Saturday, November 2, 2024


 

শোধ

সম্মিলিতা দত্ত


কলিংবেলটা তখন থেকে বেজেই চলেছে। কেউ যাচ্ছে না দেখে আমিই উঠে গেলাম দরজা খুলতে। দরজা খুলে দেখি ভাই দাঁড়িয়ে আছে। আমায় দেখে চুপচাপ মাথা নীচু করে ঘরে ঢুকে যাওয়ার সময় দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুধু একটাই কথা বলল, 'আজও হলো না।' বাবা চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, 'কে এসেছে রে?' আমি বললাম,' ভাই এসেছে।'বাবা শুনে বললেন, 'ও, তো কিছু কাজকম্ম জুটলো কপালে? বলি আমারও তো বয়স হয়েছে। এভাবে বাপের হোটেলে পড়ে পড়ে আর কতদিন চলবে? সমাজে তো আমার একটা মানসম্মান আছে নাকি? এবার কিছু একটা কর। নাহলে সমাজে মুখ দেখাবো কেমন করে?'
ভাই হাতমুখ ধুয়ে টেবিলে খেতে বসেছিলো। বাবার কথা শুনে উঠে পড়লো। বাবা চেঁচিয়ে বলতে লাগলেন, 'নবাবপুত্তুর এসেছেন কিনা! এভাবে না খেয়ে কী বোঝাতে চাইছে ও? অকম্মার ঢেঁকি একটা। দেখ না পাশের বাড়ির সায়ন্তনকে। তোরই তো সমবয়সী। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করার পর একদিনও বসে থাকেনি। কিছুদিন আগে প্রমোশন পেয়েছে, বাজার করতে গিয়ে শান্তনুবাবুর কাছে আজ শুনলাম। আচ্ছা আমি তোর কাছে একটাই কথা জানতে চাই। এভাবে আর কতদিন?' ভাই কিছু না বলে চুপচাপ নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। কাজেই বাবাও রণে ভঙ্গ দিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলো।

বিছানায় শুয়ে শুয়ে থাকতে থাকতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম মনে নেই। ঘুম থেকে ওঠার পর মনে পড়লো আজ কেমিস্ট্রি পড়া আছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি সাড়ে ছয়টা প্রায় বাজে। উফ্, আজকে আবার লেট হয়ে গেলো। তড়িঘড়ি করে রেডি হয়ে বাবা - মাকে বলে বাড়ির থেকে বের হয়ে এলাম। ভাইকে অনেকবার ডাকলাম, দরজা খোলেনি। থাক, হয়তো ঘুমোচ্ছে।

টিউশন ছুটি হতে হয়ে সাড়ে নয়টা বেজে গেলো। তারমধ্যে স্যার আবার আজ পরীক্ষা নিয়েছিলেন। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে ভুল করে মোবাইলটাও বাড়িতে ফেলে এসেছি। অন্যদিন অটো বা টোটো ধরে বাড়ি চলে যাই। আজ রাস্তায় বেরিয়ে দেখি একটাও অটো নেই। রাস্তাটাও কেমন নির্জন। গা-টা কেমন ছমছম করে উঠলো। এদিকে সাথে ফোনটাও নেই যে ভাইকে ফোন করে বলবো এসে নিয়ে যেতে। ভাবলাম যে এটুকুই তো রাস্তা। কতক্ষন আর লাগবে! বড়জোর দশ মিনিট। হেঁটেই চলে যাই। জোরে জোরে পা চালালাম। কিছুদূর যাওয়ার পর মনে হলো কে যেনো আমার পিছন পিছন আসছে। পিছনে তাকিয়ে দেখি দুই - তিনটা ছেলে আমার দিকে তাকিয়ে কীসব বলতে বলতে আসছে।সকলেরই মুখ কালো কাপড়ে ঢাকা। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওরা হঠাৎ আমার সামনে এসে পথ আটকে দাঁড়ালো। 'কি মামনি, এই রাতের বেলা কোথায় যাওয়া হচ্ছে একা একা? টিউশন থেকে ফেরা হচ্ছে বুঝি? আমাদের কথা শোনো আজ আর তোমাকে ফিরতে হবে না বাড়িতে কেমন?' আমার মেরুদন্ড দিয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেলো। চিৎকার করে যে কাউকে ডাকবো সে উপায়ও নেই। ওরা আমার ওড়নাটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে গা থেকে খুলে নিয়ে আমার মুখ বেঁধে ফেললো। তারপর আমাকে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে যেতে শুরু করলো রাস্তার ধারে। জ্ঞান হারিয়ে ফেলার আগে ওদের মুখের দিকে তাকাতে থাকতে থাকতে আমার মনে হলো ওদের মধ্যে একজনের চোখগুলো আমার খুব চেনা। কিন্তু ছেলেটা কে ?

জ্ঞান ফেরার পর দেখি মাথার কাছে একটা জটলা। সেই জটলার মধ্যে বাবাকেও দেখতে পেলাম। ছুটে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরলাম। বাবা দাঁড়িয়ে আছে, চোখমুখ একদম কাগজের মতো সাদা। বাবা তার জামা খুলে আমাকে জড়িয়ে বাড়িতে নিয়ে এলো। পথে একবারও জিজ্ঞেস করেনি কীভাবে কী হলো। বাড়িতে এসে ঢুকতেই ভাই বেরিয়ে এলো। বাইরে এত চিৎকার চেঁচামেচি শুনে ও বেরিয়ে এসেছে। আমায় ওই অবস্থায় দেখে ও ততক্ষণে বুঝে গেছে যা বোঝার। বাবা নিজের ঘরে চলে গেলো। আর মা আমাকে তাড়াতাড়ি পোশাক এনে দিলো ঘর থেকে। 
আমি যখন নিজের ধরে বিছানায় উপুড় হয়ে কাঁদছি, ভাই এসে ঢুকলো ঘরে। বললো, ' কি হয়েছে আমাকে সব খুলে বল।' ভাইকে সব বললাম। কথা বলতে বলতে ভাইয়ের হাত লেগে হঠাৎ ফোনের গ্যালারিটা খুলে গেলো। সেখানে একটা ছবি দেখে আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত কেঁপে উঠলো। এই সেই চোখ যা আজকে আমি দেখেছি। এ তো সায়ন্তন! কাঁপতে কাঁপতে ভাইকে বললাম, ভাই সায়ন্তন! ওকে আর কিছু বলার দরকার হলো না, আমার মুখ দেখে ও নিমেষের মধ্যে বুঝে গেলো। বললো, 'আমি একটু বেরোচ্ছি।'

রাত গড়িয়ে যাচ্ছে। ভাইয়ের আসতে এত দেরি হচ্ছে, কোথায় গেছে তাও বলে যায়নি। আবার বাবা মাকেও জানাতে না করেছে। এদিকে আমি যে বাইরে বের হয়ে দেখব সেই সাহস আর অবস্থা কোনোটাই আমার নেই। জেগেই ছিলাম। রাত তখন তিনটা বাজে। দরজায় নক করার শব্দ শুনে আইহোলে চোখ রেখে দেখলাম ভাই এসেছে। আমি দরজা খুলে দিতেই কিছু না বলে তাড়াতাড়ি করে নিজের ঘরে চলে গেলো। ওর জামাকাপড়ে লাল যে দাগ দেখলাম, ওগুলো কি রক্ত? আর মুখেও অদ্ভুত রকমের একটা প্রশান্তি লক্ষ করলাম। আমি ওকে আর কিছু জিজ্ঞেস না করে শুয়ে পড়লাম। সারারাত ঘুমোতে পারলাম না গতকালের ঘটনা মনে করে। পরেরদিন সকালে উঠে দেখি চারদিকে হইহই পড়ে গেছে। পাশের বাড়ির সায়ন্তন খুন হয়েছে! কে বা কারা নদীর ধারে ওকে ফেলে রেখে গেছে খুন করে। ধড় থেকে মাথা আলাদা করে দিয়েছে। সায়ন্তন-এর ইতিহাস ঘেঁটে ওর নামে উঠে এসেছে অনেক অজানা তথ্য। ও এর আগেও অনেক মেয়ের সর্বনাশ করেছে, কিন্তু প্রতিবারই কোনো না কোনোভাবে পার পেয়ে যাচ্ছিল। তাহলে কি তার খুনি কি কোনো মেয়েই? যার সে আবার সর্বনাশ করেছে? 
আমার মনে পড়লো কালকে ভাইয়ের জামায় রক্তের দাগের কথা। ছুটে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলাম।

No comments:

Post a Comment