রাতের সওয়ারি
চি
সেদিন সন্ধ্যে বেলায় খুব জমে গ্যাছে গল্প। একে শীতকাল, তার ওপরে অনেকে আজ ক্লাব ঘরে জমায়েত হয়েছে। পরবর্তি পিকনিক নিয়ে আলোচনাও বেশ জমে উঠেছে,কোথায় হবে,কত চাঁদা ধার্জ হবে সেসব নিয়ে তর্ক চলছে তুমুল। তার ওপরে ক্লাবের কেয়ারটেকার কাম চা সাপ্লাই করার ছেলে গদাই সবে এক রাউন্ড গরম চা দিয়ে গেছে,কথাবার্তা চলছে বাজারের ধেনুর দোকান থেকে গরম গরম বেগুনি আনানোর ব্যবস্থা করা যায় কিনা। আজ জহর কাকা বড় উদার হয়ে গেলেন যেন কেমন করে।বললেন,যা তো গদাই সবার জন্যে গরম বেগুনি নিয়ে আয়,বলে হাতে টাকা ধরিয়ে দিলেন,আর জটাদা বলে দিলো,আমার সাইকেলটা নিয়ে দৌড়ে যা,দেরি করবি না। গদাই সাইকেল নিয়ে বেরিয়েছে,শীতকাল বলে দরজাটাও টেনে দেওয়া হলো, এমন সময়ে ঝুপ করে আলো গেলো নিভে। খুঁজেপেতে মোমবাতি জ্বালিয়ে আবার বসলো সবাই। মোমবাতির কাঁপা কাঁপা আলোয় রাজাদা বলে উঠলো, আজ একেবারে ভুতের গল্পের পরিবেশ। হয়ে যাক ভূতের গল্প।তখন কেউই ঠিক বলতে চাইলো না ,জহর কাকা বললেন,আমি একটা কাহিনী বলছি,ঠিকভূতের নাও হতে পারে, তবে একেবারে সত্যি ঘটনা।
তোমরাতো সবাই জানো, এটা আমার পিসির বাড়ি, আগে থেকেই আসা যাওয়া আমিই বেশি করতাম এখানে। আমার পিসিমা আমাকে ভালো বাসতো খুবই। সেবার কি একটা দরকারে বাবা বললেন যে তুই একবার রাধার কাছে যেতে পারবি?রাধা আমার পিসিমার ডাক নাম। তাহলে কাজটা তাড়াতাড়ি হয়ে যায়।আগে আমি বহুবার এসেছি, এখানে কতদিন থেকেছি, পিসিমার বাড়ীর পাড়ার লোকজন পর্য্যন্ত আমায় চেনে,আমি যেতে পারবো না, ঠিকপারবো।
পাশ থেকে ভবানীদা জিজ্ঞেস করে, তখন তুমি কত বড়?কত আর বড়,এই নাইন টেনে পড়ি বোধ হয় ,বলে জহর কাকা আবার শুরু করেন।আমি রাজি হয়ে গেলাম। বাবা আমাকে বললেন,এই সামনেই বড়দিনের ছুটি সেই সময় গেলেই ভালো। বাবা আমাকে দার্জিলিং মেলের টিকিট কেটে দিলেন, আর বললেন,রাধাকে একটা টেলিগ্রাম করে দিই কত তারিখে তুই যাচ্ছিস।কারণ তখনকার দিনে তো এতো মোবাইলের রমরমা ছিলো না। এত কি বলছি,মোবাইলই তো ছিলো না। সেই মত সব ব্যবস্থা পাকা হলো।আমারও খুব উত্সাহ যে আমি আবার পিসিমার বাড়িতে আসবো।
যেদিন আসবো,সেদিন ক্যানো য্যানো দার্জিলিং মেল শিয়ালদা থেকে ছাড়তেই দেরি করলো। ফরাক্কায় পৌঁছতেই প্রায় সন্ধ্যে। তখন আবার ফরাক্কা ব্রীজ হয়নি।আমাদের সব কিছু বিরাট বড় গাদা স্টিমারে করে এপারে আসতো। এপারে দুটো ট্রেন দাঁড়িয়ে থাকতো,একখানা দার্জিলিং মেল আর একখানা আসাম যাবার কামরুপ এক্সপ্রেস।আমার যেহেতু জলপাইগুড়িরোড যাবার টিকিট ছিলো, আমি কামরুপ এক্সপ্রেসে উঠে পড়লাম।উঠেই নিজের বিছানা পত্তর করে শুয়ে পড়লাম। শোয়ার পরেই একেবারে গভীর ঘুম। এতো ঘুমিয়েছি আমি ,যে কখন মালদা চলে গ্যাছে টেরই পাইনি।একেবারে ঘুম ভাঙ্গলো নিউ জলপাইগুরিতে এসে। যাই হোক সঙ্গে যা ছিলো, একটু খাবার দাবার খেয়ে হাত মুখ ধুয়ে বিছানাপত্র গুছিয়ে তৈরি হয়ে বসলাম। ট্রেন ছেড়ে দিলো।এর পরের স্টেশনই জলপাইগুড়ি রোড।কিন্তু স্টেশন আর আসেই না। গাড়ি দু পা যায় আর থামে। এই করে যখন জলপাইগুড়ি রোড স্টেশনে আমি নামলাম তখন রাত এগারোটা। কেউ কোত্থাও নেই।যে দুচারজন প্যাসেঞ্জার নামলো,তারা টুপটাপ কোথায় হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো।
চারদিকঘুটঘুটে অন্ধকার।মাইলের পরে মাইল নিকষ কালো। একমাত্র স্টেশন মাষ্টারের ঘরে একখানা হ্যাজাক জ্বলছে। আমি স্টেশন মাষ্টারের ঘরে গিয়ে বললাম, আজ রাত্তিরটা এখানেথাকতে পারি? উনি বললেন,যাবেন, কোথায়?আমি বললাম, পান্ডাপাড়া। বললেন,ওদিকে এখন যাবার কিছুই নেই। রামদিন রাতে পাহারায় থাকে।আমি একটু পরেকাজ মিটিয়ে চলে যাব। ওকে বলে যাব। আমি ভাবলুম,একটা ব্যবস্থা তো হয়ে গেলো।এবার বাইরে গিয়ে দেখি তো একবারঅবস্থাটা কি,বলে বাইরে এলাম। এসে দেখি ,একখানা রিক্সা যেন দাঁড়িয়ে। রিক্সাওলা রিক্সার সিটে সারা গা মাথা মুড়ি দিয়ে গুটিশুটি মেরে শুয়ে। আমি বেশ জোরেই বললাম,ওভাই যাবে নাকি?ও আমার ডাক শুনে সীট থেকে নেমে রিক্সা নিয়ে আমার কাছে এলো। আমি বললাম, পান্ডাপাড়ায় যাব,যাবে? ও ঘাড় নেড়ে বললো, হ্যাঁ।ওর সারা গা মোটা চাদরে ঢাকা,মাথায় একখানা মাফলার একেবারে নাক মুখ বেড় দেওয়া । একে কালিগোলা অন্ধকার,তার ওপরে শীতকাল,কোনক্রমে তার মাথা নাড়াটা বুঝতে পারছি। আমি দৌড়ে গিয়ে স্টেশন মাস্টারের ঘর থেকে আমার লাগেজ নিয়ে কোনক্রমে রিক্সায় উঠে পড়লাম। খানিকটা এসে দিনবাজারের কাছে প্রায়, আমার কি মনে হতে রিক্সাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলাম,তুমি কি বিল্টু? অন্ধকারে কিছু বোঝা যায় না,তার ওপরে মাথামুন্ডু সব ঢাকা আমার মনে হলো যেন ও বললো হ্যাঁ। আমি নিশ্চিন্ত হয়ে বসে রইলুম।কারণ আমি জানি বিল্টু রিক্সাওয়ালা পিসিমার বাড়ির চেনা লোক। দরকারে অদরকারে ওকেই পিসিমার বাড়ির সবাই ডাকে। কখন যেন আমার একটু তন্দ্রা এসেছিলো, ঘুমের চটকা ভেঙে দেখি,আমি একেবারে পিসিমার বাড়ির দোরে। ডাকাডাকি করে ঘুম ভাঙিয়ে তবে সদর খোলা হলো। আমি ওকে বললাম,তুমি কাল সকালে একবার এসো।ও ঘাড় কাত করে চলে গেলো।
পরের দিন সকালে সবাই আমাকে দেখে হৈচৈ করছে,এমন সময়ে পিসিমা বললেন,অত রাতে তুই এলি কি করে? আমি বললাম, ক্যানো, বিল্টুর রিক্সায়। এয়াঁ, সে কি রে, সে তো মাস ছয়েক আগে ওই কাছেপিঠেই রাস্তায় এক্সিডেন্টে মারা গ্যাছে। তুই ওর গাড়িতে কি করে এলি? আমিও মহা ধন্দে পড়ে গেলুম, আমি তাহলে কার রিক্সায় এলাম?ওকি বিল্টু না অন্য কেউ? সে যাই হোক আমার মনে হয় আজও যে ও বিল্টুই ছিলো না হলে ঠিক জায়গায় নামিয়ে দিলো কী করে?
জহর কাকার এই গল্পের পরে রাস্তায় কেউ নামতেই চায় না, কেননা, রাস্তাওযে লোডসেডিং-এর জন্যে ঘুটঘুটে অন্ধকার।
No comments:
Post a Comment