Saturday, November 2, 2024


 

কার্তিক মাসের লোকউৎসব

শ্রাবণী সেনগুপ্ত 


বাংলা সনের সপ্তম মাস কার্তিকে হেমন্তের শুরু।শিশিরের ছোঁয়ায় প্রকৃতি স্নান করে।কথিত আছে যে,এইসময় ভগবান বিষ্ণু তাঁর চার মাসের যোগনিদ্রা থেকে জেগে ওঠেন।কার্তিক সংক্রান্তিতে বাংলায় কার্তিক পুজো হয়।এই সময় কাটোয়ায় `কার্তিক লড়াই`বাংলার একটি বিখ্যাত আঞ্চলিক উৎসব।কার্তিক পুজোকে কেন্দ্র করে এতো বড় আঞ্চলিক উৎসব বিরল।
        কার্তিক মাসের সংক্রান্তির রাত্রে এই উৎসবের শুরু এবং পরেরদিন ভাসানে শেষ।বর্ধমান,নদীয়া,মুর্শিদাবাদ, হুগলি প্রভৃতি জেলার মানুষেরা এতে অংশগ্রহণ করে থাকেন।তবে কাটোয়ার মতন এতো বড় করে কোথাও এই উৎসব হয়না।অনুমান করা যায় যে,কাটোয়ার কার্তিক পুজো নবম দশম শতক থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে কোনো এক সময়ে প্রবর্তন হয়েছে।প্রাচীন জনপদ কাটোয়ার পুরাতন পুজোগুলির মধ্যে তাঁতিপাড়ার 'সাত ভাই কার্তিক'পুজাটি অন্যতম।এই পুজোটিতে মূর্তি নির্মাণের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যায়। এক্ষেত্রে একটি 'থাকায়' সাতটি মূর্তিকে বাঙালি বেশে সাজিয়ে রাখা হয়।  সবার উপরে একটি অনেকটা রাজার মতন একটি বিরাট মূর্তি,আর দুই পাশে উপর থেকে নীচে পরপর তিনটি থাকে তিনটি করে মোট সাতটি মূর্তি একই ভঙ্গি ও আকৃতিতে রাখা হয়।মূর্তিগুলোর পরনে ধুতি,গায়ে জামার উপর ওড়না,মাথায় মুকুট, ডান হাতে গোলাপের গুচ্ছ।প্রচলিত কার্তিকের মূর্তির থেকে আলাদা এই মূর্তিগুলি অনেকের মতে লৌকিক প্রভাবে কল্পিত হয়েছে।একমাত্র তাঁতিপাড়াতেই এই সাত ভাই কার্তিকের পুজো হয়।
    'খোকা’ বা  'নেংটো'  কার্তিকের পুজো মালোপাড়াতে হয়।এটি একটি একক উলংগ মূর্তি। শায়িত ময়ূরের পিঠে বিশালাকার নগ্ন মূর্তি দাঁড়ানো অবস্থায় থাকে,এর এক হাতে মোয়া, অন্য হাতে ফুল।কথিত আছে যে, ভাগীরথী অজয় নদী সংযোগ কুলবর্তী বারবনিতারা এই মূর্তি পুজোর প্রচলন করেছিল। অতীতের বড় ব্যবসাকেন্দ্র কাটোয়াতে জলপথে দেশবিদেশের যে সমস্ত ব্যবসায়ীরা এসে সাময়িকভাবে বসবাস করতেন, মূলত তাদের কারণেই নাকি এই বারবনিতাদের একটি আস্তানা এই নদীর ধারে গড়ে উঠেছিল।
          এছাড়া বাবু কার্তিক, জামাই কার্তিক উদাসী কার্তিক প্রভৃতি একক মূর্তিও পুজিত হয়।জামাই বা বাবু কার্তিকের পরনে প্রায় একই ধরনের ধুতি,পাঞ্জাবি ,পায়ে জুতো থাকে,এক হাতে ধুতির কোঁচা ধরা থাকে।উদাসী কার্তিকের এক হাতে মদের বোতল ,অন্য হাতে ঝোলা,পরনে কাপড়,গায়ে জামা।তবে মূর্তির সংখ্যাগত দিক থেকে দেব সেনা কার্তিক এবং কাত্যায়নী কার্তিকের সংখ্যাই বেশি।তবে এক্ষেত্রে এগুলি থাকায় পুজিত হয়- এই অভিনব রীতি কাটোয়া ছাড়া আর কোথাও বড় একটা চোখে পড়েনা।
       'থাক 'বা 'স্তর 'থেকে 'থাকায়' শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে।কাঠের একটি মজবুত পাটাতনের উপর বাঁশের চটার সাহায্যে কয়েকটি থাক তৈরি করা হয়। নিচটা প্রশস্ত থাকে। পর্যায়ক্রমে সংকীর্ণ হয়ে উপরে একটি মূর্তি বসার মতো থাক করা হয়। পাঁচ থেকে নয়টি থাক বর্তমানে হয়,আগে আরো বেশি হত।সর্বোচ্চ বা মাঝে কাত্যায়নী কার্তিক অথবা দেবসেনা কার্তিককে স্থাপন করা হয়।পরের থাকগুলিতে মহাভারত রামায়ণ পুরাণ কাহিনী অবলম্বিত মূর্তি রাখা হয়।থাকায় দুইপাশে প্রতিটি থাকে উপর থেকে নীচ পর্য্যন্ত নৃত্যরত ভঙ্গিতে সুসজ্জিতা নারীমূর্তি থাকে।মূর্তির সংখ্যার উপরে কাঠামোর উচ্চতা নির্ভর করে।থাকায় সাধারণত 'শুম্ভ নিশুম্ভ বধ', 'কুম্ভকর্ণ বধ','দূর্যোধন বধ','অভিমন্যু বধ', 'পুতনা বধ','রাবণ বধ,''সীতার অগ্নিপরীক্ষা','সীতার পাতাল প্রবেশ','দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ,' 'সীতাহরণ,''শ্রী কৃষ্ণের ননী চুরি,' 'জগাই মাধাই উদ্ধার',প্রভৃতি কাহিনী মূর্তির সাহায্যে প্রদর্শন করা হয়।এখন আবার কোনো কোনো থাকায় কপালকুণ্ডলা,রামকৃষ্ণের সাধনা,রামপ্রসাদের কালীদর্শন প্রভৃতি কাহিনীও সংযোজিত হচ্ছে।এমনকি জয় জওয়ান জয় কিষাণ, অমর ভারত প্রভৃতিও ইতিমধ্যে কোনো কোনো থাকায় স্থান পেয়েছে।নকশাল কার্তিকের উপস্থিতিও দেখা গেছে।বছর বছর এই 'থাকার পালা'পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রেখে তৈরি করা হয়।আনন্দ এবং তার সঙ্গে লোক শিক্ষার মহান দায়িত্ব পালিত হয়ে চলে এইভাবে।এক্ষেত্রে লক্ষ্যণীয় বিষয়টি হল এই যে,থাকায় প্রধানত মহাকাব্যের যুদ্ধাংশ তথা বধের অংশই প্রাধান্য পেয়ে আসছে।কাটোয়া শহরের প্রতিটি কার্তিক পুজোতে প্রতিটি থাকায় আলাদা আলাদা পালা উপস্থিত করা হয়।সবক্ষেত্রেই 'শুভ শক্তির জয়' দেখানো হয়।মূর্তির কাঠামো তৈরির রীতি বাংলায় প্রচলিত থাকলেও কাটোয়ার কার্তিকের থাকার আকৃতি প্রকৃতি স্বতন্ত্র।এর বহন ক্ষমতা,সাজসজ্জা সবই অভিনব।
       তৈরি মণ্ডপে কার্তিক সংক্রান্তির রাত্রে পুজো হয়।পুরোহিত পুজো করেন খুব সাধারণ উপাচার দিয়ে।সারা রাত দর্শনার্থীদের ভিড় থাকে চোখে পড়ার মতন।পরেরদিন, অর্থাৎ ১লা অগ্রহায়ণ ভাসান হয় ভাগীরথীর জলে। ভাসানের আগে থাকা সমেত শোভাযাত্রা বের হয়,একেই বলে 'কার্তিক লড়াই'।কাটোয়ার এই উৎসবের সঙ্গে বিভিন্ন স্তরের ব্যবসায়ীরা যুক্ত থাকেন।
        শহরে জাঁকজমক করে কার্তিক সংক্রান্তির রাতে কার্তিক পুজো হয়,আর সূর্যোদয়ের আগে কাটোয়ার চারপাশের গ্রামে গ্রামে কৃষকদের' মুঠ পুজো 'হয়।এখন এই পুজোর প্রচলন কমে এলেও আছে।এই পুজোয় কোনো মন্ত্র,পুরোহিত ,শাস্ত্রীয় আচার অনুষ্ঠান নেই,শুধুই লোকাচার।হাতে শঙ্খ আর হলুদ রঙের রঙিন ন্যাকড়া নিয়ে কৃষকেরা ভোর হওয়ার সাথে সাথেই মাঠে যায়,'লঘু ধান' কেটে এক মুঠো করে রঙিন ন্যাকড়ায় জড়িয়ে শঙ্খ বাজাতে বাজাতে মাথায় করে নিয়ে ফিরে আসে।বাড়িতে আসার পর মেয়েরা সেটিকে ঘরে নিয়ে যায়।ঘরের মধ্যে করা আতপ চালের গুঁড়ো আলপনার মধ্যে সেটিকে স্থাপনা করা হয়।সেই সঙ্গে ছড়া বলা হয়-
   "কাঠির মুঠি কুড়াতে গেলাম,
    লক্ষ্মীর কথা শুনে এলাম।
     কথা শুনলে কি হয়?
      নিধনের ধন হয়।- ইত্যাদি।
এরপর  সেই 'মুঠ' গোলার 
চালের উপর রেখে দেওয়া হয়।'মুঠ 'এর ধান ঝরে গেলে শুকনো খড়গুলো আড়াই পাক দিয়ে লক্ষ্মীর হাঁড়ির গলায় বেঁধে রাখা হয়।
       এইভাবে বাংলার ঘরে ঘরে পালিত হয় বিভিন্ন আনন্দোৎসব।এইসমস্ত লোক উৎসবের মধ্যে লক্ষ্য করা যায় বাস্তবধর্মীতা, স্বতস্ফূর্ত  আন্তরিক আবেদন,সার্বজনীনতা।
          

No comments:

Post a Comment