কালী পুজো : কিছু কথা
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়
"আমি তোমার কি ধার ধারি, শ্যামা মায়ের খাস তালুকে বসত করি।"
ত্রিপুরার নারায়ণপুরের মৃজা হুসেন আলী যমকে তাচ্ছিল্য করে এই গান গেয়েছিলেন ।বিষয়টা এমনই তিনি সহায় থাকলে আর কারো ধার ধরার প্রয়োজন নেই। মা কালী সহায় মানেই স্বর্গ, মর্ত পাতাল সবটাই হাতের মুঠোয়।
একমাত্র কেরালা ছাড়া সমগ্র দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া এবং ভারতীয় উপমহাদেশে কালীকে ভগবান শিবের স্ত্রী পার্বতীর রূপ হিসেবে বিশ্বাস করা হয়। কেরালার লোকবিশ্বাস অনুসারে ভগবান শিবের তৃতীয় নয়ন থেকে রাক্ষসদের ধ্বংস করার জন্য তিনি আবির্ভূতা হন। তাই কেরালায় তিনি ভৈরবপত্নী মহাকালী হিসেবে পুজিত হন।
ষোলো শতকের আগে কালী পুজো অজানাই ছিল। বিখ্যাত ঋষি কৃষ্ণানন্দ আগমবগিষা প্রথম কালীপূজোর সূচনা করেন। সতেরো শতকের শেষের দিকে "কালিকা মহাকাব্য" নামে একটি ভক্তিমুলক গ্রন্থে কালীকে উৎসর্গীকৃত একটি বার্ষিক উৎসবের কথা উল্লেখ আছে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে বাংলায় নবদ্বীপের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র কালীপূজোর ব্যাপক প্রসার ঘটান।
পশ্চিমবঙ্গ,বিহার,নেপাল, ত্রিপুরা, বাংলাদেশে কালী পুজোর সর্বাধিক জনপ্রিয়তা থাকলেও বিদেশেও কালী পুজো প্রচলিত। নেদারল্যান্ডস এ ধুমধামের সঙ্গে কালী পুজো অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। পর্তুগীজ বংশোদ্ভূত এন্টনি কবিয়াল,বা এন্টনি ফিরিঙ্গি নামে পরিচিত ছিলেন, আসল নাম, হেনসম্যান এন্টনি (১৭৮৬ থেকে ১৮৩৬) শ্যামা সঙ্গীত রচনা করেছেন। তিনি নিজেও খুব ভালো শ্যামা সঙ্গীত গাইতেন। কোলকাতার বিপিন বিহারি গাঙ্গুলি স্ট্রিটের ফিরিঙ্গি কালি মন্দির খুবই জনপ্রিয় এবং প্রসিদ্ধ।
তন্ত্র অনুসারে কালী দশমহাবিদ্যার প্রথম দেবী। মা কালীর দুটি রুপ, যোগমায়া ও মহামায়া। বিষ্ণু পুরান অনুসারে দেবীকে বৈষ্ণবী, ক্ষেমোদা, মোক্ষদা, ভদ্রকালী ও দূর্গা নামেও প্রকাশিত। সৃষ্টির জন্মলগ্নে পরমব্রহ্ম যখন ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বরকে সৃষ্টি করেন, তখন নারায়ণ বলরামকে দেবকীর গর্ভ থেকে নিয়ে রোহিনির গর্ভে প্রতিস্থাপন করেছিলেন। দেবকীর সপ্তম সন্তান কে কংস হত্যা করার জন্য ছুঁড়ে মারলে, মা যোগমায়া তার নিজের রূপ প্রকাশ করেন।সেই হিসাবে মা যোগমায়া শ্রীকৃষ্ণের বোন। অন্যদিকে সৃষ্টির বিনাশের কোন কারণ দেখা দিলে, পরমাপ্রকৃতি দেবী মহামায়ার রুপ ধারণ করেন এবং সৃষ্টিকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেন। মহামায়া হলেন দেবী দূর্গা যিনি জড়জগতকে শাসন করেন। অন্য দিকে মা যোগমায়া আধ্যাত্মিক জগতের রসসৃষ্টি এবং রসবৃদ্ধি করে থাকেন।
সৃষ্টি সুখের উল্লাসের কবি কাজি নজরুল ইসলাম অন্য ধর্মের মানুষ হলেও তিনি ২৪৭ টি শ্যামা সঙ্গীত রচনা করেছিলেন। হালিশহরের গায়ক এবং সাধক কবি রামপ্রসাদের পরই কবি নজরুল ইসলামের স্থান। তিনি তাঁর কবিতায় এবং শ্যামা সঙ্গীতে হিন্দু ধর্মের নিগুঢ় তত্ত্বের ব্যাখ্যা দিয়েছেন যা দেশ কালের গন্ডি পার করে সাগর পাড়েও অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে মানা হয়ে থাকে। কবি নজরুল ইসলামই সেই মানুষ যাকে কবিতা লেখার জন্য জেলে যেতে হয়েছিল। তিনি লিখেছেন 'ভক্তি আমার ধুপের মতো উর্ধ্বে ওঠে অবিরত" বা " মা'র হাসি মোর চিত্তে ভাসে চন্দ্রসম নীল আকাশে। " শোনা যায় তাঁর অতি ঘনিষ্ঠ ভট্টাচার্য পরিবারের কালীপূজো থেকে তাঁর মায়ের প্রতি ভক্তি এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে সেই পুজোই তাঁর শ্যামা সঙ্গীত রচনার অনুপ্রেরণা ছিল।
মৃম্ময়ী অর্থাৎ মাটির প্রতিমায় পুজারী ব্রাহ্মণ, পুরোহিত বা তন্ত্র সাধক তার নিজের হৃদয় বা প্রাণ প্রতিমায় প্রতিষ্ঠা করেন। পাথর বা ব্রোঞ্জের মূর্তির ক্ষেত্রেও প্রান প্রতিষ্ঠার বিষয়টি থাকে। বৃক্ষ দেবতা বা গাছের প্রাণ থকে তাই বৃক্ষ দেবতার প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে হয় না। ভুত চতুর্দশীতে আদ্যাশক্তি মহামায়ার আরাধনা করলে পূণ্যফল লাভ হয়। ভক্তিযুক্ত মনে নিয়মিত আদ্যাস্তোস্ত্র পাঠে সুস্থ নীরোগ জীবন লাভ সম্ভব হয়।
প্রথম শ্মশানে যাওয়ার দিনটির কথা আজও মনে আছে। তখন কাঠ সাজিয়ে চিতায় মুখাগ্নি করে মৃতদেহ দাহ করা হত। আবহাওয়া ভালো ছিল তবুও আড়াই ঘন্টা লেগেছিল সব কাজ সমাধা করতে। এই দীর্ঘ সময়ে ভাবনায় নানা বিষয় উঠে এসেছিল। গোবরডাঙ্গার ভরা যমুনার জল চিন্তার জাল কাটলেও শ্মশান কালীর সামনে দাঁড়ানোর সাহস দেখাতে পারিনি। মনে একটা ভয় কাজ করত। গভীর রাতের শ্মশানে গেলেও গা ছমছম করত। তার প্রধান কারণ ছিল ভয়। ইতিমধ্যে কয়েক' শ মৃতদেহ দাহ করলেও, ভয়ালদর্শনা শ্মশান কালীর সামনে দাঁড়াই আরও একদশক পরে, এবং তা অবশ্যই উত্তরবঙ্গে আসবার পর জলপাইগুড়ি মহাশ্মশানে। বঙ্গবাসী প্রায় সকলেই মা কালীর আরাধনা করেন, সেটা হয় ভয়ে অথবা ভক্তিতে। অনুভব এবং মনের বিশ্বাসই আধ্যাত্মিক চেতনার ভিত্তিভূমি। রামকৃষ্ণদেবের জীবন কাহিনি থেকে জানা যায় প্রাচুর্যতা নয়,মনের ভক্তি তেই তিনি মা ভবতারিণীর দর্শন পেয়েছিলেন।
No comments:
Post a Comment