Sunday, July 20, 2025


 

পাঠ প্রতিক্রিয়া

মেলাটোনিন ২০: আরণ্যক চক্রবর্তী

তরুণ কবি আরণ্যক চক্রবর্তীর `মেলাটোনিন ২০` কাব্যগ্রন্থে স্থান পেয়েছে ৫৪টি কবিতা। আরণ্যক ইতিমধ্যে চলচ্চিত্র পরিচালনা করে যথেষ্ট পরিচিত। তাঁর পড়াশোনার ব্যাপ্তিও গভীর। সবচেয়ে বড় কথা, প্রচারবিমুখ আরণ্যক নিজের মধ্যে থাকতে ভালবাসেন। সত্যিই সাহিত্য সাধনা করেন।  `মেলাটোনিন ২০` পড়তে পড়তে এই কথাটিই বারবার মনে হচ্ছিল।   

এই প্রজন্মের কবি বলে আরণ্যকের লেখায় একটি স্বতন্ত্র স্বর রয়েছে। আর সেটি বলে দেয়, কবিতা ভুবনে তিনি থাকতে এসেছেন। খুব সহজ সরল ভাষায় জীবনের গভীর দিকগুলি ফুটিয়ে তুলতে দক্ষ আরণ্যক লিখছেন, `আমার শত্রুর খরগোশটা মারা গেছে আজ খবর পেলাম../ সকাল থেকে মনটা ভাল নেই শোনার পর.../ যখন আমরা শত্রু ছিলাম না, যখন যেতাম তার বাড়ি/ সব বন্ধুরা যখন খোশগল্পে ব্যস্ত থাকত.../ আমি পাশের ঘরে গিয়ে হাত বোলাতাম খরগোশটার গায়ে...` যাপনের এরকম টুকরো ছবি তাঁর কবিতায় বারবার এসেছে নানাভাবে `যখন একটা বছর সতেরোর কিশোর আর বছর ষোলোর কিশোরী/ এক পর্যন্ত খামার বাড়িতে পড়ন্ত দুপুরে চুম্বনরত অবস্থায় ধরা পড়ে.../ তার পরদিন সভ্যতা ধ্বংস হয়.... বিশাল বিস্ফোরণে ভূমিকম্পে বন্যায় ইত্যাদিতে....` কখনও তিনি লিখছেন, `আকাশ হালকা নীল যেখানে হলুদ সূর্য / আর যাবতীয় যা বর্তমান সব রঙিন.../ এবং সাদা শীতের পোশাক পড়া এক কিশোরী ছুটি কাটাচ্ছে, সঙ্গে তার ধূসর কালো কুকুর।` এই সারল্যই আরণ্যকের কবিতার বড় অস্ত্র।   

যে কবিতার নামে কাব্যগ্রন্থের নাম সেই `মেলাটোনিন ২০`-তে কবি প্রশ্ন রেখেছেন `একটা মানুষের জীবনে দুঃসংবাদ মাপা হয় কোন এককে?/ মৃত্যুসংবাদ কি সর্বশ্রেষ্ঠ দুঃসংবাদ? না রোগসংবাদ?` মৃত্যু সম্পর্কিত এই ভাবনা কিন্তু সত্যিই চমকপ্রদ। পাঠককে ভাবায়। এমনিতে মেলাটোনিন একটি হরমোন যা শরীরে প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া যায়। এটি একটি 'ঘুম-প্ররোচিত হরমোন', যা ঘুমের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অন্ধকারে থাকলেও, মেলাটোনিন তৈরি হয় এবং তা শরীরে শান্ত প্রভাব ফেলে। অন্যদিকে, মেলাটোনিন উৎপাদনে সামান্য হ্রাস শরীরকে জেগে থাকার সংকেত দেয়। মেলাটোনিন ২০ একটি ওষুধের নাম। বোঝাই যাচ্ছে, সেটি আমাদের শারীরবৃত্তীয় কিছু বিষয়কে ঠিকঠাক রাখে। যদি আমরা গভীরভাবে ভাবি, তবে দেখব সমস্ত জীবনটাই আমাদের এক ধরণের `ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার`, যা আধুনিক সময়ের সবচেয়ে বড় রোগ। আর সেই রোগে ভুগে দিনের পর দিন সভ্যতা ও মানুষ `মৃত্যু দেখতে আর ক্লান্ত হয় না সে.../ রক্ত দেখতে আর ক্লান্ত হয় না সে..../ রাতে কাশির শব্দ শুনে তার আর ঘুম ভাঙে না।` 

এভাবেই আরণ্যক আমাদের দাঁড় করিয়ে দেন এক অখন্ড সত্যের সামনে। সেখানে `মরণশীল কবি বুঝতে পারে তার মৃত্যু হলেও পাখিটির মৃত্যু নেই`। আর সেই পাখিই আমাদের চিনিয়ে দেয় তৃতীয় গোত্রের সেই নারী কে যার ওষ্ঠ স্পর্শ করা `মরে যেতে চাওয়ার একটা কারণ হতে পারে`। আরণ্যকের কবিতায় বারবার নানাভাবে এভাবেই মৃত্যু চিন্তা এসেছে। এত কম বয়সে মৃত্যু নিয়ে এই প্রজ্ঞা খুব কমই দেখেছি। এই ক্ষেত্রে সমসাময়িক কবিদের চাইতে আরণ্যক অনেকটা এগিয়ে গেছেন বলেই ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়েছে। নারী, পানীয়, সমুদ্র, যুদ্ধ ইত্যাদি সব কিছুকেই যেন ছাপিয়ে গেছে মৃত্যুর সুক্ষ চেতনা। আর সব কবিতাতেই দক্ষতা অনিবার্যভাবে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর হাত ধরে। 

মনোজিৎ নন্দীর উপযুক্ত প্রচ্ছদে কালচিত্রের এই কাব্যগ্রন্থটি কোচবিহারের কবিতা জগতে একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন। বইয়ের মুদ্রণ, কাগজ ইত্যাদিও ভাল। এর আগে আরণ্যকের দুটি ইংরেজি কবিতার বই প্রকাশিত হলেও, বাংলা কবিতা হিসেবে এটিই তাঁর প্রথম প্রকাশ। সেদিক থেকেও এই কাব্যগ্রন্থের তাৎপর্য আলাদা।

আলোচক- শৌভিক রায়      


No comments:

Post a Comment