম বৈশিষ্ট্যগুলির পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে দেশে-বিদেশে। নির্দিষ্ট পদ্ধতির সাহায্যে বিজ্ঞান সুনিশ্চিত ও সার্বজনীন জ্ঞান উপস্থাপন করে আর এই জ্ঞান ব্যাপকতা ও সার্বিকতা প্রাপ্ত হলে তা দর্শন নামে অভিহিত হয়।
Plato তার Republlic গ্রন্থে বলেছেন----
The philosopher one who loves not a part of knowledge but the whole ,his passion is for truth....
প্রতিটি মানুষের উপাস্য স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর বিভিন্ন রচনার মাধ্যমে এক বিচক্ষণ মনস্তাত্ত্বিকের মনীষা নিয়ে আজও মানুষকে পরিচিত করিয়ে চলেছেন প্রকৃত মানব দর্শনের সঙ্গে। তাঁর অমৃত বাণী আশীর্বাদী ফুলের মতোই মানুষের যেকোনো সমস্যার বলিষ্ঠ উপশম। স্বামীজীর ভাষায় সর্বাগ্রে কাম্য হল আত্মশক্তির অনুভব। তিনি প্রথম বোঝাতে চেয়েছিলেন-
জীবনের পরম সত্য : এই শক্তিই জীবন ;দুর্বলতাই মৃত্যু; শক্তিই সুখ আনন্দ : শক্তি অনন্ত অবিনশ্বর জীবন; দুর্বলতাই দুঃখ ও উদ্বেগের কারণ, দুর্বলতাই মৃত্যু। শক্তি হলো আত্মশক্তি বা আত্মবিশ্বাস। আমাদের প্রত্যেকের উচিত এই শক্তিকে অন্তরে উপলব্ধি করা।
স্বামীজি বারবার বলেছেন,
`তোমরা নিজ নিজ স্বরূপের চিন্তা করো এবং সর্বসাধারণকে ওই শিক্ষা দাও। ঘোর মোহনিদ্রায় অভিভূত জীবাত্মার নিদ্রা ভঙ্গ করো। আত্মা প্রবুদ্ধ হলে পবিত্রতা আসিবে, যাহা কিছু ভালো সকলি আসিবে।`
যেকোনো লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার জন্য দৃষ্টিভঙ্গি সদর্থক হওয়াই সমীচীন। ব্যর্থতাকে যদি ব্যর্থতা মনে না করা হয় তবেই আন্তরিক শক্তি সহজে স্ফূরিত হয়। এই জগত ভালো ও মন্দ দিয়ে প্রস্তুত; তবুও এর উপাদান হচ্ছে ভালো,তার চেয়েও ভালো এবং তার চেয়ে আরো ভালো... পরিস্থিতি মানুষকে শিক্ষা দেয়। যে কোন অবস্থাতেই একেবারে হাল ছেড়ে দেওয়ার দরকার নেই ....যেকোনো মনোবৃত্তির নীতি বা ধর্মকে ওই ভাব--- যে অবস্থায় পায় সেই অবস্থাতেই সাদরে গ্রহণ করে এবং এই অবস্থাতেই আমাদের শেখায়-- এ পর্যন্ত সব ভালই হয়েছে এখন আরও ভালো করার সময় এসেছে। এটাই আমাদের বাস্তবে মেনে নিতে হবে যে,যদি পাওয়ার আশঙ্কা থাকে তবে দেখা যাবে যে সেই স্বর্গ রাজ্য আগে থেকেই বিদ্যমান; মানুষের যদি দেখার স্বাদ থাকে তবে সে দেখবে সে যে পূর্ব থেকে ই পূর্ণ।
তবে প্রকৃতিগত ভাবে মানুষের চিন্তা পরস্পরের থেকে আলাদা, সকলের ভাবনা সমান নয়। অনেক মানুষ কৃত্রিম-- ঈশ্বর অদৃষ্ট বা প্রকৃতির অধীন সাফল্য ও ব্যর্থতাকে এক মানদন্ডেই বিচার করে ।এজাতীয় চিন্তাও আত্ম বিশ্বাসকে প্রশমিত করে।
স্বামী বিবেকানন্দ কিন্তু মানুষের মধ্যেই ঈশ্বরকে উপলব্ধি করার বোধ জাগ্রত করেছেন। তাঁর মতে মানব সত্ত্বা সর্বশক্তিমান ---মানুষের জন্ম প্রকৃতিকে জয় করার জন্য; তাকে অনুসরণ করবার জন্য নয়.... ঈশ্বর, প্রকৃতি ও অদৃষ্ট এই তিনটি বাহ্য মানদণ্ড নয় ,মানুষ তার কর্মফল নির্ধারণ করে নিজেই ।অন্তরের আত্মবিশ্বাসকে তার প্রিয়জনের মতো অবলম্বন করতে হবে যার উপস্থিতি মনোবল বৃদ্ধি করে, আস্থার আশ্বাস দেয়। বাস্তব জগত যা প্রকাশ করে তা সত্য ।সত্যকে সহজে গ্রহণ করার সাহস মানুষের অন্তরেই বিদ্যমান। মানুষের উচিত নিজেকে এমন ভাবে তৈরি করা যেখানে হতাশা নৈরাশ্য বা অবসাদের কোন স্থান নেই।
মৃণালিনী বসুকে লেখা পত্রে স্বামীজি লিখছেন,
'যখন হৃদয়ের মধ্যে মহাযাতনা উপস্থিত হয়, চারিদিকে দুঃখের ঝড় ওঠে বোধহয় যেন আলো দেখতে পাবো না,যখন আশা ভরসা প্রায় ছাড়ে ছাড়ে, তখনই এক মহা আধ্যাত্মিক দুর্যোগের মধ্য থেকে অন্তর্নিহিত ব্রহ্মজ্যোতি প্রকাশ পায়। ক্ষীর ননী খেয়ে, তুলোর উপর শুয়ে, ----এক ফোঁটা চোখের জল না ফেলে-- কেউ কি বড় হয়েছে,, কাঁদতে ভয় পেলে চলবে না ,কেঁদে কেঁদে তবে- তবে অন্তর্দৃষ্টি হয়.... প্রতিটি নেতিবাচক অবস্থায় প্রতিটি নারূপ পরিস্থিতিতে আত্মবিশ্বাসের সাথে মানিয়ে নেওয়াটাই জীবন: তাই তো জীবনের সমস্ত রহস্যই হলো খাপ খাওয়ানো, মানিয়ে নেওয়া ,উপযোগী করা ---- এটাই হল প্রানের অন্ত:শক্তি এবং এর প্রভাবেই জীবন বিকশিত হয় ..শক্তির বিরুদ্ধে যুয্যুমান ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ই হলো সামঞ্জস্য বিধান।'
স্বামীজি বলেছেন, 'দৈহিক বলে উন্নয়নের চেষ্টা করিও না আত্মার শক্তিতে উদ্ধারের উপায় দেখো।' ক্রমাগত ব্যর্থতার সম্মুখীনতায় নৈরাশ্য বা অবসাদ কে প্রশ্রয় দেওয়ার অর্থ পরাজয়। নিরন্তর প্রয়াসই মানুষকে তার সাফল্যের নিকটবর্তী করে। মানুষকে তার লক্ষ্যে উপনীত হতে সাহায্য করে। এই নিশ্চিত সংগ্রামে স্বামীজি মানুষের জয় কামনা করেছেন। নিজের অন্তরের শক্তির শেষ কণাটুকুকেও জীবন সংগ্রামের প্রয়োজনীয় ভূমিকায় অবতীর্ণ করতে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন, কারণ প্রয়াসের কোন বিকল্প নেই।
সাফল্য ও অসাফল্যের বুননে মানুষের জীবনচিত্র তৈরি হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এই দুইয়ের দ্বন্দ্ব চিরকালীন। মন থেকে সহজ ভাবে এই দুটি বিষয় গ্রহণ করতে হবে। ডিপ্রেশন বা অবসাদ মানুষের অভ্যন্তরীণ শক্তি বা আত্মশক্তির তুলনায় নগণ্য , আত্মশক্তির উদ্বোধনের সাহায্যে এই সমস্যার সমাধানও মানুষের অসাধ্য নয়।
মনেরে তাই কহ যে
ভালো-মন্দ যাহাই আসুক
সত্যেরে লও সহজে।।
কবিতা
কাঞ্চনজঙ্ঘা
গৌতমেন্দু নন্দী
শুভ্রতার ঐ দৃশ্য সুখে মুগ্ধতার দৃষ্টি--নয়ন ফিরে ফিরে দেখা সেই সৌম্য কান্তি"বুদ্ধ-শয়ন"।
দৃষ্টি সুখের ক'জন জানে স্পর্শ সুখের যন্ত্রণা
কোন্ সে দুর্গম তুষার পথে ঈশ্বরের ঐ বন্দনা ?!
শান্ত,শুভ্র, সমাহিত গিরির উচ্চ ঊর্ধমুখ
রবির হলুদ কিরণ ছটায় ঋদ্ধ সেই দৃষ্টি সুখ।
হিমালয়ের কোলে কোন্ জাদুতে এই স্বপ্নরূপ
কখনো আড়াল অদৃশ্য কখনো সে মৌনচুপ।
স্বর্গ সৃষ্টি করেছে বিছিয়ে মৃত্যু-কাঁটা চলার পথে
নিচ্ছে কেড়ে প্রাণ সে কতোই অভিযানের মৃত্যু-রথে।
আজ কোনো আরিস্ততল নেই
অশোক কুমার ঠাকুর
আরিস্ততল বলেছিলেন
রাজাকে দার্শনিক হতে হবে
অথবা দার্শনিককে রাজা হতে হবে।
তারপর কতো যুগ কতো সহস্রাব্দ
রাজাকে দার্শনিক হতে দেখা যায় নি
দার্শনিকরাও কখনো রাজপদ নিতে চান নি।
অজ্ঞানীরাই জ্ঞানী ও বিজ্ঞানীদের
শাসন করে চলেছে যুগ যুগান্তর ধরে
অজ্ঞানের হাতে জ্ঞান নিয়ন্ত্রণ হতে হতে
পাল্টে গেছে জ্ঞানের সংজ্ঞা।
আজ কোনো আরিস্ততলও নেই।
গল্প হলেও সত্যি লীনা রায়
১
না হয় খুঁজে হন্যে হলি
পাঞ্চজন্য, ভিক্ষে ঝুলি,
হয়ত ভবি ভুলবে খানিক
ভাবের অভাব,তুক মাদুলি।
২
রং মিছিলে ভেকধারী আর
সামিল হল ব্রহ্মচারী –
তুষের আগুন লাল ফাগুনে
গনগনে আঁচ , স্বৈরাচারী।
৩
গজব খবর আজব দেশের
ডিঙিয়ে পাহাড় ঐ ছোটে,
খুঁজছে ভোলা শব্দকোষে
কথার অর্থ ফুট নোটে ।
৪
তুক করে ঐ ছুঁক ছুঁকে হাত
যুক্তি ভুলে মুক্তি পাবার,
টাকা মাটি,মাটিই টাকা
হক কথা ভাই লাখ টাকার।
ঈদের শোক
সুগন্ধি চালের পোলাও
পেটে দাউ দাউ আগুন জ্বালে।
ক্ষুধা হতে আক্ষেপ বাড়ে
আনন্দের ঢেউ জাগে না খুশির সাগরে।
মাংস ফ্রিজের খাবার হয়ে
জমা হয় হিমাগারে।
ঈদ আসে ঈদ যায়
ক্ষুধার উত্তাপে গলে না বরফ।
যেখানে জীবন আছে জীবিকা নেই
ক্ষুধা আছে খাবার নেই
ঈদ আছে আনন্দ নেই
সেখান ঈদ শুধু কেড়ে নেয় নিদ।
অন্যদিকে ঈদ পুনর্মিলনী উৎসব দেখে
আরও কিছু শোক পায়
দেহের কফিনে ঢাকা বেঁচে থাকা শব
প্রতিটি মানুষ কবিতা লিখুক
রেজাউল করিম রোমেল
পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ কবিতা লিখুক।
কবিতা লিখুক প্রতিটি নদী, সাগর, মহাসাগর,
গ্রহ,নক্ষত্র, এলিয়েন, জ্বিন জাতি,প্রতিটি মানুষ ও মানুষী।
কবিতা হোক বিশ্বময়।
শিল্প সাহিত্যের চর্চা হোক।
চর্চা হোক সঙ্গীত, নৃত্য, নাটক, চিত্রাঙ্কন।
চর্চা হোক শিল্পের প্রতিটি শাখা প্রশাখা।
কবিতা লেখা হোক মহাবিশ্বের সব কূল সঙ্গে নিয়ে।
কবিতাই আমাদের মুক্তির একমাত্র পথ।
অভিমানীসারণ ভাদুড়ী
আমি এখন অনেক পর, তাই না?
হাসিটা তাও রাখি জানিস
যদি ঢাকতে পারি এই ক্ষত....
এখন হয়তো তোর বদল এসেছে,
বাচ্চামো আর নেই ...
হয়তো সত্যিই "বড়" হয়ে গেছিস ।
আমিও বুঝতে শিখেছি জানিস
আর অবুঝ আমি নেই !
তবে অনেক দেরিতে বুঝেছি
যে ওটা ভালোবাসা তো না -ই
প্রেমও ছিল না.....
ছিল একতরফা উচ্ছ্বাস।
অভিমান রয়ে গেছে
হয়তো আক্ষেপও..
তবুও আমার উপন্যাসে
তোর অভিমান ঠাঁই পাবে
" অভিমানী " নামে।
চিঠি দিও
পাপু মজুমদার
বলতে ভুলে গেছি
আমি তাকে হারিয়েছি....
যে কখনো বলত
আমি শুধুই তোমার
আর তুমি.....
চিঠি দিও
কথা রেখ
আমায় কখনো ভুলে যেওনা !
আজ সবই আছে
অভাব,
বুকচাপা যন্ত্রণা
তবে
সে বেখেয়ালে কোথাও যেন
পালিয়েছে
আমার স্বপ্নীল মনের শহর ছেড়ে !
গল্প
রথচক্রগ্রাস
লিপিকর
ঔপন্যাসিক ভাবিয়া রাখিয়াছিলেন এটি তাঁহার নবতম সৃজনে ব্যবহার করিবেন।
ব্যস্ত মহানগরীর ব্যস্ততর এক মোড়ে রক্তিম নিষেধসঙ্কেত উচ্ছ্বাসের হরিৎ হইবার অপেক্ষায় সারি সারি নিষ্প্রাণ ব্যক্তিগত যানের মধ্যে প্রথমে ছিল একটি বাদামী বর্ণের গাড়ি। (ঔপন্যাসিকের কলমে চালিকার দেহবল্লরী হয়তো আরও কিছুটা মূর্ত হইত, কিন্তু আমাদের দৃষ্টিতে থাকুক গাড়ির লাল রঙের L চিহ্নটি। )
আলোকসঙ্কেত পাল্টাইলেও তরুণীর পথ-তরণীটি ঢাল অতিক্রম করিয়া ডাহিনে নিজ গন্তব্যে যাইতে পারিতেছিল না, পশ্চাতের চালকদের ক্যাঁকো-ফোনি নিছকই উপস্থিত সকলের রক্তচাপ বৃদ্ধি করিতেছিল। পার্শ্বের সারির গাড়িগুলি দ্রুত হুশহাশ চলিয়া যাইতেছিল। আরক্ষাকর্মীটি অনুধাবন করিতে পারিতেছিলেন কী ঘটিতেছে এবং সাহায্য করিবার ঈপ্সাও সামান্য হইলেও তাঁহার ছিল, কিন্তু গাড়ীচালনা বিদ্যাটি তাঁহারও অনধীত। তিনি নিরাসক্ত চক্ষে যান নিয়ন্ত্রণের সবুজ আলো পুনরায় লাল হইতে দেখিলেন। (শব্দগুনতি-ব্যস্ত হইলে হয়তো ঔপন্যাসিক আরক্ষা-দফতর, তাহাদের প্রতিনিধি-র মানসিকতা বা দক্ষতা লইয়াও কিঞ্চিদধিক অক্ষর ব্যয় করিতেন, আমরা নজর রাখি পরের গাড়ীটির উপর।)
বাদামী যানটির অব্যবহিত পশ্চাতে একটি শ্বেতবর্ণের ভাড়াগাড়ী আটকাইয়া ছিল। পূর্বের সবুজসঙ্কেতেই এই পথযোগটি তাহার অতিক্রম করিবার কথা, কিন্তু সম্মুখের গাড়ীটির অযোগ্যতাযোগ তাহাকে এক্ষণেও আটকাইয়া রাখিয়াছে। সৌভাগ্যক্রমে এমুহূর্তে তাহার কোনো সওয়ারী নাই। সঙ্কেত রক্তবর্ণ হইলে সে নিজ বাহন হইতে নামিয়া বাদামী গাড়ীর চালিকাকে নামিতে বলিল। তরুণীটি তাহা করিলে সে গাড়ীটি চালাইয়া ঢালের উপর দিয়া বামদিকের সরণীতে উঠাইয়া, তরুণীকে তাহার চাবিটি প্রত্যাৰ্পণ করিল। (জীবনের গতিপথ কীভাবে পাল্টায়, সে সম্বন্ধে ঔপন্যাসিক আরও সুন্দর পরিচ্ছেদ গাঁথিতে পারিতেন, আমরা দেখি গাড়ির মালকিন তাহার পরে কী করিল।)
বিড়ম্বিত তরুণীটি গাড়ীতে উঠিয়া, পুনর্বার যানে জান আনিয়া, চালককে ধন্যবাদ দিয়া, বামদিকের মার্গেই চলিয়া গেল, পরবর্তী পথসংযোগে উল্টামুখে ফিরিতে তাহার অসুবিধা হইবার আশঙ্কা কম, কারণ সেস্থলে চড়াই-উৎরাই আলোচ্য মোড়টির তুলনায় অনেক শমিত। (ঔপন্যাসিক হয় তো এই পর্বে আসিয়া নতুন ভাবনা, চরিত্র বা সঙ্কটের অবতারণা করিতে পারিতেন, আমরা লক্ষ্য করি, সেই বিশেষত্বহীন যান-চালকের পরবর্তী কর্ম।)
ট্যাক্সিচালকটি প্রায় দৌড়াইয়া নিজ বাহনে ফিরিয়া তাহা চালু করিল, লাল ফের সবুজ হইবার উপক্রম হইয়াছে। আরক্ষাকর্মীটিও তাঁহার উদ্বেগ মোচন উদযাপন করিতে দুই বেপরোয়া বাইক-ধারীকে সংহত চালনার নির্দেশ দিয়াই ক্ষমা করিলেন। আলোক, কালের নিয়মে ও যন্ত্রের দক্ষতায়, পুনরায় সবুজ হইলে ট্যাক্সি ডাহিনে নিজ গন্তব্যে গেল, তরুণী, ট্যাক্সিচালক, আরক্ষাকর্মী কাহারো সেই ঘটনা সম্বন্ধে বিশেষ চিন্তা রহিল না। (ঔপন্যাসিক চিন্তা করিতে লাগিলেন, এই খন্ডদৃশ্যটি তিনি কোন স্থলে ব্যবহার করিবেন, সেই অবসরে আমরা অন্য কোন অণুগল্পে মনোনিবেশ করি।)
ভাঙা কুলো
হেমন্ত সরখেল
তাকে দেখতে চাওয়া জীবনের সবথেকে বড়ো ভুল হ'ল। এতদিন ভেবে নেওয়া গেছিল, যা কৃতকর্ম সবই ভুল। তার ডিগ্রি নির্ধারণের চেষ্টাও করে ওঠা হয়নি। ভুল তো ভুলই, তার আবার ছোটো বড়ো কী! এইবার, তার সম্পর্কে নাক গলাতে এসে ভুলের একটা ডিগ্রি নির্ধারণের সময় এ'ল। ইস, যদি অন্ততঃ, তার একটা ছবি থাকতো!
তাকে কেউ চায় না। তাই, সে কোথাও থাকে না। থাকে না মানে, তার উপস্থিতি কেউ টের পায় না। মাত্র, বিয়েবাড়িতে নোংরা কোথায় ফেলা হবে, কাজের লোকেরা ছোট বাইরে পেলে কোন স্থানে যাবে, কুকুর কে তাড়াবে, গাড়ি কোথায় পার্ক করা হবে– এসবগুলো সে চুপচাপ সমাধা করে দেয়। সেদিন নবীনের বাবার ব্যাগের হ্যান্ডেল ছিঁড়ে সব্জিগুলো রাস্তায় পড়ে গেল। সে তার গেঞ্জির মধ্যে সব তরকারি ঢুকিয়ে বাড়ি অব্দি পৌঁছে দিয়ে এ'ল। দিলীপের মায়ের রক্ত লাগতো। অত রাতে কে দেবে! সে দু ইউনিট দিয়ে দিলো। তার 'ও পজিটিভ'। সে ব্যাপারটায় পজিটিভ হয়ে গেল।
মাখনের বড়দা বিদেশে থাকে। মাখনের মতো চেহারা। টোকা দিলে যেন শরীর থেকে রক্ত বের হয়ে যাবে। ওদের মায়ের শ্মশান যাত্রায় হাতে ঝোলানো যে মাটির হাঁড়ি, যার মধ্যে ঘুঁটে জ্বালানো ছিল, তার তাপ লাগছিলো বড়দার হাতে। সোনার অঙ্গ পুড়ে যায় আর কি! মায়ের শেষ যাত্রা, কষ্টে প্রাণ যাচ্ছে কিন্তু কিছু বলতে পারছেন না। সকলেই হাঁটছে অথচ টের পাচ্ছে না। কোত্থেকে সে এলো আর, হাত থেকে হাঁড়ির দড়িটা ছোঁ মেরে নিয়ে নিলো। সারাটা রাস্তা, তারপর সে হাঁড়িটাকে বয়ে নিয়ে চললো আর, বড়দা তার হাতটা ধরে থাকলেন। ছুঁয়ে থাকলেও একই ফল হয়, লোকে বলে। তার হাতে তাপ লাগলো না শ্মশান অব্দি।
সে রাতে কোথায় থাকে, কোথায় খায়, কোথায় ঘুমায় কেউ জানে না। যখন প্রচণ্ড দুপুরে সূর্য তা তা করে রোদ দেয়, পাড়ার সুনশান গলিতে জিভ বের করে কুকুর হাঁফায়, পিচের রাস্তা গলে ওঠে, ঝিলমিল করে বাতাসের ঢেউ সেই রাস্তার বুকে, যখন প্রিপেইড ট্যাক্সি গরমে সওয়ারীর কাছে মস্ত দাম হাঁকে তখন সে দুলুর দোকানের জল বাঁকে করে টেনে দেয়। রোদ পড়ে এলে দুলু দোকান খুলবে, জল তো লাগবে! বিকেলে আর তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। সেই আবার রাতে দোকান বন্ধ করার সময় সে আসে। হাতে হাতে গুছিয়ে দেয়। দুলু দোকান বন্ধ করার ফাঁকে আবার সে কোথাও গায়েব। দুলু জানে, সে সকালে আসবে, দোকান খোলার সময় সব বাইরে বের করে দিয়ে অশোকের পিসিমার দোক্তা পাতা কিনে দিতে ও পাড়ায় চলে যাবে। ঘুরঘুর করবে পাড়া থেকে বাজার, বাজার থেকে স্টেশন, স্টেশন থেকে রেশন দোকান। কারও কোন প্রয়োজন হলে সে সেখানে থাকবে। কেন থাকবে, কীভাবে পৌঁছে যাবে, জানবে কী করে, এসব অবান্তর কথা। এ না জানলেও চলবে। শুধু, সে থাকবে, থাকে, থাকেই। এটাই নিয়ম। এ আর বেশী কথা কী!
সেদিন তুমুল বৃষ্টি। কেমন?এক হাত দূরের মানুষ আবছা লাগে তেমন। তার মধ্যে বাবার পা স্লিপ করলো সিঁড়িতে। মাথা ফেটে, পা মচকে সে এক বিদিকিচ্ছিরি কাণ্ড। ঘরে মানুষ বলতে আমি, বোন আর বাবা। মা গেছেন কবেই। সেও এই সিঁড়ি থেকে গড়িয়েই। আমি সিঁদুরে মেঘ দেখে ডরালাম। এই ঝুম বৃষ্টিতে কাকে পাই? বাবা রীতিমতো গোঙাচ্ছেন। মনে পড়লো, যদি তাকে পাই! সে তো সবার বিপদে সর্বত্রই। নীচের ঘরে বাবাকে বোনের জিম্মায় রেখে তাকে খুঁজতে ছাতা নিয়ে বের হলাম। অতি কষ্টে চুপচুপে ভিজে রাস্তার এ'মাথা ও'মাথা, দুলুর চায়ের দোকান, মাখনদের ছাদ তোলা রোয়াক, দেবেশদের গোয়ালঘর সব দেখে যখন ফিরলাম, বাবা মায়া কাটিয়েছেন, বোনের কোলে মাথা রেখে শান্তিতে ঘুমোচ্ছেন। সুবুক সুবুক করে কেঁদে চলেছে বোন। বৃষ্টিটা ধরে এসেছে। যদি ওকে পেয়ে যেতাম তাহলে হয়তো ওর ডেকে আনা ট্যাক্সিতে অন্ততঃ বাবাকে হাসপাতাল নিয়ে যাওয়ার সুযোগটুকু থাকতো। ইস, যদি সময়মতো ওকে পেয়ে যেতাম!
না। এর পর আর এ তল্লাটে ওকে কেউ দেখেনি। আমি বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন সমস্যায় আবার বারবার ওকে খুঁজেছি। শুধু আমি কেন, সবাই খুঁজেছে। কেউ পায়নি। দুলু জবাব দিতে দিতে নাজেহাল হয়েছে। ও ও ওকে দেখেনি। ও কোথায় কেউ জানে না। কেউ কোথাও ওকে দেখেছে বলেও শুনিনি। কতদিন ওকে দেখি না! দেখতে খুব মন চায়। কোথায় হতে পারে ও! যদি জানতাম ঠিক যেতাম। পেপারে দেব? ছবি চাই তো! তা ও তো নেই! এবার উপায়?
অশ্রু সু
শর্মিষ্ঠা
পেরিয়ে যায় কত কত দশ তারিখ! বছরের আবর্তে মাস! বয়স বেড়ে যায়, আয়ু গড়িয়ে চলে। অস্তমিত সূর্যের দেশে একে একে জ্বলে ওঠে মাটিতে জোনাক থেকে আকাশের তারা। পিক পিক আলো। কালপুরুষ, সপ্তর্ষীমণ্ডল। আরও কত কী! সবাই তো আর পরিচিত নয়! নাম-না-জানা অথচ বড্ড সহজ গল্পরা ফাঁকটাক খুঁজে টুক করে লুকিয়ে পড়ে। সহজ অচেনা হয়ে ওঠে। আড়াল হলো সহজ থেকে কঠিন রূপান্তরণের জ্যামিতিক বিচরণ।
এখন ধান রোয়ার কাজ চলছে। ক্ষেতের পাশে সোঁদা গন্ধ সর্বত্র। জমির গোড়ালি ডোবা জলে সাদা ধ্যানমগ্ন বক। দূর থেকে দেখলেও সনাক্ত করা যায়। মাঝে মাঝে কিছু কিছু জমিতে যেন সবুজ ভেলভেটি ওম ধরেছে। নদী শুকিয়ে উদোম চর। তার উন্মুক্ত বুকে শিবরাত্রির মেলা বসেছে। নদীর ওপর ব্রিজ যেন এখন পার থেকে দেখলে আকাশছোঁয়া মনে হয়। পারুলের বাবা জিলিপি ভেজে লোহার শিক দিয়ে তুলেই রসে ডুবিয়ে দিচ্ছে। গাঢ় আঠালো রস। রসের কড়াইতে লাভের পরিণামে আত্মহত্যা করেছে কয়েকটা ডাসা কালো পিঁপড়ে। তাদের নিয়ে কারোর কোনো মাথাব্যথা নেই। জিলিপি দাঁতে কাটলেই আঙুলের ফাঁক দিয়ে কব্জি বেয়ে গড়িয়ে নামে চিকন ধারা। চ্যাটচ্যাটে। চম্পা টাগরায় জিভের শব্দ তুলে চালতার আচার চিবিয়ে খাচ্ছে। চেবাতে চেবাতে অলীক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সার্কাসের তাঁবুর দিকে। ছোট তাঁবু। দু'চারটে বাঁদর, একটা হাতি আর কয়েকটা কথা বলা কাকাতুয়া। ওইই গরীব সার্কাসওয়ালার সম্বল। তার পাশে নৌটঙ্কি শুরু হবে। এসব বাইজির নব্য সংস্করণ। ওদিকে গোবিন্দ ঠিক তাক করে গাদাবন্দুকে লক্ষ্যভেদ করে ফেলেছে। সবুজ ফুলের মাঝের বেলুন থেকে ডানদিকের নীল বেলুন ঘেঁষা হলুদটা এবং সুতোয় ঝোলানো পেরেক আর পাঁচ পয়সা। খুশি ও। আহাঃ! পয়সা উসুল! শিবের ত্রিশূল কপালে এঁকে দিতে লালচন্দন নিয়ে ঘুরছে শিব ভক্তরা। আসলে স্টিলের প্লেটে কিছু নগদ পাওয়ার আশা।
এসব ডালভাতের দৈনন্দিন সংলাপ আর ভীষণ সহজের ভেতর খুউব সহজ হয়ে যেতে ইচ্ছে হয় ডালিয়ার। সহজ হতে পারলে যতিহীন হাউমাউ করে কাঁদা যায়। শুধু হৃদয় আছে বলেই অনাবিল নিঃশর্ত ভালোবাসা যায়। 'কখনও কি নদী হতে পারবো! আমাকে ঘিরে খুশির মেলা বসবে!' নিজের মনে বিড়বিড় করতে করতে ডালিয়া এগিয়ে যায় মেলার নকশীকাঁথায়। ধুলো ওড়ে হাওয়ায়। কত বুনোট! নির্দিষ্ট দূরত্বে সবাই। ঘুরতে ঘুরতে হাওয়ামিঠাইএর দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালো ও। এক 'বোঙ্গা' গোলাপি চিনি মাঝখানে ঢেলে দিচ্ছে যুবক ছেলেটা। গোল করে ঘুরছে স্টিলের বড় বাটি। চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে গোলাপি জাল। মাকড়সার জালের মতো। একটা কাঠি গোল করে ঘুরিয়ে সেটাই ওতে আটকে নিচ্ছে। ডালিয়া একদৃষ্টে দেখছিল মিঠাই বানানো। জিভে পড়লেই যে অস্তিত্বহীন, তার অবয়ব তৈরিতে কত কায়দা! কত রঙিন কল্পনার মায়াজাল! কারুকার্য! কয়েকমাস আগেও ইন্দ্রজিৎকে ও কতবার বলেছে, অনুনয় বিনয়ের সুরে, 'আমাকে একটা মেলা দেখাতে নিয়ে যাবে ইন্দ্র? কত বছর দেখি না! সেই ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে চরকের পিঠ ফোটানো দেখতে যেতাম। তারপর বড় হয়ে সব যেন গল্প আর স্মৃতি হয়ে গেল! কাগজের প্লেট থেকে তালপাতার চামচে ঘুগনি তুলে খেতাম। ময়ূরের পালকে ছোট ছোট ফুল লাগিয়ে ওরা ফুলদানি বানিয়ে দিত। আমিও দুটো কিনেছিলাম। পুতুলের জন্য। কতদিন হাওয়ামিঠাই খাওয়া হয় না! ইন্দ্র...' পিছনে ফিরে ডাকতেই শুনতে পেয়েছে নিচের তলার দরজা খোলার শব্দ। গ্যারেজ থেকে সটান বেরিয়ে যায় কালো স্কর্পিও। ইন্দ্রর অত সময় কোথায়! ডালিয়ার বকবক শুনবে! তার চেম্বারে তখন ক্লায়েন্ট বসে। ততক্ষণে অফিস থেকে দুবার ফোন এসে সারা!
― এই যে নেন।
ঘোর কাটলো দোকানের ছেলেটার ডাকে। হাত বাড়িয়ে গোলাপি হাওয়া মিঠাই নিয়ে যতটা সম্ভব হাঁ করে কামড় দিতেই কোথায় মিঠাই! শুধু মিঠাজল। আরেকবার, আবার... সববারই তাই। ডালিয়ার ঠোঁটের চারপাশে লেগে আছে গোলাপি আঁশ। ও প্রাণপণে শুষে নিচ্ছে ঈপ্সিত সুধা। সার্কাসের তাঁবুর ওপর দিয়ে উঁকি দিচ্ছে একটা তারা। নক্ষত্র। সেদিকে তাকিয়ে ওর মনে হলো, 'বাবাই না!'
সকালে প্রহ্লাদের মাকে রান্নার ফিরিস্তি দিয়ে ডালিয়া বেরিয়ে এসেছিল। টাঙন পারের শিবের মেলা দেখতে যাবে। এ বাড়িতে বাবা নেই প্রায় ছয় বছর। মা'ও গতবছর ডালিয়াকে ফাঁকি দিয়ে চলে গিয়েছেন। শীতের রাতে ঠাণ্ডা বরফের মতো শক্ত শরীরটা একলা পড়ে ছিল লেপের তলায়। ডালিয়া কয়েকদিন আগেই ইন্দ্রকে আর্জি জানিয়েছিল যে মাকে ওর কাছে এনে রাখার। কারণ উত্তরবঙ্গের এ অঞ্চলে শীতের বড্ড দাপট! সে আর্জি মঞ্জুর হতে আরও চারদিন। তারপর ট্রেনের টিকিট পেয়ে অকুস্থলে এসে পৌঁছানোর আগেই মায়া কাটিয়ে ফেললেন ওর মা।
ডালিয়া টোটো রিজার্ভ করে নেয়। একলা খোলা বাতাসে ভরদুপুরে ঘুরতে ওর খুব ভালো লাগে। উচ্ছন্নে যাওয়া মন্দ মেয়েদের মতো! যা ও কোনওদিনই হয়ে উঠতে পারেনি। মন্দ হয়ে ওঠা ওর কাছে রহস্য। তার অন্তরালে কী কী থাকে বা প্রাপ্তিযোগ কী তা জানার তুমুল ইচ্ছে ওর সেই বয়ঃসন্ধি থেকেই। ডালিয়ার তকমা, খুব ভালো মেয়ে। হাইরোডের বাঁপাশ ঘেঁষে মধ্যগতিতে ছুটছে বাহন। হঠাৎই ডালিয়ার মনে হলো, সেই বিয়ের পরে শপিং মলে ইন্দ্র ওর জন্য হট-প্যান্ট কিনতে গিয়ে কেমন তছনছ করা দৃষ্টিতে ওকে মাপছিলো! স্ট্রবেরি প্রিন্টের গোলাপি প্যান্টটা ওকে দিয়ে বলেছিল একটা গোলাপি ব্রেসিয়ার কিনতে। সাথে নেটের ট্রান্সপারেন্ট নাইটগাউন। ইন্দ্রর একের পর এক অযাচিত আবদারে ডালিয়া বিস্ফারিত নেত্রে কুঁচকে উঠছিল। রাতের আঁধারটুকু শরীর খেলার পরে সকাল হলেই এ যেন অন্য ইন্দ্র! সেদিন ক্যালেন্ডারে জ্বলজ্বল করছিল দশ। বিবাহবার্ষিকী। ‘আজও তো দশ! কেন একবারও খোঁজ নিলো না ইন্দ্র! কেন একবারও শুনতে চাইলো না আমায়! একবারও ফোন এলো না!...’ দু’হাত দিয়ে নিজেকে প্রায় জাপটে ধরলো ডালিয়া। টোটোতে ফরফর করে বাতাস এসে লাগছে চোখে-মুখে। ছিটকে পড়ছে সামান্য চোখের জল। খুঁজে পাওয়া দায়!
হলদিবাড়ী পেরিয়ে বাঁ দিকের ঢাল ধরে গাড়ি আলের পথ ধরলো। এবড়োখেবড়ো রাস্তা। এক মিনিট স্থির বসা যায় না। সমস্ত শরীরে ঝাঁকুনি। তলপেটের সেলাইয়ের জায়গাটা চিনচিন করে উঠলো ব্যথায়। প্রহ্লাদের মা অনেকবার বলেছিল, 'অহনও তো কাটা শুকায় নাই! ওই রাস্তায় এহন যাইস না মা! অত ঝাঁকুনি প্যাটে লাগব। ম্যালা তো থাকব পনেরদিন!...' ডালিয়া কথা শোনেনি। অবাধ্য হতে ইচ্ছে হচ্ছিল ওর। 'কখনও তো অবাধ্য হই! আমার কথাও তো কেউ রাখেনি! কেউ না! বাবাই, মা! ইন্দ্র! কেউই না! ডাক্তারবাবুও না! বাবাই তো ছেড়ে চলেই গ্যালো! কত কিছু বায়না না মিটিয়েই চলে গ্যালো! বলেছিল কাঁটাতার পেরিয়ে পদ্মা পারে আমরা দু’জন হাত ধরে জোৎস্নায় হাঁটবো! বলেছিল বাহিনের জমিদার বাড়ির ছাদে চুপিচুপি উঠবো! একদিন কালীর মোখা পরে রাতের অন্ধকারে তোর মাকে ভীষণ ভয় দেখাবো!...আরও কত কী! বাবাইএর সাথে তো আড়ি হয়নি কোনওদিন! তাহলে লুকিয়ে গ্যালো কেন! একবার শুধু জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি মাকে বেশি ভালোবাসো না আমাকে! সেও একবারই! একবারই রাগতে দেখেছিলাম বাবাইকে। তারপর আর কখনও জিজ্ঞেস করিনি। বুঝেছিলাম, ভালোবাসার পৃথক পৃথক সংজ্ঞা হয়।...' পেটের ব্যথাটা বাড়ছে। ডালিয়া ভাবলো, একবার টোটোওয়ালাকে বলবে দাঁড়ানোর জন্য। কিন্তু এখানে তো দূরদূরান্ত পর্যন্ত শুধুই জমি! জনমানবহীন! মেরুদণ্ড সোজা ও শক্ত করে বসলো ও। নিজেকে শক্ত করা ছাড়া অন্য উপায় নেই। ফিরে যাওয়াটাও বোকামো হবে। কারণ শহর ছেড়ে বহুদূর এসে পড়েছে ও।
দুটো বাঁক পেরোতেই মনে হলো একটা পাড়ায় ঢুকছে ও। হাতে সিমেন্টের খালি ব্যাগ নিয়ে বছর দশেকের এক মেয়ে গরুর চারিতে খড় ঢালছে। একবার মুখ তুলে দেখে নিলো ডালিয়াকে। এখানে বসন্ত এলেও শীত এক্কেবারে চলে যায়নি। শীত এখানে মিঠে রোদ্দুর বিছিয়ে দিয়েছে। লিচুগাছের ডালে কচিপাতা সুখ। রান্নাঘর থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসছে সেদ্ধ ভাতের ঘ্রাণ। পুকুরঘাট থেকে দুয়ার পর্যন্ত ভেজা চুলের ডগা থেকে টপটপ করে পড়তে থাকা জলের ডটেড লাইন নিঃসঙ্গ পড়ে আছে। যেন প্রেয়সী তাকে ত্যাগ করেছে এইমাত্র। তারই ইশারার দিকে ঠাঁয় তাকিয়ে। থালা ভরা বিউলির ডাল গা-গরমে ব্যস্ত। হাফপ্যান্ট পরা দুটি ছেলে ফর্দাফাই করে দিচ্ছে আম-কাঁঠালের গাছের গোড়ায় চড়ুইদের খুনসুঁটি। ওদের হাতে খড়ির পাতলা লাঠি। মাঝে মাঝেই পুঁইএর লকলকে ডগা টালির ওপরে পড়ন্ত রোদ্দুরে চকচক করছে। ডালিয়ার মনে পড়লো একবার পুঁইএর বিচি হাতে ডলে এক্কেবারে ভির্মী খাইয়ে দিয়েছিল মাকে। ‘আর সব্বার মতো মাও তো কথা রাখলো না!’ ধুলো উড়ছে চারপাশে। নিঝুম পাড়া। শুকিয়ে গেছে পুকুরের জল। সামান্য অবশিষ্টতেই কাদার ভেতরে গুগলি খুঁজছে কয়েকটি হাঁস। 'ইন্দ্র কেন যে ডঃ সেনের কথায় রাজি হলো! কেন বললো না একটু রিস্ক নেওয়া যায়। শুধু টিউমারটা কেটে বাদ দিয়ে ইউটেরাসটা রাখলে কী হতো! এক-দুমাস তো দেখাও যেত! সঙ্গে সঙ্গে তো আর ক্যানসার হচ্ছে না! আর কিছুদিন তো চেষ্টা করা যেত! যদি...'
বুকের ভেতরটা খালি হয়ে এলো ওর। মনে হলো ওর বদলে কোনও একটা অস্তিত্বহীন অবয়বকে বহন করে চলেছে টোটো। না, আর কোনও ঝাঁকুনি বোধ হচ্ছে না ওর। কোন ব্যথাও না! ধুলোর ভেতরে হালকা হাওয়ায় দুলে উঠছে ক্যালেন্ডার। আজকের তারিখ দশ। ‘শুভ বিবাহবার্ষিকী ডলি!’ নিজের মনে নিজেই বলে উঠলো ও। নাকি নিজেকে উইশ করলো! ‘এই নামেই তো ইন্দ্র ডাকত! কবে যেন শেষ ডেকেছিল!’ চৈত্রের রুখা-সুখায় জলদি শুকিয়ে যাবে তলপেটের সেলাই। ফসিলের মতো থেকে যাবে দাগ। ডালিয়া এতদিনে দাগরাজি হতে পেরেছে। একটু যেন হাসলো ও। মন্দ হতে আর বাঁধা কোথায়! ‘দিদি ম্যালা আইসা গ্যাছে। নামো! তুমি ঘুইরা আইসো। ঐদিকের অশত্থ গাছের তলায় আমি বইয়া থাকুম। তয় বেশি দেরি কইরো না!...’ টোটো থেকে নেমে দাঁড়ালো ডালিয়া। আর কিছুক্ষণ পরেই তো ধুলো জমে যাবে এই দশে। আবার অপেক্ষা অন্য কোনও দশের! ততক্ষণ না হয় একটু হুল্লোড় হয়ে যাক এই গন্তব্যহীন, লক্ষ্যহীন, বেনামি জীবনের সাথে! একা! বাবাইএর ‘ফুল’। মায়ের ডালিয়া আর ইন্দ্রর ডলি! ‘এক্কেরে নির্ভার!’...
বিপত্তি
রীনা মজুমদার
কর্তামশাই গিন্নিমাকে আড়াল করে, রাতে খাওয়ার সময় একটুকরো রুটি দিয়েছে আমাকে। সেই রুটি খেতে গিয়েই যত বিপত্তি মাঝরাতে!
গিন্নিমা সারাক্ষণ কর্তামশাইকে বলে চলে, "ওই নেংটি ইঁদুরকে বিষ দিয়ে তাড়াতে হবে। সারা ঘরময় এই দৌরাত্ম্য আর সহ্য করবো না। কর্তামশাইও ছাড়েন না বলতে, "গনেশ বাবার বাহন, বাবার দয়াতে ভাল মন্দ খাচ্ছ পরছো। সেটা মনে রেখো!"
কত্তামশাই আমাকে যারপরনাই আদর করেন। দিব্যি আছি।
একদিন কর্তামশাইকে না জানিয়ে গিন্নিমা এক বেড়ালছানাকে এনে হাজির। ব্যাস লেগে গেল কর্তামশাই ও গিন্নিমার সেই ধুন্ধুমার কান্ড!
গিন্নিমার যুক্তি-- মা ষষ্ঠীর বাহন। তোমার আদরের বাহন যদি থাকে, তবে মা ষষ্ঠীর বাহন কেন ঘরে থাকতে পারবে না? ছেলে মেয়ে দুটো বাইরে থাকে, ওদেরও ভালো মন্দ আছে!
কর্তামশাইও ছাড়ার পাত্র না, কত্তামশাইয়ের যুক্তি -- আমার নেংটি স্বাধীন ভাবে চলাফেরা করতে পারবে না।
আমি বাবা গর্তে বসে কর্তামশায়ের যুক্তিতে হাততালি দিই মহা আনন্দে। যাক, দেখেশুনে চলাফেরা করে ভালোই চলছিল আমাদের চারজনে।
বিপত্তিটা ঘটলো মাঝরাতে! সেদিন সেই একটুকরো রুটি খেতে গিয়েই। কর্তামশাইয়ের দেওয়া রুটিটা যেই না একটু কামড় দিয়েছি, হঠাৎ কখন মেনিটা এসে লেজে দিয়েছে পা! টান মেরে পালাতে গিয়ে-- উঃ আঃ কী যে কোমড়ে লাগলো! ঘুম আসে না ব্যথায়। গিন্নিমারও হয় ব্যথা। মনে পড়ল, গিন্নিমাকে দেখতাম ড্রয়ার খুলে একটা মলম লাগাতে। তাই নিঃশব্দে গেলাম একটু মলম লাগাতে! যেই না টেনেছি ড্রয়ারটা -- ক্যাচ করে একটা বিকট শব্দ!
ব্যাস! মাঝরাত, গিন্নিমা ঘুমের ঘোরে চোর চোর করে এমন চিৎকার! কর্তামশাইও ঘোরের মধ্যে কে কে? ধর ধর বলে পাড়া মাথায় করে চিৎকার চেঁচামেচি। পাড়ার লোক জন চলে এল। এ বলে পুলিশে খবর দাও, কেউ বলে কোথা দিয়ে পালালো! ধরতে পারলে জ্যান্ত পিটিয়ে মারব।
কে কার কথা শোনে! রাত কেটে ভোর হয়ে গেল তবুও কর্তামশাই গিন্নিমা শান্ত হয় না! বিপত্তি বলে কথা!
এ তো মহা বিপদ। আমি কী আর করি! গর্তে ঢুকে বাবাকে ডাকি, শান্ত করো বাবা দুজনকে। বছর শেষের এই বিপত্তি আর না আসে। বছর শুরু হয় তো আমার বাবার পুজো দিয়েই!
সারারাত ঘুম হয়নি, জয় বাবা গনেশ।
ইমনকল্যাণ
অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী
ড্রইং রুমটায় নীচু স্বরে গুঞ্জন উঠছিল থেকে থেকে।কদিন ধরেই এমন চলছে।মধুরা নার্সিং হোম থেকে বাড়ি ফেরার পর থেকেই।আজ তো দোলের অজুহাত আছেই। রং দেওয়ার আছিলায় আরো একটু বেশি সংখ্যায় এরা সব এসে হাজির হয়েছে।মায়ের অবিরাম বলে চলায় আর কান্নাকাটিতে মধুরাকেও এসে দাঁড়াতে হয়েছে এদের মাঝে।কত দুঃখ আর দেবে বাবাকে, মাকে। এমনিতেই তো মরে বেঁচে আছে মানুষ দুটো কিছুদিন যাবত।মধুরাকে একটু স্বাভাবিক দেখলে, ওর মুখে একটু হাসি দেখলে প্রাণ পায় যেন এঁরা। নিজের জীবনের সমস্ত রং চলে গেলেও অনুজ্জ্বল ফ্যাকাসে মুখে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে তাও মধুরা এঁদের জন্যই শুধু সকলের দেওয়া রং মুখে মেখে ঘরের এককোণে বসেছে সবাইকে সঙ্গ দিতে।
জানলা ঘেঁষে বসে বেশ অনেকটা ওপর থেকে দামাল বসন্ত বাতাসের হুটোপুটির দিকে আলগোছে চেয়ে ছিল মধুরা। দামাল..ঠিক আবিরের মতো।মুখটা মনে ভেসে উঠতেই চোখের কোণ চিকচিক করে উঠলো।
অবন্তীকার প্রায় ফিসফিস করে বলা আন্তরিক কথাগুলো কানে এল,
'কী করে ওর মতো ছেলে এমন পারলো! আবিরের বিয়ে!আমার তো ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে।'
খসখসে গলায় চাপা স্বরে ব্রততী বলে উঠলো,'না ভাবতে পারার আছেটা কি? এটাই খুব স্বাভাবিক।ওর নিজের জীবন,নিজের সিদ্ধান্ত এবং উপযুক্ত সঠিক সময়ে ও সেটা নিয়েছে।'
নীচু আওয়াজে বাসবীদি যোগ করলো,'যতই আমরা এগোই না কেনো,এখনও সমাজ, পরিবার ও কিছু মূল্যবোধের ওপরে আমরা উঠতে পারিনা।'
কাতর স্বরে অবন্তীকা বলল,'থামবে তোমরা প্লিজ.. কোথায় বসে কথাগুলো বলছো সে খেয়ালটুকু অন্তত রাখো..'
এত মন কেমনের মধ্যেও হঠাৎ খুব হাসি পেল মধুরার। এই ব্রততী আর বাসবীদি মিলেই কিছুক্ষণ আগে মায়ের সামনে কত ভালোবাসা দেখিয়ে মধুরাকে জোর করে ফলগুলো খাওয়ালো....
আর নিতে পারছেনা মধুরা।এরা নিয়ম করে সেই কবে থেকে দায়িত্ব নিয়ে আসা শুরু করেছে এখানে।মা-বাবার ধারণা এরা এলে মধুরার মন ভালো থাকবে,ও পুরোনো সবকিছু ভুলে যাবে ধীরে ধীরে, ওর একা লাগবেনা।ও একা ঘরে থাকলেই মা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে,বাবা অস্থির হয়ে বাড়িময় পায়চারি করে বেড়ায়।এমনিতেই এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেছে..বাবা- মাকে নতুন করে আর চাপ দিতে মন চায়না বলেই এদের মাঝে এসে বসা।মধুরা শুধু অবাক হয় এটা ভেবেই ,ওকে যারা ছোট থেকে মানুষ করলো ওর মনটাকে একটুও বোঝেনা তারা। বাবা- মাকে কিছুতেই বোঝাতে পারছেনা, ওর এখন কিছুদিন নিজের মতো করে থাকবার খুব প্রয়োজন....
বড় বিরক্তিকর লাগছিল মধুরার। দম আটকে আসে আজকাল সকলের এই অতিরিক্ত মনযোগে, এতটা বাড়াবাড়ি রকমের লোকদেখানো ভালোবাসায়। সবটাই ভীষণ মেকি মনে হয়। সবাই মিলে এগুলো করে আরও বেশি করে প্রতি মুহূর্তে মনে করিয়ে দিচ্ছে সেই ভয়ংকর দিনটির কথা। করুণা ঝরছে যেন সকলের দৃষ্টিতে। 'কারো অনুকম্পা চাইনা আমার.. চাইনা'.... চিৎকার করে বলে উঠতে মন চায়।
ছোটবেলা থেকে এমনিতেই না চাইতেই সব পেয়ে বড় হয়ে ওঠা। বড় দুই দিদির সঙ্গে বয়সের বিস্তর ফারাক থাকায় বহুবছর আগেই তারা নিজ নিজ কর্মজীবনে, সাংসারিক জীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। বাবার চাকরি থেকে অবসর আর মধুরার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বার শুরু। বাড়ির সকলের থেকে প্রয়োজনের চাইতে বেশি আদর পেলেও মধুরার চাইতে বয়সগত বিস্তর ফারাকের জন্যই হয়তো বা বাড়ির কেউই সে অর্থে মধুরার বন্ধু হয়ে উঠতে পারেনি।
ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বার সময় থেকেই জীবনে বন্ধুত্বের আসল আস্বাদ মিলেছে। চাকরিতে জয়েন করবার পর সেই পরিধি বেড়েছে আরও। বাড়ির লোকজন, পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন, চেনা পরিচিত লোকজনদের সঙ্গে সঙ্গে সেই কাছের, ভালোবাসার বন্ধুদের, কলিগদের মুখগুলোও কেমন অচেনা হয়ে গেছে এখন। মধুরার মুখের দিকে তাকিয়ে ওর ভেতর পর্যন্ত পড়ে নিতে চায় ওরা কেউ কেউ। মা ঘরে না থাকলে এমন সব প্রশ্ন করে, যে মধুরার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে,
'তোমরাও যে মেয়ে সেটা ভুলে যাও কেমন করে? এ ঘটনাটা সেদিন তোমাদের যে কারোর সঙ্গে ঘটতে পারতো। '
মনের সমস্ত প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে আর ক'দিনের মধ্যে অফিস যাওয়া শুরু করবে ভেবেছিল। ভেতরের যে দগদগে ক্ষত সে তো রয়েই যাবে নিজের মতো। তবুও সময়ই হয়তো প্রলেপ হয়ে উঠবে একদিন এ কথা ভেবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল স্বাভাবিক জীবনে ফিরতেই হবে, নিজের জন্য যতটা নয় বাবা মায়ের জন্য আরো বেশি করে। কিন্তু সেখানে তো এরাই থাকবে।এই মানুষগুলিই।এ মুহূর্তে বাইরে কোথাও চাকরির খোঁজখবরের কথা ভাবতেও পারছেনা। অচেনা নতুন কোনো পরিবেশে গিয়ে নতুন করে মানিয়ে নেবার মনও নেই আর।
ভুলতে চেয়েও ভুলতে পারে কই.. মধুরার মন বার বার পিছিয়ে যায় অন্ধকার সেই দিনটিতে।
পাশের দুরন্ত পাহাড়ি ঝোরাটির মতোই কলকল করতে করতে এগিয়ে চলেছিল কয়েকজনের ছোটখাটো একটি দলের স্বতঃস্ফূর্ত ছেলেমেয়ে গুলো। হঠাৎ পাওয়া কয়েকদিনের ছুটির আনন্দ লুটে নিতে ঝাঁক বেঁধে বেরিয়ে পড়েছিল ওরা।
পূর্ব ভারতের এই অদেখা পাহাড়টিকে ঘিরে মধুরার বেশ কৌতূহল ছিল। সাহিত্যপ্রেমী বাবার কাছে এই পাহাড়ের পৌরাণিক গল্প শোনার পর থেকে এই পাহাড় ওকে টানতো খুব। আবিরকে একবার কখনো বলেছিল সবটা। ব্যাস্, সে- ই তোড়জোড় করে সকলকে একসঙ্গে করে এখানে আসবার পরিকল্পনা করে ফেলল। আবির এমনই। শান্ত মধুরার জীবনে ঝোরো হাওয়া হয়ে এসেছিল সে। মধুরার মনের সমস্ত বন্ধ দরজাগুলোও জীবনের প্রথম ভালোবাসার মানুষকে পেয়ে সমস্ত আগল ভেঙে অচেনা স্রোতের টানে ভেসে গিয়েছিল। তারপর.... শুধু ভালোবাসা আর ভালোবাসা....
এখানে এসেও বন্ধুরা একটু বাড়তি ভালোবাসার সুযোগ করে দিয়েছিল আবির আর মধুরাকে। সকলের সঙ্গে বেড়িয়েও তাই দলছুট হয়ে নিজেদের মতো করে চারিদিকের সৌন্দর্য্যকে লুফে নিতে নিতে আর বাবার থেকে শোনা কল্পলোকের ছবি আঁকতে, আঁকতে আবিরের হাত ধরে এগিয়ে চলেছিল মধুরা।
গল্প কথার মাঝে হঠাৎ ওরা আবিষ্কার করেছিল, ওরা পথ হারিয়েছে। প্রথমে খুব মজা লেগেছিল দুজনের। এরপর ধীরে ধীরে সন্ধ্যার ছায়া গাঢ় হতেই কেমন একটা অনুভূতি বাসা বাঁধছিল মনের মধ্যে। দুজনে মিলে বন্ধুদের নাম ধরে অনেক ডাকাডাকি করেও সাড়া পায়নি কারো। ছায়া ছায়া পথ ধরে কয়েকটি লোক তাদের পালিত পশুগুলিকে নিয়ে বাড়ি ফিরবার পথে তাদের দেখে দাঁড়িয়ে পড়েছিল সেখানে। ওদের সবটা বলায় ওরা পথ দেখিয়ে ওদের নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলল।
'না, না, না'..... নিজের তীব্র এই আর্তনাদ নিজের কানে এখনও বড় স্পষ্ট মধুরার। একটা প্রায় অন্ধকার ঘরে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসা লোকগুলো বেঁধে রেখেছিল আবির আর ওকে। ওদের মোবাইল থেকে শুরু করে সঙ্গে থাকা টুকিটাকি সমস্ত জিনিস নিজেদের জিম্মায় করে নিয়েছিল ওরা। এরপর মধুরার দিকে হাত বাড়িয়েছিল। ওদের অনুনয়, কাকুতি মিনতি, চোখের জল কিচ্ছু সেই নির্মমতা, বিকৃতি, পাশবিকতাকে স্পর্শ করেনি। আবিরের চিৎকার, প্রতিবাদ সব ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছিল ওদের লিপ্সার কাছে। প্রচন্ড মারধোর করে আবিরকে প্রায় অজ্ঞান করে ওরা তিনজন পর পর ক্ষুধার্ত শিকারি পশুর মতো মধুরার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। যন্ত্রণা ও আচ্ছন্নতার মধ্যেও আবিরের কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছিল মধুরার কানে। চরম অসহায়তার মধ্যে দিয়ে পার হয়েছিল সেই অন্ধকার রাত। মানুষরূপী হিংস্র পশুগুলোর লালসার শিকার অচেতন মধুরাকে নিয়ে আবিরের সেখান থেকে ফিরে আসা, সে এক অন্য গল্প।
নিজেকে নার্সিং হোমের বেডে আবিষ্কার করবার পর থেকে এই কিছুদিন আগে পর্যন্ত মধুরাকে একমাত্র সাথ দিয়ে গেছে আবির। আর সকলে সঙ্গে থেকেও যেন সঙ্গে নেই। বাড়ির লোকেরা লজ্জায়, কে কী বলবে সেই ভাবনায়, অহেতুক কান্নাকাটি করে আরও দুর্বল করেছে মধুরাকে। কী হতে পারতো বা পারতোনা তা নিয়ে খোশ গল্প বানিয়েছে অনেক কাছের আত্মীয়েরা। এর পরবর্তী পদক্ষেপ কী হতে পারে তা নিয়ে নীতি উপদেশ দিতে বিনা আমন্ত্রণেই বাড়িতে এসে আজকের মতোই প্রায় প্রতিদিন আড্ডা বসিয়েছে কিছু বন্ধু, কলিগ। কিছুদিন আগে পর্যন্ত এই পরিস্থিতি অনেকটাই সামলে নিয়েছে আবির। বাড়িতে লোকজনের আসা যাওয়া অনেকটাই কমে এসেছিল তখন আগের তুলনায়। তবে হঠাৎ করেই আবিরের আসা- যাওয়া বন্ধ হয়েছে কয়েকটা দিন ধরে। মধুরাকে বলেছে অন্য কোম্পানিতে জয়েন করবে শিগগিরই, তাই ব্যস্ততা চলছে খুব।
মধুরার চিকিৎসা থেকে শুরু করে কাউন্সেলিং, ওকে ওই ভয়ানক ট্রমা থেকে বের করে আনার জন্য ডাক্তারের নির্দেশে যাবতীয় কিছু নিয়ে যা কিছু করবার সবটাই একার দায়িত্বে করে গেছে আবির। একবারের জন্য কোনো সমবেদনা, অহেতুক সহানুভূতি দেখায়নি মধুরার সামনে। মধুরার মুখটা দেখে কষ্টে বুক ফেটে গেলেও হাসিমুখে সবটা করে গেছে কোনো প্রসঙ্গ না তুলে। আবিরের এই গভীরতা বারে বারে ছুঁয়ে গেছে তখন মধুরাকে। আরও ভালোবেসেছে ওকে,শ্রদ্ধা মিশে গেছে সে ভালোবাসায়।
আবির বিয়ে করবে এরমধ্যেই.. কানাঘুষোয় খবর এসেছে মধুরার কাছে। এখনও তো ওর কলিগরা এ নিয়েই কথা চালাচালি করছে। একেবারে প্রথমে খবরটা মধুরাকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। ওই নারকীয় ভয়াবহতার থেকে বের হবার লড়াইয়ের মধ্যে আবিরের বিয়ের খবর প্রচন্ড আঘাত হয়ে এসেছিল মধুরার কাছে। ফোনেও একবারের জন্যও এ নিয়ে প্রশ্ন করেনি আবিরকে। মধুরার বাস্তববাদী মন নিজেকেই নিজে বুঝিয়েছিল অনেককিছু। সত্যিই তো, ওরা দুজন দুজনকে ভালোবাসলেও বিয়ের কোনো প্রতিশ্রুতি কখনো দেয়নি আবির। ওদের আলাপ ও ভালোবাসার সময়কালও খুব অল্প দিনের। আবির সবসময় বলতো, 'ভালো বন্ধু হিসেবে আমাকে সবসময় পাশে পাবি।'বন্ধুর দায়িত্ব সে নিজের সবটুকু দিয়ে পালন করেছে। তবুও এই ভরা বসন্তে কুয়াশা জমাট বাঁধে মনে। একরাশ শীতকাল বরফ শীতলতা নিয়ে ছেয়ে বসে রন্ধ্রে রন্ধ্রে। দুচোখ ছাপিয়ে অকাল বর্ষার জলধারা নেমে আসে গাল বেয়ে।
দু সপ্তাহ পর.....
কুমকুম চন্দনে সাজানো স্নিগ্ধ মুখখানির দিকে তাকিয়ে ছিল আবির। রাজ্যের বাইরে একটি কোম্পানির নতুন চাকরিতে জয়েন করবার তাড়াহুড়োয় চটজলদি এই বিয়ের সিদ্ধান্ত নিতে হলো আবিরকে। এজন্য পাত্রীর বাড়ির ও আবিরের বাড়ির লোকেরা কেউই সেভাবে প্রস্তুত ছিলেননা।হাতে হাত রেখে মন্ত্রোচ্চারণের সময় নিজের হাতের উষ্ণতা টুকুকে ভরসায় ও বিশ্বাসে ছড়িয়ে দিচ্ছিল নববধূর হাতে।নিজের চোখের আনন্দকে ভাগ করে নিচ্ছিল কাজল কালো মায়াবী চোখদুটির সঙ্গে।সাত পাকের প্রতিটি আবর্তের চিরন্তন ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা জড়ানো কথাগুলিকে আগামীর নিশ্চিত সত্য হিসেবে অগ্নি দেবতার কাছে প্রার্থনা করে নিচ্ছিল দুটি সুন্দর মন।
'যদেতৎ হৃদয়ং তব, তদস্তু হৃদয়ং মম। যদিদং হৃদয়ং তব, তদস্তু হৃদয়ং মম..... ' বৈশাখী বাতাসে উড়ে উড়ে মধুর ধ্বনি হয়ে ভেসে বেড়াচ্ছিল শুভ পরিণয়ের মন্ত্রোচ্চারণ। আবিরের দেওয়া সিঁদুর ছুঁয়ে যাচ্ছিল মধুরাকে.. হ্যাঁ, মধুরাকেই।একটা ঘোরের মধ্য দিয়ে, একটা সুন্দর স্বপ্নের সত্যি হবার মাহেন্দ্রক্ষণকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে পার হচ্ছিল ওরা দুজন। মধুরার চোখের বিষন্নতা তখন বদলে যাচ্ছিল আনন্দে, মন জুড়ে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল মিষ্টি এক আগামী, যার সবটা জুড়ে শুধু একটাই নাম..... 'আবির'....আর আবিরের ঠোঁট এত ভিড়ের মাঝেও মধুরার কানের কাছে নির্জনতা খুঁজে নিয়ে 'বন্ধু' বলে ভালোবাসার আশ্বাস ছড়িয়ে ডেকে নিচ্ছিল সুন্দর এক উজ্জ্বল সত্যিকারের গল্পকে।
রম্য রচনা
সেদিন চৈত্র মাস
স্বপন কুমার দত্ত
আবার একটা বছর হয়ে গেল শেষ। চারদিকে উদাসী মন পাগল করা হাওয়া বোধহয় বুঝিয়ে দেয় -- এখন চৈত্র মাস। শুকনো পাতা উড়িয়ে, ধূলো ছড়িয়ে, পুরোনোক সরিয়ে নতুনের আবাহনে তাই মাতোয়ারা চৈত্র মাস।
সেকারণেই বোধহয় সঠিকভাবেই কবি লিখেছিলেন,-- " সেদিন চৈত্র মাস, তোমার চোখে দেখেছিলেম আমার সর্বনাশ।"
সর্বনাশের শুরুতো চৈত্রের প্রথম থেকেই। চৈত্র সেলের বড় বড় সাইনবোর্ড বক্ষ বিদীর্ণ করা লক্ষ্মণের শক্তিশেলের থেকেও আরো ভয়ঙ্কর। আপনি আপনার অর্ধাঙ্গিনীকে যতই বোঝান, যে সেলের জিনিস ভালো হয়না, কোন ব্যবসায়ী অত বোকা নয়,যে লাভ ছেড়ে দিয়ে ফিফটি পার্সেন্ট ডিসকাউন্টে মাল দেবে। ভবি ভোলবার নয়, আপনাকেই বুদ্ধু বলে অভিহিত করে একগাদা বাজার হবে সেলের হাট থেকেই। উল্টে বোঝাবে, গোটা বছরের প্রেজেন্টেশন, মাসীর শাড়ি আরও কত কী যে সস্তায় হল--তুমি
বুঝবে কোত্থেকে? ছাত্র ঠেঙিয়ে ঠেঙিয়ে বুদ্ধিটাও করে ফেলেছ ভোঁতা! কিন্তু ওনার তখন বোধোদয় হয়, তখনতো সব শেষ! এক ধোয়ার পর? লাভের গুড় খায় পিঁপড়েয়! সেলে কেনা বারো হাতের শাড়ি ন' হাত হলে বপুতে আর কুলোয় না। আরে কলেবর হস্তীসম হলে সেলের মালের আর দোষ কি? ডাইনে টানলে বিয়ে হয়না, আর বায়ে টানলে.... সাধে কি আর বলে," বারো হাত কাপড়েও কাছা দিতে পারে না।"
চৈত্র মাসে বের হয় , গাজনের সঙ। ঢাকের বাদ্যির সাথে সাথে শিব পার্বতীর নাচ, হনুমানের
লম্ফঝম্ফ, মুন্ডমালিনী কালিকার ভয়াল মূর্তিসহ শোভাযাত্রা আরও কত কী! সারাবছর আমজনতা যে সঙ সেজে নেত্যসহ সংসার করে, এটা বোধহয় তারই প্রতীকী! গিন্নির মন পাবার জন্য ভেতরে চাপা রাগ থাকলেও হাসি হাসি মুখ করে প্রেমিক পতি সাজতে হয়। গাজনের সঙ এর চেয়ে এগুলো কম কিসে?
এমাসের কল্যানে আছে, সিদ্ধি,ভাঙ, গাঁজা, আফিমের নেশার মৌতাতে বুঁদ হয়ে থাকার ঢালাও ব্যবস্থা। অবশ্য বাঘছাল পরিহিত ভোলে বাবার ঐ ব্যাকডেটেড ফর্মুলার নেশা এখন একেবারেই অচল। বরং বিশ্বায়নের কল্যানে মুক্ত বানিজ্যের ছত্রছায়ায় প্রদান করে নিয়েছে, চরস,ড্রাগস,ব্রাউন সুগার,হাসিস আর সর্বকালের প্রাণহরা সোমরস " বিপিনবাবুর কারণ সুধা!"
এরপর চরকের বনবন পাক খাওয়া। পাক খাওয়ার শুরুতো জন্মের আগে থেকেই। মাতৃজঠরে থাকবার সময়েই ডাক্তারের কাছে পাক খাওয়া! পাক খেয়ে ভূমিষ্ঠ হয়েও নেই নিস্তার। এরপর স্কুলে ভর্তির জন্য শুরু হয় পাক খাওয়া। সেও দারুণ রকমারী। মার ইন্টারভিউ, বাবার পারসোনালিটি টেষ্ট ,তারপর অবোধ
শিশুটির লটারির পাক খাওয়ার পর বরাত ভালো হলে ছিড়বে ভর্তির শিকেয়। পাক খাওয়ার শেষ হয়না সহজে। পাশ করে চাকরির জন্য অবিরাম পাক খাওয়া। দরজায় জানালায় পাক খেতে খেতে কপালের জোর থাকলে ঘুচতে পারে বেকার নামের বদনাম। হল এবার চাকরি, এবার চাই নারী। অর্থাৎ বিয়ে, সেখানেও পাক খাওয়া। ছাদনাতলায় না ছ্যাদা হবার তলায় - একেবারে গুণে গুণে সাতটি পাক খেয়ে
তবে আপনার মোক্ষলাভ! সবথেকে হালকা শোলার টোপর পড়িয়ে দিয়ে পরে বিরাশি সিক্কা ওজনের মাল বহনের উপযুক্ত করবার জন্যই বোধহয় চোখকান বুঁজে সাতপাক খাওয়ানোর ব্যবস্থা!
এক বন্ধুর বিয়েতে বরযাত্রী গিয়ে হাত পাক ঘোরাবার সময় লেগে গেল ধুন্দুমার কান্ড। পাত্রপক্ষের বক্তব্য , সাতপাক হয়ে গিয়েছে।অথচ কন্যাপক্ষ মানতে নারাজ, তাদের নাকি হয়েছে ছ' পাক। কেউ রাজি নয়, এক ইঞ্চি জমি ছাড়তে। অগত্যা আমাকেই নামতে হয় ময়দানে। বন্ধুকে বলি, " ডরো মত্, তুমিতো এখন ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছ সূর্যের মতো, তোমার চারদিকে পাক খাচ্ছে তোমার অর্ধাঙ্গিনী। যাহা সাত,তাহাই আট। ওতে কিছু যায় আসে না। এরপর তোমার প্রিয়তমা থাকবেন ঠাঁয় বসে আর তুমি বেকুব তার চারপাশে পাক খেয়ে মরবে লাট্টুর মতো। মুখে ' রা ' কাড়বার থাকবেনা ক্ষমতা। সর্বদাই
মোলায়েম করে বলতে হবে," দেহি পদপল্লব মুদারম"! বিয়ে বাড়ীর লোকজন সব হাসিমুখে আর একপাক ঘুরিয়ে হন ক্ষান্ত।
এরপরতো জীবনের অন্তিম কাল পর্যন্ত শুধু পাক খাওয়ার পালা। প্রাত্যহিক জীবন যাত্রা, ছেলের পড়াশোনা, মেয়ের বিয়ে, সংসারের খুঁটিনাটি বিষয়ে অবিরাম একই পাক খেয়ে চলা। পিঠে বড়শি সেঁধিয়ে চরকের খুঁটিতে ঝুলিয়ে মানুষের পাক খাওয়ানোটা তাইতো সংসার আবর্তে পাক খাওয়ার সমার্থক। বেঁচে থাকবার লোভে মানুষতো আগেই টোপ লাগানো বড়শি গিলে বসে আছে। টোপ ও যায়না খোলা আবার বড়শিও যায়না খোলা। এ এক আজব" খুড়োর কল"!
সংসারী মানুষই যে শুধু পাক খাওয়ার যন্ত্রণায় বিদ্ধ তা নয়, সংসার বিবাগী রামপ্রসাদ ও ওই বেদনায় দীর্ণ। তাইতো তিনি গেয়েছিলেন, " মা আমায় ঘোরাবি কত, কলুর চোখ ঢাকা
বলদের মতো।"
তবুও আসে চৈত্র মাস, আসে চৈত্র সেলের বাজার, বাজে গাজনের ঢ্যাম কুড়াকুড় বাদ্যি, চলে গাজনের সঙ। মন আনচান করা এলোমেলো হাওয়ায় গাছের পুরোনো পাতা ঝরিয়ে চৈত্রমাস ঘোষণা করে নতুন বছরের আগমন বার্তা। পুরোনোকে সরিয়ে তবেইতো জায়গা নেবে নতুন।
ছবি
চিত্রাক্ষী রায়