Sunday, June 1, 2025


 

স্বদেশ আমার স্বপ্ন গো

অনিতা নাগ 


ভারতবর্ষ সূর্যের এক নাম
আমরা রয়েছি সেই সূর্যের দেশে
লীলা চঞ্চল সমুদ্রে অবিরাম
গঙ্গা যমুনা ভাগিরথী যেথা মেশে।

এই গানটা বড্ড প্রিয় অনুর। ইতিহাস আর ভূগোলে কোনোকালেও ভালো ছিলো না অনু। ১০০ তে ৪০ ছিলো পাশ নম্বর। মেরে কেটে ৪৪। মনে রাখতে পারতো না অতো যুদ্ধ, অতো দেশ মহাদেশের নাম। শুধু পলাশীর যুদ্ধ মনে থাকতো, মনে থাকতো মিরজাফরের নাম। তারজন্যই তো বাংলার নবাব সিরাউজদৌল্লা পরাজিত হয়েছিলেন। কতো রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, কতো জীবনের বিনিময়ে আজকের স্বাধীনতা। বাবা ম্যাপ পয়েন্টিং শেখাতেন। গ্লোব ছিলো না বাড়ীতে। অ্যাটলাস বইতে রঙীন ম্যাপ দেখিয়ে বাবা চেনাতেন। হাজার দেশের মধ্যে থেকে ভারতবর্ষকে চিনতে ভুল হতো না অনুর। ভারতবর্ষের ম্যাপের উপর ট্রেসিং পেপার রেখে বারবার পেন্সিল বুলিয়ে অভ্যেস করতে করতে কখন যে ভারতবর্ষের ম্যাপ আঁকায় বেশ সড়গড় হয়ে গিয়েছিলো তা নিজেও টের পায় নি। আর ভারতবর্ষের ম্যাপের ডান দিকে পশ্চিমবঙ্গ। পশ্চিমবঙ্গের কলিকাতা, এখন কলকাতা অনুর জন্মস্থান। স্কুলের পাঠ্যবইতে নানান মণীষীদের জীবনী পড়ানো হতো। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, নেতাজী সুভাষচন্দ্র, ঋষি অরবিন্দ। দেশের জন্য তাঁদের ত্যাগ, তাঁদের বলিদান কোনোদিন ভোলার নয়। ২৩শে জানুয়ারী পাড়ায় নেতাজী সুভাষচন্দ্রের ছবি দিয়ে সৌধ সাজানো হতো রঙীন কাগজ দিয়ে শিকলি বানিয়ে সাজানো হতো। ঠিক দুপুর বারোটায় শাঁখ বাজিয়ে প্রণাম জানানো হতো। জাতীয় পতাকা উড়তো। দেশাত্মবোধক গান গাওয়া হতো। সে এক হৈহৈ ব্যাপার। দেশনায়কের জন্মদিন। তার দু'দিন পরেই প্রজাতন্ত্র দিবস। সে'দিন ও পাড়ায় জাতীয় পতাকা উত্তোলন হতো। সকাল সকাল স্কুলে যেতে হতো। স্কুলে কতো অনুষ্ঠান হতো। একবার তো প্রজাতন্ত্র দিবসের সরকারী কুচকাওয়াজে অংশ নিয়েছিলো স্কুল থেকে। এমন কতো স্মৃতির কোলাজ ধরা দেয় মনের আয়নায়। স্বামীর কর্মসূত্রে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশে থেকেছে অনু। ভাষাগত দূরত্ব থাকলেও ভারতবর্ষের মূল সুরটা সব জায়গায় একই ছিলো। ছেলেমেয়ের পড়াশোনা দক্ষিণ ভারতে। তারা তেলেগু ভাষা যেমন রপ্ত করেছিলো, সাথে বাংলা, হিন্দী, সংস্কৃতও সমান গুরুত্ব দিয়ে শিখেছিলো। কোথাও কোনো বিরোধ ছিলো না। আজকাল সব যেনো কেমন অন্যরকম। আমার আমার করে চারদিকে হৈহল্লা। আরে বাবা সবটাই তো আমার। সবটা নিয়েই তো আমার দেশ। সবাই মিলে আগলে রাখলে সাধ্য কি অন্য কোনো শক্তি তার মধ্যে থাবা ফেলে! 
একবার কিছুদিনের জন্য ঢাকা গিয়েছিলো অনু৷ কর্মসূত্রে মেয়ের তখন ঢাকায় বাস। কলকাতা বিমানবন্দর থেকে চল্লিশ মিনিটের যাত্রাপথ। চল্লিশ মিনিট পর ঢাকায় পৌঁছানোর সাথে সাথে ঘড়ির সময় গিয়েছিলো বদলে। মোবাইল এর টাওয়ার গিয়েছিলো থেমে। একটা বেড়াজাল পেরোতেই ভারতবর্ষ কতে দূরে সরে গিয়েছিলো। সেই প্রথম অনুর খুব কষ্ট হয়েছিলো দেশের জন্য। অসহায় মনে হয়েছিলো। অলক্ষ্য এক সীমারেখা আলাদা করে দিয়েছিলো তার দেশকে। সেই সীমারেখা দেখার বড় সাধ ছিলো অনুর। ভাগ্যের পরিহাসে সে সুযোগ ও হয়েছিলো। আগরতলা হয়ে দেশে ফেরা। মেয়ে এসেছিলো বর্ডার অবধি পৌঁছে দিতে। ইমিগ্রেশন সেরে যেই না বর্ডার সিকিউরিটির গেট পেরিয়ে ওপারে গেলো সময়ের কাঁটা বদলে গেলো, মোবাইলে টাওয়ার লোকেশন ফিরে এলো। একটা গেটের ওপারে বিদেশে রইলো মেয়ে, অনুরা এসে পড়লো ভারতবর্ষের সীমানায়। হাপুস নয়নে অনু তাকিয়ে রইলো। ঐ যে মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওপারে। ক্রমশঃ দূরত্ব বাড়লো। একটা সীমা রেখা তার ভারতবর্ষকে কেমন আলাদা করে ফিরিয়ে দিলো তার কাছে। শত কষ্টে, শত যন্ত্রণাতেও এই তার সাধের দেশ। এখনকার ডিজিটাল দুনিয়ায় সবটাই বড় সহজলভ্য। কিন্তু সে'দিনের সেই লড়াই সহজ ছিলো না। কতো প্রাণের বলিদানে পাওয়া এই স্বাধীণতা। জীবনের এই পড়ন্ত বেলায় আলিপুর জেল মিউজিয়ামে গিয়েছিলো অনু। না গেলে কতো কিছু জানা হতো না। ইতিহাসের পাতার বাইরে তাদের যন্ত্রণাময় দিনগুলো রয়েছে আলিপুর জেলের আনাচ কানাচে। ফাঁসির মঞ্চের ঠিক সামনে বড় বাড়ীর জানলায় সব বন্দীদের দাঁড় করিয়ে ফাঁসি দেখতে বাধ্য করা হতো। আলিপুর জেলে তখন প্রতিধ্বনিত হতো ‘বন্দে মাতরম’। হাসতে হাসতে ফাঁসির মঞ্চে উঠতেন বীর যোদ্ধারা। শত যন্ত্রণা হাসিমুখে সহ্য করে দেশ মাতৃকাকে যারা মুক্ত করেছেন তাদের প্রতি শ্রদ্ধায়, সম্মানে নত হয় অনু।
আজকের যুগে বড্ড দ্রুত বদলে যাচ্ছে সবকিছু। দেশ ডিজিটাল হচ্ছে, আগে বাড়ছে। সে ভালো কথা। কিন্তু সেই এগিয়ে চলার পথে রাজনৈতিক দিশারীদের অন্ধকারময় জীবন বড় আশাহত করে। কি রেখে যাবে আগামী প্রজন্মর জন্য! মিথ্যা আর অন্ধকারময় জীবনের হাতছানিতে তারা যেনো হারিয়ে না যায়। বড্ড ভয় করে অনুর। সহজে উপরে উঠতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ছে সব। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্ম, সবেতে শুধু মিথ্যার জয়। যোগ্যতা থাকলেও মূল্যায়ন হচ্ছে না। ছেলে মেয়েরা স্বদেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে শিক্ষা ও কর্মের খোঁজে। অসহায় বাবা মা’রা মুঠোফোনে নিজেদের সচল রাখতে শিখছে। অনুও তার ব্যাতিক্রম নয়। তবু যতক্ষণ শ্বাস, ততোক্ষণ আশ। ‘ভারত আবার জগত সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে’, এই আশা নিয়ে আগলে রাখে অনু ভারতবর্ষের মানচিত্রকে বুকের মধ্যে। সেই ছোটবেলায় ম্যাপ পয়েন্টিং এ শেখা ভারতবর্ষের মানচিত্রকে আগলে রাখে পরম সোহাগে, পরম যত্নে, পরম শ্রদ্ধায়।

No comments:

Post a Comment