Saturday, November 2, 2024


 


মুনা 

অনলাইন কার্তিক সংখ্যা ১৪৩১



সম্পাদকের কথা 

উৎসব শেষের পথে। তবু শবের শেষ নেই। এই লেখা যখন লিখছি, তখন মুজনাই তীরের ফালাকাটার জটেশ্বর ক্ষোভের আগুনে জ্বলছে। নাবালিকা শিশুও রেহাই পাচ্ছে না আমাদের বিকৃত লালসা থেকে। আলিপুরদুয়ার জেলা সহ উত্তরবঙ্গে দিনের পর দিন বেড়ে চলেছে ধর্ষণ-খুনের মতো সঙ্গীন অপরাধ। `উত্তরবঙ্গ` শব্দটি ইচ্ছে করেই ব্যবহার করলাম। জানি অপরাধীর কোনও জাত ধর্ম হয় না, অপরাধের কোনও স্থান ভেদ নেই।  তবু রাজ্যের এই উত্তরাংশে ক্রমবর্ধমান অপরাধের এই মাত্রা কখনও দেখা যায়নি। বিষয়টি তাই অত্যন্ত উদ্বেগের ও আশঙ্কার। এই জাতীয় অপরাধ দমনের ক্ষেত্রে প্রশাসনের কড়া পদক্ষেপের পাশাপাশি, আমাদের সচেতনতাও অত্যন্ত জরুরি। সমস্যা হল, এই মুহূর্তে সমাজজীবনে  দুটি বিষয়েরই অত্যন্ত অভাব দেখা যাচ্ছে। অবিলম্বে সতর্ক না হলে এই প্রবণতা বাড়বে বৈ কমবে না!   


মুনা 

অনলাইন কার্তিক সংখ্যা ১৪৩১



রেজিস্ট্রেশন নম্বর- S0008775 OF 2019-2020

হসপিটাল রোড 

কোচবিহার 

৭৩৬১০১

ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com 

প্রকাশক- রীনা সাহা    

সম্পাদনা, প্রচ্ছদ, অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায়


এই সংখ্যায় আছেন যাঁরা 

দীপায়ন ভট্টাচার্য, কবিতা বণিক, মাল‍্যবান মিত্র, শ্রাবণী সেনগুপ্ত, 

পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়, জয়তী ব্যানার্জী, সঞ্জয় সাহা, অনিতা নাগ, 

চিত্রা পাল, সুজাতা কর, ঋতুপর্ণা ভট্টাচার্য, সম্মিলিতা দত্ত, 

প্রদীপ কুমার দে, শুভেন্দু নন্দী, বটু কৃষ্ণ হালদার, 

অশোক কুমার ঠাকুর, মাথুর দাস, সজলকুমার টিকাদার,

লিপিকর , অমিতাভ চক্রবর্ত্তী, কেতকী বসু, 

রীনা মজুমদার, মিষ্টু সরকার, প্রতিভা পাল,

পক্ষিরাজ, প্রাণেশ পাল, মনোরঞ্জন ঘোষাল,

স্বপন কুমার সরকার, পাঞ্চালী  দে  চক্রবর্তী, মনোমিতা চক্রবর্তী,

আকাশলীনা ঢোল, বিপ্লব গোস্বামী, মনীষিতা নন্দী,

গৌতম সমাজদার, আশীষ  কুমার  বিশ্বাস, মজনু মিয়া, রেজাউল করিম রোমেল


মুনা 

অনলাইন কার্তিক সংখ্যা ১৪৩১



 

  


 

এই সময় 


বাংলার গরিমা কথা 

    কবিতা বণিক



বাংলা ভাষার ওপর লেখা গ্রন্থের  খোঁজ করছিলেন  রাজেন্দ্র লাল মিত্র নামে এক ব্যক্তি।  সে সময়  বাংলার আবহাওয়া , তুর্কী  আক্রমণ নানান সমস্যার কারণে পুঁথি সংরক্ষণ অসম্ভব থাকার কারণেই তিন বছরের প্রচেষ্টার পর  নেপাল থেকে বেশ কিছু বাংলায়  লিখিত পুঁথি আবিস্কার করেন।  ১৮৮২ সালে  সে সব পুঁথির  এক ক্যাটালগ তৈরি করেন।  রাজেন্দ্রলাল মিত্রের মৃত্যুর পর, তৎকালীন বৃটিশ সরকার  হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর উপর এই দায়িত্ব তুলে দেন। ১৯০৭ সালে সেখানে `চর্যাপদ` গ্রন্থের খোঁজ পান।  চর্যাপদ হল বাংলা ভাষায় রচিত  বৌদ্ধ গান ও দোঁহা নামে গ্রন্থের  চব্বিশ জন সিদ্ধাচার্যের  রচনা করা  ছেচল্লিশটি গান। এতে বৌদ্ধ ধর্মের গূঢ় সাধন প্রণালী,দর্শন তত্ব নানা রূপকের মাধ্যমে আভাসে  ইঙ্গিতে ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে এর সাহিত্যের মূল্যের সাথে  সাথে তখনকার  বাঙলার সমাজের  চিত্র কেমন ছিল তা জানা  যায়।  এই চর্যাপদ রচনা হয়েছে তারও অনেক আগে নিশ্চয়ই। ১৯০৭ সালে চর্যাপদ পাওয়ার পর  এর রচনা কালনিয়ে যে গবেষণা শুরু হয়েছিল ,  সেই গবেষণা শতবর্ষ পার করেও আরও গবেষণার পর  দেখা যায় এই চর্যাপদ রচিত হয়  খ্রীষ্টীয় অষ্টম শতাব্দীতে। লিখিত পদ্যের এই রকম নিদর্শনের জন্যও বেশ কয়েক শত বছরের  প্রস্তুতির প্রয়োজন হয়।   আরও একটি  তথ্য পাওয়া যায় অষ্টম শতকে  লি ইয়েন  নামে এক চৈনিক ভদ্রলোক  সংস্কৃত - চীনা ডিকশনারি তৈরি করেন। তিনি মারা গেছেন ৭৮৯ খ্রীষ্টাব্দে।  অষ্টম শতাব্দী  শেষ হওয়ার  আগেই তিনি মারা যান।  অভিধান সংকলিত হয় তার আগেই। চীন দেশেই এই অভিধান সংকলিত হয়েছিল। এই ডিকশনারিতে যে লিপিতে চীনা হরফ লেখা হয়  সে লিপি পড়ার লোক এখন নেই।  সংস্কৃত লেখা হয় সিদ্ধম  লিপিতে।  এর থেকে পরবর্তীতে  সিদ্ধ মাতৃকায় বাংলা লিপি তৈরি হয়েছিল।  মজার কথা এই অভিধানে ৫২ খানা বাংলা শব্দ পাওয়া গেছে। যে অভিধান সংস্কৃত- চীনা ভাষায় সংকলিত  হয়েছে চীনে অর্থাৎ ভারতের বাইরে। এই শব্দ গুলোর মধ্যে — ভাতার, মাংস, আইসো, বইসো ইত্যাদি পাওয়া যায়। বাংলা ভাষার  প্রভাব ছিল বলেই  অষ্টম শতকে ভরতের বাইরে  সংস্কৃত ও চীনা ভাষায়  রচিত অভিধানেও বাংলাভাষা তার মধ্যে স্হান করে নিয়েছে।  বাংলার প্রাচীনতা বলতে অবিভক্ত বাংলাদেশ অবশ্যই ধরতে হবে। সেইমত প্রাচীনতম লিখিত প্রমাণ পাওয়া যায়  বগুড়া জেলার মহাস্হানগড় ইন্সটিটিউশনে। সেখানেই প্রথম ‘ বঙ্গ ‘ নামটা লিখিত আকারে পাওয়া যায়। সেখানে খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকের ইতিহাস পাওয়া গেছে।   আমরা জানি অতীশ দীপঙ্কর ও বাঙালী ছিলেন।  ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উঃ চব্বিশ পরগনার বেড়াচাঁপায়  খনা- মিহিরের যে ধ্বংশাবশেষ পাওয়া যায় সেখানে যে সভ্যতা গড়ে ছিল তা ছিল খ্রীষ্ট পূর্ব অষ্টম শতাব্দীর। 

 2004 সালে  ভারত সরকার বিভিন্ন ভাষাকে ক্ল্যাসিক্যাল তকমা দেওয়ার জন্য  একটা স্কিম তৈরি করেন।   তার কিছু শর্ত -- যেমন-                                                                                               

১ নং -   লিপিবদ্ধ নথির ইতিহাস ১৫০০ - ২০০০ সালের পুরোন হতে হবে। 
২নং--    সাহিত্যের নমুনা প্রাচীন কাল থেকে  বর্তমান ও ভবিষ্যতেও তার স্বীকৃতি থাকবে।
৩নং--    কাব্য ও খোদাই করা নমুনা ছাড়াও জ্ঞান মূলক রচনা, বিশেষ করে গদ্য রচনা থাকবে।
৪নং--     ভাষার পরিবর্তন হলেও এখনও সমান প্রাসঙ্গিকতা থাকা প্রয়োজন। 

এই সমস্ত গবেষণার  উপর বিশেষ যে দল কাজ করেছেন তারা হলেন—

 ভাষা বিজ্ঞান ছাত্র -           শ্রী রাজীব চক্রবর্তী।
বাংলার গবেষণার প্রধান — শ্রী অমিতাভ দাস।
আর্কিওলজিস্ট  —  -            শ্রী রজত স্যান্যাল।
তরুন গবেষক -                   শ্রী সোমনাথ চক্রবর্তী।
সংস্কৃত ছাত্র গবেষক —   -     শ্রী সায়ক বসু।

এদের সাথে সাহায্য করেছেন- ডঃ শ্রীমতী স্বাতী গুহ। তিনি  ইনস্টিটিউট অফ  স্টাডিজ এণ্ড ল্যাঙ্গুয়েজ এণ্ড রিসার্চের অধিকর্তা।  তিনিই সরকারের  সাথে  যোগাযোগের মূল জায়গা তৈরি করেছেন। শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর সহায়তাও  উল্লেখযোগ্য।  গবেষণা লব্দ্ধ তথ্য দিয়ে ২০০০ পাতার একটি নথি তৈরি করে  কেন্দ্রের কাছে  বাংলা ভাষা যে সাহিত্য নির্ভর , ২০০০ বছরের পুরোন ভাষা তাই  তারা এই ভাষা        `ধ্রুপদী` সম্মান পাওয়ার  জন্য দাবি  রাখেন। এই দাবী জানিয়েছেন অনেকেই। তার মধ্যে আমার জানা মুর্শিদাবাদের অধীর চৌধুরী, আন্তর্জাতিক বাংলা ভাষা ও সমিতির  শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়ি শাখার  শ্রীযুক্ত সজল কুমার গুহ, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ইত্যাদি। 

                  ধ্রুপদী কাকে বলে?  ধ্রুপদ হল রাগ সংগীতের একটি  পুরোন ধারা। এটি দীর্ঘ স্হায়ী ব্যবহার হয়। ধ্রুবপদ  থেকেই হয়ত এই শব্দটা এসেছে। ধ্রুব অর্থাৎ  সত্য - যা ছিল, আছে, থাকবে। পদ হলো বাণী। যা সত্যবাণী তাই  ধ্রুপদ।প্রাচীন কালে ধ্রুপদ গাওয়া হত শুধুই মন্দিরে। রাজা মহারাজাদের জয়জয়কার , ঈশ্বর লীলা লেখা হত।  প্রবন্ধের একটাছোট্ট সংস্করণে সুর, তাল, লয় সহ যে পদ ,তাই হলো ধ্রুপদ।

                  ধ্রুপদী ভাষা বলতে বোঝায়  ১৫০০ থেকে ২০০০ বছরের পুরোন ভাষা। যে ভাষায় সাহিত্য চর্চার প্রচার বেশবড়।  যাদের প্রাচীন সাহিত্যের ঐতিহ্য স্বাধীন ও স্বাবলম্বী ভাবে গড়ে ওঠে , যে ভাষা  প্রাচীন কাল থেকে প্রচলিত এবং মূল্যবোধ, স্বতন্ত্র, সাহিত্যিক ঐতিহ্য সম্বলিত  ভাষাকে ধ্রুপদী ভাষা বলা হয়।   এর কিছু শর্ত আছে। 

  ভাষার লিপিবদ্ধ নথির ইতিহাস ১৫০০ থেকে ২০০০ পুরোন হতে হবে। 
  সাহিত্যের নমুনা প্রাচীন কাল থেকে বর্তমান  ও ভবিষ্যতেও  তার স্বীকৃতি থাকবে।
  কাব্য ও খোদাই করা নমুনা ছাড়াও জ্ঞানমূলক রচনা বিশেষ করে গদ্য রচনা থাকা উচিত। 
  সেই ধ্রুপদী ভাষা ও সাহিত্যের সঙ্গে আধুনিক ভাষার ফারাক থাকতে পারে। ভাষার পরিবর্তন হলেও এখনও সমান প্রাসঙ্গিক হওয়া চাই। 

  ধ্রুপদী তকমা পাওয়া অর্থাৎ  সরকারী স্বীকৃতি পাওয়া।  এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে বিশেষত কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে সেই ভাষার পঠন পাঠনের  একটা বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়।  এছাড়া নানান সাংস্কৃতিক যে উপাদানগুলি  ভাষার সাথে লগ্ন হয়ে থাকে  তার একটা সংগ্রহশালা, সংরক্ষণ,  তা নিয়ে গবেষণা , তার জন্য বরাদ্দ অর্থ থাকবে, সরকারী, বেসরকারী সমস্ত  ক্ষেত্রে  সেই ভাষাও গুরুত্ব পাবে।  আমাদের পশ্চিমবঙ্গে হিন্দী, ইংরেজির সাথে এখন থেকে  বাংলায়ও লেখা থাকবে। আমি আমেরিকায় সর্বত্র দেখেছি ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ, চাইনিজ ভাষায়  লেখা থাকে।   প্রত্যেক গবেষকদের  জন্য অনেক  অনেক শুভেচ্ছা  রইল, আমাদের লেখক, কবিদের প্রতি সম্মান জানিয়ে বলি আজ আমাদের  সত্যিই গর্বের দিন, আমাদের ভালবাসার বাংলা ভাষা এভাবেই এগিয়ে চলুক। 


 

প্রবন্ধ 


মাল‍্যবান, কাঞ্চনফুলের কবি এবং অনুবাদ 

মাল‍্যবান মিত্র

ইংরেজি সাহিত্যের পরিচিত মুখ রেবেকা হুইটিংটন সম্প্রতি পাশ্চাত্য সাহিত্যের পাঠকদের জন্য ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন একটি উপন্যাস , যে উপন্যাসের  , শুরু ও সমাপ্তির অবকাশ নেই , রিক্ত হৃদয়ের করুণতা ছত্রে ছত্রে প্রতীয়মান।  মনখারাপ উদযাপন থেকে সমাজ , দৈনিক জীবনের ওঠাপড়া , জৈবিক টানাপোড়েন থেকে মধ্যবিত্তের যাপনসীমানার মধ্যে থাকা মানুষদের দ্বন্দ্ব , জীবনদরিয়ার সহযাত্রীদের মধ্যে তৈরী হওয়া আক্ষেপ - রিরংসা , ছত্রে ছত্রে বিদ্যমান সেই উপন্যাসে !  অনুবাদিত সেই উপন্যাসটির নাম “ মাল্যবান ”  , এবং সেই উপন্যাসটির রচয়িতার নাম জীবনান্দ দাস।  

                                                               জীবনানন্দ দাস অনুবাদ করা যেকোন অনুবাদকের কাছে একটি বাস্তব চ্যালেঞ্জ। কারণ জীবনান্দের সাহিত্য শুধুমাত্র শব্দ এবং বাক্যাংশের অনুবাদ  না, এটি রঙ এবং সঙ্গীত, কল্পনা , বাস্তবতা , পরাবাস্তবতার কল্পিত  চিত্রের 'অনুবাদ' । অনুবাদ কে  ব্যাখ্যা এবং পুনর্গঠনের কাজ হিসেবে মনে করলে যখন জীবনানন্দের  কথা আসে, তখন তা  উভয়ই বেশ কঠিন। যদিও এর আগেও বহুবার জীবনানন্দের সাহিত্য অনুবাদের চেষ্টা হয়েছে। কবি বুদ্ধদেব বসুর অনুরোধে জীবনানন্দ নিজেই তাঁর কিছু কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন সেটি ছিল ১৯৫২ , তার অনুবাদের মধ্যে রয়েছে “ বনলতা সেন” , “ মেডিটেশন” , “ ডার্কনেস” যার অনেকগুলি এখন হারিয়ে গেছে। এগুলো দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সংকলন ও পত্রিকায় বিভিন্ন সময় প্রকাশিত হয়েছে। চিদানন্দ দাসগুপ্ত জীবনানন্দ দাসের সাহিত্যের অনুবাদ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, 

"Effort has of course been made to see that the original's obliqueness or deliberate suppression of logical and syntactical links are not removed altogether. Sometimes Jibanananda's very complicated and apparently arbitrary syntax has been smoothed out to a clear flow. On occasion, a word or even a line has been dropped, and its intention incorporated somewhere just before or after. Names of trees, plants, places or other elements incomprehensible in English have often been reduced or eliminated for fear that they should become an unpleasant burden on the poem when read in translation".

জীবনানন্দের কবিতা  অনুবাদের ক্ষেত্রে জীবনানন্দ নিজে ছাড়া  দুজনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য; একজন হলেন ক্লিনটন বি. সিলি [বই: A Poet Apart: A Literary Biography of the Bengali Poet Jibanananda Das (1899-1954)] এবং অন্যজন ফকরুল আলম [বই: Jibanananda Das: Selected Poems with an  Introduction, Chronology, and Glossary]। নিজের কবিতা অনুবাদের ক্ষেত্রে জীবনানন্দ একটু বেশি স্বাধীনতা নিয়েছেন অনুবাদের ব্যাপারে সেটা তার ও ক্লিনটন বা ফকরুল এর অনুবাদের তুল‍্যমুল‍্য বিচার করলে বোঝা যায়, অনুবাদেও তিনি সৃষ্টিশীল। 

মাল্যবান , বাশমতির  উপাখ্যান , কারুবাসনা , বিরাজ , চারজন , প্রেতিনীর উপাখ্যান , জলপাইহাটি প্রমুখ কোনো উপন্যাসই জীবনান্দের জীবনকালে প্রকাশিত হয়নি , মাল্যবান জীবনান্দের প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস , যা ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। সেই মাল্যবানের অনুবাদের প্রেক্ষিতে , আসল উপন্যাসটির দিকে ফিরে তাকাতে গিয়ে অ্যালেন গিন্সবার্গ  এর বলা সেই উক্তিটির দিকে দৃষ্টিপাত করলে , একজন অন্য বিশ্বের , অন্য ভাষার  সাহিত্যিক হিসেবে, জীবনান্দের সাহিত্য সম্পর্কে বহির্বিশ্বের অনুভব ধারণা করা যায়।

    "One poet now dead, killed near his fiftieth year ... did introduce what for India would be "the modern spirit" – bitterness, self-doubt, sex, street diction, personal confession, frankness, Calcutta beggars ect [sic] – into Bengali letters — Allen Ginsberg


কবিতায় যেমনি, কথাসাহিত্যেও তিনি তার পূর্বসূরীদের থেকে আলাদা, তার সমসাময়িকদের থেকেও তিনি সম্পূর্ণ আলাদা। তার গল্প-উপন্যাসে আত্মজৈবনিক উপাদানের ভিত লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু তাই বলে এই রচনাগুলো আত্মজৈবনিক নয়। তার সর্বাধিক পরিচিত উপন্যাস মাল্যবান,সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রতি সদা  সোচ্চার সেই কবি  ,  কলকাতায়  ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে  হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা যখন  ছড়িয়ে পড়ে কবি তখন লেখেন ১৯৪৬-৪৭ কবিতাটি। দেশভাগের কিছু আগে কবি  কর্মস্থান  থেকে  ছুটি নিয়ে কলকাতায় আসেন  ।  ছুটি বাড়িয়ে কলকাতায় দীর্ঘ কয়েক মাস অবস্থান করেন সেই  কবি  ।  ১৯৪৭-এ দেশ ভাগের কিছু পূর্বে  সপরিবারে বাংলাদেশ অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করে কলকাতায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।


                                               কলকাতায়  ''দৈনিক স্বরাজ'' পত্রিকার রোববারের সাহিত্য বিভাগের সম্পাদনা  শুরু  করলেন  সেই  কবি  । কিন্তু এই চাকুরি স্থায়ী হলোনা  ,  ছিল মাত্র সাত মাস। কাজী নজরুল ইসলাম বিষয়ক একটি গদ্য রচনা মালিক পক্ষের মনঃপুত না-হওয়ায় এই চাকুরিচ্যূতি “মৃত্যুর  আগে ” এর  কবির  ।   কবি   দু'টি উপন্যাস লিখেছিলেন - ''মাল্যবান'' ও ''সুতীর্থ'', তবে জীবদ্বশায়   অপ্রকাশিত রেখে যান  “মহাপৃথিবীর  ” কবি  ।  এই  বছরেই   ডিসেম্বরে সেই  মানুষটির   পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ “  সাতটি তারার তিমির “  প্রকাশিত হয় এবং  এই   একই মাসে কলকাতায় মাতৃহারা  হন  বনলতা সেন এর কবি  , মা  কুসুমকুমারী দাশের জীবনাবসান ঘটে , যে  মা  সেই  কবে  লিখতে  পেরেছিলেন  –


“  আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে

কথায় না বড় হয়ে কাজে বড়ো হবে” –


                                                                  জীবদ্দশায় অন্নদা শংকর রায়ের "শুদ্ধতম কবি "এর  , তার একমাত্র পরিচয় ছিল কবি। অর্থের প্রয়োজনে তিনি কিছু প্রবন্ধ লিখেছিলেন ও প্রকাশ করেছিলেন। তবে নিভৃতে গল্প এবং উপন্যাস লিখেছিলেন প্রচুর যার একটিও প্রকাশের ব্যবস্থা নেননি। এছাড়া ষাট-পয়ষটিট্টিরও বেশি খাতায় "লিটেরেরী নোটস" লিখেছিলেন যার অধিকাংশ এখনও  প্রকাশিত হয়নি।


                                                                              জীবনানন্দ কলকাতার সাহিত্যিক সমাজে নিজস্ব একটি অবস্থান তৈরি করে নিয়েছিলেন। তিনি 'সমকালীন সাহিত্যকেন্দ্র' নামে একটি সংস্থার সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন এবং এই সংস্থার মুখপত্র দ্বন্দ্ব পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক নিযুক্ত হন। মাঝে তিনি কিছুকাল খড়গপুর কলেজে অধ্যাপনা করেন। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে তার জনপ্রিয় কবিতার বই বনলতা সেন সিগনেট প্রেস কর্তৃক পরিবর্ধিত আকারে প্রকাশিত হয়। বইটি পাঠকানুকূল্য লাভ করে এবং নিখিল বঙ্গ রবীন্দ্রসাহিত্য সম্মেলন-কর্তৃক ঘোষিত "রবীন্দ্র-স্মৃতি পুরস্কার" জয় করে। মৃত্যুর কিছু পূর্বে হাওড়া গার্লস কলেজ-এ অধ্যাপনার চাকুরি জুটে গেলে তার কলকাতা জীবনের অপরিসীম দৈন্যদশার সুরাহা হয়। ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে প্রকাশিত হয় জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা। ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে ভারত সরকারের সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন।


                                           জীবনানন্দের অধিকাংশ গদ্যপ্রবন্ধ-নিবন্ধগুলো রচনাই ফরমায়েশী। সাহিত্য, শিক্ষা, সমাজ, এই তিনটি পরিক্ষেত্রে জীবনানন্দ প্রবন্ধ-নিবন্ধগুলো লিখেছেন। তার বিশিষ্ট প্রবন্ধগুলোর শিরোনাম এরকম - ‘কবিতার কথা’, ‘রবীন্দ্রনাথ ও আধুনিক বাংলা কবিতা’, ‘মাত্রাচেতনা’, ‘উত্তররৈবিক বাংলা কাব্য’, ‘কবিতার আত্মা ও শরীর’, ‘কি হিসাবে কবিতা শ্বাশত’, ‘কবিতাপাঠ’, ‘দেশকাল ও কবিতা’, ‘সত্যবিশ্বাস ও কবিতা’, ‘রুচি, বিচার ও অন্যান্য কথা’, ‘কবিতার আলোচনা’, ‘আধুনিক কবিতা’, ‘বাংলা কবিতার ভবিষ্যৎ’, ‘কেন লিখি’, ‘রবীন্দ্রনাথ’, ‘শরৎচন্দ্র’, ‘কঙ্কাবতী ও অন্যান্য কবিতা’, ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ভবিষ্যৎ’, ‘পৃথিবী ও সময়’, ‘যুক্তি, জিজ্ঞাসা ও বাঙালি’, 'অর্থনৈতিক দিক’, ‘শিক্ষা ও ইংরেজি’, ‘শিক্ষা-দীক্ষা-শিক্ষকতা’, ‘শিক্ষার কথা’, ‘শিক্ষা সাহিত্যে ইংরেজি’ এবং ‘শিক্ষা-দীক্ষা’। বলা যায় যে সাহিত্য, বিশেষ ক’রে কবিতা নিয়ে জীবনানন্দ বেশ কিছু প্রবন্ধ-নিবন্ধ উপহার দিয়েছেন। প্রতিটি রচনাই বহুমাত্রিক মৌলিক চিন্তাসূত্রের স্বাক্ষর বহন করে।


                                        শেষ পর্যন্ত মাল্যবান ভাবনার গল্প , যে ভাবনা বহুমাত্রিক , মাল্যবান সহ অন্যান্য জীবনান্দের উপন্যাস অনুবাদ হোক জীবনান্দের ভাবনায় নির্ভর করে। লাবণ্য দাস , জীবনানন্দের সহধর্মিনীর মতে জীবনানন্দ একেবারেই মাল্যবানের মতো ছিলেন না , তবু কবির মনের গহীন অন্তরে হয়তো মাল্যবান ছিল , যা   মাল্যবানের ভাবনাকে শেষে উধৃতকরে , জীবনান্দের প্রথম উপন্যাস - তার অনুবাদের খোঁজ ও তার সাফল্য কামনা করে , মাল্যবান উপন্যাসটির নাম হটাৎ করে আয়নায় দেখা দিলো।     


“ ঘড়িতে প্রায় সাড়ে তিনটা বাজে। মাল্যবান  দেখল, এতক্ষণ সে বিছানায় পিঠে শুয়ে অনবরত ভাবছে, আর সে সব ভাবনাই তার হৃদয়কে নিছক শুষ্ক করে রেখেছে – কোন তীর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, তার চোখে ঘুমের পলক নেই। সে ধীরে ধীরে উঠে বসল। 

“ মাল্যবান”  - জীবনানান্দ দাস



 

বিশ্ব রঙ্গমঞ্চের বিবর্তন-কথা

দীপায়ন ভট্টাচার্য 


আবহমান কাল থেকে মানুষের হৃদয়-অন্দরে রয়েছে তীব্র প্রকাশমানতা। সে সৃষ্টির ডানায় ভর করে আপনার গন্ডিটুকু ছাড়িয়ে যেতে চায়। অন্তরে তার অব্যক্ত অনেক কথা। সৃজনের মাধ্যমে চায় অন্যের কাছে নিজের বার্তাটুকু পৌঁছে দিতে। আদিম মানুষ বিচিত্র গুহাচিত্রে সে কাজ শুরু করেছিল। স্পেনের আলতামিরা, ফ্রান্সের ত্রোয়া ফ্রের বা ভারতের ভীমবেটকা গুহায় তার জলছাপ তো পাথরের দেওয়ালে এখনও দৃশ্যমান।  আজকের মানুষ তাদের সেদিনের কথা হয়তো সবটুকু বোঝে নি। কিন্তু প্রকাশমানতার সেই ধারাকে বিকাশের পথে আজও ছুটিয়ে নিয়ে চলেছে। সুদূর অতীতের মিশরীয় কি মেসোপটেমীয় সভ্যতা, ব্যবিলন- রোম কি গ্রীস সভ্যতা, সিন্ধু বা চিন সভ্যতা, মায়া অথবা অ্যাজটেক সভ্যতা – সবখানে এই প্রকাশব্যাকুলতার চিহ্ন। আজও কেউ যদি অজন্তা-ইলোরার গুহার অভ্যন্তরে গিয়ে দাঁড়ায়, কোনারক বা খাজুরাহো মন্দির গাত্রে চোখ রাখে, পিরামিডের চুড়োয় বিস্মিত দৃষ্টি পাঠায়- অতীতের সৃষ্টি-যাদুকরদের আত্মপ্রকাশের বৃন্দগান যেন ঠিক শুনতে পায়।

           মানুষের সৃষ্টি যখন উপভোক্তার সমীহ আদায় করবার পর্যায়ে উন্নীত হল, তখন তাকে ভালো করে দেখে-শুনে নেবার সুবিধে পেতে সৃজন-মুহূর্তকে বিশেষ দ্রষ্টব্য স্থানে স্থাপনের জন্যে কলারসিকদের মধ্যে আগ্রহ তৈরি হল। এ তো অবশ্যম্ভাবী – যারা গড়ে না, তারাও অনুপুঙ্খভাবে দেখতে-শুনতে চায়। তার অন্তর্লীন শিল্পীসত্তা সৃজনের আনন্দ প্রাণভরে উপভোগ করতে চায়। সৃষ্টি করে স্রষ্টা যে আনন্দ পেয়েছে দ্রষ্টা হয়ে সেই আনন্দকে ছুঁয়ে দেখতে চায়। এ থেকেই পৃথিবীর নানা প্রান্তে শুরু হয়ে গেল মঞ্চ তৈরির উদ্যোগ। গ্রীসে অঙ্গনমঞ্চ প্রাধান্য পেলেও রোমে নাটমঞ্চের মতই উঁচু বেদী তৈরি হল অভিনয়ের জন্যে। ভরতের নাট্যশাস্ত্র থেকে জানা গেল প্রাচীন ভারতে নাট্যাভিনয়ের উদ্দেশ্যে তিন ধরনের রঙ্গালয়ের প্রচলন হয়েছিল – বিকৃষ্ট (আয়তাকার বা Rectangular), চতুরস্র ( বর্গাকার বা Square) এবং কনীয় বা ত্র্যস্র ( ত্রিভুজাকার বা Triangular)। এগুলোর নানা স্তরের জন্যে নানা সূক্ষ্ম মাপজোখের বিধান ছিল। এর দর্শকদেরও নাট্যভাষায় সুসংস্কৃত হতে হত। ফলে এ ধরণের প্রেক্ষাগৃহগুলোতে আম-জনতার প্রবেশাধিকার কতটা ছিল তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়। হয় তো শাসক ও অভিজাতবর্গই ছিল প্রাচীন ভারতীয় প্রেক্ষাগৃহে ভাস, ভবভূতি, কালিদাসের নাটকের দর্শক ও পৃষ্ঠপোষক। ছত্তিসগড়ের  সীতাবেঙ্গা গুহাটি ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীনতম রঙ্গমঞ্চ বলে অনেক  নাট্যতাত্ত্বিক মনে করেন।  প্রাচীন ভারতীয় রঙ্গমঞ্চে পরিবেশিত  নাট্যরীতি প্রসঙ্গে এখানে দু’চার কথা বলে নেওয়া যাক । 

• পূর্বরঙ্গ  – যবনিকা ওঠার আগে গায়ক ও বাদকদলের সমবেত হওয়ার পর সংগীত পরিবেশিত হত। 

•  ধ্রুবা – নাট্য সংগীত। ধ্রুবা ৫ প্রকার – প্রাবেশিকী (প্রবেশের সময়)। নৈষ্কামিকী (প্রস্থানের সময়)। আক্ষেপিকী (বন্দিদশা, রোগাক্রমণ, মৃত্যু প্রভৃতি সময়)। প্রাসাদিকী (উত্তেজিত দর্শকচিত্তকে শান্ত করতে)। অন্তরা (প্রধান চরিত্রগুলির বিষাদ, উদাসীনতা ও ক্রোধের অবস্থায়)। ধ্রুবাগীতিগুলির মধ্য দিয়ে চরিত্রের মানসিক অবস্থা বা নাট্যসময়ের সংকেত দেওয়া হত।

•  জর্জর দন্ড প্রতিষ্ঠা - জলভরা সোনার কলস নিয়ে সাদা পোশাক পরিহিত, সাদা ফুল সাথে সুত্রধার ও তার দু'জন সহকারী প্রবেশ করে ব্রহ্মার উদ্দেশ্যে প্রণাম নিবেদন করতেন। পরে এদের দ্বারাই জর্জর দন্ড প্রতিষ্ঠিত হত।

•   নান্দীপাঠ - দেবতা, রাজা, ব্রাহ্মণ, নাট্যকার, প্রয়োগকর্তার প্রশংসা সম্বলিত নান্দীপাঠ করতেন সূত্রধার। তারপর তার সহকারী বা বিদূষকের ডাক পড়ত। সংলাপের মাধ্যমে নাটকের বিষয়বস্তু ঘোষণার পর এরা সবাই মঞ্চ ত্যাগ করত। এখানেই পূর্ববঙ্গের চূড়ান্ত সমাপ্তি। ভরতের কঠোর নির্দেশ - পূর্বরঙ্গ যেন দীর্ঘস্থায়ী না হয়।

•  প্রস্তাবনা- 'নান্দ্যন্তে সূত্রধার'। সূত্রধারই 'প্রস্তাবনা' করে নাট্যারম্ভ করিয়ে দিতেন। দর্শকদের কাছে নাটকের পরিবেশ পরিস্ফুট করতেন। কখনো বা পাত্রপাত্রীর পরিচয় দিতেন বা তাদের প্রবেশ বিষয়েও উল্লেখ করতেন।

মূল নাটক শুরু হত এসব রীতি-রেওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়ে যাবার পর। এদেরই বিপরীত মেরুতে লোকশিল্পীরা পথকেই নাট্যমায়াতে মোহিত করে চারণিক রূপে স্থানে স্থানান্তরে ছুটত শিল্পের ফুল ফোটাতে। সব রকমের বাঁধনেই এদের অনীহা ছিল, তাই মঞ্চের বাঁধনও সযত্নে এড়াতে পেরেছে। ইংলন্ডে অবশ্য এলিজাবেথিয়ান থিয়েটারে সাধারণ দর্শক প্রবেশমূল্যের বিনিময়ে প্রবেশাধিকার পেয়েছিল আমাদের আগেই। সে যাক – মঞ্চ পাবার পর মানুষ বুঝল, এ আশ্চর্য এক দেশ। এর কোণে কোণে ছড়িয়ে রয়েছে অদ্ভুত রহস্য। এখানে কোথা থেকে যে কী হয়ে যায় আগে থেকে আঁচ করাই যায়না। এই মঞ্চই তো অভিনেতাদের স্বপ্ন। শুধু অভিনেতাই বা বলি কেন – নৃত্যশিল্পী, সংগীতশিল্পী, যন্ত্রসংগীতশিল্পী, আবৃত্তিকার, মূকাভিনেতা, হরবোলা, বক্তা – সবারই মনের গহীনে লুকিয়ে রয়েছে মঞ্চাবতরণ করে সমবেত দর্শকদের মনে স্থায়ী রেখাপাত করবার অভিলাষ। তাদের দীর্ঘদিনব্যাপী একনিষ্ঠ অনুশীলন তো মঞ্চে  ওঠার স্বপ্নিল দিনগুলোর দিকে চেয়েই। নিজের অভ্যন্তরের সৃষ্টিবীজের তারা যত্ন নিচ্ছে তো এই মঞ্চের উর্বর ক্ষেত্রে সোনালি ফসল ফলাবার জন্যেই। মঞ্চ সত্যিই এক মায়াভুবন। দিনের অন্তিম আলো দিনান্তে মিলিয়ে যাবার পর মঞ্চে যে আলোর জোনাকি ফুটে ওঠে, শিল্পীর অন্তরাঙ্গনে তা বয়ে আনে হাজার সূর্যের দীপ্তি। ওই আলোকরশ্মিতে স্নাত হতে হতেই সে সৃষ্টিসুধা নির্মাণে মগ্ন হবে। মঞ্চশিল্পীর নিপুণ করস্পর্শে এই মঞ্চেই ফুটে উঠবে স্থাপত্যের নানা আলপনা। তার যাদুকাঠিতে এই মঞ্চ কখনো হবে ঘর, কখনো ঘন অরণ্য, কখনো ধূসর মরুভূমি, কখনো ধূ ধূ প্রান্তর বা স্নিগ্ধ নদীতীর – আবার কল্পলোকের স্বর্গ হতেও তার কোন বাধা নেই। দর্শকাসনে উপবিষ্ট দীনের চেয়েও দীন যে ব্যক্তি, এই মঞ্চে রাজপ্রাসাদ গড়ে উঠলে তিনিও হবেন তার অংশীদার। আবার মঞ্চে রণক্ষেত্র তৈরি হয়ে গেলে দর্শকের নিরপেক্ষ থাকার কোন সুযোগ নেই – তাদের মন স্বতঃপ্রণোদিতভাবেই তখন ঢলে পড়ে ন্যায়ের পক্ষে। অন্যদিকে এই মঞ্চেরই বিভিন্ন তল বা উপকরণে যখন মঞ্চালোক পিছলে যায়, তখন দর্শকমনে তার প্রতিক্রিয়ায় ওঠানামা করতে থাকে অনুভূতির উথাল-পাথাল ঢেউ। মঞ্চমায়ার এই তো তেজ — ক্ষীণতেজা মানুষকেও সতেজ করে তুলতে তার জুড়ি নেই।

             আজকের কথা তো নয়, প্রায় আড়াই হাজার বছরের পুরোনো দিনে গ্রীস দেশের এথেন্স নগরীর উপকন্ঠে এ্যাক্রোপোলিস পাহাড়ের গায়ে খোলামেলা ডাওনিসাস থিয়েটারে প্রায় তিরিশ হাজার দর্শক এসে জড়ো হয়ে বসতেন নাটক দেখবার আশায়। অতীতের সেই দুর দিগন্তে নাটকের সাথে জুড়ে থাকত ধর্মাচার। কৃষি ও সুরার দেবতা ডাওনিসাসের মূর্তি নিয়ে শোভাযাত্রা হত। ওই এ্যাক্রোপোলিস পাহাড়ের মাঝে অর্কেষ্টা পিট, তাকে ঘিরে পাহাড়ের গায়ে ধাপে ধাপে কাটা অর্ধবৃত্তাকার দর্শক গ্যালারি। সামনের সারি পুরোহিতদের জন্যে সংরক্ষিত। গ্রীসের এপিডোরাস থিয়েটার অঙ্গনে অর্কেষ্ট্রার মাঝখানে দাঁড়িয়ে মৃদুস্বরে কথা বললেও দর্শকাসনের শেষপ্রান্তের দর্শকেরাও তা স্পষ্ট শুনতে পেতেন। অর্কেস্ট্রা নির্ধারিত ছিল কোরাসদের জন্যে। নাটক শুরুর আগে অর্কেস্ট্রার বেদীতে পুরোহিতদের নেতৃত্বে হত কিছ ধর্মীয় কৃত্য। পূর্বোল্লিখিত শোভাযাত্রায় এফিবোই অস্ত্রসজ্জিত হয়ে থাকতেন পুরোভাগে। শোভাযাত্রাটি আকাদেমিতে এসে পৌঁছোলে অর্কেস্ট্রাসংলগ্ন বেদীর ওপর মূর্তিস্থাপন করা হত। তারপর তার সামনে হত যাগযজ্ঞ, প্রার্থনা, পশুবলি ও নাচগান। গাওয়া হত ডিথিরাম্ব স্তুতিগীতি।  এই গীতিতে বলা হয়েছিল ডাওনিসাসের জন্ম, মৃত্যু ও পুনর্জন্মের উপাখ্যান। সেকালের নাট্যতাত্ত্বিক আরিস্টটলের মতে, এই ডিথিরাম্ব থেকেই এথেনিয়ান ট্র্যাজেডির উৎপত্তি। অর্কেস্ট্রা পিটে এসে দাঁড়াত সমবেত সঙ্গীতদল বা chorus. কোরাসদলের নেতার গায়ে মূল্যবান পোশাক, উঁচু গোড়ালিযুক্ত জুতো (কোথর্ন), মাথায় রাজমুকুট-তুল্য উন্নতশীর্ষ মুখোশ। গ্রীসদেশের মানুষের মনে গাঁথা ছিল এই ধারণা যে, শীতকালে প্রকৃতির জীবনীশক্তি শুকিয়ে যায়, গ্রীষ্মে আবার তা পুনর্জীবন লাভ করে। এই ঋতুচেতনা থেকেই মার্চ মাসের শেষদিকে হত পাঁচ-ছ'দিনের ডাওনিসাস উৎসব – যেখানে পরিবেশিত হত ট্র্যাজেডি নাটক আর জানুয়ারির শেষে বা ফেব্রুয়ারির শুরুতে অনুষ্ঠিত হত দু' তিন দিনের লেনাইয়া উৎসব – যা ছিল কমেডি নাটক প্রদর্শনের জায়গা – সবই ওই আলোচ্য ধরণের রঙ্গস্থল-কেন্দ্রিক। ৫৩৪ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে পেইসিসট্রোটাসের উদ্যোগে পৃথিবীর প্রথম যে নাট্য প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল, তা-ও এই ধাঁচের রঙ্গমঞ্চে। এখানেই বিশ্ববিখ্যাত নাট্যকার ইস্কাইলাস, সোফোক্লিস, ইউরিপিদিসের নাটক দেখেছেন গ্রীসদেশের দর্শকবৃন্দ।

   রোমে খ্রীষ্টপূর্ব ১ম শতাব্দীতেও হাল্কা চালের কৌতুকনক্সা (কমেদিয়া দেল আর্তে) পথে পথে ঘুরে ঘুরে পরিবেশিত হত। গ্রীসদেশ রোম দখল করবার পর দখলদার দেশের উন্নততর সংস্কৃতির প্রভাবে রোমান নাট্যচর্চা উন্নত হয়। ধর্মাচরণ জড়িত ছিল রোমান থিয়েটারের সঙ্গেও। তবে দেবদেবীর প্রভাব খর্ব হযে যখন রাজারাজড়ার প্রভাব বিস্তারলাভ করতে লাগল, তখন নাট্যানুষ্ঠানের ধরণও বদলে যেতে লাগল। রোমের প্রাচীন থিয়েটার ছিল পম্পেই আর মার্শেলাস শহরে। অভিজাতেরা নিয়ন্ত্রক ছিল গ্রীক থিয়েটারের আর রোমান থিয়েটারে প্রাধান্য হল ক্রীতদাসদের।  রোমান রঙ্গমঞ্চে অর্কেস্ট্রা বা সেখানকার বেদী বাদ গেল। উঁচু মঞ্চে খোলা আকাশের নিচে অভিনয় হতে থাকল। আগে অনুষ্ঠানের দিন অস্থায়ী রঙ্গমঞ্চ তৈরি করে নাট্যানুষ্ঠান হয়ে যাওয়ার পর আবার সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হত, পরে মন্দির, প্রাসাদ প্রভৃতি স্থাপত্যকীর্তি নির্মাণের প্রচলন হওয়ার সাথে সাথে নগরে স্থায়ী রঙ্গমঞ্চু তৈরিও শুরু হয়ে গেল। সামাজিক প্রতিষ্ঠা অনুযায়ী প্রেক্ষাস্থলে বসবার আসনের আগু-পিছু নির্ধারণ করা হতে লাগল। অর্কেস্ট্রার নামটা বজায় রইল তবে সে জায়গাটা নির্ধারণ করা হল সেনেটরদের বসার জন্যে। বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতিনিধি আর রাজ-পরিবারের কিছু সদস্যের এখানে বসবার সুযোগ ছিল। অর্কেস্ট্রার পেছনে ১৪টি সারির মধ্যে নাইটরাও বসতে পারতেন। অবিবাহিত নরনারীর চেয়ে বিবাহিত নরনারীদের স্বাচ্ছন্দ্যকর বসবার স্থান দেওয়া হত। থিয়েটার হলে দর্শক হিসেবে ক্রীতদাসদের প্রবেশাধিকার ছিল না, কিন্তু নাটকে ভাড়াটে অভিনয়শিল্পী হয়ে এরাই দেখা দিত বারবার। কিছু মুক্তিপ্রাপ্ত কয়েদিও এদের সাথে জুটে যেত। কৌতুকাভিনয়, মূকাভিনয় আর লোকসংস্কৃতি থেকে তুলে আনা 'আতেল্লানা' দর্শকমহলে সমাদৃত হত। ইতালিতে বাতির সামনে রঙিন জলের বোতল স্থাপন করে, পেছনে আয়না জুড়ে আলোর হেরফের ঘটিয়ে আলোকসম্পাতের নানা পথ খোঁজা চলত এই সময়ে। পার্মা শহরের ফারনিস থিয়েটারেই প্রথম মঞ্চের সামনের অংশ 'প্রসেনিয়াম', 'আর্চ' আর 'কার্টেন' দিয়ে ঢাকা হল – এভাবেই সূত্রপাত পিকচার ফ্রেম স্টেজের।

        ষোড়শ শতাব্দীর লন্ডনে সরাইখানার প্রাঙ্গনে মঞ্চ বানিয়ে নাটক হত, মুক্তাঙ্গনেও পরিবেশিত হত 'কর‍্যাল' থিয়েটার। 'কর‍্যাল' বলতে বোঝায় সারি সারি বাড়ির পেছনে আবর্জনা ফেলার জায়গা। ১৫৭৬ সালে প্রথম এলিজাবেথের রাজত্বকালে ইংল্যান্ডে প্রথম সাধারণ রঙ্গমঞ্চ স্থাপিত হয়  – নাম তার ‘দি থিয়েটার', নির্মাতা একজন কাঠমিস্ত্রি জেমস বারবেজ। আবার তিনি অভিনেতাও বটে। থিয়ে- টারের বিরুদ্ধে তখন কিছু অভিযোগও উঠে যাচ্ছিল। যেমন, সেখানে দর্শকদের ভিড়ে চোরেরা হাতসাফাই করে, প্রোটেস্ট্যান্ট আর ক্যাথলিকদের দাঙ্গাহাঙ্গামাও ঘটে, দর্শকদের ভিড়ে সেই আমলের বিভীষিকা প্লেগ মহামারীর সংক্রমণও ছড়াতে পারে, আর ছোঁড়া হল নৈতিকতার বাণ – নাটক দুষ্কর্মে প্ররোচনা যোগায়। রানি বা রাজন্যবর্গ অবশ্য এসব নালিশে কর্ণপাত না করে নাট্যচর্চার পৃষ্ঠপোষকতাও করতেন। এলিজাবেথিয়ান থিয়েটারে অভিনেতাদের ব্যবহারের জন্যে পেছনে দু'দিকে দুটি দরজা, ওপরে বারান্দাসহ মঞ্চ, দর্শকদের যাতায়াতের জন্যে বড় দরজা আর তিন দিক জুড়ে ছিল গ্যালারি। মঞ্চের অর্ধেকটা সামনের খোলা প্রাঙ্গণের দিকে এগিয়ে থাকত। এলিজাবেথিয়ান রঙ্গমঞ্চে অভিনয় ক্ষেত্র ৭টি – মূল মঞ্চ, একই উচ্চতায় অন্দর-মঞ্চ, তোর দুপাশে দুটি জানালাযুক্ত দুই মঞ্চ, উঁচুতলায় বাদকদের জন্যে জায়গা। 

             চীনা রাজাদের নির্মিত প্রাচীন মন্দিরে প্রার্থনার সময় পতাকা, পালক ও অন্যান্য উপকরণ নিয়ে লোকেরা নাচগান করত। বলা হয়, তা থেকেই চীনা নাটকের উদ্ভব। এসব নাটকে কোরাস, বাদ্যযন্ত্র, কথ্যভাষা, দৃশ্য, অঙ্ক এসব ছিল – যেগুলো এসেছে গ্রীক নাটক থেকে। নাটকে দেবদেবী থেকে সম্রাট বা দাসদাসীরাও চরিত্র হিসেবে আসত। তবে চীনদেশের তখনকার আইনে কিন্তু সম্রাট, সম্রাজ্ঞী ও মহামানবদের চরিত্রচিত্রণ নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু ওসব গ্রাহ্য করা হত না। য়ুয়ান রাজবংশের শাসনকাল ছিল চীনা নাটকের স্বর্ণযুগ। সে সময় নাটকের চরিত্রগুলি সংলাপ বলার পাশাপাশি ঘন ঘন গানও গাইত। দৃশ্য বা অঙ্কের পর পর্দা ওঠানামার কোন বালাই ছিল না। শুধু দেহ ভঙ্গিমায় ঘোড়ায় চড়া, নদীতে নৌকোযাত্রা ইত্যাদি বুঝিয়ে দেওয়া হত। কিছু বড় শহরে অল্প কিছু  স্থায়ী মঞ্চ ছিল। তার মধ্যে বিশেষভাবে বলা যায় ‘চা-ঘর  থিয়েটার'-এর কথা – যেখানে নাটক প্রদর্শনের পাশাপাশি চা-পানেরও ব্যবস্থা থাকত। সেখানকার গ্রামেগঞ্জে ভ্রাম্যমান অভিনেতারা বাঁশের বেড়া আর পাতার ছাউনি দেয়া মঞ্চে নাটক পরিবেশন করতেন।

এখন জাপানে আধুনিক নাটক পরিবেশনের পাশাপাশি ঐতিহ্যশালী 'নো' আর 'কাবুকি’ থিয়েটারও চালু রয়েছে। 'সারগাকু' নৃত্য থেকেই 'নো' নৃত্য-গীতিনাট্যের উদ্ভব।  নো প্রধানত নাচ-গানের নাটক। বৌদ্ধ ধার্মিকেরা কিওগেন নামে এক ধরণের ব্যঙ্গ নাটিকাও প্রদর্শন করতেন। নো বা কিওগেন সর্বসাধারণের জন্যে নয়, অভিজাত লোকদের জন্যে। কামারের মেয়ে ইজুমোনো ও-কুনি নো নাটকে ধর্মীয় সংগীতের পরিবর্তে জনপ্রিয় গানের প্রচলন করেন। এ রকম ধর্মনিরপেক্ষ জনপ্রিয় অনুষ্ঠানকে বলা হত শিবাই'। এই শিবাইয়েরই নাম পরে হয়েছে 'কাবুকি'। ইয়েদো শহরে ১৬২৪ সালে প্রতিষ্ঠিত সারুগাজা থিয়েটারই জাপানের প্রথম কাবুকি রঙ্গমঞ্চ । প্রেক্ষাগৃহের এক প্রান্ত থেকে বিপরীত প্রান্তবর্তী মঞ্চের সমান উঁচু পথকে বলা হয় ‘হানামিচি' বা ফুল-বিছানো পথ। ডানদিকেও এ রকম পথ থাকলে তাকে বলে 'কারিবানা মিচি’ বা অস্থায়ী ফুলের সেতু। হানামিচি আর মঞ্চের মধ্যবর্তী জায়গা চিহ্নিত হয়ে আছে 'হাশিগাকারি' বা যোগাযোগ স্থল হিসেবে ।  কখনও যোদ্ধা চরিত্রের ছোটাছুটির এ জায়গাটা হয়ে ওঠে 'মুশা বাশিরি’ বা যোদ্ধাদের দৌড়ক্ষেত্র। এরই কাছাকাছি থাকে হঠাৎ মঞ্চে প্রবেশ-প্রস্থানের পথ 'ওকুবায়ো গুচি’ বা ভীতুদের গর্ত। 'বুতাই বান' হল মঞ্চাধ্যক্ষের স্থান।

      বাংলার মঞ্চকথা এখানে একটু আলোচনা করে নেওয়া যেতে পারে। চর্যাপদ' বা 'শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ওপর নির্ভর করে বলা যায় – প্রাচীন যুগ থেকেই বাংলায় নাট্যচর্চা ছিল। নেপালের রাজ-গ্রন্থাগারেও পুরোনো বাংলা নাটকের নিদর্শন পাওয়া গেছে। বৃন্দাবন দাসের 'চৈতন্য ভাগবত'-এর তথ্যসূত্র থেকে জানতে পারি – শ্রীচৈতন্যদেবও অভিনয়ে অংশগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু এই নাটকগুলি সবই পালাগান ধাঁচের। কোনো মঞ্চে এগুলি অভিনীত হয়েছে বলেও কোন তথ্য নেই। প্রকৃতপক্ষে প্রাচীন বাংলার কোন আদর্শ রঙ্গমঞ্চ অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হয়নি। হয় তো অঙ্গন অথবা মন্দির প্রাঙ্গনই ছিল প্রাচীন বঙ্গদেশের অভিনয়স্থল। আধুনিক থিয়েটারের Picture Frame Stage পরাধীন ভারতে এল ইংরেজদেরই হাত ধরে। সাম্রাজ্যরক্ষার প্রয়োজনে মেসব ইংরেজ স্বদেশ ছেড়ে ভারতবর্ষে আস্তানা গাড়তে বাধ্য হলেন – তারাই মনোরঞ্জনের খাতিরে দেশজ সংস্কৃতিটাকেও এদেশে নিয়ে এলেন। আধুনিক থিয়েটার স্টেজ এল সেই সুবাদে। এর প্রথম নিদর্শন – ১৭৫৩ সালে কলকাতার লালবাজারে প্রতিষ্ঠিত 'প্লে হাউস'। প্রখ্যাত ব্রিটিশ মঞ্চাভিনেতা ডেভিড গ্যারিক এই মঞ্চ প্রতিষ্ঠার কাজে স্থানীয় ইংরেজ উদ্যোক্তাদের সহায়তা করেছিলেন। ১৭৫৬ সালে নবাব সিরাজদ্দৌল্লার হানায় কলকাতার পতনের পর প্লে হাউস বন্ধ হয়ে যায়। এর পর ১৭৭৫ সালে প্রতিষ্ঠিত 'ক্যালকাটা থিয়েটার' ৩৩ বছর ধরে কলকাতার বুকে টিঁকে ছিল। পরে দেনার দায়ে এটাও স্তব্ধ হয়ে যায়। ইংরেজ প্রতিষ্ঠিত অন্যান্য নাট্যশালাগুলি হল – মিসেস ব্রিস্টোর প্রাইভেট থিয়েটার ( ১৭৯৭), মিসেস লিচের থিয়েটার, ওয়েলার প্লেস থিয়েটার, দমদম থিয়েটার,  আর্মেনিয়ান থিয়েটার, এথেনিয়ন থিয়েটার (১৮১২) , চৌরঙ্গী থিয়েটার ( ১৮১৩) ,বৈটাকোণা থিয়েটার ( ১৮২৪) সাঁ সুসি থিয়েটার ( ১৮৪১)  প্রভৃতি। ১৭৯৫ সালের ২৭শে নভেম্বর ২৫ নং ডোমতলা লেনে রুশ দেশ থেকে কলকাতায় আগত ভাগ্যান্বেষী গেরাসিম স্তেপানভিচ লেবেদেফ প্রথম বাংলা অনুবাদ নাটক 'কাল্পনিক সংবদোল' (মূল নাটক – দ্য ডিসগাইজ, নাট্যকার – এম. জোড্রেল) মঞ্চস্থ করেন। তাঁর রঙ্গালয়টির নাম ছিল- 'বেঙ্গলি থিয়েটার'। কিন্তু ইংরেজদের কুনজরে পড়ে লেবেদেফ এই মঞ্চটিকে টেঁকাতে পারেন নি। ১৭৯৬ খ্রীস্টাব্দে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর   মাসের মধ্যে এটি ভস্মীভূত হয়।  এর মধ্যে বাঙালি বাবুদের মনেও থিয়েটারের রং লেগে গিয়েছিল। ইংরেজ থিয়েটারে একের পর এক নাটক মঞ্চস্থ হতে দেখে তারা চাইলেন ভারতীয় ঘরানায় একটা-কিছু করে দেখাতে।। ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে প্রসন্নকুমার ঠাকুর নারকেলডাঙায় তার শুঁড়োর বাগানবাড়িতে ‘হিন্দু থিয়েটার’ প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু এখানে সংস্কৃত, ইংরেজি প্রভৃতি ভাষার নাটকেই পরিবেশিত হত। বাংলা ভাষায় থিয়েটার পরিবেশনে সর্বাগ্রগণ্য নাম নবীনচন্দ্র বসুর।  ইনি ১৮৩৬ খ্রীস্টাব্দে নিজের প্রাসাদোপম বাসগৃহে থিয়েটার স্থাপন করেন। এখানে নাকি বছরে চার পাঁচটি করে নাটক মঞ্চস্থ হত।  ১৮৩৫ খ্রীস্টাব্দের ৬ই অক্টোবর এখানে পরিবেশিত হয়েছিল কবি রায় গুণাকর ভারতচন্দ্রের ‘বিদ্যাসুন্দর'-এর নাট্যরূপ। বাংলা   ভাষায় এই নাটকটি সেদিন রাত ১২-৩০ টায় শুরু হয়ে পরের দিন ভোর ৬-৩০ টায় শেষ হয়েছিল।   নবীনচন্দ্রের বাড়ির পুকুরপাড়, বাগান, বৈঠকখানা প্রভৃতি স্থানে নাটকের বিভিন্ন দৃশ্য সাজিয়ে রাখা হয়েছিল। এক জায়গায় অভিনয় দেখে দর্শক দ্রুত ছুটছিলেন  আরেক জায়গার অভিনয় দেখতে। কখনো বা যেতে হচ্ছিল মাটির নিচের সুড়ঙ্গপথ দিয়ে।এই নাটকে রাধামণি, জয়দুর্গা,রাজকুমারী প্রভৃতি মহিলাদের দ্বারাই নারীচরিত্র রূপায়িত  হয়েছিল।  শিল্পী ও কলাকুশলী সকলেই ছিলেন বাঙালি। 'লক্ষাধিক চল। নাটকটির হয়েছিল। লি। শোনা যায় এ নাটকের মঞ্চায়নে নবীবচন্দ্রের দু’লক্ষাধিক টাকা ব্যয়িত হয়েছিল, যার ফলশ্রুতিতে তাকে ইংরেজটোলার খাতাবাড়ি বিক্রি করতে হয়েছিল। বাঙালি বাবু সম্প্রদায়  প্রতিষ্ঠিত আরো কয়েকটি নাট্যশালা হল – শোভাবাজার নাট্যশালা  (১৮৪৪, রাধাকান্ত দেব)  জোড়াসাঁকো থিয়েটার (১৮৫৪, প্যারীমোহন বসু),  বিদ্যোৎসাহিনী থিয়েটার  (১৮৫৭, কালীপ্রসন্ন সিংহ), বেলগাছিয়া থিয়েটার (১৮৫৮, প্রতাপচন্দ্র সিংহ ও ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ), মেট্রোপলিট্যান থিয়েটার (১৮৫৯,  রামগোপাল মল্লিক ), পাথুরিয়াঘাটা বঙ্গনাট্যালয় (১৮৬৫, সৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর ও যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর), বহুবাজার বঙ্গনাট্যালয় (১৮৬৮, বলদেব ধর ও চূণীলাল বসু) প্রভৃতি। এই থিয়েটারগুলি মূলত ছিল বাঙালি অভিজাত সম্প্রদায়ের বাড়ি বা বাগানবাড়িকেন্দ্রিক। ইংরেজ নাট্যশালায় শেক্সপীয়র ও লন্ডনের রঙ্গমঞ্চের জনপ্রিয় নাটকগুলির পুনরাভিনয় দেখার অভিজ্ঞতার সাথে বাংলার ঘরোয়া যাত্রা দেখার অভিজ্ঞতা একত্রে জড়ো করে বাঙালি বিত্তশালীরা এই থিয়েটার অভিযান শুরু করেন। এদের কারো কারো কাছে এই নাট্যচর্চা ছিল নিতান্তই বিলাসিতা – ঘুড়ি ওড়ানো বা বুলবুলির লড়াইয়ের পেছনে পয়সা ওড়ানোর মত। অন্তরঙ্গ, অনুগত বা ভাড়াটে শিল্পীদের দিয়ে এরা এসব নাট্যায়োজন সম্পন্ন করতেন। কখনো কখনো বিত্তশালী বাবুর অভিনয়ের কেরামতি দেখানোর জন্যে অন্যান্য শিল্পীরা সহায়ক হিসেবে নিযুক্ত হতেন। আবার নাট্যচর্চার আবডালটি কোন কোন বাবুর বারবিলাসিনীর সঙ্গ পাবার পক্ষে সুবিধেজনক হত বলে কারো মনে সন্দেহ জাগাটা কোন অস্বাভাবিক বিষয় ছিল না। নাট্যচর্চাকে সবসময় এই বাবুরা কলাকৈবল্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গীতে প্রশ্রয় দিতেন কি? তা যদি হয় তো 'কিছু কিছু বুঝি' প্রহসনে 'দন্তবক্র' চরিত্রে অভিনয়ের জন্যে অর্ধেন্দুশেখর মুস্তফিকে পাথুরিয়াঘাটার রাজবাড়ির আশ্রয় থেকে বিতাড়িত হতে হল কেন? তবে এই ধরণের নাট্যশালাগুলির মধ্যে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ও গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির নাট্যশালা (১৮৬৫) রুচি ও নিষ্ঠার দিক থেকে সম্ভবত ছিল অন্য ধাঁচের। বাবু থিয়েটারে সাধারণ দর্শকদের প্রবেশাধিকার ছিল না – আমন্ত্রিতরাই সেজেগুজে এখানকার দর্শকাসন অলঙ্কৃত করতেন। নির্মেঘ সন্ধ্যায় মায়াবী আলোকমালায় সাজানো অনুষ্ঠানমুখর বাবুদের নাট্যশালার দিকে চেয়ে নিজের ভেতর থেকে উঠে আসা হতাশ্বাসে সাংস্কৃতিক বাসনাকে চাপা দেয়া ছাড়া আমজনতার তখন আর কিছুই করণীয় ছিল না। এর মধ্যে অভিজাত সমাজের মধ্যে থিয়েটার বেশ জাঁকিয়ে বসেছে, কিন্তু ইংরেজ রাজপুরুষ বা স্থানীয় অভিজাতদের আওতাভুক্ত না হওয়ার দুর্ভাগ্যে সাধারণ মানুষ থিয়েটারেরও কেউ হতে পারেন নি। কারণ, তারা ইংরেজ রাজপুরুষ নন, অথবা বাবুদের টাকার স্তূপে গজিয়ে ওঠা মোসায়েব নামক আগাছাও তারা নন – তারা যে সাধারণ মানুষ। অতএব, থিয়েটার তাদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। সাধারণ দর্শক দর্শনীর বিনিময়ে নাট্যশালায় প্রথম প্রবেশাধিকার পেলেন ১৮৭২ সালের ৭ই ডিসেম্বর ন্যাশন্যাল থিয়েটারে 'নীলদর্পণ' নাটকের প্রদর্শনীতে। আট আনা ও এক টাকা ছিল সেই থিয়েটারের প্রবেশমূল্য।

তখন থেকে থিয়েটারের ঘটল বাঁকবদল – নাকি একে রাহুমুক্তি বলা যাবে? থিয়েটারের ক্ষীণ ধারা স্রোতস্বিনীর সাথে মিশে দেখা করতে রওয়ানা দিল মহামহিম জলধির সাথে।

             

                 


সহায়ক গ্রন্থঃ-

• থিয়েটারে দৃশ্যের বিকাশ ও সমীক্ষা - রঞ্জিত কুমার মিত্র

• রঙ্গমঞ্চ স্থাপত্য- কৌশিক সান্যাল

• সংস্কৃত নাট্য প্রয়োগ- পরিমল চট্টোপাধ্যায়


 

কার্তিক মাসের লোকউৎসব

শ্রাবণী সেনগুপ্ত 


বাংলা সনের সপ্তম মাস কার্তিকে হেমন্তের শুরু।শিশিরের ছোঁয়ায় প্রকৃতি স্নান করে।কথিত আছে যে,এইসময় ভগবান বিষ্ণু তাঁর চার মাসের যোগনিদ্রা থেকে জেগে ওঠেন।কার্তিক সংক্রান্তিতে বাংলায় কার্তিক পুজো হয়।এই সময় কাটোয়ায় `কার্তিক লড়াই`বাংলার একটি বিখ্যাত আঞ্চলিক উৎসব।কার্তিক পুজোকে কেন্দ্র করে এতো বড় আঞ্চলিক উৎসব বিরল।
        কার্তিক মাসের সংক্রান্তির রাত্রে এই উৎসবের শুরু এবং পরেরদিন ভাসানে শেষ।বর্ধমান,নদীয়া,মুর্শিদাবাদ, হুগলি প্রভৃতি জেলার মানুষেরা এতে অংশগ্রহণ করে থাকেন।তবে কাটোয়ার মতন এতো বড় করে কোথাও এই উৎসব হয়না।অনুমান করা যায় যে,কাটোয়ার কার্তিক পুজো নবম দশম শতক থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে কোনো এক সময়ে প্রবর্তন হয়েছে।প্রাচীন জনপদ কাটোয়ার পুরাতন পুজোগুলির মধ্যে তাঁতিপাড়ার 'সাত ভাই কার্তিক'পুজাটি অন্যতম।এই পুজোটিতে মূর্তি নির্মাণের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যায়। এক্ষেত্রে একটি 'থাকায়' সাতটি মূর্তিকে বাঙালি বেশে সাজিয়ে রাখা হয়।  সবার উপরে একটি অনেকটা রাজার মতন একটি বিরাট মূর্তি,আর দুই পাশে উপর থেকে নীচে পরপর তিনটি থাকে তিনটি করে মোট সাতটি মূর্তি একই ভঙ্গি ও আকৃতিতে রাখা হয়।মূর্তিগুলোর পরনে ধুতি,গায়ে জামার উপর ওড়না,মাথায় মুকুট, ডান হাতে গোলাপের গুচ্ছ।প্রচলিত কার্তিকের মূর্তির থেকে আলাদা এই মূর্তিগুলি অনেকের মতে লৌকিক প্রভাবে কল্পিত হয়েছে।একমাত্র তাঁতিপাড়াতেই এই সাত ভাই কার্তিকের পুজো হয়।
    'খোকা’ বা  'নেংটো'  কার্তিকের পুজো মালোপাড়াতে হয়।এটি একটি একক উলংগ মূর্তি। শায়িত ময়ূরের পিঠে বিশালাকার নগ্ন মূর্তি দাঁড়ানো অবস্থায় থাকে,এর এক হাতে মোয়া, অন্য হাতে ফুল।কথিত আছে যে, ভাগীরথী অজয় নদী সংযোগ কুলবর্তী বারবনিতারা এই মূর্তি পুজোর প্রচলন করেছিল। অতীতের বড় ব্যবসাকেন্দ্র কাটোয়াতে জলপথে দেশবিদেশের যে সমস্ত ব্যবসায়ীরা এসে সাময়িকভাবে বসবাস করতেন, মূলত তাদের কারণেই নাকি এই বারবনিতাদের একটি আস্তানা এই নদীর ধারে গড়ে উঠেছিল।
          এছাড়া বাবু কার্তিক, জামাই কার্তিক উদাসী কার্তিক প্রভৃতি একক মূর্তিও পুজিত হয়।জামাই বা বাবু কার্তিকের পরনে প্রায় একই ধরনের ধুতি,পাঞ্জাবি ,পায়ে জুতো থাকে,এক হাতে ধুতির কোঁচা ধরা থাকে।উদাসী কার্তিকের এক হাতে মদের বোতল ,অন্য হাতে ঝোলা,পরনে কাপড়,গায়ে জামা।তবে মূর্তির সংখ্যাগত দিক থেকে দেব সেনা কার্তিক এবং কাত্যায়নী কার্তিকের সংখ্যাই বেশি।তবে এক্ষেত্রে এগুলি থাকায় পুজিত হয়- এই অভিনব রীতি কাটোয়া ছাড়া আর কোথাও বড় একটা চোখে পড়েনা।
       'থাক 'বা 'স্তর 'থেকে 'থাকায়' শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে।কাঠের একটি মজবুত পাটাতনের উপর বাঁশের চটার সাহায্যে কয়েকটি থাক তৈরি করা হয়। নিচটা প্রশস্ত থাকে। পর্যায়ক্রমে সংকীর্ণ হয়ে উপরে একটি মূর্তি বসার মতো থাক করা হয়। পাঁচ থেকে নয়টি থাক বর্তমানে হয়,আগে আরো বেশি হত।সর্বোচ্চ বা মাঝে কাত্যায়নী কার্তিক অথবা দেবসেনা কার্তিককে স্থাপন করা হয়।পরের থাকগুলিতে মহাভারত রামায়ণ পুরাণ কাহিনী অবলম্বিত মূর্তি রাখা হয়।থাকায় দুইপাশে প্রতিটি থাকে উপর থেকে নীচ পর্য্যন্ত নৃত্যরত ভঙ্গিতে সুসজ্জিতা নারীমূর্তি থাকে।মূর্তির সংখ্যার উপরে কাঠামোর উচ্চতা নির্ভর করে।থাকায় সাধারণত 'শুম্ভ নিশুম্ভ বধ', 'কুম্ভকর্ণ বধ','দূর্যোধন বধ','অভিমন্যু বধ', 'পুতনা বধ','রাবণ বধ,''সীতার অগ্নিপরীক্ষা','সীতার পাতাল প্রবেশ','দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ,' 'সীতাহরণ,''শ্রী কৃষ্ণের ননী চুরি,' 'জগাই মাধাই উদ্ধার',প্রভৃতি কাহিনী মূর্তির সাহায্যে প্রদর্শন করা হয়।এখন আবার কোনো কোনো থাকায় কপালকুণ্ডলা,রামকৃষ্ণের সাধনা,রামপ্রসাদের কালীদর্শন প্রভৃতি কাহিনীও সংযোজিত হচ্ছে।এমনকি জয় জওয়ান জয় কিষাণ, অমর ভারত প্রভৃতিও ইতিমধ্যে কোনো কোনো থাকায় স্থান পেয়েছে।নকশাল কার্তিকের উপস্থিতিও দেখা গেছে।বছর বছর এই 'থাকার পালা'পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রেখে তৈরি করা হয়।আনন্দ এবং তার সঙ্গে লোক শিক্ষার মহান দায়িত্ব পালিত হয়ে চলে এইভাবে।এক্ষেত্রে লক্ষ্যণীয় বিষয়টি হল এই যে,থাকায় প্রধানত মহাকাব্যের যুদ্ধাংশ তথা বধের অংশই প্রাধান্য পেয়ে আসছে।কাটোয়া শহরের প্রতিটি কার্তিক পুজোতে প্রতিটি থাকায় আলাদা আলাদা পালা উপস্থিত করা হয়।সবক্ষেত্রেই 'শুভ শক্তির জয়' দেখানো হয়।মূর্তির কাঠামো তৈরির রীতি বাংলায় প্রচলিত থাকলেও কাটোয়ার কার্তিকের থাকার আকৃতি প্রকৃতি স্বতন্ত্র।এর বহন ক্ষমতা,সাজসজ্জা সবই অভিনব।
       তৈরি মণ্ডপে কার্তিক সংক্রান্তির রাত্রে পুজো হয়।পুরোহিত পুজো করেন খুব সাধারণ উপাচার দিয়ে।সারা রাত দর্শনার্থীদের ভিড় থাকে চোখে পড়ার মতন।পরেরদিন, অর্থাৎ ১লা অগ্রহায়ণ ভাসান হয় ভাগীরথীর জলে। ভাসানের আগে থাকা সমেত শোভাযাত্রা বের হয়,একেই বলে 'কার্তিক লড়াই'।কাটোয়ার এই উৎসবের সঙ্গে বিভিন্ন স্তরের ব্যবসায়ীরা যুক্ত থাকেন।
        শহরে জাঁকজমক করে কার্তিক সংক্রান্তির রাতে কার্তিক পুজো হয়,আর সূর্যোদয়ের আগে কাটোয়ার চারপাশের গ্রামে গ্রামে কৃষকদের' মুঠ পুজো 'হয়।এখন এই পুজোর প্রচলন কমে এলেও আছে।এই পুজোয় কোনো মন্ত্র,পুরোহিত ,শাস্ত্রীয় আচার অনুষ্ঠান নেই,শুধুই লোকাচার।হাতে শঙ্খ আর হলুদ রঙের রঙিন ন্যাকড়া নিয়ে কৃষকেরা ভোর হওয়ার সাথে সাথেই মাঠে যায়,'লঘু ধান' কেটে এক মুঠো করে রঙিন ন্যাকড়ায় জড়িয়ে শঙ্খ বাজাতে বাজাতে মাথায় করে নিয়ে ফিরে আসে।বাড়িতে আসার পর মেয়েরা সেটিকে ঘরে নিয়ে যায়।ঘরের মধ্যে করা আতপ চালের গুঁড়ো আলপনার মধ্যে সেটিকে স্থাপনা করা হয়।সেই সঙ্গে ছড়া বলা হয়-
   "কাঠির মুঠি কুড়াতে গেলাম,
    লক্ষ্মীর কথা শুনে এলাম।
     কথা শুনলে কি হয়?
      নিধনের ধন হয়।- ইত্যাদি।
এরপর  সেই 'মুঠ' গোলার 
চালের উপর রেখে দেওয়া হয়।'মুঠ 'এর ধান ঝরে গেলে শুকনো খড়গুলো আড়াই পাক দিয়ে লক্ষ্মীর হাঁড়ির গলায় বেঁধে রাখা হয়।
       এইভাবে বাংলার ঘরে ঘরে পালিত হয় বিভিন্ন আনন্দোৎসব।এইসমস্ত লোক উৎসবের মধ্যে লক্ষ্য করা যায় বাস্তবধর্মীতা, স্বতস্ফূর্ত  আন্তরিক আবেদন,সার্বজনীনতা।
          


 

কালী পুজো : কিছু কথা 
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় 

"আমি তোমার কি ধার ধারি, শ্যামা মায়ের খাস তালুকে বসত করি।"

ত্রিপুরার নারায়ণপুরের মৃজা হুসেন আলী যমকে তাচ্ছিল্য করে এই গান গেয়েছিলেন ।বিষয়টা এমনই তিনি সহায় থাকলে আর কারো ধার ধরার প্রয়োজন নেই।  মা কালী সহায় মানেই স্বর্গ, মর্ত পাতাল সবটাই হাতের মুঠোয়। 

একমাত্র কেরালা ছাড়া সমগ্র দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া এবং ভারতীয় উপমহাদেশে কালীকে ভগবান শিবের স্ত্রী পার্বতীর রূপ হিসেবে বিশ্বাস করা হয়।  কেরালার লোকবিশ্বাস অনুসারে ভগবান শিবের তৃতীয় নয়ন থেকে রাক্ষসদের ধ্বংস করার জন্য তিনি আবির্ভূতা হন। তাই কেরালায় তিনি  ভৈরবপত্নী মহাকালী হিসেবে পুজিত হন।

ষোলো শতকের আগে কালী পুজো অজানাই ছিল। বিখ্যাত ঋষি কৃষ্ণানন্দ আগমবগিষা প্রথম কালীপূজোর সূচনা করেন। সতেরো শতকের শেষের দিকে "কালিকা মহাকাব্য" নামে একটি ভক্তিমুলক গ্রন্থে  কালীকে উৎসর্গীকৃত একটি বার্ষিক উৎসবের কথা উল্লেখ আছে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে বাংলায় নবদ্বীপের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র কালীপূজোর ব্যাপক প্রসার ঘটান।

পশ্চিমবঙ্গ,বিহার,নেপাল, ত্রিপুরা, বাংলাদেশে কালী পুজোর সর্বাধিক জনপ্রিয়তা থাকলেও বিদেশেও কালী পুজো প্রচলিত। নেদারল্যান্ডস এ ধুমধামের সঙ্গে কালী পুজো অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।  পর্তুগীজ বংশোদ্ভূত এন্টনি কবিয়াল,বা এন্টনি ফিরিঙ্গি নামে পরিচিত ছিলেন,  আসল নাম, হেনসম্যান এন্টনি (১৭৮৬ থেকে ১৮৩৬) শ্যামা সঙ্গীত রচনা করেছেন। তিনি নিজেও খুব ভালো শ্যামা সঙ্গীত গাইতেন। কোলকাতার বিপিন বিহারি গাঙ্গুলি স্ট্রিটের ফিরিঙ্গি কালি মন্দির খুবই জনপ্রিয় এবং প্রসিদ্ধ। 

তন্ত্র অনুসারে কালী দশমহাবিদ্যার প্রথম দেবী। মা কালীর দুটি রুপ,  যোগমায়া ও মহামায়া। বিষ্ণু পুরান অনুসারে দেবীকে বৈষ্ণবী, ক্ষেমোদা, মোক্ষদা, ভদ্রকালী ও দূর্গা নামেও প্রকাশিত।  সৃষ্টির জন্মলগ্নে পরমব্রহ্ম যখন ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বরকে সৃষ্টি করেন, তখন নারায়ণ বলরামকে দেবকীর গর্ভ থেকে নিয়ে রোহিনির গর্ভে প্রতিস্থাপন করেছিলেন। দেবকীর সপ্তম সন্তান কে কংস হত্যা করার জন্য ছুঁড়ে মারলে, মা যোগমায়া তার নিজের রূপ প্রকাশ করেন।সেই হিসাবে মা যোগমায়া শ্রীকৃষ্ণের বোন। অন্যদিকে  সৃষ্টির বিনাশের কোন কারণ দেখা দিলে, পরমাপ্রকৃতি দেবী মহামায়ার রুপ ধারণ করেন এবং সৃষ্টিকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেন। মহামায়া হলেন দেবী দূর্গা যিনি জড়জগতকে শাসন করেন। অন্য দিকে মা যোগমায়া আধ্যাত্মিক জগতের রসসৃষ্টি এবং রসবৃদ্ধি করে থাকেন।

 সৃষ্টি সুখের উল্লাসের কবি কাজি নজরুল ইসলাম অন্য ধর্মের মানুষ হলেও তিনি ২৪৭ টি শ্যামা সঙ্গীত রচনা করেছিলেন। হালিশহরের গায়ক এবং সাধক  কবি রামপ্রসাদের পরই কবি নজরুল ইসলামের স্থান। তিনি তাঁর কবিতায় এবং শ্যামা সঙ্গীতে হিন্দু ধর্মের নিগুঢ় তত্ত্বের ব্যাখ্যা দিয়েছেন যা দেশ কালের গন্ডি পার করে  সাগর পাড়েও অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে মানা হয়ে থাকে।   কবি নজরুল ইসলামই সেই মানুষ যাকে কবিতা লেখার জন্য জেলে যেতে হয়েছিল। তিনি লিখেছেন 'ভক্তি আমার ধুপের মতো উর্ধ্বে ওঠে অবিরত" বা " মা'র হাসি মোর চিত্তে ভাসে চন্দ্রসম নীল আকাশে। " শোনা যায় তাঁর অতি ঘনিষ্ঠ  ভট্টাচার্য পরিবারের কালীপূজো থেকে তাঁর মায়ের প্রতি ভক্তি এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে সেই পুজোই তাঁর শ্যামা সঙ্গীত রচনার অনুপ্রেরণা ছিল। 
মৃম্ময়ী অর্থাৎ মাটির প্রতিমায়  পুজারী ব্রাহ্মণ, পুরোহিত বা তন্ত্র সাধক তার নিজের হৃদয় বা প্রাণ প্রতিমায় প্রতিষ্ঠা করেন। পাথর বা ব্রোঞ্জের মূর্তির ক্ষেত্রেও প্রান প্রতিষ্ঠার বিষয়টি থাকে। বৃক্ষ দেবতা বা গাছের প্রাণ থকে তাই বৃক্ষ দেবতার প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে হয় না।  ভুত চতুর্দশীতে আদ্যাশক্তি মহামায়ার আরাধনা  করলে পূণ্যফল লাভ হয়। ভক্তিযুক্ত মনে নিয়মিত আদ্যাস্তোস্ত্র পাঠে সুস্থ নীরোগ জীবন লাভ সম্ভব হয়।

 প্রথম শ্মশানে যাওয়ার দিনটির  কথা আজও মনে আছে।  তখন কাঠ সাজিয়ে চিতায় মুখাগ্নি করে মৃতদেহ দাহ করা হত। আবহাওয়া ভালো ছিল তবুও আড়াই ঘন্টা লেগেছিল সব কাজ সমাধা করতে।  এই দীর্ঘ সময়ে ভাবনায় নানা বিষয় উঠে এসেছিল। গোবরডাঙ্গার ভরা যমুনার জল চিন্তার জাল কাটলেও শ্মশান কালীর সামনে দাঁড়ানোর সাহস দেখাতে পারিনি। মনে একটা ভয় কাজ করত। গভীর রাতের শ্মশানে গেলেও গা ছমছম করত। তার প্রধান কারণ ছিল ভয়। ইতিমধ্যে কয়েক' শ মৃতদেহ দাহ করলেও, ভয়ালদর্শনা শ্মশান কালীর সামনে দাঁড়াই  আরও একদশক পরে, এবং তা অবশ্যই উত্তরবঙ্গে আসবার পর জলপাইগুড়ি মহাশ্মশানে। বঙ্গবাসী প্রায় সকলেই মা কালীর আরাধনা করেন, সেটা হয় ভয়ে অথবা ভক্তিতে। অনুভব এবং মনের বিশ্বাসই আধ্যাত্মিক চেতনার ভিত্তিভূমি। রামকৃষ্ণদেবের জীবন কাহিনি থেকে জানা যায় প্রাচুর্যতা নয়,মনের ভক্তি তেই তিনি মা ভবতারিণীর দর্শন পেয়েছিলেন।


 

নারী: তুমি জননী জায়া দুহিতা

জয়তী ব্যানার্জী 


           আমাদের রবি ঠাকুর -আমার ছোটবেলার রবি কবি।কৈশোরের লেখনী আর যুবতীর না বলা কথার আশ্রয়স্থল।সেই রবিবাবু তার উর্বশী কবিতায় নারীকে শুধুমাত্র ভোগ্যপণ্য হিসেবেই ব্যবহার করেননি। তার ভাষায়_____

         "নহমাতা নহ কন্যা
           নহবধূ সুন্দরী রূপসী
        হে নন্দনবাসীনি উর্বশী,"
ভারতীয় নারী শব্দটি নিয়ে অনেকেই অহংকার প্রকাশ করে থাকেন। ভারতীয় নারীর আদর্শ মাফিক আপন আপন পরিবারের নারীদের নিয়ন্ত্রণের মহতি প্রচেষ্টা অনেকেই করে থাকেন ।ভারতীয় নারী বলতে বোঝায় কতগুলি বিশেষ গুণে ভূষিতা নারী ।আজ একবিংশ শতাব্দীর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ এই ভারতীয় নারী নামক ধ্যান ধারণার স্রষ্টা ।এর পশ্চাতে হিন্দু পুনরুত্থান বাদী চেতনাও ক্রিয়াশীল।
        সুকুমার রায়ের "বাবুরাম সাপুড়ে "যেমন যেকোনো সাপের নয়, বিশেষগুণ সম্পন্ন সর্পের রসদদার ;তেমনি জাতীয়তাবাদী ভারতবর্ষীয়রা যে কোনো রমণী নন, বিশেষ গুন সম্পন্ন রমনীর সমঝদার। আদর্শ ভারতীয় নারী নাকি সীতার মতো সহনশীল হবে, সাবিত্রীর মত হবে পতিব্রতা আবার দ্রৌপদীর মত হবে রন্ধন কুশলী। তারা পরিবার-পরিজনদের জন্য প্রশ্নহীনভাবে শ্রম দান করবে, কোন বিপরীতে প্রশ্ন উচ্চারণ করবে না, এমন কি সহনশীলারা যদি সংহার মূর্তি ধারণ করেন তাহলেও পুরুষদের মতামত নিতে হবে । মহিষাসুরমর্দিনী দূর্গা পুরুষ দেবতাদের অস্ত্রে সজ্জিতা। অসুর নিধানান্তে তিনি পতিগৃহে সংসার কার্যেও যোগ দেন। বঙ্কিমচন্দ্র প্রফুল্ল কে দেবী চৌধুরানী করেন বটে তবে পরিশেষে দেবীকে প্রফুল্লে রূপান্তর করণে এতটুকু দ্বিধাও করেননি।
        তাইতো কবির ভাষায় বলা যায় 'হিন্দু নারী মহিমার পূর্ণরূপ প্রকট তোমায়'। -আদর্শ জননী জায়া কন্যা ভগিনী আচার্যা- মায়ায় মহাদেবী- মানবীর বেশে দেশকাল পাত্র-পাত্রী জাতি ধর্ম নির্বিশেষে-সকলেরে বাসিয়াছো ভালো।
       'তব স্নেহ ছায়া তলে কত খ্রিস্ট বৌদ্ধ জৈন অহিন্দুর জীবন জুড়ালো, খ্রিস্টান তোমার মধ্যে দেখিয়াছে মেরি মাতার পরিপূর্ণ প্রতিচ্ছবি; বৌদ্ধ স্বামীজীর যশোধারা দেবী; বৈষ্ণবের তুমি বিষ্ণুপ্রিয়া; একহাতে বর আরেক হাতে অভয় বহিয়া আসিয়াছো বিশ্বধামে প্রচারিতে মায়ের মহিমা'।______ এই হলো ভারতীয় নারী _সত্যের পরকাষ্ঠা; আধুনিকা--, যিনি জগতের শ্রী শ্রী মা, যার চরিত্র পাঠ গীতা বেদ সংহিতা পাঠের সুফল প্রদান করে। সর্বগ্লানি ঘুচিয়ে জীবন সার্থক করে। তাই তো আধুনিক মা মূর্ত গীতা স্বাহা: গৌরী স্ব:ধা গঙ্গা হিমাদ্রি দুহিতা।
এদিকে ঋতুরাজ বসন্ত যে জানান দিয়েছে, আমি এসেছি তোমার ই দুয়ারে, রুদ্ধ কেন দ্বার-- তাইতো আমরাও তৈরি- আমাদের কন্যাকে ভুবন মোহিনী রূপে বরণ করে নিতে, আমি নারী ---চিত্রাঙ্গদা!
        আমরা বড় হয়ে উঠি সেই মাতৃত্বের আবরণ ভেঙে -সেখানে নেই কোন আত্মম্ভরিতা ,আছে শুধু গড়ে নেওয়ার মানসিকতা, নেই, ভেঙে দেবো গুঁড়িয়ে দেব-র মনোভাব।
           বারবার করে মনে পড়ে,
       আমি যেদিন এলেম,
       সেদিন দীপ জ্বলে না ঘরে।
          বহুদিনের শিখার কালি,
           আঁকা ভিতের প'রে।
       সত্যিই কি তাই, বোধ হয় না, আজ আমরা মুক্তবিহঙ্গ কিন্তু এক অদৃশ্য বাহুডোরে বন্দী মোরা । নারীদের পূর্ণ প্রকাশ বোধ হয় মাতৃত্বের বন্ধনে আবৃত। মা হওয়ার এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা ----এক অব্যক্ত অনুভূতি যেন তৈরি হয়ে যায় মাতৃজঠরে পরিপোষিত হওয়ার জন্য। সেই স্বপ্ন আস্তে আস্তে বড় হয়ে ওঠে আর মনের কোণে উঁকি দেয়___
       'হাজার তারা আলোয় ভরা,
      চোখের তারা তুই-
          স্বপ্ন দিয়ে সাজাই তোরে,
        কান্না দিয়ে ধুই।'
   সেই নারী কিন্তু অসুর দলনী আবার সর্বং সহা জননী। দেবী দুর্গাকে যদি আমরা নারী শক্তির পরকাষ্ঠা ধরি তাহলে কি আমরা প্রস্তুত। তাকে দেবীরূপে কল্পনা না করে আমাদের সংসার জীবনে নামিয়ে আনতে পেরেছি কি? তার রিপু দলনী শক্তিকে আমাদের মধ্যে জাগাতে।
        না পারিনি।তাই তো আজও আমরা অবলা পুরুষদের হাতের পুতুল ।কিন্তু মা যে নারী শক্তির প্রতীক, তিনি যে অসুর দলনী সর্বং সহা ।আমাদের এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে দেবী দুর্গা যে চন্ডী রুপিনী, কিন্তু আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদেরকে সুদূরের পিয়াসী করে তোলে ।আমিও যে আনমনে তারই আশায় চেয়ে থেকেছি সকলেরই মত মুক্ত বাতায়নে । প্রতিটি মুহূর্তেই সালমা আজাদের কবিতা টি মনে করিয়ে দেয় ভবিষ্যতের নারীর মিষ্টি অস্তিত্বকে,
       তুই যে আমার ঘরের শোভা
        জাদু সোনা ময়না
       হাটি হাটি করে
          ধরিস শত বায়না।
      তবু অসুররূপী পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী শক্তিকে খর্ব করার যে প্রচেষ্টা।তা কিন্তু আজও থেমে নেই ,আমার তোমার সকলের রবি ঠাকুর লিখে গিয়েছিলেন___
"কালের কপোল তলে শুভ্র সমুজ্জ্বল
                           এ তাজমহল."
      এর পেছনেও কি নেই সুক্ষ এক আত্মম্ভরিতার স্পর্শ।ভালোবাসার দাবীকে ছাপিয়ে যায় নাকি পুরুষ সিংহের দাপট ।গার্গী মৈত্রী লোপামুদ্রার দেশে আজও কিন্তু থেমে নেই অন্যায় অত্যাচার। সেখানে কমলা রমলার মত মেয়েরা হচ্ছে নির্যাতিতা নিপীড়িতা ।আজকের নারী এভারেস্ট বিজয়ী, আজকের নারী মহাকাশচারিনী কিন্তু তবুও যে সে নারী। বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষায় সে যে অবলা, শরৎ বাবুর ভাষায় বাবুদের চরিত্র হরণের চাবিকাঠি।    
         তর্কের খাতিরে বলা যায, আজকের মেয়েরা মানে আমরা স্বাধীন তবু যেন অদৃশ্য শেকল পরানো ,আমাদের পায়ে। উনিশ শতকে গড়ে তোলা এই পুরুষতান্ত্রিক পরিবার কেন্দ্রিক এক চোখা আদর্শবাদের কি অবসান হয়েছে? আপাতদৃষ্টিতে অবশ্য হয়েছে তলিয়ে দেখলে টের পাওয়া যায়_____ নানা রূপে আদর্শ তন্ত্র এখনো বর্তমান। স্কুল-কলেজে শিক্ষিকারা তাদের পছন্দমতো সুবিধার অবশ্যই শালীনতা সম্পন্ন বেশভূষা পড়ে গেলে শার্ট প্যান্ট পরিহিত পুরুষ সমাজ রে রে করে ওঠে, কর্মক্ষেত্রে দায়িত্বশীলা মহিলা দিনের শেষে ঘরে ফিরলে দশভূজা উপাধি প্রদান করে ভারতীয় পরিবার তাকে পাক শালে ঠেলে পাঠান। অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন নারী অবসন্নতা দূরীকরণের জন্য একা একা পানভোজন করতে গেলে মহিলাদের পানাধিকার নিয়ে কথা ওঠে। বিশেষত রক্ষণশীল দের বক্তব্য --এসব নাকি ভারতীয় নারীদের সাজে না এটি সম্পূর্ণই অপযুক্তি তাতে সন্দেহ নেই।
      কিন্তু আন্তর্জাতিক নারী দিবসে আমরা কি উচ্চস্বরে বলতে পারি? আমরা আধুনিক____
       সেই আধুনিকতা কি শুধুমাত্র আমাদের পোশাকেই,আমরা কি পেরেছি সত্যিকারের আধুনিক হতে ?পুরুষ সমাজ ঠিক যতখানি ছাড়ে বা যতটুকু দেখে তারা নিজেদের পৌরুষত্বকে জাহির করতে পারে আমরা ঠিক ততটুকুই আধুনিক ।আজও কি লুপ্ত হয়ে গিয়েছে ইভটিজিং ,শ্লীলতাহানি ,কন্যা ভ্রুণ হত্যা ---আমরাই তো ছোটবেলায় শিশু কন্যার হাতে তুলে দিই রান্না বাটি পুতুল খেলার সামগ্রী। এগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে তারাও ভাবে যে তারা বোধ হয় সংসারের পুতুল।
       তাই আন্তর্জাতিক নারী দিবস একদিন নয় এ যে প্রতিদিনের দিবস। শেষে রবিবাবুর অমিত'র সাথে গলা মিলিয়ে না বললেই নয়
       "ভালো জিনিস পৃথিবীতে যত কম হয় ততই ভালো" তাই তার অস্তিত্ব কম।


 

মানবতাবাদে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাটক ডাকঘর 
              সঞ্জয় সাহা 

রবীন্দ্রনাথের নানান রূপ, তাই নাট্যকার রবীন্দ্রনাথকে আমরা হয়তো ভুলতে বসেছি তাঁর কবিতা, গান আর গল্প কাহিনী প্রবল বাতাসে। অথচ মানব জীবনের বহু বিচিত্র বিষয়াদি তিনি হাজির করেছেন নাটকের ক্যানভাসে। প্রকৃতি,মানব-মন,আনন্দ-বেদনা আর পাওয়া না পাওয়ার অনেক হিসেব হয়তো মিলবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাটকের সংলাপে,চরিত্রের গতি অন্বেষায় ও বিকাশে।
মানুষের মানবতা বোধগুলোকে আলোকিত করার জন্য রবীন্দ্রনাথের সার্বক্ষণিক যে আকুলতা,তার সরল স্বাভাবিক প্রত্যাশিত চিন্তাবলি সারিবদ্ধভাবে সাজানো হয়েছে তাঁর নাটক বুননের কৌশলে আর সৃষ্ট নাটকীয়তায়।
ডাকঘর (১৯১১খ্রিষ্টাব্দ) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্প। মোট তিনটি দৃশ্যে ও ৩৯৯ টি সংলাপে নাটকটি সম্পূর্ণ হয়েছে। ডাকঘর রবীন্দ্রনাথের সাংকেতিক নাটকগুলির মধ্যে সম্ভবত সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় যা দেশে তো বটেই,বিদেশেও অনূদিত ও অভিনীত হয়েছে। 
নাটকের মূল চরিত্র অমল, সে তার পিসেমশাই মাধব দত্ত ও তাঁর স্ত্রীর কাছে থাকে। কঠিন অসুখে আক্রান্ত অমর গৃহবন্দী কবিরাজের নির্দেশে।বাইরের আলো বাতাস তার কাছে যমদূতের সমান। তবে শরীর ঘরে আটক থাকলেও তার মন উড়ে বেড়ায়,ঘুরে বেড়ায়,চলে যেতে চায় দূর দেশে সমস্ত কঠোর বাধা নিষেধকে উপেক্ষা করে। তার মনের খবর রাখেন শুধু ঠাকুরদা। একা জানালার ধারে বসে থাকা অমলকে তিনি শোনান দেশ-বিদেশের খবর, যা অমলের কল্পনাকে লাগাম ছাড়া করে দেয়। সারাদিন বসে থাকা অমলের সঙ্গে আলাপ হয় নানা চরিত্রের দইওয়ালা,রাজার প্রহরী,মোড়ল,ছেলের দল। অমলের সঙ্গে তাদের কথায় বারবার বোঝা যায় যে, অমল এর কাছে শারীরিক কষ্টের চেয়ে অনেক বেশি কষ্টকর তার এই বন্দিদশা। সে মুক্তভাবে দেখতে চায় পৃথিবীকে, কিন্তু বাদ সাধে তার অসুখ। অমর অপেক্ষা করে সুদিনের যেদিন তার বন্দিদশা ঘুচে যাবে। সে অপেক্ষা করে কোন এক ডাক হরকার যে নিয়ে আসবে রাজার চিঠি, যাতে থাকবে তার মুক্তির কথা। অমল কল্পনায় কখনো হয়ে যায় দইওয়ালা,এখনো প্রহরী,আবার কখনো বা ডাক হরকরা। প্রতিটি মানুষের চোখ দিয়ে অমল দেখে এইসব সম্পর্ক। কঠিন পরিস্থিতিতেও তার মন মুক্ত আর গভীর আশাবাদী, মূল নাটকের শেষে দুতের হাত ধরে অমল ধীরে ধীরে চলে যায় সেই পরম মুক্তির পথে । তার আর রাস্তার পাহারাওয়ালা হওয়া হয় না, সম্ভব হয় না সুধার সঙ্গে দেখা করা, কিন্তু এই মুক্তিতেই তো অমল প্রকৃত অর্থে মিশেছে বিশ্বের মানবতার সঙ্গে।
রবীন্দ্রনাথ মানবতার পূজারী ছিলেন। মানবপ্রেম তাঁর দার্শনিক চিন্তার মূল বিষয়। তিনি উপনিষদের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত ছিলেন ।
                    "অসতো মা সদ্গময় 
                    তমসো মা জ্যোতির্গময়
                               মৃত্যোর্মামৃতং গময়" ।
অর্থাৎ, আমাকে অসৎ থেকে সৎ অন্ধকার থেকে আলোক এবং মৃত্যু থেকে অমৃতে নিয়ে যাও। উপনিষদের এই মহান বাণীকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর যাবতীয় কর্মের মধ্য দিয়ে জীবনের সমস্ত ঘাতপ্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে,তাঁর সমগ্র সৃজনশীল সৃষ্টিতে বহন করেছেন। 
১৯৩০ সালে Oxford এর Manchester college এ  হির্বাট টাস্ট যে বক্তৃতার আয়োজন করেছিলেন, তাতে রবীন্দ্রনাথ একটি ভাষণ দিয়েছিলেন । সেই ভাষণের ভিত্তিতে তিনি 'Religion of Man' বা "মানুষের ধর্ম 'গ্রন্থটি প্রণয়ন করেন। এই গ্রন্থে তিনি অত্যন্ত যুক্তিনিষ্ঠ ভাবে মানব ধর্মকেই মানুষের একমাত্র ধর্ম রূপে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। গ্রন্থটির মুখবন্ধে তিনি আরও বলেছিলেন, আমাদের অন্তরে এমন কেউ আছেন যিনি মানব অথচ তিনি ব্যক্তিগত মানবকে অতিক্রম করে- "সদা জানানাং হৃদয়ে সন্নিবিষ্টঃ"- তিনি সর্বজনীন সর্বকালীন মানব।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁরই আকর্ষণে মানুষের চিন্তায়,ভাবে,কর্মে,সার্বজনীনতায় অমল চরিত্রটির আবির্ভাব ঘটিয়েছিলেন । এই চরিত্রের মধ্য দিয়েই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে,মানুষের উপলব্ধির বিকাশ মানুষের আপন জীবসীমা অতিক্রম করে মানবসীমায় উত্তীর্ণ হওয়া যায় । আশুতোষ ভট্টাচার্য যথার্থই বলেছিলেন,       
 "অমল ও মানবতার প্রতীক,বন্ধনই আত্মার পীড়া । অমলের পীড়া শারীরিক কোন বিকার মাত্র নহে,ইহা মনের অস্তিত্ব অবস্থা,চারিদিকের বন্ধন হইতে অস্বস্তির জন্ম,এই বন্ধন হইতে মুক্তিই আত্মার চিরন্তন কাম্য একমাত্র মৃত্যুর মধ্য দিয়াই এ মুক্তি সম্ভব হইয়া থাকে ।"
রবীন্দ্রনাথের এই নাটকের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো,মানুষের নিজের অন্তরের মধ্যে যে পরম সম্পদ নিহিত রয়েছে তার আবিষ্কার ও সেই সম্পদ যে অন্যের মধ্যেও সুপ্ত রয়েছে, সেই বোধ থেকে মানবপ্রীতি,প্রেম,নিঃস্বার্থ ত্যাগ ও সেবার প্রকাশ ঘটানো । এই মানব প্রেমে উচ্চ-নীচ,ধনী-দরিদ্র,হিন্দু-অহিন্দু প্রভৃতি বর্ণভেদ ও জাতিভেদের কোন স্থান নেই । মানুষের একটি পরিচয় তার কাছে বেশি মূল্য পেয়েছে যে,সে মানুষ । আর এই মানুষকে ভালবাসার মন্ত্র আজীবন জব করেছিলেন বলেই তিনি বলতে পেরেছিলেন,
         "মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক 
                         আমি তোমারই লোক"।
আসলে রবীন্দ্রনাথের চিন্তাভাবনায় মানুষের মধ্যে প্রেম- ভালোবাসা-মানবতা মিলেমিশে এক হয়ে গিয়েছে । তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বিশ্বাস করতেন যে,সেবা ও ত্যাগের মহান মন্ত্রের দ্বারা মানবজাতির কল্যাণ সাধন সম্ভব । আধ্যাত্মিকতার পীঠস্থান ভারতবর্ষের মহান ব্রত হল সেবা, ত্যাগ ও তপস্যা । এই ঐতিহ্যের যোগ্য উত্তরসূরী হলেন ঋষি-কবি-দার্শনিক রবীন্দ্রনাথ । তাইতো তিনি মানবকল্যাণের ভাবনাকে তার অন্তরের অন্তস্থলে সর্বদা এক প্রেরণা হিসেবে স্থান দিয়েছিলেন । তার গভীর অন্তর দৃষ্টিতে ধরা পড়েছিল যে মানুষের মধ্যেই পূর্ণব্রহ্ম বা পরমব্রহ্ম বিরাজমান। মানুষের অন্তরে এই পরম,অনন্ত সত্তাকে যথার্থভাবে উপলব্ধি করতে পারলেই মানবকল্যাণের ভাবনা স্বতঃস্ফূর্তভাবে মানুষকে অনুপ্রাণিত করবে। নিজের কল্যাণ ও মঙ্গলের ভাবনায় নিজেকে নিয়োজিত রাখলে তাকে মনুষ্যোচিত ভাবনা বলা যায় না। তাই রবীন্দ্রনাথ 'চিত্রা' কাব্যে বলেছিলেন,
      "স্বার্থমগ্ন যে জন বিমুখ বৃহৎ জগৎ হতে   
                           সে কখনো শেখেনি বাঁচতে"।
প্রাণ ধর্ম ও জড় ধর্মের সামগ্রিক দ্বন্দ্বই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরে তাঁর ডাকঘর নাটকে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। আরে এই নাটকের বিষয়বস্তু অমল নামে একটি ছয় সাত বছরের ছেলের মধ্যে ক্ষয়,অবসন্নতা ও মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে শারীরিক বদ্ধতার মধ্যে, ক্লান্তি ও অসহায়তার মধ্যে, তার মনটি কেমন উজ্জ্বল চঞ্চলতায় দেশ-বিদেশের পরিক্রমায় ছুটে যেতে চাইছে, এই দ্বন্দ্ব সমগ্র পরিসর জুড়ে ফুটিয়ে তোলেন লেখক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ।