Sunday, September 1, 2024


 

সম্পাদকের কথা 

গত মাসে যখন মুজনাইয়ের পরবর্তী সংখ্যার বিষয় জানানো হয়, তখনও স্বপ্নেও ভাবিনি এই শহর এই জীবন কী মারাত্মক হতে চলেছে। রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর প্রয়াণের ঠিক পরদিন যে ভয়ঙ্কর ঘটনা আমরা জানতে পারলাম, তার থেকে নারকীয় কিছু হতে পারে তা কল্পনাও করা যায় না। নিজের কর্মক্ষেত্রে মানবসেবার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে যিনি আসীন, তাঁকে যদি এভাবে ধর্ষিতা ও নিহত হতে হয়, তবে তার চেয়ে দুর্ভাগ্য আর কিছুই হতে পারে না। এই জীবন, এই শহর কি আমরা চেয়েছি আদৌ? এই কি আমাদের নাগরিক নিরাপত্তা? এই কি আমাদের মনন? 

মারাত্মক এই ঘটনার পরেও প্রশাসনের ভূমিকা আমাদের ব্যথিত ও ক্রুদ্ধ করেছে। তছনছ হয়ে গেছে আমাদের এতদিনের সব ধ্যানধারণা। অবশ্য যথারীতি এর মাঝেও ফায়দা তুলতে নেমে পড়েছেন অনেক ধুরন্ধর। ক্রমাগত পিছিয়ে যাচ্ছে দোষী বা দোষীদের সনাক্তকরণ ও ন্যায় বিচার। 

রাষ্ট্রের এই ভূমিকায় আমরা স্তম্ভিত। কিন্তু দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে আমাদের। কিন্তু এর শেষ না দেখে থামতে চাই না আমরাও। আমাদের ঘরের সন্তানকে এভাবে মেরে ফেলা হবে, আর আমরা চুপ করে থাকব, সেটা কখনই হতে পারে না। এই রাজ্য তথা দেশের প্রত্যেক নারীর নিরাপত্তা, সম্ভ্রম ও সম্মান যতদিন না আমরা সুনিশ্চিত করতে পারছি, ততদিন হয়ত আমরা নিজেরাও আয়নায় মুখ দেখতে পারব না।   



মুজনাই অনলাইন ভাদ্র  সংখ্যা ১৪৩১


 রেজিস্ট্রেশন নম্বর- S0008775 OF 2019-2020

হসপিটাল রোড 

কোচবিহার 

৭৩৬১০১

ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com (মাসিক অনলাইন)

ক্রোড়পত্রে ব্যবহৃত সংগৃহিত  ছবি- যামিনী রায়   

প্রকাশক- রীনা সাহা    

সম্পাদনা, অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায়

 প্রচ্ছদ- মর্নিং আউটডোর গ্ৰুপ, কোচবিহার 

(* প্রচ্ছদ ছবিটি তিলোত্তমার ধর্ষণ ও নির্মম হত্যার প্রতিবাদে ও 

দ্রুত ন্যায় বিচারের দাবিতে   

কোচবিহারের লেখক-শিল্পী-নাট্যকর্মীদের আয়োজিত প্রতিবাদ মঞ্চে আঁকা)


মুজনাই অনলাইন ভাদ্র সংখ্যা ১৪৩১ 


এই সংখ্যায় আছেন যাঁরা

কনক চক্রবর্তী, বেলা দে,  অমলকৃষ্ণ রায়  

গৌতমেন্দু নন্দী, পার্থ বন্দোপাধ্যায়,  পর্ণা চক্রবর্তী, 

আফতাব হোসেন, রুদ্র সান্যাল, অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী,

জয়িতা সরকার, দেবযানী ভট্টাচার্য, ঋতুপর্ণা ভট্টাচার্য, 

বটু কৃষ্ণ হালদার, অনিতা নাগ, জয়তী ব্যানার্জী, 

শুভেন্দু নন্দী, জনা বন্দোপাধ্যায়, অমিতাভ চক্রবর্তী,

লিপিকর, প্রদীপ কুমার দে, সন্তোষ ভট্টাচার্য, 

রুদ্র, গৌতম সমজদার, সম্মিলিতা দত্ত, 

সঞ্জয় সরকার, মজনু মিয়া, মনীষিতা নন্দী, 

প্রাণেশ পাল, কেতকী বসু, অলকানন্দা দে, 

শ্রাবণী সেন, অঙ্কুরিতা দে, প্রতিভা পাল, 

নিতাই দে, মিষ্টু সরকার  


 

স্লোগান

আফতাব হোসেন


রাত তিনটে , সেকেন্ড ফ্লোর ।

ঘুম আর আসবে না ধরে নিয়েই ধীমান বাথরুমের দিকে এগোয় । সুলেখা বেঁচে থাকার সময় খিটখিট করতো বেশ । মশারী তুলে বাথরুমে যাওয়ার সময় নাকি মশা ঢোকে বেশি । সে নিয়ে রোজ অশান্তি ছিল একসময় । এ শহর মানুষের চেয়ে বেশি মশাদের এ নিয়ে তর্কও হয়েছে বেশ কয়েকবার । তবে ওই যে , নামেই স্ত্রী , পুরুষদের সাধ্য কোথায় জিতবে । এমনকি করোনার সময়কালেও ইহ জগৎ ছাড়ের কম্পিটিশনেও সুলেখা হারিয়ে দিয়েছে তাঁকে । থাক সে সব । ইদানিং বড্ড খেই হারিয়ে ফেলছে ধীমান । চোখের সামনে সবসময় ভাসতে দেখছে অতীত । গুগল পড়ে দেখেছে ধীমান বয়সকালে এ সব হয় । যে সব অতীত অবচেতন হয়ে নিজেকে এককালে পুরুষ করে তুলেছিল , সে সব অতীত বড্ড নিঃসঙ্গ করে আজকাল । সে প্রায় বিয়াল্লিশ বছর আগে সুলেখার বাবার হাত থেকে রাজদূত নেবার সময় সুলেখার চোখ এর চাউনি হোক , কিংবা আট মাসের মেয়ে মহুয়ার জন্মদিনের দিনেই বংশ রক্ষায় রাহুল কে আমার পরিকল্পনা, কোনটাতেই কেন যে সুলেখা বাধা দেয়নি সে নিয়ে আজও মাঝে মাঝে অনমনা হয়ে পড়ে ধীমান । ছেলে মেয়ের ভরা সংসারে রাহুলকে চার বছর বয়সে রামকৃষ্ণ মিশনে , চোদ্দপুরুষের  উঠোনবাড়ির তুলসী গাছের মায়া ছেড়ে থ্রি বি এইচ কে কিংবা মহুয়ার পছন্দের ছেলেকে না করে একটু বেশি বয়সের স্কুল মাস্টারের সঙ্গে মহুয়ার বিয়ে , কোনটাতেই সুলেখা বাধা দেয়নি । শুধু তাকিয়েছে এক বার । সেই তাকানো গুলো বড্ড মনে পড়ে ইদানিং ধীমানের । অথচ ধীমানের দোষ নেই , ধীমান সারাজীবন সংসারের কথাই ভেবেছে ।

বাথরুম থেকে এসে জানলার সামনে দাঁড়ায় ধীমান । দূরে কোথাও স্লোগান ভেসে আসছে । রাত বাঁচানোর লড়াই এর স্লোগান । মেয়ে বাঁচানোর স্লোগান । রাত দখল করার স্লোগান । কোন স্লোগানই স্পষ্ট নয় ধীমানের কাছে । তাও স্লোগান গুলোর আবছা স্বরে ধীমানের কষ্ট হচ্ছে খুব । জানলা গুলো টাইট করে বন্ধ করে ধীমান চিৎকার করে উঠবে নাকি !

চিৎকার করে বলবে নাকি ?

সুলেখা ক্ষমা করে দিও ...কেন ? কে জানে ?

স্লোগান এখনো চলছে ।

 
*********

 ভোর চারটে, ফার্স্ট ফ্লোর ।

ধড়পড় করে উঠে বসে বিহান । লজ্জায় নাকি অভ্যেসে নিজের উলঙ্গ শরীরটাকে ঝটপট করে ঢাকতে গিয়েও মিসেস রয় এর শরীরটা দেখে সামলে নেয় খানিক । একটা উলঙ্গ থলথলে পঁয়তাল্লিশ এর মেয়ে শরীর, কত নিশ্চিত ঘুমিয়ে । অথচ এই শরীরটাই রাতভর কতই না বিকৃত লালসা মিটিয়েছে বিহানের ওপর । বিহান অবশ্য এ সবে অভ্যস্থ । এ শহরের সব ময়লা মেখেও নিজেকে পলিসড করার প্রসেস বিহান জানে । কতই বা বয়স তখন , মেরে কেটে বাইশ । ওর মা বলতো ছেলেই আমার দুধে আলতা, বউমা খুঁজে আনা খুব কঠিন । লজ্জায় লাল হত বিহান । মৈত্রী কাছে আসার পর লজ্জাটা বেড়ে আরো লাল হচ্ছিল । গালিবের সায়েরি আর অরিজিৎ এর স্লো মোশন । মৈত্রীর চুমু খাওয়ার ব্যস্ততায় বিহান বুঝিয়েছিল মৈত্রীকে সিঁথির সিঁদুর আর রোম্যান্সের কম্বিনেশন ।

তারপর লক ডাউন । শহর ,পেটের ভাত কাড়লো বিহানের বাবার আর ভাইরাস কাড়লো ছাদ আর মায়ের আঁচল । রূপ আর লাল লজ্জা যে মৈত্রীর মাথার সিঁদুরের যোগ্যতা হতে পারে না সে অভিজ্ঞতা বিহানকে কখন আজকের এই ' দেশী বয়েস ' মার্কা বিহান করলো সে  নিজেও গুছিয়ে উঠতে পারে নি আজ অব্দি । স্বপ্নের যে রাতগুলো সিঁদুর আর ফুলশয্যার শায়েরিতে সাজিয়েছিল , প্রতিরাতে ধারালো নখের আঘাতে ছিন্ন ভিন্ন হয়েও বোবা হয়ে ফুলশয্যা ভোগ করে বিহান । রোজ ।  কাস্টমার দের বলেও দেয় ওর ট্যাবুর কথা , ফ্যান্টাসির আগে একটু সিঁদুর , ব্যাস ।

শাওয়ার শেষে নিজেকে পরিপাটি করে ফার্স্ট ফ্লোরের ফ্লোরের দরজা খুলে বেরিয়ে যাওয়ার সময় স্লোগান শুনলো বিহান । এ শহরের নারী পুরুষের সমান সমান হওয়ার স্লোগান । রাত গুলো সবার জন্য সমান হোক স্লোগান । সিঁড়ি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে স্লোগান শুনে বড্ড হাসি পেল বিহানের । পকেটে হাত ভরে হদিস পেল সিঁদুর কোটটার । কৌট ছুঁয়ে

বিহান হাসছে বড্ড ...

হাসতে হাসতে চোখে জল এলো বলে ,

স্লোগান তখনো চলছে ।

 
***********

ভোর পাঁচটা , গ্রাউন্ড ফ্লোর ।

ফুলমতি বাচ্চাটাকে আর এক রাউন্ড ঘুম পাড়িয়ে , জগজিৎ কে পাঠায় মিউনিসিপ্যাল এর কল থেকে জল আনতে । ভোর বেলায় ভিড় কম থাকে বলে জগজিৎ সারাদিনের পানি ভরে নেয় এ সময় জ্যারিকেনে । ফুলমতিও এ সময় ওর থাকা পছন্দ করে না । ফ্ল্যাটের লিফ্ট ম্যান টু সিকিউরিটি , সব এক হতেই সামলাতে হয় জগজিৎ কে । ফুলমতি ঝাড়ু পোছা সামলায়। গ্রাউন্ড ফ্লোরে লিফট্ এর পাশের এক কামরার জায়গাটা এখন সংসার ওদের ।

ফুলমতির ঝাড়ু পোছা সদ্য শুরু ,

পায়ের আওয়াজ শুনে ফুলমতির মনে হয় সেকেন্ড ফ্লোরের বুড়া বাবু নামছে , মর্নিং ওয়াকে । বুকের ওড়নাটা একটু এলোমেলো করে রাখে ফুলমতি , পুরুষের নজর ছোট থেকেই চিনে মনে হয় । রোজ দশ টাকা পায় ফুলমতি বাবুর কাছে । বুড়া বাবু ভালো মানুষ না কি ওড়নার দাম দশ টাকা কে জানে । ফুলমতি শুধু জানে গেল মাস থেকে আমূল দুধের দাম দশ টাকা হয়েছে ।

তবে আজ বুঝতে ভুল করলো মনে হয় । বাবুর বদলে ফার্স্ট ফ্লোরের মালকিন নামছে কাকে যেন খুঁজে ।

না পেয়ে ফেরার আগে শাসিয়ে গেল ফুলমতির দিকে চেয়ে ,কাপড় ঠিক করে পরার জন্য , না হলে জগজিৎ সমেত তাড়াবে।

ফুলমতির মন খারাপ । নিজের জন্য নাকি মালকিনের বকা খাওয়ায় কে জানে ?

দূরে স্লোগানটা এখনো বাজছে...

কাকে বাঁচাতে কে জানে ...



 

এই শহর,এই জীবন
রুদ্র সান্যাল

"পুরানো দুঃখ গুলো আজকাল মৃদু ঢেউ হয়ে/ সুখের মতন ফিরে আসে।/ তাদের বয়েস ও শরীর আছে/ ইচ্ছে অনিচ্ছে আছে/ তারা দেখা হলেও কথা বলে না।" সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার শব্দ গুলির মতন আজকাল ফিরে ফিরে আসে আমার শহর। বোবা চাহনিতে শুধু তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। 

শহর, এক চিরচেনা শব্দ যা আমাদের জীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। এই শহরের আলো হট্টগোল,জনজীবনের তীব্র কোলাহল এবং রাস্তার ব্যস্ততা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই শহর আমাকে অনেককিছুই আজ শিখিয়েছে। এখানে একা পথচলা, নিজেকে গড়ে তোলা এবং সেই সাথে মানুষের ভিড়ে নিজেকে নতুন করে খুঁজে পাওয়া সবকিছুই আমার শহরের অবদান। 

আমার শহরের আলো আঁধারির মাঝে অজস্র লুকিয়ে থাকা গল্প, যা অনেক ক্ষেত্রেই জীবনের গল্প কেও হার মানায়, সেখানে মিশে থাকে হাসি কান্না আর ইট পাথর এবং কংক্রিটের যান্ত্রিক জীবনের মাঝে লুকিয়ে থাকে অনেক ইতিহাস। 

এ শহর আমাকে শিখিয়েছে নতুন সম্পর্ক নতুন বন্ধু এবং নতুন ভাবনা কিভাবে নিজের জীবনকে নতুন ভাবে আন্দোলিত করতে পারে তার দিশা। এই শহর শিখিয়েছে জীবনের প্রতিটি পর্বে কিভাবে প্রতিকূলতার মধ্যে থেকে নিজের পথ খুঁজে নিতে হয়। আশা নিরাশার মাঝে এই শহর আর এই জীবন একে ওপরের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। শহরের প্রতিটি দিন-রাত প্রতিটি মুহূর্ত আমাদের জীবনকে নতুন গল্প শোনায়। তবুও এই মধ্যবয়েসে এই শহর কেও মাঝে মাঝে কেমন যেন অজানা লাগে, বোবা চাহনিতে সে যেন আমাকে শুধুই বলতে চায়, " শেষ পর্যন্ত তুমিও যান্ত্রিক হয়ে গেলে!"


 

দহন বেলা 
অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী 


অলিন্দের থেকে ভাঙা থামের উপরে বসে দেখি 
চত্বরের মাঝখানে স্থগিত শবের চারপাশে 
শরিকেরা অন্ধকারে আসাড় মুদিত হয়ে আসে 
ধুনিগুলি জ্বেলে নিয়ে তৃতীয় চোখের দিব্যতায়।
                                                                      -শঙ্খ ঘোষ


একটি ইঁট-কাঠ-পাথরের জনবসতি, তার অলিন্দে জমা করা কতশত ইতিহাস, পরিবর্তন, বিবর্তন, আপাত উন্নয়ন, এবং ‘কতিপয়’ ক্ষয়িষ্ণু ঐতিহ্য। গড়িমসি বিহীন জীবনে সূর্যোদয়ের গেরুয়াতেও ব্যস্ততার রং। নিঃসীম ছুটে চলা। লোকাল ট্রেন, মেট্রো, বাস, অটো - সর্বত্র নাগরিক অরণ্য। পিচডালা রাস্তায় গাড়ির সারি, সিগন্যালে লাল আলো, জ্যাম, মিছিল, অবরোধ, স্লোগান। ফুটপাথ জুড়ে হকার, অগুন্তি ব্যস্ত পায়ের পাতা, “দু’টাকা দাও মা, খেয়ে বাঁচি”-দের ওরাংওটাং চালচুলো। আকাশের গায়ে সিঁটিয়ে থাকা হাসপাতাল, নার্সিংহোম জুড়ে   চিকিৎসা আর চিকিৎসকের, থুড়ি পাপ আর পুণ্যের চু কিৎ কিৎ। ট্রেনের কামরায়, গাড়ির জানলার কাঁচে হঠাৎ হঠাৎ বৃহন্নলাদের  উঁকিঝুঁকি। রঙচঙে সাজে পথের ধারের কিছু অস্তিত্বের টিকে থাকার অভ্যেস, শুকনো বেলির মালায় নিষিদ্ধপল্লীর কিছু রাতজাগা গল্প। কিছু অবৈধ প্রেম, ভ্রূণহত্যা, উচ্ছ্বাস ও উন্মাদনার কিছু রাতের ঠেক, নেশার আখড়া, চোরাকারবার, অন্ধগলি, কিডন্যাপ, ধর্ষণ, খুন। ভৌগলিক লক্ষণরেখা পেরিয়ে অবয়বের পুণরাবৃত্তি বা ঈষৎ হেরফের।

ঘরে বাইরে লক্ষাধিক মানুষের জীবন নির্বাহের অভ্যেস এই শহুরে ঘড়ির সাথে ঘূর্ণায়মান। প্রাত্যহিকতার সেই ধারাবাহিক সুরকে হোঁচট খেতে হয় কোন পৈচাশিক শিরোনামে। ছিটকে পড়ে জীবন নামক নাগরদোলার আরোহীদের গোলাপী চশমা। চেনা থেকে ক্রমশ অচেনা হয়ে ওঠার সেই ঘ্রাণ ছেলেধরার গল্পের মত ছড়িয়ে যায়। থেকে থেকে কাঁটা দেয় গায়ে, একঝাঁক জুজুবুড়ি এসে ছোট্ট মেয়েটিকে দুঃস্বপ্ন দেখায়।ইচ্ছায় অনিচ্ছায় কিছু অবিশ্বাস চিরতরে বাসা বাঁধে মনের অন্ধ কোটরে। বাড়ি থেকে বহুদূরে নতুন জীবনে অভ্যস্ত হবার মুখে প্রবল এক ঝাঁকুনি দিয়ে যায় দানবিকতার বাস্তবচিত্র। গুটিয়ে যায় অদম্য উদ্যম। একলা ঘরে মধ্য রাতে ঘাড়ের কাছে জান্তব নিঃশ্বাস টের পায় যেন অবচেতনে। অসংখ্য চেনা মানুষের ওপর অচিরেই অপ্রতিরোধ্য অবিশ্বাস বীজ বুনে চলতে শেখে তারা। মন বলে এই নীল সাদা গোলকে একলা নারীর কাছে সকলেই তো অচেনা।প্রাণভরে বিশ্বাস করা যেন দুর্বলতা, হাতের বেড়ের আগলে নেওয়ার আশা তখন অলীক। 

কলেজের ল্যাবরেটরি, লাইব্রেরী, শপিং মল, বাসস্ট্যান্ড, অটো বা রাস্তার মোড় - নির্জনতার সুতোয় নিরাপত্তাহীনতার ফাঁদ বুনে চলা। বহুতল অফিসের লিফটের চার দেওয়ালে কাঁটা হয়ে থাকা মন। সাবলীল স্বাধীনতা শুধু অতীতের সুখকর স্মৃতি। দিনের মানববিহীন পথ, রাতের রহস্যময় আলো, বাধ্যতামূলক দূরপাল্লার ট্রেনের শৌচাগার শুধু তাড়া করে ঘরের দিকে। কিন্তু, এ কথা জানা, ঘরের চারদেয়ালও তার নিরাপত্তার ঠিকানা নয়! রাজনৈতিক কালিমা লেপন, নাটকীয়তার মোড়কে মিডিয়ার ম্যাজিকাল চমক, আবেগহীন গড্ডালিকা প্রবাহে বিচারের বাণীর নীরব হাহাকার। বিকেলের শহরে সুগন্ধী মাধবীলতা যখন মেয়েকে বহুদূরের বাড়ির উঠোনকে মনে করায়, ঠিক তখন ছোট্ট শান্ত নাম-না-জানা পাড়াগাঁয়ের গাছে গাছে খেলে বেড়ানো ছোট্ট চঞ্চল পাখিটি মায়ের মনে মেয়ের শিশুবেলার ছবি আঁকে। আদ্র চোখে ছায়া পড়ে নিরবিচ্ছিন্ন অসহায়তার। সর্বজয়া হয়েও শুধুমাত্র নারী বলেই নিজের ভাগ্যের কাছে পরাজিত হয়ে এই লাঞ্ছনার পথচলা? পৈশাচিক অত্যাচারের কাছে হেরে যাওয়ার অন্ধকারময়তায় 'পরোয়া করিনা’-র বুলি তখন অবাঞ্ছিত দুঃসাহস। দুরাচারি, নরখাদকের থাবায় পিষ্ট তরতাজা প্রাণের উচ্ছ্বাস! কেন? উত্তর মেলেনা। মেলেনা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, সুবিচার। প্রতিবাদীর হাতের দীপ্ত মশালও এক রাতে নিভে যায় বিষাক্ত ঝোড়ো হাওয়ার দুরাভিসন্ধীতে।

                  তবুও, হয়তো থাকে কিছু আলোর পথ। নানান ফাঁদে গুলিয়ে দেওয়া আইনকানুনের ভুলভুলাইয়ার অন্ধ অলিগলি বেয়ে হয়তো বা একবিন্দু অংশু পথ দেখায় শক্তিশালী প্রতিবাদের, শপথ জারি থাকে দোষীদের কঠোরতম শাস্তির।

                    যে আলোর ইমারত সর্পিল পথের নিস্তব্ধতার কাছে এ শহরের তিল তিল করে গড়ে ওঠা ঐতিহ্যের ও গরিমার গল্প করতো, আজ সে বা তারা আঁধারে মুখ ঢাকে। তাদের দলিত করে শত সহস্র মানুষের পদযাত্রা এগিয়ে যায় আলোর অভিমুখে। শ্লোগানের ধ্বনি আর্তনাদ হয়ে শহরের বুক খানখান করে তোলে। ধিক্কার জাগে প্রলোভনে, প্ররোচনায়,অসত্যে, নিষ্ঠুরতায়। নীরবে বিচার চায় শহরের প্রতিটি ধূলিকণা। হারিয়ে যাওয়া দশভূজাদের অশ্রুজলের সঙ্গে আপামর নারীর ক্রোধাক্ত স্লোগান যেন অপেক্ষা করে ত্রিনয়নের দৈবিক দিব্যতার।


 

এই শহর এই জীবন ---

গৌতমেন্দু নন্দী


বিশাল এই পৃথিবীতে এশিয়া,ইউরোপ, আমেরিকার মতো বড় বড় মহাদেশ। তারমধ্যে এশিয়া মহাদেশের অন্তর্গত আমাদের দেশ এই ভারতবর্ষ এক উপমহাদেশ। এই উপমহাদেশ আবার অনেকগুলো  রাজ্য নিয়ে গঠিত। যে রাজ্যগুলি বেশ কিছু সংখ্যক জেলা নিয়ে গঠিত। প্রতিটি জেলা আবার একাধিক মহকুমার সমাহার। সেই মহকুমায় মধ্যে অবস্থিত  একাধিক শহর। সেই শহরগুলির কোন একটির  পৌরসভার বিশ-পঁচিশ বা তার অধিক ওয়ার্ডের  কোন একটি ওয়ার্ডের বাসিন্দা আমি বা আমরা। অর্থাৎ অসংখ্য বাসভবনের মধ্যে কোন এক নির্দিষ্ট আবাস স্থলের গৃহকোণেই  সাধারণত আমাদের শৈশব, কৈশোর,যৌবন এবং বার্ধক্যের  বিভিন্ন স্তরের জীবন যাপন নির্ধারিত হয়।

পৃথিবীর নিজস্ব নিয়মেই অক্ষরেখা, দ্রাঘিমা রেখায়ভৌগলিক অবস্থান এবং আহ্নিক গতি, বার্ষিক গতির নির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক নিয়মেই নিয়ন্ত্রিত হয় এই জীবন।শহর--নগরে বা গ্রামে--গঞ্জে।  ঠিক তেমনি সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয়  কাঠামোর উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের 
সামাজিক জীবন। আমাদের সমস্ত যাপনেই তাঁর  প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব। আমরা স্বাধীন হলেও 
 সাংবিধানিক নিয়ম-শৃঙ্খলের আগলে বাঁধা।
       আমাদের প্রত্যেকের নাগরিক জীবন ও যাপন সেই নিয়মের অনুসারী। সেই নিয়মেই প্রতিটি জীবন
দাবি করে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমতা। দাবি করে ন্যায়-নীতির সঠিক বিচার ব্যবস্থা এবং দাবি করে হিংসা -দ্বেষ মুক্ত এক সুস্থ সমাজ। যে সমাজে শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিকাঠামো আলোকিত হবে সঠিক  পরিবেশ ও পরিষেবার আলোকে। যে নাগরিক জীবন সুস্থ সংস্কৃতির বাতাবরণে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে। যে সমাজে অগ্রাধিকার পাবে নারী ও শিশু কল্যাণ। অর্থাৎ সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যহীন যে 
নাগরিক জীবনে থাকবে বিভিন্ন জাতি,ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক সৌভ্রাতৃত্ব বোধের অখণ্ড সংহতি।
        কিন্তু বর্তমানে এই শহর,নগর জীবন এক বিরাট প্রশ্নচিহ্নের সামনে। আমাদের শৈশব থেকে বেড়ে ওঠা এই শহর দিনে দিনে কেমন অচেনা হয়ে উঠছে।  উদ্ধত, বেপরোয়া, নিয়ম শৃঙ্খলা লংঘনকারীদের 
দৌরাত্ম্য ও আস্ফালনে অতিষ্ঠ আজ নাগরিক জীবন।  অনেক ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক প্রশ্রয়ের কাছেমাথা নত করে পুলিশ ও প্রশাসন। দলীয় রাজনীতির বাড় বাড়ন্তে অন্যায়ের বিরুদ্ধে অদলীয় নাগরিক প্রতিরোধকে অনেক সময় "মূল্য" দিতে হয় অপমানিত বা লাঞ্ছিত হয়ে। 
    
মাঝে মাঝে তাই মনে হয় শহর তুমি কার? গানের চারটি লাইন তখন খুব মনে পড়ে------

              " দিশাহীন চোখে খুঁজে যাই
                শুধু খুঁজে যাই কী আশায়
                    এ শহর বড় অচেনা 
                 কেউ বোঝেনা তাকে হায়..…"

    মূল্যবোধ হীন রাজনৈতিক ক্ষমতা সর্বস্ব, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে দুর্বিত্তায়ন সর্বস্ব এই নাগরিক জীবনে দুর্নীতির গুমোট বাতাস এখন যেন শ্বাস রোধ করতে চায়। স্বাধীন, গণতান্ত্রিক দেশে এই কি প্রতিশ্রুতি ছিল নাগরিক জীবনের? নারী নিগ্রহ ও ধর্ষণের পাশবিক উল্লাসেও আইনগত জটিলতায় বিলম্বিত অপরাধীর
শাস্তি ----এ কোন্ সমাজ?! কোন্ নাগরিক জীবন?! টাকার অংকে শিক্ষায় ডিগ্রী মেলে, অযোগ্যদের 
চাকরি মেলে, মোটা টাকার অংকে চুরি হয়ে যায়  মেধাবীদের স্বপ্ন ----এ কোন্ নাগরিক সমাজ?!

     এই সমাজ, শহরের জঞ্জাল সরবে কবে জানিনা। তবুও কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের স্বপ্ন নিয়ে আশাবাদী 
  হোতে কোন দোষ নেই ----তাঁর উচ্চারণই হোকনা আজকে আমাদের সকলের উচ্চারণ -------

       " এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি 
    নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার.…"


 

শহুরে আলাপ
জয়িতা সরকার

ঠিক দিক বুঝতে পারছি না, পূর্ব না উত্তর, আরে দরজা তো উত্তরমুখীই ছিল,  কেনার সময়  তেমনটাই বলেছিল, তবে তো ডান হাতের দিকে পূর্ব। দিক তো আর ঘুরে যায়নি, সময়টা শুধু এগিয়েছে। কতটা এগিয়েছে বলতে পারিস? ঠিক যতটা এগোলে দিক বোঝা যায় না। ভোর হতেই হলের জানলা দিয়ে প্রথম নরম আলো বলত বিছানা ছাড়ার সময় হয়েছে, শহরের ঘুম ভেঙেছে। সেসব দিন কি হারিয়ে গেল? না না, হারায়শহুরে আলাপনি, চোখ বুঝলেই দিব্যি আসে। 

নতুন দিনের প্রথম আলো, সেসব ভুলে যাওয়াই ভালো,  কবিতা কিংবা গল্পের পাতায় ঠাই নিয়েছে ওসব ভোলো। এমনটা হলো কেন? ওই যে ওরা এলো দলে দলে, ভিড় জমাল তোমার বুকে। উফফ ভীমড়ি খাই রোজ দিনে দুপুরে। অপেক্ষা করো আরও অনেক আছে বাকি, যেমন করে দিয়েছ ফাঁকি, সবটার হিসেব রেখেছে নাকি? 

হো হো স্বরে হাসছে কারা? ওই ইমারতের দখলি যারা। থামাও এবার রসিকতা, বলো তোমার শহুরে কথা।
        এলাম নতুন দেশে, রাত নামলেও রাস্তাঘাটে যেন দীপাবলি, হুমম, প্রথম যখন প্লেনটা রানওয়ে ছুঁল এমন চকচকে জায়গা আমার তল্লাটে ছিল না, আরে এয়ারপোর্ট এমনই হয়,  সে যা হোক, আমার মত সাদাসিধে মফস্বল শহরে বেড়ে ওঠা একটা ছেলে মেয়েরা অবশ্যই অবাক হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। শুরু হল নতুন শহরে,  নতুন জীবন। একটা ব্যস্ত শহর, যার সবটা নতুন আমার কাছে। ঘুম ভেঙে বাইরে যেতেই দেখছি, উল্টো দিকের বাড়ির সদর দরজায় সকাল সকাল কী সুন্দর আলপনা, বহু বছর আগে বিশাখাপত্তনম বেড়াতে গিয়ে এমনটা দেখেছিলাম, বুঝলাম এটা দক্ষিণের একটা প্রথা, আলপনার নকশার ধরনও অন্য। প্রথম সকালে আর তেমন পার্থক্য চোখে পড়েনি। তবে সময়ের গতিতে সকালে  রুটি কিংবা লুচি বাঙালি কখন ইডলি দোসাতে অভ্যস্ত হয়ে গেল ধরতে পারিনি। ওই যস্মিন দেশে যদাচার।
তবে কি ভাবছেন, অন্য রাজ্যে বাসা বেঁধেছে বলে গুটিয়ে থাকবে বাঙালি,  এসব ভুল ধারণা, দিব্যি গ্যাটের কড়ি খরচা করে বেশ উদ্যম - উদ্দীপনায় উদ্যান নগরীতে কোন এক কুড়ি তলায় হাজার স্কয়ার ফুটের মালিক হয়েছেন। নীচের দিকে বড্ড ধূলো, আলো বাতাস খেলে না, টপ ভিউটা বাড়ির কনিষ্ঠটির ভীষণ প্রিয়, তাই তো শেষমেশ ওর কথাই রইল। ই এম আই টা পড়ছে বেশি, তবুও কী এ শহরে নিজের বাড়ি, উফফ, মা বাবা তো আহ্লাদিত। ছেলে-মেয়ের মস্ত বাড়ি, ধমকে দিলাম হালকা করে, মা, এসব প্রচার বাড়াবাড়ি। 
মস্ত বাড়ির পার্কিংটা কি থাকবে খালি? এমন গল্প এ শহরে মেলা ভারি। দু- চাকা,  চার চাকা মিলে বেশ রয়েছে, নেই কোন মারামারি। কি ভাবছেন দিব্যি সবাই বেড়িয়ে পড়ি, এমন স্বপ্ন চক্ষু জুড়ি। তবে এবার পথের গল্পে ফিরি। 
     মানুষ-গাড়ি-রাস্তা একটা ঘিঞ্জি ব্যাপার। মূল শহর ছাড়িয়ে অফিস বাড়ি সব ছড়িয়ে পড়েছে এদিক ওদিক, যাতায়াতের জন্য বাস কিংবা নিজস্ব গাড়ি, ক্যাবের দাপট আছে স্বমহিমায়। মেট্রো নতুন সংযোজন। তবে নিজের গাড়িতেই ভরসা রাখছেন মানুষ। আর তাতেই বিপত্তি, বাড়ি থেকে গন্তব্যের দূরত্ব ১০ কিলোমিটার, কিন্তু হাতে দেড় ঘন্টা সময় নিয়ে বের হওয়া বাঞ্ছনীয়। ট্রাফিকের বেড়াজালে নাভিশ্বাস ওঠে। না না এখানেই ক্ষান্ত নয়, রাস্তাঘাট জবাব দিয়েছে। এত পেষাই এর চাপ সহ্য করতে না পেরে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। নিজের বুকে গর্ত করে প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে মানুষকে ফেলেছে বিপাকে। বৃষ্টি হলে রাস্তা- পুকুর সমনাম, চেনা পথ না হলে গভীরতা মাপা দুঃসাধ্য। আর বৃষ্টিহীন হলে তো বিনা বাতাসে ধূলোর ঝড়। এ এক অদ্ভুত পরিস্থিতি।
সিলিকন ভ্যালি অফ ইন্ডিয়া - বর্হিবিশ্বের বড় বড় এম এন সি র এদেশীয় প্রাণকেন্দ্র। কিন্তু এ শহরের প্রাণ হাসফাস করছে। মূল শহরের কাছাকাছি নেই কোন নদী। শহর তৈরির প্রাথমিক উপকরণের ব্যবস্থা করতে জন্মলগ্নে কাটা হয়েছিল লেক। কায়- কলেবরে বড় হতে শুরু করতেই কোপ পড়ল ওই লেকেই। বুজিয়ে তৈরি হল ইমারত, প্রকৃতিও হিসেব নিকেশ করে বুঝিয়ে দিচ্ছে জলকষ্ট কাকে বলে? টানা ২৪ ঘন্টা জল ছাড়া থাকার অভ্যেসও মানুষ রপ্ত করে ফেলেছে। জলের জন্য হোটেল - শপিং মল কিংবা অফিসে কাটিয়েছেন দীর্ঘ সময়। তবুও চলছে সবটা, থামেনি কোন অট্টালিকা বানানোর কাজ কিংবা কোন নতুন টেক পার্ক। আসলে থামালে অনেক কিছু থমকে যাবে। তবুও মনে প্রশ্ন জাগে এই অগ্রগতি কি আর কোন শহরে ছড়িয়ে দেওয়া যেত না?

সব কিছুতেই একটা বেপরোয়া লাগামহীন প্রতিযোগিতা। বাড়ির ছোট সদস্যের জন্য বরাদ্দ সব থেকে বেশি। সেটাই যদিও স্বাভাবিক, তাকে গড়ে তোলার সময় এখন। কিন্তু স্কুল খরচ মাত্রা ছাড়িয়েছে। স্কুল এখানে ব্যবসার অন্যতম ভিত্তি। ঝা চকচকে ক্যাম্পাস, বাতানুকূল বাস থেকে ক্লাসরুম, সপ্তাহে হরেকরকম ড্রেস, অপ্রয়োজনীয় রঙিন অনুষ্ঠান, সব মিলিয়ে কয়েক লক্ষ টাকার বারো বছরের প্যাকেজ। এমনকি স্কুল দেখতে গেলেও গ্যাটের কড়ি খরচ করতে হবে। আর এসব কর্মকান্ডে আপনি আমি না চাইলেও সামিল হয়ে যাব, সবটা ভাল নিজের হবে এই মনোভাব নিয়ে গড়ে ওঠা মানুষের মন কেমন করে নিজের সন্তানকে এমন সাজানো পৃথিবী থেকে বঞ্চিত করতে পারে?

তবে কি এমন বিদেশিয়ানা চালচলন শেখা অন্যায়, এগিয়ে যাওয়া তো প্রয়োজন, অবশ্যই দরকার, কিন্তু সীমাহীন এক খরচের বহর নিয়ে হাঁপিয়ে যাওয়া ক্লান্ত পরিবারগুলো মাঝে মাঝেই ঘরোয়া আড্ডায় বলে ওঠে যদি নিজের শহরে ফেরার সুযোগ থাকত, এসব ভেবে আসরের সুর ভারি হয়, অসহায় অবসন্ন লাগে। কেন আসতে হল এত দূরে তা নিয়ে তর্ক বির্তক ওঠে, এমন আড্ডার নির্যাস নিয়ে নতুন সপ্তাহ শুরু করে এই শহর।

এখনও অনেকটা পথ চলা বাকি এই শহরের। শুরুর কথাই সত্যি হবে হলফ করে বলতে পারি। জানলা দিয়ে দেওয়াল ছাড়া কিছুই চোখে পড়বে না আগামীতে। সকালের সূর্য কেমন হয়, কিংবা বেলাশেষের আকাশ নতুবা বৃষ্টির পর রামধনুর দেখা পেতে ভিড় ঠেলে যেতে হবে শ'মাইল দূরে। তবুও এ শহরে বসন্ত আসে। গোলাপি আভায় রঙিন হয় অলিগলি থেকে রাজপথ। মূল শহরে আছে আভিজাত্যের ছোঁয়া, আছে টিপু সুলতান থেকে ওয়াদিয়ার বিজড়িত ইতিহাস। আর সবকিছুর উর্ধ্বে  আছে লক্ষাধিক মানুষের অন্ন সংস্থান। আর সব জায়গায় মানিয়ে নিতে পারা বাঙালি পরবাসে নিজভূম বানিয়ে নেওয়ার দক্ষতায় পয়লা বৈশাখ থেকে বসন্ত উৎসব সবটা নিয়ে নিজেদের একটা পরিচয় বানিয়ে নিয়েছেন নিজস্ব দক্ষতায়।  ডিম আলু সহযোগে বাঙালি বিরিয়ানির সঙ্গে কারি পাতা যোগে বিরিয়ানিও সমান তৃপ্তিতে উদরস্থ করার মত উদারতা আমরা আত্মস্থ করেছি অবলীলায়।



 

জবানবন্দী 

দেবযানী ভট্টাচার্য


আমি তোমাদের শহরের এক সাধারণ মেয়ে বলছি, হে পুরুষ, আমার জীবনে ঘনিয়ে আসছে এক ঘোর অমনিশা, তোমার ঘৃণার আগুনে পুড়তে পুড়তে লিখে যাই এই জবানবন্দী ---

তোমার নিজস্ব কার্য্য সিদ্ধির উদ্দেশ্যে আমাকে বরাভয়রূপী মহীয়সী মাতা, দেবী রূপে মন্দিরে করেছ প্রাণ প্রতিষ্ঠা ! আবার শিল্পের প্রয়োজনে  প্রতিস্থাপন করেছ স্তন ও যোনি সম্বল এক মাংসপিণ্ডে ।

হে পুরুষ, তুমিই দিয়েছ অর্ধেক আকাশের মর্যাদা, আবার রাতের অন্ধকারে হিংস্র পশুর মতো করেছ যুগপৎ ধর্ষণ ও খুন। যখনই পার হতে চেয়েছি নারীত্বের বন্ধন, শাঁখা, সিঁদুর, লোহার বন্ধনে করেছ আবদ্ধ। আধিপত্য স্থাপনের উদ্দেশ্যে দিয়েছ সোনার খাঁচা। দ্বিধান্বিত অস্তিত্ত্বের মাঝে গড়তে চেয়েছ তোমারই হাতে গড়া এক পুতুল!

হে পুরুষ,পাপ বলতে আমি তোমাদের রচিত চক্রবুহ্য ভঙ্গ করে একটি নিজস্ব রাস্তা তৈরি করতে চেয়েছি। শাস্তি স্বরুপ লিঙ্গের স্পর্ধায় আমায় করেছ আঘাত।


 


এই শহর, এই জীবন

ঋতুপর্ণা ভট্টাচার্য



এক শৈশব, অনেক শহর

ঝুপ করে আলোটা চলে গেল। ঘড়িতে ঠিক রাত নটালোডশেডিংরোজ নিয়ম মেনে ঠিক এই সময়েই লোডশেডিংটা হয়কাছাকাছি দু’ তিনটে পাড়া মিলিয়ে গরমকালে প্রতিদিন রাতের এক রোজনামচা হাতের কাছে তাই লণ্ঠন তৈরিই থাকে ঝটপট দুখানা লণ্ঠন জ্বেলে দরজার পেছনে গুটিয়ে রাখা সরু মেরুনরঙা কাপড়ের পাড় দেওয়া মাদুর হাতে নিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে সিঁড়ি বেয়ে সোজা ছাদে। কোচবিহারে সাহিত্যসভার মোড় থেকে বাঁধের দিকে মিনিট পাঁচেক হাঁটলেই প্রথম যে তিনমাথার ছোট্ট মোড়টা পড়েতার ঠিক ডানদিকের চৌকনো জমির ওপর বানানো চারখানা ফ্ল্যাটের মাথায় ছড়ানো একঢালা প্রশস্ত এই ছাদ আমাদের বাড়িটা পেছনের দিকের বাম অংশে। জমির পেছনদিকটা একদম ফাঁকা। কিছু গাছপালা গজিয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। তার মধ্যে একটা বিশাল বড় ঝাঁকড়া সজনে গাছ উঠেছিল এই জমির পেছন পাঁচিলের একদম গা ঘেঁষে 

  আমাদের অংশের ছাদের ওপরের অনেকটা জুড়ে ছড়িয়ে থাকত তার ঝিরি ঝিরি পাতাভরা অসংখ্য স রু সরু ডালপালা। এছাড়া অনেক রকমের রঙবাহারি ফুলগাছের টবও থাকত সব ভাড়াটেদের অংশেই। তবে যথেষ্ঠ প্রশস্ত হওয়ায় তার পরেও ছাদের অনেকটা জায়গা খোলাই পড়ে থাকত আর তাই লোডশেডিং হলেই প্রতিদিন আমি আর বোন মা বাবার সাথে বইখাতা নিয়ে পরের দিনের পড়াশোনা করতে যেতাম ওই খোলা ছাদে। লোডশেডিং নিয়ে একটুও ক্ষোভ ছিল না মনের মধ্যে। বদ্ধ ঘরের একঘেয়ে নিয়মের বাঁধন থেকে মুক্তি পেতে এই ঘন্টাখানেক সময়টা যেন সত্যিই ছিল বড় আরামেরবড় অপেক্ষার ওপরের মিটমিটে লক্ষ তারায় ভরা অনন্ত আকাশমৃদুমন্দ শীতল মনোরম হাওয়ার মনকেমন করা শিরশিরানি আর উন্মুক্ত খোলা পরিবেশে মনের আনন্দে রোজকার পড়া তৈরির ওই অদ্ভুত সময়টা কিভাবে যেন আজও মনে রয়ে গেছে আলোমাখা এক নির্মল শৈশবের সুখস্মৃতি হয়ে!


এরপরের গল্প মালদায়। আমাদের ছোটবেলায় পুজো আর গরমের সময়ে ছুটি থাকত প্রায় এক মাসের। দীর্ঘ ওই ছুটিতে তাই প্রথমে মালদায় জেঠুর বাড়ি এবং তারপর শ্রীরামপুরে মামাবাড়ি যাওয়ার চল ছিল। মালদার বাড়ির শৈশবের স্মৃতি বলতে ঠাকুমার হাতের তেলে ঝোলে মশলায় মাখামাখি দারুণ স্বাদু বাঙাল রান্নার পাশাপাশি বাধা নিষেধহীন অবাধ আনন্দে ভরা হেসে খেলে বেড়িয়ে আপনমনে সময় কাটানোর দিনগুলো ভীষণই মনে পড়ে। স্টেশন থেকে মিনিট কুড়ি রিকশায় গিয়ে বড় রাস্তা ছেড়ে বামদিকে বেশ কিছুটা নেমে দক্ষিণ সর্বমঙ্গলা পল্লীর সরু সরু লাল ইঁটের রাস্তার দুপাশে ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে থাকা উঁচু উঁচু বাড়িওলা তিনখানা গলি পেরিয়ে আমার জেঠুর বাড়ি। গরমের দুপুরে সবাই দ্বিপ্রাহরিক ভোজনের পর্ব সেরে বিশ্রামে ব্যস্ত সারা পাড়ায় একমাত্র মধ্যে মধ্যে পাখিদের মৃদু কলকাকলি ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। আর এমন সময়েই দোতলায় দাদার দেয়াল আলমারির তাক ঘেঁটে ওরই স্কুলের প্রাইজের বই থেকে কোনও একটা বই বেছে নিয়ে এক ছুট্টে তিনতলার খোলা ছাদের কোনও একটি কোণে ছায়ায় বসে একমনে মগ্ন হয়ে চলত আমার বই পড়া। এভাবেই পড়েছিলাম বাদশাহী আংটি আমার পড়া ফেলুদার প্রথম বই তারপর এক নিঃশ্বাসে গোগ্রাসে গিলেছি গ্যাংটকে গণ্ডগোলজয় বাবা ফেলুনাথসোনার কেল্লাশিবরাম চক্রবর্তীর মজার সব গল্প আর পাণ্ডব গোয়েন্দাদের রকমারি অ্যাডভেঞ্চারের কাহিনী এছাড়াও কাকামণির বাড়ির বইয়ের আলমারি থেকেও চুপিসারে নিয়ে পড়তাম রবীন্দ্রনাথশরৎচন্দ্রবঙ্কিমচন্দ্র আর কালিদাস সমগ্র পড়ার বইয়ের বাইরের একটা বিশাল বহুস্তরীয় বই পৃথিবীর সাথে আমার পরিচয় ঘটেছিল এই মালদার বাড়িতেই এখনও তাই মালদায় গেলে সব ছাড়িয়ে সেই ছোটবেলার পুরনো বইয়ের পাতার গন্ধটাকেই খুঁজি আমি যার পরতে পরতে আজও জেগে আছে আমার হারিয়ে যাওয়া শৈশব


শ্রীরামপুরের মামাবাড়ি ছোটবেলায় আমাদের কাছে ছিল সব পেয়েছির দেশ সেসময় ওই যৌথ বাড়িটা ভাগ হয়নি অনেকটা অংশ জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিশাল বাড়িটার মাঝখানের উঠোনটা ছিল ছাদহীন খোলামেলা যার তিনপাশ দিয়ে সারি সারি ঘরটানা ঘোরানো বারান্দা আর পেছনদিকের বিশাল রান্নাঘর। ছুটিতে মামাবাড়ি এলেই বাড়িতে উৎসবের ধুম পড়ে যেত। দিদা অর্থাৎ আমাদের সব মামাতো মাসতুতো ভাইবোনের প্রিয় মিমি বয়ামের পর বয়াম ভরে অক্লান্ত ধৈর্য্য সহকারে তৈরি করত নোনতা কুচো নিমকি, বরফি আকারের চিনিমাখা মিষ্টি নিমকি আর আনন্দ নাড়ু। লম্বা বারান্দার ওপরের কড়ি বরগায় শাড়ি বেঁধে তৈরি হত দোলনা। মাঝখানের সুপ্রশস্ত খোলা উঠোনে বড় বড় গামলায় জল ভরে সব ভাইবোনেরা মিলে ফোয়ারার মতো জল ছিটিয়ে ছিটিয়ে সারা হত রোজকার হুল্লোরভরা স্নানপর্ব। গরমের ছুটিতে সবাই মিলে কলকাতায় চিড়িয়াখানা, ময়দান আর সার্কাসে যাওয়া হতই আর পুজোর ছুটির আকর্ষণ ছিল কালীপুজোর সময় দুদিন ধরে বাড়ির সবাই মিলে রকমারি বাজি ফাটানোর মজাদার প্রতিযোগিতা সারা ছাদ জুড়ে সুতো দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দীর্ঘ প্যাঁচালো পথ বানানো হত যার ওপর দিয়ে চোখের নিমেষে ছুটত রেলবাজি এছাড়া চরকি, তুবরি আর রকেটও ছিল আমাদের দারুণ প্রিয়। মালদার বাড়ির দুর্গাপুজো আর শ্রীরামপুরের বাড়ির কালীপুজোর বাজি ফাটানো এই দুটি স্মৃতিই আমার ফেলে আসা শৈশবের ঝলমলে সময়ের এক উজ্জ্বল দলিল


কৈশোরবেলা আর শহর কোচবিহার 

আমার কিশোরীবেলার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে যে শহর তার নাম কোচবিহার বালিকাবেলা পেরিয়ে এসে কৈশোরের এই সময়টা থেকেই পড়াশোনার চাপ বেড়ে যায় বেশ খানিকটা স্কুলজীবনের দু’ দুটো বড় পরীক্ষায় বসতে হয় এ সময়। ফলে আগে যেমন কেবল স্কুলের পড়ানোটুকুই যথেষ্ঠ ছিল, একটা সময়ের পর তাতে আর প্রয়োজন মেটে না তাই অন্য অনেকের মতোই আমিও প্রাইভেট টিউশন পড়া শুরু করি এ সময় থেকে তবে প্রথমদিকে একটা দুটো জরুরি বিষয়ই কেবল বাইরে পড়তাম এর মধ্যে স্কুলজীবনের শেষ চার বছরে যে কজন গৃহশিক্ষকের কাছে পড়েছি তাঁদের মধ্যে তিনজনের কথা বিশেষ করে বলতেই হয়। এঁরা হলেন আমার বাংলার শিক্ষিকা সুমনাদি, অঙ্কের শিক্ষক বিবেকজ্যোতি চক্রবর্তী এবং ইংরাজীর শিক্ষক এন ডি স্যার ভাষা ও বিজ্ঞান বিভাগের এই তিনজন শিক্ষকই পড়ানোর ছলে বিষয়গুলির পুঁথিগত ও পরীক্ষার্থে প্রয়োজনীয় জ্ঞানের বাইরে গিয়ে এমন কিছু সার্বিক শিক্ষা সেসময় দিয়েছিলেন যা পরবর্তীকালে আমার জীবন দেখার দৃষ্টিভঙ্গিটিকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছিল বিদ্যালয় জীবনে নিয়মের মধ্যে, শৃঙ্খলার মধ্যে থেকে যা যা আমরা শিখি তার যথার্থ মূল্য যে কেবল পরীক্ষার নম্বরে নয়, শেষ অবধি নিজের নিজের জীবনশৈলীর গুণগত এবং নীতিগত উন্নয়নে তাই দারুণ অনায়াসে আমাকে সেদিন শেখাতে পেরেছিলেন তাঁরা


প্রথমেই বলব বাংলার কথা বাংলা আমাদের মাতৃভাষা এবং এই ভাষাটি শেখার অর্থ যে কেবল সুন্দর সুন্দর অজস্র শ্রুতিমধুর শব্দপ্রয়োগে কোনও বক্তব্যকে কেবল অলঙ্কৃত করে পরিবেশনে নয়, বরং, মনের সঠিক ভাবটিকে যুক্তিসহকারে সুচিন্তিত যথাযথ শব্দে গেঁথে সমাজের সামনে স্পষ্ট করে তুলে ধরায়, তাই আমাকে হাতে ধরে শিখিয়েছিলেন আমার বাংলার শিক্ষিকা, যা নিঃসন্দেহে আজ আমার ব্যক্তিত্ব গঠনে সবিশেষ ভূমিকা নিয়েছে আমার ইংরাজীর শিক্ষক এন ডি স্যারের কাছ থেকে স্কুলজীবনের শেষ দু’ বছরে মূল যে জিনিসটি আমি শিখেছিলাম তা হল সময়ের মূল্য আমাদের জীবনের সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ বস্তু হল সময়, তাই কোনও বিষয়ে বক্তব্য, সে লিখিতই হোক কি উচ্চারিত, সর্বদাই সীমিত শব্দচয়নে পরিস্কারভাবে প্রকাশ করতে হবে, এবং বলাই বাহুল্য, এই সঠিক শব্দচয়নের পারদর্শিতার জন্য শেষ অবধি ওই ভাষাটিকেই খুব ভাল করে শেখা চাই। আর সবশেষে, বিবেকবাবু, আমার অঙ্কের শিক্ষক যদিও তাঁকে শুধু এই অঙ্কের গণ্ডির মধ্যেই বেঁধে ফেললে সত্যের অপলাপ হবে নিউ কদমতলায় তাঁর হলদে রঙের দোতলা বাড়ির দোতলার পুরো অংশটা জুড়ে ছিল তাঁর পড়াশোনার জগৎ দিনহাটা কলেজের অঙ্কের বিভাগীয় প্রধান হলেও নিজের বিষয়ের বাইরের অন্য সব বিষয়েও ছিল তাঁর অগাধ জ্ঞান, অন্তহীন উৎসাহ এবং একপ্রকার শিশুসুলভ বিস্ময়ভরা আগ্রহ নতুন কিছু জানতে, নতুন কিছু শিখতে ছাত্রদের সাথে একেবারে সমবয়সী বন্ধুর মতো মিশে যেতে পারতেন তিনি বিষয়ের চেয়েও বিষয়টিকে দেখার বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গিটুকুই মনে হয় তাঁর কাছ থেকে শেখা আমার আসল প্রাপ্তি পরীক্ষার খাতায় অঙ্কের খুঁটিনাটি প্রায়োগিক ব্যবহারের ঊর্ধ্বে উঠে বাস্তব জীবনের সমস্ত সমস্যাকে অঙ্কের সমস্যার মতোই শর্ত যুক্তি আর সীমাবদ্ধতা দিয়ে মেনে নিয়ে ঠিকঠাক বাস্তবসম্মত একটা সমাধান বের করার ক্ষমতাটাই তাঁর থেকে পাওয়া আমার শ্রেষ্ঠ শিক্ষা তাই আজ ফিরে দেখলে মনে হয় কোচবিহার শহর আমার কৈশোরবেলার সেই বিদ্যাগ্রহণকালে এমন কিছু ভীষণ জরুরি শিক্ষা দিতে পেরেছিল যা এতগুলো বছর পেরিয়ে এসেও আজও আমাকে আলো দেখিয়ে চলেছে আর সেখানেই আমার জীবনে শহর কোচবিহারের প্রকৃত সার্থকতা


তারুণ্যের ঊষাকাল ও এক শহরের গল্প

আমার কলেজ জীবন কেটেছে দক্ষিণবঙ্গের হুগলি জেলার শ্রীরামপুর শহরে, শ্রীরামপুর কলেজে। বিদ্যালয়ের সীমাবদ্ধ চিরচেনা গণ্ডি পেরিয়ে বৃহত্তর জগতের সাথে এই সময়েই আমার প্রথম পরিচয়, আর সেই সাথেই উত্তরবঙ্গের খোলামেলা সহজ সরল পরিবেশ ছেড়ে দক্ষিণের কঠোর জটিল বাস্তবের মাটিতে পা রাখা কলেজ জীবনে প্রথাগত শিক্ষার একটা বাঁধন থাকলেও এ সময়টা মূলত নিজেকে চিনে নেওয়ার, নিজের আশপাশটাকে চিনে নেওয়ার ক্রমাগত ধাক্কা খেতে খেতে, চারপাশের বহু মানুষের নিরন্তর রঙ বদলানো দেখতে দেখতে, বহু ওঠা পড়া কষ্ট কান্না ক্ষোভ আর হেরে যাওয়ার পাহাড় ডিঙিয়ে অবশেষে জীবনকে ঠিকঠাক চিনে নিতে সাহায্য করে তারুণ্যের এই কালবেলা কলেজের পড়া শেষ করে রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে স্নাতকোত্তরে ভর্তি হওয়ার পরে নিয়মিত কলকাতায় যাতায়াত শুরু হয় আমার আর সেই সঙ্গেই দ্রুত বদলে যেতে থাকে আমার ছোটবেলায় দেখা স্বপ্নের কলকাতা। হাওড়া ব্রিজ ছাড়িয়ে বড়বাজার মেছুয়া সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ পেরিয়ে কলেজ স্ট্রিট এবং তারও আগে আর্মহার্স্ট স্ট্রিট শিয়ালদা ছাড়িয়ে রাজাবাজার অবধিই সেসময় আমার দৈনন্দিন গতিবিধির পরিসর। এই গোটা অঞ্চলটা মূলত পুরনো কলকাতা। রাজপথের দু’ধারে পুরনো আমলের মৃতপ্রায় জগদ্দল সব বিশাল বিশাল বাড়ি যার লম্বা টানা বারান্দায় সময় যেন থমকে থাকে নীচের রাস্তা জুড়ে মহানগরীর অবিশ্রান্ত কর্মব্যস্ততা, দিনের পর দিন একই নিয়মে বাঁধা বহুবিচিত্র জীবনের স্রোত বয়ে চলে একঘেয়েভাবে, অথচ, দুটো তলা ওপরেই যেন তার তাপটুকুও পৌঁছয় না মুটে মজুর, অস্থায়ী পরিযায়ী শ্রমিক, ছোট মাঝারি বড় সবরকমের দোকানী, ফেরিওলা, ফলওলা, ঠেলাওলা থেকে শুরু করে নানান বয়সী সাধারণ মানুষ সবাই শুধু এ শহরে নিজের লক্ষ্যে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটেই চলেছে, এক মুহূর্তের জন্যেও আশেপাশে তাকানোর সময় ইচ্ছে কি আগ্রহ কিচ্ছুটি নেই! অনেক পরে বুঝেছিলাম বড় শহরের এটাই নিয়ম এখানে সুযোগ বেশিকিন্তু তার জন্যে ভিড় বেশি, প্রতিযোগিতা বেশি, ফলে তাড়াও বেশি তাই কোনও অবাঞ্ছিত আবেগপ্রবণতা নয়, একাগ্র হয়ে একমাত্র নিজের লক্ষ্যে স্থির থেকে সামনের দিকে এগোনোই এ শহরের একমাত্র ধর্ম বহু বছর ধরে শুধু নির্নিমেষ চেয়ে চেয়ে দেখতে দেখতেই অবশেষে একদিন এই আশ্চর্য সত্যিটা উপলব্ধি করেছিলাম আমি আর তাই নিজের ভেতরে এতকালের লালিত মানবিকতাটুকু অস্বীকার না করেও মহানগরীর এই দারুণ প্রতিযোগিতামূলক মনোভাবকে সুস্থভাবে গ্রহণ করেছিলাম আমি যা কিনা পরবর্তী জীবনে কোনও ক্ষেত্রে নিজের তরফ থেকে প্রাণপণ চেষ্টার পরেও কোনও ভুল হলে তা আমাকে সহজেই নতমস্তকে স্বীকার করে নিতে শিখিয়েছে, নিজের হার শান্তভাবে মেনে নিতে শিখিয়েছে, আর তারপর, পুনরায় উঠে দাঁড়িয়ে নতুন করে শুরু করতেও শিখিয়েছে, এবং, এটাই সেই তারুণ্যের ঊষাকালে এই মহানগরীর কাছ থেকে পাওয়া আমার শ্রেষ্ঠ জীবনদর্শন 



আমার শহর, তোমার শহর

৫ই আগস্ট, ২০২৪ প্রতিবেশী দেশের উত্তাল ছাত্র আন্দোলন আমূলে উপড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল ক্ষমতাসীন শাসকের সীমাহীন অন্যায় ঔদ্ধত্যের শিকড় ১৪ই আগস্টের মধ্যরাত আপামর বাংলার শুভবুদ্ধিসম্পন্ন বিবেকবান নারী পুরুষের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে এ দেশেও জন্ম নিল এক নতুন দিন এবারের স্বাধীনতা দিবস আক্ষরিক অর্থেই ডাক দিল আরেক স্বাধীনতার। অর্ধেক আকাশের জন্য সমানাধিকারের স্বাধীনতা, সামাজিক নিরাপত্তার স্বাধীনতা, নিজের শরীরের প্রতি, নিজের স্বপ্ন ইচ্ছে মন এবং প্রতিটি সিদ্ধান্তের প্রতি একমাত্র নিজেরই নিঃশর্ত পূর্ণ স্বাধীনতা। দ্রুত বাংলার গণ্ডি পেরিয়ে দেশ জুড়ে এমনকি বিদেশের মাটিতেও দাবানলের গতিতে ছড়িয়ে এই অন্য স্বাধীনতার লড়াই এ এক আশ্চর্য  আগুনবেলা যার ওপারে আছে অমৃত আলোর দুনিয়া আজ তাই সবার উপরে শুধু এটুকুই প্রার্থনা, তোমার শহর, আমার শহর ছাড়িয়ে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ুক এই অনন্য বিপ্লবের সর্বগ্রাসী অগ্নিশিখা আর শেষমেষ সবকিছু নিঃশেষে দগ্ধ করে ফেলে শুদ্ধ করুক এ পোড়া সমাজকে যেখানে একইসাথে শান্তির শ্বাস নিতে পারে প্রতিটি প্রাণ, যেখানে লিঙ্গ পরিচয় যেন আর একটি মানুষেরও জীবনের নির্ণায়ক না হয়ে ওঠে