Sunday, September 1, 2024

 



জীবন যেমন 

জনা বন্দ্যোপাধ্যায়

আজ শহরের অডিটোরিয়ামে কবিতা পাঠের আসরে  দীপশিখা সেন কবিতা শুনতে গেছিলেন। সেখানে পরিচয় হয় এনজিও কর্মী হেমন্ত রায়ের সঙ্গে। হেমন্ত কবিতার একজন একনিষ্ঠ ভক্ত। হেমন্ত দীপশিখার ফোন নম্বর নেন। মাঝে মাঝেই গল্প হয় দুজনের। ক্রমশঃ গড়ে ওঠে তাঁদের সম্পর্ক। দীপশিখা নিজের ছেলে টুবলুর কথা হেমন্তকে বলেছেন। হেমন্ত টুবলুকে দেখার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। 
           দীপশিখা তাঁর স্বামী সমীরণের ইচ্ছা মতো ঘরোয়া স্ত্রী হতে পারেননি। প্রায় দশ বছরের বিবাহিত জীবন তাঁদের। দীপশিখা শুধু কবিতা শুনতে ভালবাসেন না, একটু আধটু লেখেন। নার্সিং পাশের পর দীপশিখার বৃদ্ধ বাবা চেয়েছিলেন মেয়ের বিয়েটা তাড়াতাড়ি দিতে। সমীরণের ব্যাটারির দোকান, নিজস্ব ব্যবসা। পাড়ায় খবর নিয়ে জানা গেছিল চরিত্র ভালো। সমীরণ পাত্র হিসাবে হয়তো খারাপ নন, কিন্তু দীপশিখার সঙ্গে রুচি ও মানসিকতার খুবই তফাৎ। দীপশিখা পেশায় নার্স। তাই অর্থনৈতিক স্বাধীনতা আছে। একদিন সমীরণকে দীপশিখা সরাসরি বলেন," আমাদের মধ্যে শুধু দূরত্ব বেড়ে চলেছে। তুমি চাইলে আমরা আলাদা হতেই পারি।"
সমীরণ যে এত তাড়াতাড়ি রাজী হয়ে যাবেন ভাবতে পারেননি দীপশিখা। সমীরণের বেঁটে ছোটখাটো চেহারা, সে তুলনায় দীপশিখার ছিপছিপে লম্বা গড়ন। পাশাপাশি দুজনকে মানায় না এ কথা ভেবেই সমীরণ দীপশিখার সঙ্গে কোথাও যেতে চাইতেন না! একটা হীনমন্য ভাব কাজ করতো। তবু পুরুষ ইগো কম নেই!
কিছু মাসের মধ্যে ডিভোর্সের পর হেমন্তের সঙ্গে একই শহরে নতুন সংসার পাতেন দীপশিখা। হেমন্ত রায়ের শৌখিন রুচির পরিচয় দীপশিখা আগেই পেয়েছেন। ব্যালকনিতে নানান ক্যাকটাসের টব। হেমন্তর বয়স বছর পঁয়ত্রিশ, দীপশিখার থেকে দু বছরের ছোটই হবেন হয়তো। সমীরণ যতটা রুক্ষ স্বভাবের ছিলেন, হেমন্ত ততটাই রোমান্টিক স্বভাবের মানুষ! বেশ স্মার্ট, ফিটফাট থাকা পছন্দ করেন।
        দীপশিখার প্রথম পক্ষের ছেলে আট বছরের টুবলুও কবিতা ভালবাসে। কোর্টে টুবলুকে নিজের কাছে রাখার কথা দীপশিখাই বলেছিলেন। সমীরণ আপত্তি করেননি। তবে দীপশিখা টুবলুকে মাঝে মধ্যে সমীরণের কাছে পাঠান। এটা তাঁর দায়িত্বের মধ্যে পড়ে বলে মনে করেন।
      সারা বাংলা আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় টুবলু অংশ নেয় এবং প্রথম হয়। স্টেজে পুরস্কার নিতে উঠে টুবলু হেমন্ত রায়ের উৎসাহ দানের কথা বলে স্টেজে হেমন্তকে ডাকে। দীপশিখার আনন্দাশ্রু বাধ মানে না! দীপশিখা টুবলুকে হেমন্তকে কাকু ডাকতে শিখিয়েছেন।
                 দেখতে দেখতে টুবলুর বয়স ষোল পেরিয়ে সতেরো। সংসারের খরচ বেড়েছে। কিন্তু হেমন্তের কোনও ভাবোদয় নেই। আর একটু বেশী সংসার খরচ দেবার কথা দীপশিখা তাঁকে নিজে মুখে বলতে পারেন না। একতলা বাড়িটা হেমন্ত রায়ের পৈতৃক সূত্রে পাওয়া। তাঁর এক বোন আছে। মুম্বাইতে বিয়ে হয়েছে। হেমন্তর বাবা বাস দুর্ঘটনায় মারা যান। কোর্টে চাকরি করতেন। এর পর মাও বেশী দিন বাঁচেননি। রক্তাল্পতা গ্রাস করেছিল। ব্যালকনির ক্যাকটাসগুলোর দিকে তাকিয়ে দীপশিখা ভাবেন শুরুটা ঠিকঠাক হলেও তার সাজানো সংসার ধীরে ধীরে  আধুনিক কবিতার মতো বিমূর্ত হয়ে যাচ্ছে, স্পন্দন হারাচ্ছে। ব্যালকনি থেকে ধূসর পৃথিবীটা দেখেন দীপশিখা! সত্যি মানুষ কত বদলে যায়! সমীরণকে দীপশিখা বুঝতে পারতেন। সমীরণের হীনমন্যতার কারণ জানতেন। কিন্তু হেমন্তকে দীপশিখা পুরোপুরি বুঝতে পারেন না! হেমন্ত যেন ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নিতে থাকেন। আজকাল কবি সভায় আমন্ত্রণ পেলে কোনও না কোনও অজুহাতে দীপশিখার সঙ্গে যেতে চান না! হেমন্ত টুবলুকেও যেন এড়িয়ে চলেন। ব্যাপারটা টুবলুর চোখে পড়ায় একদিন দীপশিখাকে সরাসরি বলে," কাকু হয়তো আর আমাদের ভালোবাসে না!"
দীপশিখা টুবলুকে বুঝতে দিতে চান না। টুবলুর সুকুমার মুখের দিকে চেয়ে হেসে বলেন," না, না, এরকম কিছু ভাবিস না।"
টুবলুর মায়ের দিকে তাকিয়ে কষ্ট হয়। সারাদিন হাসপাতালে খাটনির পর ক্লান্ত শরীরে ফিরে রান্না ঘরে ঢোকেন দীপশিখা। মাকে একদিন টুবলু লুকিয়ে কাঁদতে দেখেছে। 
            দীপশিখা যে হাসপাতালে চাকরি করেন, সেখানে সমীরণ ভর্তি হন। গলায় ক্যান্সার, লাস্ট স্টেজ। সমীরণ নিজের জমানো কিছু টাকা টুবলুর নামে লিখে দিয়েছেন। দীপশিখা সমীরণকে ক্ষমা করে দেন। নিজের ভাগ্যকেই সব কিছুর জন্য দায়ী করেন। সমীরণের শীর্ণ চেহারা দেখে চেনা যায় না।  দু কামরার ভাড়া বাড়িতে কেউ দেখার নেই। নিজের প্রতি অযত্ন শুরু করেছিলেন। দু সপ্তাহ পর দীপশিখার চোখের সামনেই সমীরণ ইহলোক ত্যাগ করেন। টুবলু মুখাগ্নি করে। 
       কালের নিয়মে কয়েকটা মাস দ্রুত কেটে যায়। দেশে ভোট হয়। রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ে। উষ্ণায়ন বাড়ে। কিছু কলকারখানায় উন্নত প্রযুক্তির মেশিন বসায় কিছু লোকের চাকরীও যায়। হেমন্তর চাকরীটা থাকলেও এত বছরে মাইনের সেরকম পরিবর্তন হয়নি। দীপশিখার থেকে ডিভোর্স চান হেমন্ত। তিনি দীপশিখার হাত ধরে বলেন,"শিখা,আমাদের মধ্যে সম্পর্কটা মরে গেছে। আমার সীমিত আয়। সংসারে বিশেষ টাকা দিতে পারিনি। তুমি প্রায় পুরো দায়ভার বহন করতে করতে বদলে গেছো। আমাদের কি আর একসঙ্গে থাকা উচিত? টুবলুও কেমন মন মরা হয়ে থাকে। ওর জন্য কিছুই করতে পারলাম না! তোমাকে বিয়ের আগে, তোমার টুবলুর দায়িত্ব নেবার আগে আমার বোঝা উচিত ছিল! সমীরণ আমাকে ক্ষমা করেছে কিনা জানি না!"
             দীপশিখাকে তাঁর বিবাহিত জীবনের দুটো অধ্যায়  হতাশা ছাড়া আর কিছুই দেয়নি! কিন্তু টুবলুর জীবন তো পড়ে আছে। ছেলেকে নিয়ে আলাদা ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকতে শুরু করেন দীপশিখা। বাহান্ন বছরে এক অদম্য শক্তি নিয়ে চলেছেন তিনি। জীবনের ঢেউ আর কত আলোড়িত হবে জানেন না! তাঁদের ফ্ল্যাট থেকে যে শিরীষ গাছটা দেখা যায়, সেই গাছে প্রতিদিন কত পাখির আনাগোনা, তার পাশের পার্কে কত মানুষের হেঁটে চলা! জীবনের নিয়মে দিন কেটে গেলেও গ্লানি কি কাটে! দীপশিখা হেমন্তকে সহজেই ডিভোর্স দেন। হেমন্তের মতো দুর্বল প্রকৃতির মানুষ দীপশিখা দুটো দেখেননি। আসলে জীবন যে মুহূর্তে যেমন ভাবে ধরা দেয়,মানুষ সেরকম ভাবেই তাকে গ্রহণ করে! চেনা সুর কখন অচেনা হয় তা বোঝা যায় না!

No comments:

Post a Comment