প্রিয় কুশলদা,
আজকের দিনটা যেন সত্যি বড় সুন্দর হয়ে ফুটে উঠেছে আকাশের ক্যানভাসে। চৈত্রের শেষ। গাঢ় সর্ষের তেলের মতো রোদ্দুর যেন গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে আকাশের গা থেকে। আর বাতাস চৈতি রোদের কড়া মেজাজ নিয়ে উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। তুমি হয়তো আজ আর অনুভব করতে পারবে না, কারণ গুগল বলছে তোমার বার্মিংহামে আজ তাপমাত্রা ১৭ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড। বহুদিন পর আজ তোমায় চিঠি লিখতে বসেছি। এই হোয়াটসঅ্যাপের রমরমা যুগে আগের মতো চিঠি লেখা তো হয়েই ওঠে না। আবার চিঠির উত্তর পাবার জন্য যে তীব্র অপেক্ষা, তাও আর বেঁচে নেই!
আমার জানালার উল্টোদিকে তোমার "পার্বণ" আর তার সামনের ঝাঁকড়া কদম গাছটা থেকে পাখিদের কলস্বর ভেসে আসছে। গাছটার সারা শরীর জুড়ে দুলছে আলো-ছায়া। আর সেই আলোছায়ার পটভূমিতে বাতাসের সূক্ষ্ম শরীর নিয়ে যেন হাজির হয়েছ তুমিও। কিছুদিন পর তোমার মানসকন্যা "পার্বণ" বৃদ্ধাশ্রমটি চারবছরে পা দেবে। আজ খুব আনন্দ নিয়ে তোমাকে জানাতে ইচ্ছে হচ্ছে যে, তোমার "পার্বণ" বৃদ্ধাশ্রম এবং "গরম তাওয়া" কিচেন দুটো উদ্যোগই খুব খুব সফলভাবে চলছে। দুটো জায়গায়তেই বেশ কিছু লোকের কর্মসংস্থানও হয়েছে। সিনিয়র সিটিজেনদের সাহায্য করবার পাশাপাশি যা ছিল তোমার একান্ত স্বপ্ন। তুমি যেদিন প্রথম জানিয়েছিলে তোমার পৈত্রিক ভিটেতে কোন বহুতল নয়, একটি বৃদ্ধাশ্রম বানাতে চাও এবং সম্পূর্ণ ঘরোয়া পদ্ধতিতে তাঁদের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করবার জন্য লাগোয়া একটা কিচেনের ব্যবস্থাও করতে চাও, সেদিন কী খুশি যে হয়েছিলাম বলে বোঝাতে পারব না, কুশলদা! সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে অবসর নিয়ে গণিতে মাস্টার্স করবার পর তুমি যেদিন ব্রিটেনে পাড়ি জামালে সেদিন তোমাকে খুব স্বার্থপর মনে হয়েছিল। মনে হয়েছিল গড়পড়তা সবার মতো তুমিও বুঝি পাউন্ডলোভী। কিন্তু যখন কোন সরকারি বা বেসরকারি সাহায্য ছাড়াই সম্পূর্ণ নিজের উদ্যোগে তুমি দেশ ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতায় দেশের সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য কল্যাণকর কার্যক্রম গ্রহন করতে চাইলে, নিশ্চিত করতে চাইলে তাঁদের ব্যাংক, হাসপাতাল, আদালতসহ সব নাগরিক সেবা পাওয়ার অধিকার, তখন সত্যি আনন্দে নেচে উঠেছিল আমার বুক। তোমার প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা আরও বেড়ে গিয়েছিল।
সুজয় চলে যাওয়ার পর আমি তখন সদ্য সতেরো বছরের ঋককে নিয়ে বাবা-মায়ের বাড়িতে এসে থাকতে শুরু করেছি। আমার দাদা চাকরিসূত্রে ব্যাঙ্গালোরে। সেখানেই বৌদির চাকরি, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া ইত্যাদি নানা কারণে আর বাংলায় ফেরেনি, ফ্ল্যাট কিনে নিয়ে সেটেল করেছে সেখানেই। কালেভদ্রেও উত্তরবঙ্গে বাবার ভিটেতে আসার সময় সে পায় না। তখন বাবার বাড়িটি আগলে রাখার দায়িত্ব আমিই নিয়েছিলাম। তাই তোমার মিশানে যুক্ত হতে তখন কোন সমস্যা হয়নি আমার।
এই মুহুর্তে আমার জানালা দিয়ে "পার্বণ" থেকে গান ভেসে আসছে — "ভা-আ-আ-আ-ঙো, বাঁধ ভেঙে দাও, বাঁধ ভেঙে দাও..." সামনেই ২৫ শে বৈশাখের অনুষ্ঠান ও পার্বণের জন্মদিন পালিত হবে। আবাসিক মাসীমা- মেসোমশাইদের রিহার্সাল চলছে। বৃদ্ধাবাসের নামকরণে সময় আমি বলেছিলাম "নবজীবন বৃদ্ধাবাস"। কিন্তু
আপত্তি জানিয়ে তুমি বলেছিলে, "না না,
কোন বৃদ্ধাশ্রম-ট্রম নয়। এখানে ওঁদের জীবন হবে পার্বণমুখর। তাই নাম হোক পার্বণ।
"পার্বণ" আর "গরম তাওয়া"-কে দেখাশোনা করবার জন্য আমাকে ম্যানেজার হিসেবে নিযুক্ত করেছিলে তুমিই। আমি নিতে না চাইলেও আমাকে সেজন্য পারশ্রমিক দাও। তুমি সাফ জানিয়েছিলে পারিশ্রমিক ছাড়া কাউকে দিয়ে কাজ করাবে না। সেই আমার জীবনের প্রথম নিজস্ব রোজগার, যার সঙ্গে তুমি ও তোমার কর্মকান্ড জড়িত।
শুধু মুখে মুখে নয়, সত্যিকারই তুমি সিনিয়র সিটিজেনদের সম্মান এবং মূল্যায়ন করেছ। পার্বণে থাকা খাওয়ার মূল্য তুমি খুব সামান্যই ধার্য করেছ। ফলে কম টাকা পেনশনভোগীরাও অনায়াশে এখানে থাকতে পারেন। তোমার ও আমার ছোটবেলার প্রতিবেশি অনেক কাকু-কাকীমা আজ পার্বণের আবাসিক। এক কথায়, দূর থেকেও তাঁদের তুমি আগলে রেখেছ।
আমাদের দেশে 'সিনিয়র সিটিজেন'দের সংখ্যা যে বাড়ছে তা তোমার নজর এড়ায়নি। সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য তোমার আন্তরিক ভাবনা-চিন্তা ও কর্মকান্ডের জন্য আজ তোমাকে প্রাণভরা শুভেচ্ছা জানাই, কুশলদা। নতুন বছরে তোমার পার্বণ আরও আরও আলোর পথে এগিয়ে চলুক, কামনা করি।
আমার প্রণাম ও ভালোবাসা নিও। সুস্থ থেকো।
ইতি
সুমী
মৌসুমী চৌধুরী
No comments:
Post a Comment