বর্ষাযাপন
অভিজিৎ সেন
একবুক মরুতৃষ্ণা নিয়ে চাতকের মতো আকাশের দিকে চেয়ে ক্লান্ত শ্রান্ত আতপ্ত দেহ,মন যখন ঘনকৃষ্ণ মেঘপুঞ্জ আকুল অন্তরে ডেকে যায়--যখন অগ্নি বলয়ের কঠোর তপস্যা ক্ষেত্রে অনুশীলনে প্রকৃতিও ক্লান্ত হয়ে অপেক্ষা করে বৃষ্টি সুধার--যখন অরণ্যে ময়ূর-ময়ূরী অনুরাগে রঙের আল্পনায় পেখম তুলে মোহিনী নৃত্যে স্বাগতম করে--যখন কদমফুল দীপাবলীর মতন আলোক সজ্জায় সজ্জিত হয়ে ওঠে--যখন কালো কুচকুচে অলোকদামের মতন ঘনকৃষ্ণ জলধর অগ্নিবর্ষক আদিত্যকে, উতপ্ত যজ্ঞকুন্ডসম আসমান ঢেকে ফেলে--হয়তো তখনই কোন কৃষক বলে ওঠে 'আল্লা ম্যাগ দে পানি দে'----তখনই যেন পৃথিবীর মানুষের ভালোবাসার প্রবলটানকে উপেক্ষা করতে না পেরে নৃত্যে,সংগীতে,মোহিনী সাজে সুরালোকিত সৌন্দর্য নিয়ে নেমে আসে প্রেমরসে পূর্ণ হয়ে বৃষ্টি, পৃথিবী মঞ্চে অভিনয় শুরু হয় দ্বিতীয় ঋতুর, অর্থাৎ--- মহাকবি কালিদাসের 'মেঘদূতম্' এর পূর্বমেঘ,উত্তর- মেঘ, বিরহী যক্ষ, তার বিরহিণী স্ত্রী, রামগিরি পর্বত, অলকাপুরী প্রভৃতি টুকরো টুকরো ছবির মতো বর্ষাসিক্ত প্রকৃতির চিত্রশালায় একে একে ভেসে ওঠে বিরহের মনে ।
মেঘের কথা শুনেই শেষ পর্যন্ত ধনপতি কুবের যক্ষের প্রতি সদয় হলেন এবং অভিশাপ থেকে মুক্তি দিলেন--" শ্রুত্বা বার্ত্তাং জলদকথিতং তাং ধনেশোহপি সদ্যঃ/শাপস্যান্তং সদয় হৃদয়ঃ সংবিধায়াস্তকোপঃ"
এই মেঘ দেখে বৈষ্ণব কবি বিদ্যাপতি যখন বলে ওঠেন "এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর/এ ভারা বাদর/ মাহ ভাদর/ শূন্য মন্দির মোর/..কুলিশ শত শত/পাত মোদির/ ময়ূর নাচত মাতিয়া/মত্ত দাদুরি/ডাকে ডাহুকী/ফাটি যাওত ছাতিয়া" রাধার এই বিরহ কৃষ্ণের জন্য সে তো মানুষের অন্তরের চির বিরহেরই নামান্তর, মেঘেঢাকা আকাশ, ঘন বর্ষণ, ঘন ঘন দামিনীর সশব্দ গর্জন বিরহের একাকীত্বকে, মানুষের অন্তরের চির একাকীত্বকে শতগুনে বর্ধিত করে তোলে। বর্ষার মেঘ যেন তারই প্রতীক। আবার এই বর্ষা মিলনেরও বার্তা বহন করে আনে মানুষের বিরহী একাকিত্বের দ্বীপ সাদৃশ্য জীবনে,যাপনের মতো শুষ্ক বিবর্ণ আনন্দহীন যন্ত্রণাময় কণ্টকময় সরণীতে । ময়ূরের মতই আমাদের মন কি এক অবর্ণনীয় আনন্দে ওঠে মেতে । মন তখনই যেন বলে ওঠে "মন মোর মেঘের সঙ্গী/উড়ে চলে দিগ্ দিগন্তের পানে/ নিঃসীম শূন্যে শ্রাবণ বর্ষণসঙ্গীতে"অথবা মন তখন প্রিয় মানুষটির কাছে ছুটে যায় হংস বলাকার পাখায় আকাশের দূর আলোকে । কবি রবীন্দ্রনাথের কাছে বর্ষাকাল শ্রেষ্ঠ কাল। বর্ষা তাঁর মনে সৃষ্টির প্রেরণা সঞ্চার করেছে চিরকাল। বৃষ্টির প্রতিটি কণার মতো তিনিও ঢেলে দিলেন তাঁর সৃষ্টিকে ।বাঙালির মনকে সিক্ত করেছে সর্বক্ষণ সেই প্রাণরস । তিনি প্রতিটি সৃষ্টিবিন্দু দিয়ে মানুষের অন্তরের ব্যথা,বেদনা,কাম, প্রেম,আনন্দের মতো সহজাত অনুভূতিকে অত্যন্ত সহৃদয় ভাবে ব্যক্ত করেছেন, অতল গহীন মনকে স্পর্শে করেছেন তাঁর সৃষ্টিতে । সাহিত্য এভাবে হয়ে ওঠে মানুষের নিশ্চিত নিরাপদ আশ্রয় ।
এই মেঘলা আকাশ, এই বর্ষার প্রকৃতি কবি জয়দেবের মনেও এনেছে এক অদ্ভুত মোহ-আকুতিপূর্ণ আদিরসাত্মক আনন্দ। সেই আনন্দের বিচিত্র রসসুধারই প্রকাশ 'গীতগোবিন্দ' । বৃষ্টি নূপুর পায়ে মোহিনী নৃত্যে সংগীতে পৃথিবীরূপ অভিমানিনী রাধার মান-ভঞ্জনে ব্যর্থ হয়ে বলছে '"স্মরগরল খন্ডনং/মমশিরসি মন্ডনম্/দেহ পদপল্লব মুদারং"-- বর্ষাঋতু আকন্ঠলগ্ন যুগল প্রেমিক প্রেমিকার মনে আবহমান কাল ধরেই প্রেমের অনুঘটকের কাজ করে আসছে। বসন্তের পরে বর্ষা সেই ঋতু সে-ই পারে বিরহী একাকিত্ব দূর করতে আবার বহুগুণে বর্ধিত করেতেও । শুষ্ক মনে প্রাণরস সঞ্চার করতেও, মানুষের একমাত্র শাশ্বত সম্পদ " প্রেম " যায় টানে দেবতাগণও মানব রূপে জন্ম নেয় বারেবারে। জয় হয় মানুষের, বর্ষা সেই প্রেমের বার্তা বহন করে অথবা মিলনের পটভূমির আয়োজন করে রাখে। মেঘের ক্যানভাসে যখন রামধনু সাতরঙে আল্পনা আঁকে শিখীরা বনে পেখম তুলে নৃত্য শুরু করে, কবি বলেন, 'হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে ময়ূরের মত নাচে রে " । আবার চির বিচ্ছেদ যখন হৃদয়কে ক্ষত-বিক্ষত করে দেয় নিরবচ্ছিন্ন ভাবে ঝরে যায় বেদনা, আজীবন কণ্ঠক-বিদ্ধ অনুভূতি সহ যাপন করতে হয় ধারাবাহিক ভাবে, কবি নজরুল সেই অসহনীয় ব্যথা অনুভব করে গেয়ে ওঠেন,"শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে/বাহিরে ঝর বহে/নয়নে বারি ঝরে।"তখন রাধার বিরহের অশ্রুধারা আর বৃষ্টিধারা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।
বর্ষাকাল অংশিককে সম্পূর্ণ করার,শুষ্ককে সিক্ত করার, দগ্ধ পোড়া বিবর্ণ প্রকৃতিকে সবুজ সতেজ প্রাণ- চঞ্চল করার কাল, আবার সে সঙ্গে করে বয়ে আনে রুদ্ররূপও । বিধ্বংসী বান ভূচিত্রের এনে দিতে পারে বদল,হড়পা বান বুঝিয়ে দিতে সক্ষম জীবন কতোটা অনিশ্চিত, ক্ষণিকের -- আকস্মিক বজ্রপাত মৃত্যুর পারিজাত যেন সঙ্গে করে নেমে আসে---দমকা ঝরো হাওয়া কীভাবে তিল তিল করে গড়ে তোল দারিদ্র্যের দুর্বল আশ্রয়কেন্দ্রেকে কাগজের মতো কোথায় উড়িয়ে দিয়ে চলে যায় কেউ জানে না। মানব বসতি, ফসল, পথের পাশাপাশি অরণ্যেও বুকেও নেমে আসে ধ্বংস অসহায় মানুষের কাছে,বোবা প্রাণীকুলের কাছে বর্ষাকাল হয়ে ওঠে অসহনীয় কালখন্ড । রূদ্রের তান্ডবের ভয়ানক বিভীষিকাময় কাল-যাপন । বৃষ্টি বিন্দু এদের জীবনে অ্যাসিড বিন্দুর নামান্তর। বহু চর্চিত জনপ্রিয় বিষন্নতার সাধক আমেরিকান কবি হেনরি ওয়ার্ডসওয়ার্থ লংফেলো তাঁর "The rainy day" কবিতায় বলেছেন- "My life is cold and dark and dreary/It rains, and the wind is never dreary/Thy fate is the common fate of all/ Into each life some rain must fall" I
যদিও বিশ্বের যাবতীয় কৃষককুল বৃষ্টি চেয়ে যুগে যুগে যেন বলে চলেছে "আয় বৃষ্টি ঝেঁপে ধান দেবো মেপে "কারণ তাকে ঘরে ফসল তুলতে হবে তবেই সংসার প্রতিপালন সম্ভব হবে । আবার এই মেঘলা আকাশ দেখে প্রিয় অথবা প্রিয়া গেয়ে ওঠে"जब चली ठंडी हवा/ जब उरी कली घटा/ एय जाने बफा/ तुम याद आए " ভানুসিংহ গেয়ে ওঠেন "গহন কুসুমকুঞ্জ মাঝে মৃদুলা মধুর বংশি বাজে/ বিসরি ত্রাস লোকলাজ সজনি আও আও লো" আচ্ছা পাঠকের কাছে আমার জানতে ইচ্ছা করছে পড়তে পড়তে কি এই গানটি মনে মনে গুনগুনি উঠলো না ?
No comments:
Post a Comment