Sunday, June 1, 2025


 

 মুনা 

অনলাইন জ্যৈষ্ঠ সংখ্যা ১৪৩২


সম্পাদকের কথা 

বহুত্ববাদের দেশ। মতভেদ থাকবেই। কিন্তু তাই বলে স্বদেশের বিরুদ্ধে ভাবব সেটা কখনই নয়। দুর্ভাগ্য, একটি চরম নারকীয় ঘটনার পরেও অনেকেই সে পথে হেঁটেছেন। তাঁদের জন্য করুণা রইল। একথা ঠিক, বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত এই দেশে আজও বহু মানুষ নিরন্ন। এখনও বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে। আজও বিভিন্ন বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনও দিশা দেখাতে পারেননি রাষ্ট্রনেতারা। কিন্তু তবু তো এ আমারই দেশ। তাই সেই দেশের কান্না, নিজেরও কান্না। সেই দেশের ওপর আঘাত, নিজের ওপর আঘাত। তাই দেশের দুর্দিনে বিপদে সব মতভেদ ভুলে আমরা সবাই একসঙ্গে। সময়ের ডাক এটাই। কেননা ভারত আমার ভারতবর্ষ, স্বদেশ আমার স্বপ্ন গো.......


মুনা 

অনলাইন জ্যৈষ্ঠ  সংখ্যা ১৪৩২



রেজিস্ট্রেশন নম্বর- S0008775 OF 2019-2020

হসপিটাল রোড 

কোচবিহার 

৭৩৬১০১

ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com 

প্রকাশক- রীনা সাহা  

প্রচ্ছদে ব্যবহৃত ছবি- পোর্ট ব্লেয়ারের (অধুনা  শ্রী বিজয় পুরম ) মেরিন পার্ক

সম্পাদনা, প্রচ্ছদ ছবি, অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায় 


    এই সংখ্যায় আছেন যাঁরা

 অভিজিৎ সেন, গৌতমেন্দু নন্দী, অনিতা নাগ,

বেলা দে, শুভেন্দু নন্দী,  জয়তী ব্যানার্জী, 

মাথুর দাস, উৎপলেন্দু পাল, প্রাণেশ পাল,

চিত্রা পাল, মহঃ সানোয়ার, সঞ্জয় সাহা, 

বিপ্লব রায়, মিষ্টু সরকার, মজনু মিয়া,

অভিমন্যু, আশীষ কুমার চক্রবর্তী, প্রিয়াঙ্কা চক্রবর্তী 


অনলাইন জ্যৈষ্ঠ  সংখ্যা ১৪৩২


 

ভারতবর্ষ: গণতন্ত্র ও সমন্বয় 

          অভিজিৎ সেন 
                   

পৃথিবীর অতি প্রাচীন সভ্যতা সমূহের মধ্যে মানব ইতিহাসের ধারাবাহিক কালক্রমে এখনো পর্যন্ত যে দুটি সভ্যতা নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে স্বমহিমায় এগিয়ে চলেছে একটি হলো ভারতীয় সভ্যতা অপরটি চৈনিক সভ্যতা। খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ শতকের আগে যাযাবর আর্যগণের আগমন ঘটেছিল ভারতবর্ষে। আর্যদের সভ্যতা ছিল উন্নত সুগঠিত এবং সমৃদ্ধ । কিন্তু আর্যদের পূর্বেও সিন্ধু নদের তীরে ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত জুড়ে আরেকটি সভ্যতার ভগ্নাবশেষ যখন আবিষ্কৃত হলো তখন ভারতের সভ্যতা আরো ৩০০০ বছর পিছিয়ে গেল। এই সভ্যতা নাম হলো সিন্ধু সভ্যতা বা হরপ্পা সভ্যতা। সময়- কাল আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ এবং ভারতের উত্তর-পশ্চিমসীমান্তে আরও একটি সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায় তার নাম মেগলিথ সভ্যতা যার সময়কাল খ্রিস্টপূর্ব ৭০০০ বছর বা তারও বেশি। এগুলো সমসাময়িক সুমেরীয় এবং মিশরীয় সভ্যতার সমকালীন। সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ থেকে উদ্ধার হয়েছে লিপিমালা। এই লিপিগুলো ডান দিক থেকে বামদিকে লিখা হতো। এই প্রতীক লিপি গুলো স্টেম্পসিল, মৃৎ পাত্র, ব্রোঞ্জ, তামার প্লেট, সরঞ্জাম ও অস্ত্রগুলিতে পাওয়া গেছে। বেশিরভাগই দুই থেকে তিন সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্যের। প্রতীকের সংখ্যা ৪০০ থেকে ৬০০ টি। সিন্ধুলিপি পাঠোদ্ধার আজও সম্ভব হয়নি। তবে ভারতের স্বাধীনতার পরের থেকে এই চেষ্টা চলছে। তবে বর্তমানে ঐতিহাসিক ইরাবথম মহাদেবন দ্রাবিড় ভাষা ও লোগো- গ্রাফিক লিপির সমন্বয়ে ২০১৭ সালে এর পাঠোদ্ধার করেছেন অনেকটাই। যদিও এখনো তা আলোচনা স্তরেই রয়েছে ঐতিহাসিক তাত্ত্বিকদের মহলে। তিনি বলেছিলেন সিন্ধু লিপির সঙ্গে ভারতবর্ষের দ্রাবিড় লিপির অনেক মিল আছে । এছাড়া যেহেতু সুমেরীয়দের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য হতো তাই সমসাময়িক সুমেরীয় সভ্যতার সঙ্গে তুলনামূলক বিশ্লেষণ পদ্ধতি তিনি গ্রহণ করেছিলেন । লিপিগুলির পাঠোদ্ধার যেদিন সঠিকভাবে হবে সেদিন ভারতের ইতিহাস ভিন্নভাবে আমাদের সামনে উঠে আসবে। তবে যতটুকু প্রমাণ আমাদের সামনে আছে তাতে বোঝা যায় একটি সমৃদ্ধ সভ্যতা ছিল আর্যগণের আগমনের পূর্বে ভারতবর্ষে। 

             যখন ইরানীরা, গ্রীকেরা ভারতবর্ষে আক্রমণের বা লুন্ঠনের উদ্দেশ্যে এসেছিল তারা সিন্দুবাসীদের "হিন্দু" নামে অভিহিত করতেন । কারণ তাদের বর্ণমালায় "স" এর জায়গায় "হ" ছিল। পরবর্তী সময় এরা ভারতবর্ষে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। এদিকে নানা কারণে সমৃদ্ধ সিন্ধু সভ্যতা 
ধ্বংস হয়ে যায়। মানবের ইতিহাস বাঁক নেয়, ভারতবর্ষে আগমন ঘটে শক্তিশালী আর্যভাষাভাষী এক জনগোষ্ঠীর। পরবর্তী সময়ে ভারতবর্ষকে আর্যাবর্ত নামে অভিহিত করা হয়েছে বেদে, রামায়ণে, মহাভারতে নানাপুরাণে। আর্যরা জানতেন লোহার ব্যবহার, জানতো ঘোড়ার ব্যবহার, তারা মূলত ছিল যাযাবর কৃষিজীবী। তারা মুখে মুখে রচনা করেছেন বেদের অপূর্ব শ্লোক সমূহ বৈদিক সংস্কৃত ভাষায় । কিন্তু এদের লিপি ছিল না। গুরু শিষ্য পরম্পরায় মুখে মুখেই শ্লোক সমূহের পাঠ, পাঠাভ্যাস চলত তপোবনে গুরুকূলে। এবং শুনে শুনে মনে রাখতে হতো বলেই এর নাম "শ্রুতি" । কিন্তু আর্যদের সভ্যতা সিন্ধুনদ কেন্দ্রিকই শুধু ছিল না। কোন কোন ঐতিহাসিক সরস্বতী নদী কেন্দ্রে সভ্যতার কথা বলেছেন । নানা প্রাকৃতিক কারণেই তাদেরকে ভারতের মধ্য ও পূর্ব দিকে এগিয়ে আসতে হলো। বিশাল সমৃদ্ধ গঙ্গা বিধৌত উর্বর পলি মাটিতে ধীরে ধীরে গড়ে উঠলো এক মহান সমৃদ্ধ সর্বকালের শ্রেষ্ঠ সভ্যতা। যার নাম আর্য সভ্যতা। আর্য কোন জাতির নাম নয়, ভাষার নাম । এভাবেই অনার্য আর্য মিলেমিশে গড়ে তুলছিল সেদিনের বৈচিত্র্যময় ভারতবর্ষ। বহু যুদ্ধ রক্তক্ষয় হয়েছিল নিশ্চয়ই তবুও শেষ পর্যন্ত এক বর্ণনাতীত আত্মীয়তার ও প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের অমোঘ টানেই একে অপরের রীতিনীতি গ্রহণ করি সমৃদ্ধ হয়, সমৃদ্ধ করে ভারত সভ্যতাকে।

             ভারতের সভ্যতা সুপ্রাচীন এ বিষয়ে বিশ্বের তাত্ত্বিক পন্ডিত ও ঐতিহাসিকদের নিশ্চয়ই আর কোন সন্দেহ নেই। তবে পাশাপাশি এ বিষয়টি অত্যন্ত বেদনার যে ভারতবর্ষের দীর্ঘকালীন সভ্যতার ধারাবাহিক ইতিহাস নেই। আছে শুধু ঐতিহাসিক নিদর্শন মাত্র। এসব টুকরো টুকরো প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের সাহায্যে ধারাবাহিক নিরবচ্ছিন্ন ইতিহাস রচনা অসম্ভব। না আমরা জানতে পারি সিন্ধুবাসীরা কোন ভাষায় কথা বলতেন। তাদের সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক জীবনের টুকরো টুকরো চিত্র পেলেও পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া সম্ভব হয়নি। যদি লিপিগুলোর অর্থ উদ্ধার করা সম্ভব হতো তাহলে কিছুটা সম্ভব হতো। আবার পরবর্তী সমৃদ্ধশালী আর্য সভ্যতা যার ধারাবাহিক ঘটনাবলীর ইতিহাস পাওয়া যায় না। আর্যদের আধ্যাত্মিক বা ধর্মীয় গ্রন্থ বেদ। এখানে দেব-দেবীর রূপকে বহু ঘটনা উঠে এসেছে। আদি ঋকের শ্লোক সমূহে কোথায় কোথায় তৎকালীন নারীদের অবস্থান সামাজিক অবস্থান উঠে এসেছে । উপনিষদ, রামায়ণ, মহাভারত এবং পরবর্তীকালে বা সমসাময়িক সময়ে রচিত অষ্টাদশ পুরাণ কাব্য সবই আধ্যাত্মিক বা ধর্মীয় রচনা। এরমধ্যে তৎকালীন ভারতবর্ষের ইতিহাসের নানা টুকরো টুকরো ছবি আছে ঠিকই। কিন্তু এগুলোকে ইতিহাস বলা যাবে না। খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ শতকে ভারতবর্ষের ধারাবাহিক ইতিহাস আমাদের কাছে অজানা আজও।
     
            বহু পরে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে ভারতবর্ষে ষোড়শ মহাজনদের কথা আমরা জানতে পালি সাহিত্যে জাতকের গল্পে--- বলা যায় এ সময় থেকেই ভারতবর্ষের ধারাবাহিক ইতিহাস আমরা জানতে পারি। খ্রিস্টপূর্ব ৩২৫ শতকে গ্রিক বীর আলেকজান্ডার ভারতবর্ষে সিন্ধু অতিক্রম করেন বহু রাজাকে পরাজিত করে। পরবর্তী সময়ে যদিও আলেকজান্ডারের সেনাপতি সেলুকাস উত্তর পশ্চিম ভারত দখল করলেও মৌর্য শাসক চন্দ্রগুপ্তের কাছে পরাজিত হয়। মৌর্য শাসকরাই ভারতবর্ষে প্রথম সার্বভৌম এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। এই সময় এসেছিলেন গ্রিক পর্যটক মেগাস্থিনিস। তিনি তাঁর "ইন্ডিকা" নামক গ্রন্থে তৎকালীন ভারতবর্ষের সামাজিক,রাজনৈতিক,অর্থনৈতিক জীবন যাপন প্রণালী, ধর্মীয় বিশ্বাস,নারীদের অবস্থান সমাজের শ্রেণীবিভাগ, শাসকদের কার্যাবলী পুঙ্খানুপুঙ্খ তুলে ধরেন। চাণক্য বা কৌটিল্যের "অর্থশাস্ত্র" থেকেও তৎকালীন ভারতবর্ষের কথা। ভারতের ধারাবাহিক লিখিত ইতিহাসের সূচনা এখান থেকেই। এরপর গুপ্ত শাসকেরা ভারতবর্ষে প্রতিষ্ঠা করেছিল এককেন্দ্রিক সার্বভৌম শাসন ব্যবস্থা। এরপরে যদিও ভারতের ইতিহাসে কোন শক্তি খ্রিস্টীয় হাজার শতকের মধ্যে সার্বভৌম এককেন্দ্রিক শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। কখনো দাক্ষিণাত্যে চোল, চালুক্যরা, সাতকর্ণীরা কখনো কৌনজকে কেন্দ্র করে পূর্ব ভারতে পুষ্যভূতি বংশের হর্ষবর্ধন পরবর্তীকালে বাংলার গৌরকে কেন্দ্র করে (বর্তমানে মালদাহ) পাল ও সেন রাজারা ছিলেন আঞ্চলিক শক্তি। কেন্দ্রীয় শক্তি নয়। এদের পূর্বে বাংলার কর্ণসুবর্ণের শাসক শশাঙ্ক আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে বাংলার শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তারপরে নেমে আসে বাংলায় মাৎসান্যয়। বাংলার জনগণ সামন্ত গোপালপালকে গৌড়ের রাজা হিসেবে নির্বাচিত করে।

            ভারতে পরবর্তীকালে অর্থাৎ খ্রিস্টীয় একাদশ শতক থেকে পরবর্তী ১৭৫৬ সালের আগে পর্যন্ত পাঠান এবং মোগলেরা শক্তিশালী এককেন্দ্রিক সার্বভৌম শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল । এরপর আসে ইংল্যান্ডের বণিক গোষ্ঠী ইংরেজরা। জ্ঞান বিজ্ঞানের বলে বলীয়ান, আধুনিক শিক্ষায় সমৃদ্ধ ইংরেজির কাছে পরাজিত হতে হয় তৎকালীন ভারতের কেন্দ্রীয়‌ ও আঞ্চলিক শাসকদের । এরপর প্রায় ২০০ বছরের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ স্বাধীন হয়, একটি গণপ্রজাতন্ত্রী সার্বভৌম ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসাবে পরিচিত হয় । ভারত পরিচালিত হয় ভারতের নবনির্মিত সংবিধানের দ্বারা। যেখানে বিশেষ কোন জাতি নয়, বিশেষ কোনো ধর্মের পরিচয় নয়, যেখানে একটি পরিচয় আমরা ভারতীয়, আমরা ভারতবাসী ‌যেখানে আছে সকলের সমান অধিকার। 
         
আল বিরুনী, ফাহিয়েন, হিউএন সাং এর বিবরণে, পরবর্তীকালে বিভিন্ন দেশী-বিদেশী ঐতিহাসিকদের, প্রত্নতাত্ত্বিকদের বিবরণে ভারতবর্ষের ইতিহাস গঠন সম্পন্ন হয়েছে । সুপ্রাচীন মেযগলিথ সভ্যতা,সিন্ধু সভ্যতা, আর্য সভ্যতা, পরবর্ইতীকালে ইসলামীয় শাসন, ইংরেজদের জ্ঞান- বিজ্ঞান ও বস্তুগত দর্শন ভারতবর্ষের মননকে ভারতবাসীর ইতিহাসের বিবর্তনের ধারাকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। আজও এগিয়ে নিয়ে চলেছে......
       
         ভারতবর্ষের সভ্যতার স্থায়িত্বের অন্যতম কারণ যদি বিশ্লেষণ করা যায় দেখা যায় তার মূল চাবি হল সহিষ্ণুতা বোধ। পারস্পরিক সমন্বয়ের বাঁধনে আমরা একে অপরে বেঁধে থাকি। পরস্পর পরস্পরের সাংস্কৃতিকে গ্রহণ করে নিজেদের সমৃদ্ধ করি। একে অপরকে শ্রদ্ধা করি। এ কথা ঠিক যখনই কোন বিদেশী জাতি লুণ্ঠন করবার উদ্দেশ্য নিয়ে এদেশে এসেছিল, কিছুদিন তারা এদেশের মানুষকে উৎপীড়ন করলেও শেষ পর্যন্ত বৈচিত্র্যময় ভারতবর্ষের পরিবেশ, এখানকার মানুষের জীবন যাপন প্রণালী তাদেরকে আকর্ষণ করেছে তারাও এ দেশের মানুষের প্রতিবেশী হয়ে থেকে গেছে। রবীন্দ্রনাথ তাই বলেন,"শক হুন পাঠান মোগল এক দেহে হল লীন"। উগ্র জাতিদের মন থেকে ধীরে ধীরে হিংসা দ্বেষ দূর হয়ে তারা হয়ে ওঠে বৃহৎ ভারতবাসী।

      সমন্বয় এবং সহিষ্ণুতা, গ্রহণ এবং অভিযোজন ভারতীয় সভ্যতার মূল ভিত্তি । এর উপরে দাঁড়িয়ে ভারতীয় সভ্যতা। ভারতবর্ষ সুবৃহৎ এক গণতান্ত্রিক দেশ। মানব সভ্যতাকে গণতন্ত্রের পাঠ পরিয়েছিল গ্রিক সভ্যতা। অজস্র দ্বীপ রাজ্য নিয়ে গঠিত এক সময়ের ক্রিট সভ্যতা যা পরবর্তীতে গ্রিক সভ্যতা নামে পরিচিত। ছোট ছোট রাজ্যগুলি যা "পলিশ" গণরাজ্য বলে পরিচিত ছিল। শাসিত হতো জনগণের দ্বারা। এথেন্স তেমনি একটি "পলিশ"। এখানেই আমরা পেয়েছি দার্শনিক সক্রেটিস, প্লেতো এবং অ্যারিস্টটলকে। তাঁদের দর্শন মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতাকে দিয়েছে গুরুত্ব । সিন্ধু সভ্যতায় রাজতন্ত্র ছিল। পরবর্তী আর্যদের সময়ে রাজতন্ত্রের প্রধান হলেও ছিল নারীর স্বাধীনতা এবং সভা ও সমিতি নামে দুটো প্রশাসনিক অংশ ছিল। যেখানে জনগণের প্রতিনিধিরা দেশ পরিচালনায় পরামর্শ দিয়ে থাকতেন। যথাযথ গণতন্ত্রের চিত্র আমরা পেয়েছি এথেন্সে। এছাড়া ষোড়শ মহাজনদের অন্তর্গত বজ্জি ও ও মল্ল নামক দুটি গণরাজ্যের উল্লেখ পাওয়া যায়। যেখানে রাজতন্ত্র নয় জনগণের দ্বারাই দেশ পরিচালিত হত।  বিভিন্ন গোষ্ঠী প্রধানরা একত্রিত হয়ে দেশ পরিচালিত করতে। বৈশালীতে তার পরিচয় পাওয়া যায়। 
           
    প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যে ভরা ভারতবর্ষ, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে ভরা ভারতবর্ষ, নানা ভাষার আবহে কল্লোলিত ভারতবর্ষ, বিভিন্ন ধর্মের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা বৈচিত্র্যপূর্ণ ভারতবর্ষ--সেই ভারতবাসী বিশ্বাস করে বহু মানুষের পারস্পরিক সহযোগিতায়, সহমর্মিতায় ও সহাবস্থানে। বিশ্বাস করে একতায়, সংহতিতে, সম্প্রীতিতে, সহিষ্ণুতায়, অহিংসায়। যে দেশে ধর্মীয় পরিচয় শেষ কথা নয়, আসমুদ্র হিমাচল গেয়ে উঠে সমন্বয়ের সংগীতের সুরে, পরস্পর পরস্পরের সাংস্কৃতিক ধর্মীয় অনুষ্ঠানে নিজেদের করে শরিক । আবার স্বাধীনতা পরবর্তী (১৯৪৭) ভারত ভূখণ্ড আক্রান্ত হয়েছে কোন বৈদেশিক শত্রুর দ্বারা সমগ্র ভারতবাসী জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে হাতে হাত বেঁধে রুখে দাঁড়িয়েছে । গণতান্ত্রিক প্রজাতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ ভারতবর্ষের একতা,দৃঢ়তা, সাহসিকতার, যথার্থ সিদ্ধান্নতের কাছে নত হয়েছে অশুভ শক্তি । বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যই ভারতের বল। এখানেই ভারতবাসীর প্রকৃত প্রাণভোমরা লুকিয়ে আছে। কোন অবস্থাতেই ভারতবাসীর স্বাধীনতা বোধ, জাতীয়তাবোধ পারস্পরিক আত্মীয়তা বোধকে কোন অশুভ শক্তি ধ্বংস করতে পারবে না, ভবিষ্যতেও পারবে না। একুশ শতকের ভারতবর্ষ জ্ঞানে বিজ্ঞানে দর্শনে সামরিক শক্তিতে কূটনৈতিক স্তরে অর্থনীতিতে বিশ্বের অন্যতম শক্তিতে পরিণত হয়েছে আজ । গৌতম বুদ্ধ যে মাটিতে জন্মগ্রহণ করেছেন, যেখানে মহাত্মা গান্ধীর মত মানুষের আবির্ভাব হয়েছে, যে দেশ স্বামী বিবেকানন্দের মত মহামানবের ছোঁয়া পেয়েছে-- সেই দেশবাসী মানবতার পথেই হাঁটবে, এবং বিশ্ববাসীকেও সে পথই দেখাবে সকল সমস্যার সমাধান হিসাবে এটাই তো স্বাভাবিক। ভারতবর্ষ যে সুপ্রাচীন সভ্যতার ঐতিহ্য কয়েক হাজার বছর ধরে বহন করে চলেছে তা যুদ্ধ নয় শান্তির কথা বলে, হিংসা নয় মানবতার কথা বলে, দূরত্ব নয় পারস্পরিক সহযোগিতার কথা বলে-- আগামী দিনেও উত্তরের সুদৃঢ হিমালয়,দক্ষিণের বিন্ধ্যাচল,সিন্ধু,গঙ্গা,ব্রহ্মপুত্র,কাবেরী গোদাবরী যেন তার সাক্ষী দিয়ে চলবে...... এটাই আমাদের ভারতবর্ষ...... আমাদের গর্ব..... বিশ্ববাসীর কাছে যথার্থ সভ্যতা একমাত্র পরাকাষ্ঠা। শিবদাস বন্দোপাধ্যায়ের লেখা  "ভারত আমার ভারতবর্ষ স্বদেশ আমার স্বপ্ন গো" প্রকৃত অর্থে আমরা ভারতবাসীরা এমন ভারতবর্ষেই স্বপ্নের আবহে সকলে মিলে বাস করি। এমন ভারতবর্ষেই আমাদের ভোর হয়, আমাদের সূর্যাস্ত হয় এবং এই বৃত্তেই আমাদের জীবন আবর্তিত হয়ে চলেছে যুগ যুগ ধরে ।



ভারত আমার ভারতবর্ষ স্বদেশ আমার স্বপ্ন..... 

গৌতমেন্দু নন্দী

এই শিরোনাম সম্পর্কিত নিবন্ধ যখন লেখা শুরু করতে যাচ্ছি তখন  আমার ঘরে দূরদর্শনে সম্প্রচারিত একটি সংবাদে শুনতে পাচ্ছি এই রাজ্যের এক ক্ষমতাশালী নেতা তাঁর জেলাতেই কর্মরত এক পুলিশ অফিসারকে ফোনালাপে "তুই তোকারি"সহ অশ্রাব্য গালি-গালাজ করে বলছেন ঐ অফিসারকে  নাকি তিনি কোয়ার্টার থেকে মারতে মারতে নিয়ে আসবেন......। ক্ষমতার কী আস্ফালন! কী ঔদ্ধত্য!

      খবরের পরবর্তী দৃশ্যান্তর---- আন্দোলনরত  চাকরি হারানো যোগ্য শিক্ষক/শিক্ষিকাদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের উপর প্রশাসনের পুলিশি আক্রমণ .......।

        এইসব ধারাবাহিক অবাঞ্ছিত খন্ডচিত্র যে রাজ্যের বা যে দেশের সেই দেশের স্বাধীনতার বয়স  প্রায় আশি বছরের দোরগোড়ায়। ইংরেজ শাসনাধীন  থেকে মুক্ত হওয়াই কি "স্বাধীনতা" প্রাপ্তি? নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হলেও কি সেই স্বাধীনতা রক্ষিত থাকে নাকি থাকবে?! 
    
আজ থেকে আটাত্তর বছর আগে স্বাধীনতা প্রাপ্তির জন্মলগ্নে মধ্যরাতের ভাষণে পন্ডিত নেহেরু উচ্চারণ করেছিলেন " স্বাধীনতা এবং ক্ষমতা দায়িত্ব অর্পণ করে...." ।  

সেদিন তিনি তাঁর ভাষণে নির্বাচন সর্বস্বতাকে অতিক্রম করে যে দর্শনের কথা বলেছিলেন তা হল গণতন্ত্রের মর্মস্থলে সার্বভৌমত্বের ধারণাটিকে প্রতিষ্ঠা করা।  গণতন্ত্রে এই সার্বভৌমত্বে জনসাধারণের ভূমিকা স্বীকৃত। এই নাগরিকদের অস্বীকার, উপেক্ষা  ক'রে রাষ্ট্রীয় শক্তির ক্ষমতাধররা, যাঁরা গণতান্ত্রিক 
পদ্ধতিতে নাগরিক সমাজের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়ে নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁরা অর্থাৎ শাসন যন্ত্রীরা সেই  গণতন্ত্রকে অস্বীকার করছেন। সার্বভৌমত্বকে তাঁরা  জনসাধারণের সক্রিয় ভূমিকার নিরিখে দেখেন না, দেখতে চান না। তারই প্রকাশ ঔদ্ধত্যের রাজনীতি।
       
নিরুঙ্কুশ আধিপত্যের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণে  "স্বাধীনতা"শব্দটি "সোনার পাথরের বাটি"তে পর্যবসিত হয়ে কোন্ স্বাধীনতার কথা বলে?

      " ভারত আমার ভারতবর্ষ" "স্বদেশ আমার স্বপ্ন"--- যে আশা নিয়ে রক্ত ঝরিয়ে স্বাধীনতার স্বপ্ন  দেখেছিলেন এবং দেখিয়েছিলেন আমাদের বরেণ্য দেশ নেতা গণ, সেই দেশ নেতাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উপেক্ষা করে, তাঁদের চিন্তা চেতনাকে শ্রদ্ধা না জানিয়ে মেকি দেশাত্মবোধ ও জাতীয়তাবাদের ঢাক-ঢোল পেটানো,ধর্মান্ধতার  অস্ত্রে মানবতাকে রক্তাক্ত করার নির্বাচন সর্বস্ব দেশটি আমার স্বপ্নের দেশ ভারতবর্ষ হোতে পারেনা, হিংসা--দ্বেষ- মত্ত পবিত্র ভূমি "স্বদেশ"এর  স্বপ্নভঙ্গ হয়ে সেই দেশ রূপান্তরিত হয়ে যায় "স্ব-দ্বেষ"- এ। 

      শাসনযন্ত্রীর নিষ্পেষণে জনসাধারণের স্বাধীনতা বারবার খর্বিত হতে থাকলে, তাঁদের ন্যায্য অধিকার থেকে বারবার বঞ্চিত করা হোতে থাকলে, শাসক মদতপুষ্ট অপরাধীরা বারবার নির্দোষের ছাড়পত্র পেতে থাকলে, কিংবা ক্ষমতার ঔদ্ধত্যে "ধরা" কে "সরা" জ্ঞান করতে থাকলে সেই ভূমি, সেই দেশ তখন "স্বপ্নভঙ্গ" দেশের নামান্তর হয়ে যায়। 

       যে স্বদেশ আমার স্বপ্ন ভূমি, সেই স্বদেশের নাগরিকদের বৃহৎ অংশ স্বাধীনতা প্রাপ্তির এতো বছর বাদেও যদি শাসকের দৃষ্টিকোণ থেকে আক্ষরিক অর্থেই "প্রজা"র স্তরে নেমে যায়, সমর্থকের বিপ্রতীপে
অবস্থানের মাশুল যদি দিতে হয় শাসকের পক্ষপাতিত্বের শ্যেণ দৃষ্টির তীর্যক আক্রমণে, তখন  অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে "ভারত আমার ভারতবর্ষ, স্বদেশ আমার স্বপ্ন..." উচ্চারণ করলেও একটা  অব্যক্ত যন্ত্রণা কিন্তু থেকেই যায়।


 

স্বদেশ আমার স্বপ্ন গো

অনিতা নাগ 


ভারতবর্ষ সূর্যের এক নাম
আমরা রয়েছি সেই সূর্যের দেশে
লীলা চঞ্চল সমুদ্রে অবিরাম
গঙ্গা যমুনা ভাগিরথী যেথা মেশে।

এই গানটা বড্ড প্রিয় অনুর। ইতিহাস আর ভূগোলে কোনোকালেও ভালো ছিলো না অনু। ১০০ তে ৪০ ছিলো পাশ নম্বর। মেরে কেটে ৪৪। মনে রাখতে পারতো না অতো যুদ্ধ, অতো দেশ মহাদেশের নাম। শুধু পলাশীর যুদ্ধ মনে থাকতো, মনে থাকতো মিরজাফরের নাম। তারজন্যই তো বাংলার নবাব সিরাউজদৌল্লা পরাজিত হয়েছিলেন। কতো রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, কতো জীবনের বিনিময়ে আজকের স্বাধীনতা। বাবা ম্যাপ পয়েন্টিং শেখাতেন। গ্লোব ছিলো না বাড়ীতে। অ্যাটলাস বইতে রঙীন ম্যাপ দেখিয়ে বাবা চেনাতেন। হাজার দেশের মধ্যে থেকে ভারতবর্ষকে চিনতে ভুল হতো না অনুর। ভারতবর্ষের ম্যাপের উপর ট্রেসিং পেপার রেখে বারবার পেন্সিল বুলিয়ে অভ্যেস করতে করতে কখন যে ভারতবর্ষের ম্যাপ আঁকায় বেশ সড়গড় হয়ে গিয়েছিলো তা নিজেও টের পায় নি। আর ভারতবর্ষের ম্যাপের ডান দিকে পশ্চিমবঙ্গ। পশ্চিমবঙ্গের কলিকাতা, এখন কলকাতা অনুর জন্মস্থান। স্কুলের পাঠ্যবইতে নানান মণীষীদের জীবনী পড়ানো হতো। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, নেতাজী সুভাষচন্দ্র, ঋষি অরবিন্দ। দেশের জন্য তাঁদের ত্যাগ, তাঁদের বলিদান কোনোদিন ভোলার নয়। ২৩শে জানুয়ারী পাড়ায় নেতাজী সুভাষচন্দ্রের ছবি দিয়ে সৌধ সাজানো হতো রঙীন কাগজ দিয়ে শিকলি বানিয়ে সাজানো হতো। ঠিক দুপুর বারোটায় শাঁখ বাজিয়ে প্রণাম জানানো হতো। জাতীয় পতাকা উড়তো। দেশাত্মবোধক গান গাওয়া হতো। সে এক হৈহৈ ব্যাপার। দেশনায়কের জন্মদিন। তার দু'দিন পরেই প্রজাতন্ত্র দিবস। সে'দিন ও পাড়ায় জাতীয় পতাকা উত্তোলন হতো। সকাল সকাল স্কুলে যেতে হতো। স্কুলে কতো অনুষ্ঠান হতো। একবার তো প্রজাতন্ত্র দিবসের সরকারী কুচকাওয়াজে অংশ নিয়েছিলো স্কুল থেকে। এমন কতো স্মৃতির কোলাজ ধরা দেয় মনের আয়নায়। স্বামীর কর্মসূত্রে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশে থেকেছে অনু। ভাষাগত দূরত্ব থাকলেও ভারতবর্ষের মূল সুরটা সব জায়গায় একই ছিলো। ছেলেমেয়ের পড়াশোনা দক্ষিণ ভারতে। তারা তেলেগু ভাষা যেমন রপ্ত করেছিলো, সাথে বাংলা, হিন্দী, সংস্কৃতও সমান গুরুত্ব দিয়ে শিখেছিলো। কোথাও কোনো বিরোধ ছিলো না। আজকাল সব যেনো কেমন অন্যরকম। আমার আমার করে চারদিকে হৈহল্লা। আরে বাবা সবটাই তো আমার। সবটা নিয়েই তো আমার দেশ। সবাই মিলে আগলে রাখলে সাধ্য কি অন্য কোনো শক্তি তার মধ্যে থাবা ফেলে! 
একবার কিছুদিনের জন্য ঢাকা গিয়েছিলো অনু৷ কর্মসূত্রে মেয়ের তখন ঢাকায় বাস। কলকাতা বিমানবন্দর থেকে চল্লিশ মিনিটের যাত্রাপথ। চল্লিশ মিনিট পর ঢাকায় পৌঁছানোর সাথে সাথে ঘড়ির সময় গিয়েছিলো বদলে। মোবাইল এর টাওয়ার গিয়েছিলো থেমে। একটা বেড়াজাল পেরোতেই ভারতবর্ষ কতে দূরে সরে গিয়েছিলো। সেই প্রথম অনুর খুব কষ্ট হয়েছিলো দেশের জন্য। অসহায় মনে হয়েছিলো। অলক্ষ্য এক সীমারেখা আলাদা করে দিয়েছিলো তার দেশকে। সেই সীমারেখা দেখার বড় সাধ ছিলো অনুর। ভাগ্যের পরিহাসে সে সুযোগ ও হয়েছিলো। আগরতলা হয়ে দেশে ফেরা। মেয়ে এসেছিলো বর্ডার অবধি পৌঁছে দিতে। ইমিগ্রেশন সেরে যেই না বর্ডার সিকিউরিটির গেট পেরিয়ে ওপারে গেলো সময়ের কাঁটা বদলে গেলো, মোবাইলে টাওয়ার লোকেশন ফিরে এলো। একটা গেটের ওপারে বিদেশে রইলো মেয়ে, অনুরা এসে পড়লো ভারতবর্ষের সীমানায়। হাপুস নয়নে অনু তাকিয়ে রইলো। ঐ যে মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওপারে। ক্রমশঃ দূরত্ব বাড়লো। একটা সীমা রেখা তার ভারতবর্ষকে কেমন আলাদা করে ফিরিয়ে দিলো তার কাছে। শত কষ্টে, শত যন্ত্রণাতেও এই তার সাধের দেশ। এখনকার ডিজিটাল দুনিয়ায় সবটাই বড় সহজলভ্য। কিন্তু সে'দিনের সেই লড়াই সহজ ছিলো না। কতো প্রাণের বলিদানে পাওয়া এই স্বাধীণতা। জীবনের এই পড়ন্ত বেলায় আলিপুর জেল মিউজিয়ামে গিয়েছিলো অনু। না গেলে কতো কিছু জানা হতো না। ইতিহাসের পাতার বাইরে তাদের যন্ত্রণাময় দিনগুলো রয়েছে আলিপুর জেলের আনাচ কানাচে। ফাঁসির মঞ্চের ঠিক সামনে বড় বাড়ীর জানলায় সব বন্দীদের দাঁড় করিয়ে ফাঁসি দেখতে বাধ্য করা হতো। আলিপুর জেলে তখন প্রতিধ্বনিত হতো ‘বন্দে মাতরম’। হাসতে হাসতে ফাঁসির মঞ্চে উঠতেন বীর যোদ্ধারা। শত যন্ত্রণা হাসিমুখে সহ্য করে দেশ মাতৃকাকে যারা মুক্ত করেছেন তাদের প্রতি শ্রদ্ধায়, সম্মানে নত হয় অনু।
আজকের যুগে বড্ড দ্রুত বদলে যাচ্ছে সবকিছু। দেশ ডিজিটাল হচ্ছে, আগে বাড়ছে। সে ভালো কথা। কিন্তু সেই এগিয়ে চলার পথে রাজনৈতিক দিশারীদের অন্ধকারময় জীবন বড় আশাহত করে। কি রেখে যাবে আগামী প্রজন্মর জন্য! মিথ্যা আর অন্ধকারময় জীবনের হাতছানিতে তারা যেনো হারিয়ে না যায়। বড্ড ভয় করে অনুর। সহজে উপরে উঠতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ছে সব। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্ম, সবেতে শুধু মিথ্যার জয়। যোগ্যতা থাকলেও মূল্যায়ন হচ্ছে না। ছেলে মেয়েরা স্বদেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে শিক্ষা ও কর্মের খোঁজে। অসহায় বাবা মা’রা মুঠোফোনে নিজেদের সচল রাখতে শিখছে। অনুও তার ব্যাতিক্রম নয়। তবু যতক্ষণ শ্বাস, ততোক্ষণ আশ। ‘ভারত আবার জগত সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে’, এই আশা নিয়ে আগলে রাখে অনু ভারতবর্ষের মানচিত্রকে বুকের মধ্যে। সেই ছোটবেলায় ম্যাপ পয়েন্টিং এ শেখা ভারতবর্ষের মানচিত্রকে আগলে রাখে পরম সোহাগে, পরম যত্নে, পরম শ্রদ্ধায়।


 

ভারত আমার ভারতবর্ষ /স্বদেশ আমার স্বপ্ন গো
বেলা দে 

পায়ের নিচে যে শক্ত জমিনটায় আমরা দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে অত্যন্ত দৃঢ়তা এবং স্বস্তির সাথে বলতে পারি এ হল আমার দেশ, আমাদের ভারতবর্ষ। এই জায়গাটুকু ছেড়ে দাও এমন নির্দেশ  করবার ক্ষমতা বা অধিকার নেই কারো। মানবের একান্ত আধপত্যের জায়গা। বীর শহীদের স্বপ্নে গড়া স্বর্গ, এখানে আমাদের ইচ্ছের দাম স্বাধীনভাবে চলার ক্ষমতা স্বাধীন কথাবলা স্বত্বাধিকার।এমন দেশ আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মাতৃকা বন্দনায় বলেছেন "সুজলাং সুফলাং শস্য শ্যামলাং" জলে ফলে শস্য শ্যামল আমাদের এই ভারতবর্ষের মাটি।কবিগুরু বলেছেন" তোমার তরে ঠেকাই মাথা" এ মাটিতে মাথা ঠেকিয়েই আমাদের জন্ম,যাপন, মরণ। বৈদেশিক শক্তির আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার রক্ষাকবচ আমাদের সীমান্ত সৈনিক ভাই এবং বোনেরা। ওরা আমাদের নিশ্চিন্ত রাতঘুমে অতন্দ্র প্রহরায়। বিদেশি শাসনে যখন জর্জরিত দেশ,তাদের হাতে কলের পুতুল হয়ে নির্বাক নিরপেক্ষ সময় অতিবাহিত করেছে আমাদের পূর্বসূরি, ভাবলেও শিউরে উঠতে হয় কত চরম অপমান লাঞ্ছনার মধ্যে দিয়ে কাটিয়েছে জীবন। সে শৃঙ্খল মুক্ত হয়ে আজ ভারতবর্ষ বিশ্বের দরবারে মহান শক্তিশালী দেশ। 
বীর শহীদেরা আত্মবলিদান করে বুঝিয়ে দিয়ে গেছে এ ভারত নয় শক্তিহীনের, এই তো শহীদের স্বর্গ, ভারত সন্তানেরা মরতে ভয়পায় না। অন্ধকার সমাজ যখন কুসংস্কারাচ্ছন্ন তখনও জন্মেছে মৈত্রী গার্গেয়ী,ক্ষনা,লীলাবতীর মতো বীরাঙ্গনা। তাজা রক্তের বিনিময়ে বালক খুদিরাম,বিনয়, বাদল, দীনেশ ভগত সিং দেশমাতৃকার মান বাঁচিয়ে গেছে।যে দামাল ছেলেগুলো আত্মত্যাগে স্বর্গ রচনা করে গেছে, সে দেশ আজ কোথায়, স্বাধীন দেশটায় লুঠতরাজ করে চলেছে একদল রাজনীতিবাজ অসৎ অমানবিক। অথচ এই দেশেই জন্ম নিয়েছেন  বিশ্ববরেণ্য কবি রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, শরৎচন্দ্র  বিদ্যাসাগর, নজরুল। এই ভারতের দামাল সন্তান নেতাজি বলেছেন একদিন"তোমরা আমাকে রক্ত দাও আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব"।  ভারতবর্ষের এই মহান সন্তানেরা আজ থাকলে মাটির শক্ত ভিত নড়বড়ে করে দিতে পারতো না ঘরশত্রু বিভীষণেরা। সাম্প্রতিককালের যুদ্ধে বৈদেশিক শক্তিরা বুঝে গেছে ভারতকে দুর্বল মনে করা কতটা ভুল। ভারতবর্ষ ধর্মের দেশ কর্মের দেশ সত্যের দেশ।  জয় তার হবেই নিশ্চয়। 


 

মুখোস
শুভেন্দু নন্দী 

বন্ধু স্থানীয় সুমনকে বলেছিলাম " এই সব ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অনেক ভালো কিছু কথা, উপদেশ ও জ্ঞানগর্ভ তথ্যে আমরা সমৃদ্ধ হই ঠিকই এইসব মান্যগন্য ব্যক্তিদের বিশ্লেষনী বক্তৃতার মধ্য দিয়ে।" এ প্রসঙ্গে বলে রাখি যে তার অনুরোধেই এই সভায় হাজির হয়েছিলাম।

আমি তাকে আরও বলেছিলাম যে," অনেকেরই বাইরের প্রকাশে বেশ চটকদার, কিন্তু অন্তরে হয়তো ততটা নন।"  

সুমন আমার দিকে জিজ্ঞাসু  দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো। এরপর মাননীয় সভাপতি ও প্রধান অতিথিকে পুষ্পস্তবক প্রদান ও প্রদীপ জ্বালিয়ে বরন করা হোলো। সভাপতি-স্থানীয় স্কুলের হেডমাস্টার মহাশয়, তাঁর সুন্দর ও সুচিন্তিত  ভাষণের মধ্য দিয়ে উপস্থিত সকল আমন্ত্রিতদের মন জয় করলেন। 

এরপর উদ্বোধনী সঙ্গীত পরিবেশন করলো একটি ছোট্ট মেয়ে," মন চল নিজ নিকেতনে" । সুন্দর একটি গান। এরপর প্রধান অতিথি সবাইকে শুভেচ্ছা ও নমস্কার জানিয়ে শুরু করলেন তাঁর বক্তব্য। অনেক কথা বলার পর  তাঁর ভাষণে বললেন, "স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে এক নজরে দেখতে হবে। সবাই আমাদের ভাই-বোন। কিন্তু অনেক ধনী ব্যক্তিরা অর্থের গরিমায় গরীবকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে থাকেন। এটা তো ঠিক নয়। সবাই তো অমৃতের সন্তান। এরূপ ঘটনায় আমি সত্যিই ব্যথিত" ইত্যাদি ইত্যাদি বলে তাঁর দীর্ঘ বক্তৃতা শেষ করে ঢকঢক করে এক গ্লাস  জল পান করলেন ও রঙীন রুমাল দিয়ে মুখ মুছলেন। অনুষ্ঠান শেষে আমি আর প্রদীপ হলঘর থেকে বের হলাম।

... দিন কয়েকের কথা। দেখলাম
একজন রিকশাচালকের সঙ্গে তথাকথিত ঐ "প্রধান অতিথি"র বচসা ভাড়া নিয়ে। 
- বাবু - আমি তো ন্যায্য ভাড়াই চেয়েছি। আমরা তো গরীব। আপনাদের তো অনেক আছে-
- কী যত বড়ো মুখ নয়, তত বড়ো কথা। আবার ওজন করে কথা বলছো? জানো, আমি তোমাকে
"পুলিশে" দিতে পারি। আমার বিরাট ক্ষমতা-

বচসা ক্রমশঃ দীর্ঘায়িত হচ্ছে  দেখে রিকশাওয়ালাকে আমি তার ন্যায্য ভাড়া মিটিয়ে দিলাম। দেখলাম ঐ ভদ্রলোক(?) রাগে ফুসছেন। তাঁর কাছে গিয়ে বিনীতভাবে বললাম " নমস্কার! সামনের মাসে আরও একটি আকর্ষক ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন সম্পন্ন করতে যাচ্ছি। সেখানে আপনার মত মহান মানুষের অবশ্যই উপস্থিতি চাই।  সেদিন দেখেছিলাম যে আপনি বক্তৃতার তোড়ে জগৎসংসার এক্কেবারে আনন্দের  প্লাবনে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন- যেমন এখন দিচ্ছেন।  আপনি যে বাইরে ও অন্তরে এতোখানি খাঁটি ও মহান- সেদিন তেমনভাবে বুঝিনি কিন্তু আজ বেশ বুঝতে পারছি। অবশ্যই আসবেন কিন্তু সেদিন। কার্ড আমি অবশ্যই পাঠিয়ে দেবো।"

দেখলাম আমার ওষুধ অব্যর্থ। সমবেত জনতার মাঝে রণেভঙ্গ দিয়ে গুটিসুঁটি মেরে ধীরে ধীরে পা মেলালেন বাইরে।


 

ভারত বর্ষ 

        জয়তী ব্যানার্জী 

ভারত বর্ষ সূর্যের এক নাম 
আমরা রয়েছি সেই সূর্যের দেশে ।

_________কিন্তু এই ভারত ভূমি আজ রক্তাক্ত। 

যে দ্রৌপদীকে একদিন কুরু সভাস্থলে করা হয়েছিল ভুলুণ্ঠিত,
         বেআব্রু হতে হয়েছিল ,
           সমস্ত রথী মহারথী নরপতি দিকপতি এমনকি পঞ্চ স্বামীর কাছে!
          সেদিনই বোধ হয় ভরত রাজার দেশ ভারতবর্ষের কপালে সিঁদুর লুটোপুটি খেয়েছিল।

ভাগ্যের চাকা আজও বদলায় নি।

কিন্তু আমার তোমার ভারত _____
আমার ভারতবর্ষ তো পাল্টায় না। 

তবু যেন ভেবে ভেবে মরি ,
       এ কোন সকাল 
        রাতের চেয়েও অন্ধকার। 

মূহুর্মূহু গোলা বরষণে
বিদ্ধ হতে হয় আমার দেশ মাতৃকাকে।

তুমি কি শুধুই দেশমাতা 
দেশে-বিদেশে আজ ঘটা করে পালিত হয় 
          মাতৃ দিবস ।

কিন্তু তা কি শুধুই গর্ভধারিনী মায়ের উদ্দেশ্যে?

তাহলে আমরা কি বা শিখলাম আর কী বা শেখালাম,

গর্ভধারিনী মা তো মোদের,
মা তো বটেই গো। 

শুনছো হে জগমোহন, 
         যে মাটিতে জন্মাই মোরা 
          যে মাটিতে খাই ,
            আর যে মাটি মোদের 
মাতৃস্নেহে করে লালন পালন 
          সে মাটি কি মা নয় 
           নয়কো গর্ভধারিনী? 

তবে আমরা কেন করি পালন 
      দেশমাতৃকার জন্মদিন 
        ১৫ ই আগষ্ট?

কতশত বীর শহীদের রক্তে রাঙানো 
     এই স্বদেশভূমি ;
      কত রক্ত হয়েছে বিসর্জন !
       গঙ্গায় বয়ে গেছে কত জল 
    তবুও ভারত মাতা হয়নি মলিন। 

কারণটা কি ,
বলতে পারবে সহোদর সহোদরারা?

১০০ কোটি সন্তানের ভালোবাসার ফল। 

শত শত সন্তানের ভালোবাসার ফল কি বৃথা যায় গো ;
এ যে ভালোবাসার ধন।

মাতৃ দুগ্ধে পোষ্য মোরা ;
মোদের একটাই নাম ____
শক হুন দল পাঠান মোগল 
      যে দেহে হলো লীন
তার নাম যে 
            ভারতবর্ষ !
              যা কিনা সূর্যের এক নাম।


 

স্বদেশ আমার

মাথুর দাস


কে ওখানে বসে আছে সবুজ আঁচল বিছিয়ে দিয়ে,

শুভ্র মুকুট শিরোভাগে চোখের কোণে জল চিকচিক ।

গুনগুনিয়ে মলয় বাতাস কত কিছুই যায় শুনিয়ে,

শরীর জুড়ে স্রোতস্বিনী হরেক গাথা গায় যে ঠিক ॥


ইতিহাসের ওঠাপড়া ঝড়ঝাপটা মড়ক মারী

যেমন ছিল থাকবে আছে রত্নরাজি অঙ্গে যে তার ।

সুখ দুঃখ অত্যাচারেও সর্বসহা রূপ যে তারই,

মূর্ছনা তান করুণ হলেও ছন্দ গানের সঙ্গে সেতার ॥


আমরা যারা অনেক জানি শত কষ্টেও সবাই মানি

উন্নত শির ঝুঁকবে না তার হাজার আঘাত অঙ্গে পেলে ।

স্বদেশ আমার মাতৃসমান চিরদিনের রাণীর রাণী,

পা ধোওয়াতে ব্যস্ত থাকে বরুণ রাজার দামাল ছেলে ॥


 

ক্ষমতায়ন 

উৎপলেন্দু পাল 


এখন বৃদ্ধ সিংহ মহাশয় আর সুবিশাল প্রাচীন বনভূমির পশুরাজ নেই 
সময়ান্তরে পুরোনোকে সরিয়ে অভিষেক হয়েছে নতুন এক উন্মাদনার 
একটা বিরাট অজেয় অজগর গ্ৰাস করেছে বনের সমস্ত দায়িত্বভার 
নখদন্তহীন বৃদ্ধ সিংহকে আষ্টেপৃষ্ঠে চেঁপে ধরেছে ওই নব‍্য অজগর 
মেরুদন্ড পাঁজর বিচূর্ণ হয়ে তার অসহায় প্রাণ এখন প্রায় ওষ্ঠাগত 
ইতিউতি ওঠা বিদ্রোহী কন্ঠগুলোকেও শ্বাসরোধ করা হয়েছে নির্দয়ভাবে 
সমগ্ৰ বনভূমি জুড়ে এখন এক অদ্ভুত নীরব শ্মশানের শান্তি বিরাজিত 
আর শ্রীমান ঈশ্বর তাঁর নিজভূমে তাঁর নিজের অস্তিত্ব বাঁচাতেই ব‍্যস্ত । 


 

স্বপ্নমাখা মায়ের কোল 

প্রাণেশ পাল 


তোমার বুকে আজ সন্ত্রাসবাদীর নগ্ন পদচারণ,
তোমার রক্তাক্ত শরীর জুড়ে
ধর্মান্ধ মানুষের আদিম উল্লাস !

তিমিরের নির্লিপ্ত স্তব্ধতা প্রান্তর জুড়ে,
ভালবাসার সীমান্ত জুড়ে প্রতিহিংসা, 
আগুনে পুড়ে যায় প্রতিবেশীর ছায়া শরীর, 
বিবর্ণ শূন্যতায় দুলছে ঘুমন্ত কাঁটাতার !

তোমার ভালবাসা ছুঁয়ে যায় আমার অক্ষর-বৃত্ত,
কবিতার পাতায় পাতায় লিখি 
তোমার অনাবিল সৌন্দর্য্যের মুগ্ধতা,
শ্বেতশুভ্র চাদর তোমার নগ্নতা ঢেকে দেয়,
সাগরের অফুরন্ত ভালবাসায় তুমি ভেসে যাও, 
তোমার হৃদয় জুড়ে গহীন অরণ্যের 
আলো আঁধারের মায়াবী ভালবাসা !
সবুজ প্রান্তর জুড়ে তোমার অপরূপ স্নিগ্ধতা
প্রকৃতি জুড়ে তোমার অপার রূপ মাধুর্য্য !

হৃদয়ের যাপনগন্ধী নিমগ্নতায়
সভ্যতার ক্যানভাস জুড়ে তোমায় আঁকি,
তোমার স্বপ্নে আমি অনন্ত রাত জাগি !
আমার জন্মভূমি,আমার মাতৃভূমি,আমার স্বদেশ,
তুমি আমার স্বপ্নমাখা মায়ের কোল !


 

দু বাহু বাড়ায়ে

চিত্রা পাল

আমাদের দেশের মানচিত্রের দিকে তাকালে মনে হয় যেন দেশমাতা দুবাহু বাড়িয়ে আছে আমাদের দিকে। আমরা তার কাছে নিশ্চিন্তে আছি। সত্যিই তাই।আর কি অপরূপ আমাদের দেশ, কি অপার বৈচিত্র্যময়। এমন বৈচিত্রের দেশ পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া ভার। পুব পশ্চিম উত্তর দক্ষিণ যে দিকে তাকাই, সেদিকই অন্যের থেকে ভিন্ন, একেবারে নিজের মতো। পাহাড়-পর্বত-মরু সবেরই সমন্বয় ঘটেছে আমাদের এই ভারতভূমে।উত্তর জুড়ে গিরিরাজ হিমালয় আকাশকে বিদীর্ণ করে রজতশুভ্র মুকুট ভালে দাঁড়িয়ে। আর সমুদ্র সে তো পুব পশ্চিম দক্ষিণ জুড়ে।পুবে মেঘালয় মণিপুর যেমন বৃষ্টিমুখরিত,পশ্চিমে তেমন মরুরাজ্য। অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরে মেঘালয়ের শিলাময় রাজ্যে, তেমন অনাবৃষ্টির জন্য কষ্ট পায় রাজস্থানের মরুবাসী। ওদিকে উত্তর পুর্বে যখন শৈত্যপ্রবাহ তখন দক্ষিণ পশ্চিমে আরামদায়ক আবহাওয়া। সারা ভারতে যে কত নদনদী আর তার উপনদী শাখানদী তার লেখাজোকা নেই। আমাদের এই উত্তরবঙ্গে যে কত নদী শাখানদী বয়ে চলেছে তার হিসেব রাখা ভার। তাদের জল সেচনে পলল বহনে যেমন চাষের অনুকূল, তেমন বাঁধনহারা বৃষ্টিতে দুকূল ছাপানো নদী বন্যাও আনে প্রায় প্রতি বছর।

যুগে যুগে দেশদেশান্তর থেকে নানান জাতি উপজাতি এ দেশেএকীভূত হয়েছে। হেথায় আর্য হেথায় অনার্য,হেথায় দ্রাবিড় চীন-/ শক হুনদল পাঠান মোগল এক দেহে হলো লীন।কালে কালে বংশানুক্রমে বসবাসের ফলে সবাই আমাদের দেশবাসী। এদেশ মহামানবের তীর্থভূমি।আমাদের ভারতের বাহু বন্ধনে বাস করি আমরা সবাই। 



 

জন্মভূমি 

মহঃ সানোয়ার 



ভারত আমার জন্মভূমি 
ভারত আমার দেশ। 
ভারত আমার মায়ের মতোই 
লম্বা কালো কেশ।

ভারত আমার শরীর জুড়ে 
ভারত আমার বুকে।
ভারত আমার রক্ত মিশে 
দুঃখ আমার সুখে।

ভারত আমার জন্মভিটে 
ভারত আমার স্বর্গ।
ভারত আমার জন্মভূমি 
ভারত আমার গর্ব। 

ভারত আমার উঠোন জুড়ে
কাঠগোলাপের গাছে।
দাফন হবো এই মাটিতে 
সেই ইচ্ছাই আছে।


 

কখন তাদের খাদ্য হবে
সঞ্জয় সাহা 

বাজপাখির চোখ দেখিয়ে কে যেন আজ আমায় ভয় দেকাচ্ছে!
শত্রুপক্ষের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি,মনের ভিতর কাঁপন ধরাচ্ছে!
কোনো এক অশনি সংকেত ঘুরপাক খাচ্ছে আমার চারিদিক!
   কোথাও কোনো আলো নেই!
 অন্ধকারে ছেয়ে গেছে, আমার চেনা দেশটা!
এই মুহূর্তে সমস্ত দেশটাকে কারা যেন অমাবস্যার চাদরে ঢেকে ফেলেছে ,
থমকে থমকে বেজে উঠছে যুদ্ধের সাইরেন --
মাথার উপর অত্যাধুনিক বিমানের মহড়া!
স্হলপথে সেনাদের ভারী বুটের পদধ্বনি!
আর জলেপথে নৌবাহিনীর তৎপরতা!
আমার বুকের ভেতরে বইছে হিমপ্রবাহ--
শ্মশানের নিস্তব্ধতার মধ্যেও চোখে ভেসে আসছে  অসংখ্য লাশ আর লাশ!
চোখে ভাসছে মহাভারতের সেই 
চেনা ছবির ক্যানভাস!
 শকুনেরাও শূন্য আকাশে চক্র কাটছে ....
    শুধুই অপেক্ষায় প্রহর গুনছে মনে 
                     কখন তাদের খাদ্য হবে !!


 

ভারতের রত্ন

বিপ্লব রায় 


তাজমহল নয় শুধু, রত্ন তো আরও বহু, 

চোখে পড়ে না সহজে, লুকায় হৃদয়ের রূপ। 

বিজ্ঞানী, কবি, কৃষক, সৈনিক— 

তাদের ঘামে গড়া ইতিহাস চিরকাল অম্লান । 

সংস্কৃতির আলো, ভাষার মালা, 

এই দেশ জুড়ে রত্নের জয়ধ্বনি বাজে নিরালা। 

ভারতের রত্ন মানেই জীবনের গর্ব গাথা।।


 

পতাকার মান 
মিষ্টু সরকার 

মিছিল এগিয়ে চলে.....
পতাকা হেঁটে চলে ।

সামনে শুধু দেখা যায় তাকে
একা নয় সে, নয় সেএকা 
ধরেছে তারে দুপাশে চারহাত
চারটি পাও সঙ্গতে একতালে ।
পেছনে যারা উজানে ভাসে;
ভাটার টানে তারাও আসে কাছে ।

চলছে অগণিত হাত -পা নেড়ে তারা 
এই মিছিলের এই পতাকার যারা 
একাগ্র  মন,  অগণিত  চোখ ,
একই  মন্ত্র  জপছে  তাদের  প্রাণ 
আমাদের পতাকা আর পতাকার আমরা 

স্বাধীন  দেশের  অন্দরে
অভিমুখী এই টান ,
সবার  সেরা  মায়ের  স্নেহ 
আর  পতাকার  মান ।


 

এই দেশেতে জন্ম আমার

মজনু মিয়া 


এই দেশেতে জন্ম আমার কী সবুজ দেশের বুক
এই দেশেরই সোনার ছেলে আহ্ উজ্জ্বল করে মুখ।
এই দেশে যে বয়ে চলে ছোট বড় নদী
এই দেশ আমার স্বপ্ন সাজায় লম্বা নিরবধি। 
দেশ মা আমার পূণ্যভূমি আমি দেশের তরে
প্রয়োজনে জীবন আমার দেই উৎসর্গ করে।
যতদিনই বাঁচি আমি গর্ব দেশকে নিয়ে
যা পারি তা দিয়ে যাব দুহাত ভরে দিয়ে। 
দেশ যে আমার স্বপ্ন চোখে আশার আলো ধরে
এই দেশেতে জন্ম নিয়ে গর্বে বুক যায় ভরে।


 

আমাদের ভারতবর্ষ
 অভিমন্যু


ভারত আমার জন্মভূমি ভারত আমাদের মাতৃভূমি                    
ভারতের পূর্বে মায়ানমার বঙ্গোপসাগর বাংলাদেশ
পশ্চিমেতে আরব সাগর দক্ষিণে ভারত মহাসাগর
এই দেশেতে জন্ম নিয়ে আছি আমরা সতেজ বেশ।

উত্তরে নেপাল ভূটান বরফ চূড়া পাহাড় হিমালয়
গঙ্গোত্রী থেকে ভাগীরথী হয়ে গঙ্গা সাগরে প্রণাম,
ধনধান্য পুস্পভরা ভারত ভারতভাগ‍্যবিধাতার জয়
কত স্মৃতি রোমন্থন হয় ভারতবর্ষ সূর্যের এক নাম।

ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা
মুক্তির মন্দিরে সোপান তলে সেথা আছে অশ্রুজল
হও ধরমেতে ধীর হও করমেতে বীর বিপ্লবের ধ্বজা
কারার ঐ লৌহ কপাট ভাঙে পরাধীনতার শৃঙ্খল।

পলাশীর যুদ্ধ সিপাহী বিদ্রোহ বঙ্গভঙ্গ লর্ড কার্জন
ভগৎ সিং প্রফুল্ল চাকী ক্ষুদিরামের আত্মবলিদান
মাষ্টারদা বাঘা যতীনের বিপ্লব বিনয় বাদল দীনেশ
নেতাজি রবি মহাত্মা স্বাধীনতা সংগ্ৰামীর অবদান।

জালিওয়ানওয়ালাবাগ রাসবিহারীর আজাদ হিন্দ
ভারত ছাড়ো আন্দোলনে মন্ত্র স্বদেশ আমার ভাষা
ভারত মাকে প্রণাম জানাই বন্দে মাতরম বলে গো
জনগণমন অধিনায়ক প্রকৃতির সুন্দর সৃষ্টির আশা।


 

স্বদেশ আমার স্বপ্ন 
আশীষ কুমার চক্রবর্তী

ধন্য হয়েছে স্বপ্ন আমার  জনম হলো ধন্য 
ভারতবর্ষ আমার স্বদেশ আমার মূল মন্ত্র।
এক মন্ত্রে দীক্ষিত মোরা একই মোদের গান
জনগনমন অধিনায়ক আর বন্দেমাতরম্।
পাহাড়,নদী,সবুজ বনানী,পুণ্য সলিলা গঙ্গে
বহিয়া চলেছে কুলুকুলু রবে অপরূপ তার ছন্দে।
এই ভারতের মহামানবের সাগর তীরে
বরণীয় যাঁরা বরণ করে রেখেছি অন্তরে।
যত মত তত পথে গড়া মোদের এই স্বদেশ 
বিশ্বাস রাখি সনাতন ধর্মে নেই হিংসা বিদ্বেষ। 
ভারতমাতার সন্তান মোরা,এই হলো পরিচয়
একই রক্ত মোদের বুকে রবে চিরদিন অক্ষয়।
হেসে খেলে সুখে এই মায়ের কোলে
আনন্দে কাটাই দিন রসেবশে।


 

আমার ভারত
প্রিয়াঙ্কা চক্রবর্তী 

     সত্য ন্যায়ের এক জাগরণ,
                 ঐক্যের এক জ্বলন্ত অঙ্গার;
         এক এবং অদ্বিতীয়, 
             সংগ্রামের এক পবিত্র প্রতিমূর্তি,
       আমার ভারত;
         ঈর্ষা ও দ্বেষ বিষাক্ত ধোঁয়ার কুয়াশা,
           অন্ধকারের শেষে;
             নতুন আলোর দিশারী-
               আমার ভারত।।