এই শহর, এই জীবন
ঋতুপর্ণা ভট্টাচার্য
এক শৈশব, অনেক শহর
ঝুপ করে আলোটা চলে গেল। ঘড়িতে ঠিক রাত নটা।লোডশেডিং! রোজ নিয়ম মেনে ঠিক এই সময়েই লোডশেডিংটা হয়।কাছাকাছি দু’ তিনটে পাড়া মিলিয়ে গরমকালে প্রতিদিন রাতের এক রোজনামচা। হাতের কাছে তাই লণ্ঠন তৈরিই থাকে। ঝটপট দু’খানা লণ্ঠন জ্বেলে দরজার পেছনে গুটিয়ে রাখা সরু মেরুনরঙা কাপড়ের পাড় দেওয়া মাদুর হাতে নিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে সিঁড়ি বেয়ে সোজা ছাদে। কোচবিহারে সাহিত্যসভার মোড় থেকে বাঁধের দিকে মিনিট পাঁচেক হাঁটলেই প্রথম যে তিনমাথার ছোট্ট মোড়টা পড়ে, তার ঠিক ডানদিকের চৌকনো জমির ওপর বানানো চারখানা ফ্ল্যাটের মাথায় ছড়ানো একঢালা প্রশস্ত এই ছাদ। আমাদের বাড়িটা পেছনের দিকের বাম অংশে। জমির পেছনদিকটা একদম ফাঁকা। কিছু গাছপালা গজিয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। তার মধ্যে একটা বিশাল বড় ঝাঁকড়া সজনে গাছ উঠেছিল এই জমির পেছন পাঁচিলের একদম গা ঘেঁষে ।
আমাদের অংশের ছাদের ওপরের অনেকটা জুড়ে ছড়িয়ে থাকত তার ঝিরি ঝিরি পাতাভরা অসংখ্য স রু সরু ডালপালা। এছাড়া অনেক রকমের রঙবাহারি ফুলগাছের টবও থাকত সব ভাড়াটেদের অংশেই। তবে যথেষ্ঠ প্রশস্ত হওয়ায় তার পরেও ছাদের অনেকটা জায়গা খোলাই পড়ে থাকত। আর তাই লোডশেডিং হলেই প্রতিদিন আমি আর বোন মা বাবার সাথে বইখাতা নিয়ে পরের দিনের পড়াশোনা করতে যেতাম ওই খোলা ছাদে। লোডশেডিং নিয়ে একটুও ক্ষোভ ছিল না মনের মধ্যে। বদ্ধ ঘরের একঘেয়ে নিয়মের বাঁধন থেকে মুক্তি পেতে এই ঘন্টাখানেক সময়টা যেন সত্যিই ছিল বড় আরামের, বড় অপেক্ষার। ওপরের মিটমিটে লক্ষ তারায় ভরা অনন্ত আকাশ, মৃদুমন্দ শীতল মনোরম হাওয়ার মনকেমন করা শিরশিরানি আর উন্মুক্ত খোলা পরিবেশে মনের আনন্দে রোজকার পড়া তৈরির ওই অদ্ভুত সময়টা কিভাবে যেন আজও মনে রয়ে গেছে আলোমাখা এক নির্মল শৈশবের সুখস্মৃতি হয়ে!
এরপরের গল্প মালদায়। আমাদের ছোটবেলায় পুজো আর গরমের সময়ে ছুটি থাকত প্রায় এক মাসের। দীর্ঘ ওই ছুটিতে তাই প্রথমে মালদায় জেঠুর বাড়ি এবং তারপর শ্রীরামপুরে মামাবাড়ি যাওয়ার চল ছিল। মালদার বাড়ির শৈশবের স্মৃতি বলতে ঠাকুমার হাতের তেলে ঝোলে মশলায় মাখামাখি দারুণ স্বাদু বাঙাল রান্নার পাশাপাশি বাধা নিষেধহীন অবাধ আনন্দে ভরা হেসে খেলে বেড়িয়ে আপনমনে সময় কাটানোর দিনগুলো ভীষণই মনে পড়ে। স্টেশন থেকে মিনিট কুড়ি রিকশায় গিয়ে বড় রাস্তা ছেড়ে বামদিকে বেশ কিছুটা নেমে দক্ষিণ সর্বমঙ্গলা পল্লীর সরু সরু লাল ইঁটের রাস্তার দু’পাশে ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে থাকা উঁচু উঁচু বাড়িওলা তিনখানা গলি পেরিয়ে আমার জেঠুর বাড়ি। গরমের দুপুরে সবাই দ্বিপ্রাহরিক ভোজনের পর্ব সেরে বিশ্রামে ব্যস্ত। সারা পাড়ায় একমাত্র মধ্যে মধ্যে পাখিদের মৃদু কলকাকলি ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। আর এমন সময়েই দোতলায় দাদার দেয়াল আলমারির তাক ঘেঁটে ওরই স্কুলের প্রাইজের বই থেকে কোনও একটা বই বেছে নিয়ে এক ছুট্টে তিনতলার খোলা ছাদের কোনও একটি কোণে ছায়ায় বসে একমনে মগ্ন হয়ে চলত আমার বই পড়া। এভাবেই পড়েছিলাম বাদশাহী আংটি। আমার পড়া ফেলুদার প্রথম বই। তারপর এক নিঃশ্বাসে গোগ্রাসে গিলেছি গ্যাংটকে গণ্ডগোল, জয় বাবা ফেলুনাথ, সোনার কেল্লা, শিবরাম চক্রবর্তীর মজার সব গল্প আর পাণ্ডব গোয়েন্দাদের রকমারি অ্যাডভেঞ্চারের কাহিনী। এছাড়াও কাকামণির বাড়ির বইয়ের আলমারি থেকেও চুপিসারে নিয়ে পড়তাম রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র আর কালিদাস সমগ্র। পড়ার বইয়ের বাইরের একটা বিশাল বহুস্তরীয় বই পৃথিবীর সাথে আমার পরিচয় ঘটেছিল এই মালদার বাড়িতেই। এখনও তাই মালদায় গেলে সব ছাড়িয়ে সেই ছোটবেলার পুরনো বইয়ের পাতার গন্ধটাকেই খুঁজি আমি যার পরতে পরতে আজও জেগে আছে আমার হারিয়ে যাওয়া শৈশব।
শ্রীরামপুরের মামাবাড়ি ছোটবেলায় আমাদের কাছে ছিল সব পেয়েছির দেশ। সেসময় ওই যৌথ বাড়িটা ভাগ হয়নি। অনেকটা অংশ জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিশাল বাড়িটার মাঝখানের উঠোনটা ছিল ছাদহীন খোলামেলা যার তিনপাশ দিয়ে সারি সারি ঘর, টানা ঘোরানো বারান্দা আর পেছনদিকের বিশাল রান্নাঘর। ছুটিতে মামাবাড়ি এলেই বাড়িতে উৎসবের ধুম পড়ে যেত। দিদা অর্থাৎ আমাদের সব মামাতো মাসতুতো ভাইবোনের প্রিয় মিমি বয়ামের পর বয়াম ভরে অক্লান্ত ধৈর্য্য সহকারে তৈরি করত নোনতা কুচো নিমকি, বরফি আকারের চিনিমাখা মিষ্টি নিমকি আর আনন্দ নাড়ু। লম্বা বারান্দার ওপরের কড়ি বরগায় শাড়ি বেঁধে তৈরি হত দোলনা। মাঝখানের সুপ্রশস্ত খোলা উঠোনে বড় বড় গামলায় জল ভরে সব ভাইবোনেরা মিলে ফোয়ারার মতো জল ছিটিয়ে ছিটিয়ে সারা হত রোজকার হুল্লোরভরা স্নানপর্ব। গরমের ছুটিতে সবাই মিলে কলকাতায় চিড়িয়াখানা, ময়দান আর সার্কাসে যাওয়া হতই আর পুজোর ছুটির আকর্ষণ ছিল কালীপুজোর সময় দুদিন ধরে বাড়ির সবাই মিলে রকমারি বাজি ফাটানোর মজাদার প্রতিযোগিতা। সারা ছাদ জুড়ে সুতো দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দীর্ঘ প্যাঁচালো পথ বানানো হত যার ওপর দিয়ে চোখের নিমেষে ছুটত রেলবাজি। এছাড়া চরকি, তুবরি আর রকেটও ছিল আমাদের দারুণ প্রিয়। মালদার বাড়ির দুর্গাপুজো আর শ্রীরামপুরের বাড়ির কালীপুজোর বাজি ফাটানো এই দুটি স্মৃতিই আমার ফেলে আসা শৈশবের ঝলমলে সময়ের এক উজ্জ্বল দলিল।
কৈশোরবেলা আর শহর কোচবিহার
আমার কিশোরীবেলার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে যে শহর তার নাম কোচবিহার। বালিকাবেলা পেরিয়ে এসে কৈশোরের এই সময়টা থেকেই পড়াশোনার চাপ বেড়ে যায় বেশ খানিকটা। স্কুলজীবনের দু’ দুটো বড় পরীক্ষায় বসতে হয় এ সময়। ফলে আগে যেমন কেবল স্কুলের পড়ানোটুকুই যথেষ্ঠ ছিল, একটা সময়ের পর তাতে আর প্রয়োজন মেটে না। তাই অন্য অনেকের মতোই আমিও প্রাইভেট টিউশন পড়া শুরু করি এ সময় থেকে। তবে প্রথমদিকে একটা দুটো জরুরি বিষয়ই কেবল বাইরে পড়তাম। এর মধ্যে স্কুলজীবনের শেষ চার বছরে যে কজন গৃহশিক্ষকের কাছে পড়েছি তাঁদের মধ্যে তিনজনের কথা বিশেষ করে বলতেই হয়। এঁরা হলেন আমার বাংলার শিক্ষিকা সুমনাদি, অঙ্কের শিক্ষক বিবেকজ্যোতি চক্রবর্তী এবং ইংরাজীর শিক্ষক এন ডি স্যার। ভাষা ও বিজ্ঞান বিভাগের এই তিনজন শিক্ষকই পড়ানোর ছলে বিষয়গুলির পুঁথিগত ও পরীক্ষার্থে প্রয়োজনীয় জ্ঞানের বাইরে গিয়ে এমন কিছু সার্বিক শিক্ষা সেসময় দিয়েছিলেন যা পরবর্তীকালে আমার জীবন দেখার দৃষ্টিভঙ্গিটিকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছিল। বিদ্যালয় জীবনে নিয়মের মধ্যে, শৃঙ্খলার মধ্যে থেকে যা যা আমরা শিখি তার যথার্থ মূল্য যে কেবল পরীক্ষার নম্বরে নয়, শেষ অবধি নিজের নিজের জীবনশৈলীর গুণগত এবং নীতিগত উন্নয়নে তাই দারুণ অনায়াসে আমাকে সেদিন শেখাতে পেরেছিলেন তাঁরা।
প্রথমেই বলব বাংলার কথা। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা এবং এই ভাষাটি শেখার অর্থ যে কেবল সুন্দর সুন্দর অজস্র শ্রুতিমধুর শব্দপ্রয়োগে কোনও বক্তব্যকে কেবল অলঙ্কৃত করে পরিবেশনে নয়, বরং, মনের সঠিক ভাবটিকে যুক্তিসহকারে সুচিন্তিত যথাযথ শব্দে গেঁথে সমাজের সামনে স্পষ্ট করে তুলে ধরায়, তাই আমাকে হাতে ধরে শিখিয়েছিলেন আমার বাংলার শিক্ষিকা, যা নিঃসন্দেহে আজ আমার ব্যক্তিত্ব গঠনে সবিশেষ ভূমিকা নিয়েছে। আমার ইংরাজীর শিক্ষক এন ডি স্যারের কাছ থেকে স্কুলজীবনের শেষ দু’ বছরে মূল যে জিনিসটি আমি শিখেছিলাম তা হল সময়ের মূল্য। আমাদের জীবনের সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ বস্তু হল সময়, তাই কোনও বিষয়ে বক্তব্য, সে লিখিতই হোক কি উচ্চারিত, সর্বদাই সীমিত শব্দচয়নে পরিস্কারভাবে প্রকাশ করতে হবে, এবং বলাই বাহুল্য, এই সঠিক শব্দচয়নের পারদর্শিতার জন্য শেষ অবধি ওই ভাষাটিকেই খুব ভাল করে শেখা চাই। আর সবশেষে, বিবেকবাবু, আমার অঙ্কের শিক্ষক। যদিও তাঁকে শুধু এই অঙ্কের গণ্ডির মধ্যেই বেঁধে ফেললে সত্যের অপলাপ হবে। নিউ কদমতলায় তাঁর হলদে রঙের দোতলা বাড়ির দোতলার পুরো অংশটা জুড়ে ছিল তাঁর পড়াশোনার জগৎ। দিনহাটা কলেজের অঙ্কের বিভাগীয় প্রধান হলেও নিজের বিষয়ের বাইরের অন্য সব বিষয়েও ছিল তাঁর অগাধ জ্ঞান, অন্তহীন উৎসাহ এবং একপ্রকার শিশুসুলভ বিস্ময়ভরা আগ্রহ। নতুন কিছু জানতে, নতুন কিছু শিখতে ছাত্রদের সাথে একেবারে সমবয়সী বন্ধুর মতো মিশে যেতে পারতেন তিনি। বিষয়ের চেয়েও বিষয়টিকে দেখার বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গিটুকুই মনে হয় তাঁর কাছ থেকে শেখা আমার আসল প্রাপ্তি। পরীক্ষার খাতায় অঙ্কের খুঁটিনাটি প্রায়োগিক ব্যবহারের ঊর্ধ্বে উঠে বাস্তব জীবনের সমস্ত সমস্যাকে অঙ্কের সমস্যার মতোই শর্ত যুক্তি আর সীমাবদ্ধতা দিয়ে মেনে নিয়ে ঠিকঠাক বাস্তবসম্মত একটা সমাধান বের করার ক্ষমতাটাই তাঁর থেকে পাওয়া আমার শ্রেষ্ঠ শিক্ষা। তাই আজ ফিরে দেখলে মনে হয় কোচবিহার শহর আমার কৈশোরবেলার সেই বিদ্যাগ্রহণকালে এমন কিছু ভীষণ জরুরি শিক্ষা দিতে পেরেছিল যা এতগুলো বছর পেরিয়ে এসেও আজও আমাকে আলো দেখিয়ে চলেছে আর সেখানেই আমার জীবনে শহর কোচবিহারের প্রকৃত সার্থকতা।
তারুণ্যের ঊষাকাল ও এক শহরের গল্প
আমার কলেজ জীবন কেটেছে দক্ষিণবঙ্গের হুগলি জেলার শ্রীরামপুর শহরে, শ্রীরামপুর কলেজে। বিদ্যালয়ের সীমাবদ্ধ চিরচেনা গণ্ডি পেরিয়ে বৃহত্তর জগতের সাথে এই সময়েই আমার প্রথম পরিচয়, আর সেই সাথেই উত্তরবঙ্গের খোলামেলা সহজ সরল পরিবেশ ছেড়ে দক্ষিণের কঠোর জটিল বাস্তবের মাটিতে পা রাখা। কলেজ জীবনে প্রথাগত শিক্ষার একটা বাঁধন থাকলেও এ সময়টা মূলত নিজেকে চিনে নেওয়ার, নিজের আশপাশটাকে চিনে নেওয়ার। ক্রমাগত ধাক্কা খেতে খেতে, চারপাশের বহু মানুষের নিরন্তর রঙ বদলানো দেখতে দেখতে, বহু ওঠা পড়া কষ্ট কান্না ক্ষোভ আর হেরে যাওয়ার পাহাড় ডিঙিয়ে অবশেষে জীবনকে ঠিকঠাক চিনে নিতে সাহায্য করে তারুণ্যের এই কালবেলা। কলেজের পড়া শেষ করে রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে স্নাতকোত্তরে ভর্তি হওয়ার পরে নিয়মিত কলকাতায় যাতায়াত শুরু হয় আমার আর সেই সঙ্গেই দ্রুত বদলে যেতে থাকে আমার ছোটবেলায় দেখা স্বপ্নের কলকাতা। হাওড়া ব্রিজ ছাড়িয়ে বড়বাজার মেছুয়া সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ পেরিয়ে কলেজ স্ট্রিট এবং তারও আগে আর্মহার্স্ট স্ট্রিট শিয়ালদা ছাড়িয়ে রাজাবাজার অবধিই সেসময় আমার দৈনন্দিন গতিবিধির পরিসর। এই গোটা অঞ্চলটা মূলত পুরনো কলকাতা। রাজপথের দু’ধারে পুরনো আমলের মৃতপ্রায় জগদ্দল সব বিশাল বিশাল বাড়ি যার লম্বা টানা বারান্দায় সময় যেন থমকে থাকে। নীচের রাস্তা জুড়ে মহানগরীর অবিশ্রান্ত কর্মব্যস্ততা, দিনের পর দিন একই নিয়মে বাঁধা বহুবিচিত্র জীবনের স্রোত বয়ে চলে একঘেয়েভাবে, অথচ, দুটো তলা ওপরেই যেন তার তাপটুকুও পৌঁছয় না। মুটে মজুর, অস্থায়ী পরিযায়ী শ্রমিক, ছোট মাঝারি বড় সবরকমের দোকানী, ফেরিওলা, ফলওলা, ঠেলাওলা থেকে শুরু করে নানান বয়সী সাধারণ মানুষ সবাই শুধু এ শহরে নিজের লক্ষ্যে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটেই চলেছে, এক মুহূর্তের জন্যেও আশেপাশে তাকানোর সময় ইচ্ছে কি আগ্রহ কিচ্ছুটি নেই! অনেক পরে বুঝেছিলাম বড় শহরের এটাই নিয়ম। এখানে সুযোগ বেশি, কিন্তু তার জন্যে ভিড় বেশি, প্রতিযোগিতা বেশি, ফলে তাড়াও বেশি। তাই কোনও অবাঞ্ছিত আবেগপ্রবণতা নয়, একাগ্র হয়ে একমাত্র নিজের লক্ষ্যে স্থির থেকে সামনের দিকে এগোনোই এ শহরের একমাত্র ধর্ম। বহু বছর ধরে শুধু নির্নিমেষ চেয়ে চেয়ে দেখতে দেখতেই অবশেষে একদিন এই আশ্চর্য সত্যিটা উপলব্ধি করেছিলাম আমি। আর তাই নিজের ভেতরে এতকালের লালিত মানবিকতাটুকু অস্বীকার না করেও মহানগরীর এই দারুণ প্রতিযোগিতামূলক মনোভাবকে সুস্থভাবে গ্রহণ করেছিলাম আমি যা কিনা পরবর্তী জীবনে কোনও ক্ষেত্রে নিজের তরফ থেকে প্রাণপণ চেষ্টার পরেও কোনও ভুল হলে তা আমাকে সহজেই নতমস্তকে স্বীকার করে নিতে শিখিয়েছে, নিজের হার শান্তভাবে মেনে নিতে শিখিয়েছে, আর তারপর, পুনরায় উঠে দাঁড়িয়ে নতুন করে শুরু করতেও শিখিয়েছে, এবং, এটাই সেই তারুণ্যের ঊষাকালে এই মহানগরীর কাছ থেকে পাওয়া আমার শ্রেষ্ঠ জীবনদর্শন।
আমার শহর, তোমার শহর
৫ই আগস্ট, ২০২৪। প্রতিবেশী দেশের উত্তাল ছাত্র আন্দোলন আমূলে উপড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল ক্ষমতাসীন শাসকের সীমাহীন অন্যায় ঔদ্ধত্যের শিকড়। ১৪ই আগস্টের মধ্যরাত। আপামর বাংলার শুভবুদ্ধিসম্পন্ন বিবেকবান নারী পুরুষের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে এ দেশেও জন্ম নিল এক নতুন দিন। এবারের স্বাধীনতা দিবস আক্ষরিক অর্থেই ডাক দিল আরেক স্বাধীনতার। অর্ধেক আকাশের জন্য সমানাধিকারের স্বাধীনতা, সামাজিক নিরাপত্তার স্বাধীনতা, নিজের শরীরের প্রতি, নিজের স্বপ্ন ইচ্ছে মন এবং প্রতিটি সিদ্ধান্তের প্রতি একমাত্র নিজেরই নিঃশর্ত পূর্ণ স্বাধীনতা। দ্রুত বাংলার গণ্ডি পেরিয়ে দেশ জুড়ে এমনকি বিদেশের মাটিতেও দাবানলের গতিতে ছড়িয়ে এই অন্য স্বাধীনতার লড়াই। এ এক আশ্চর্য আগুনবেলা যার ওপারে আছে অমৃত আলোর দুনিয়া। আজ তাই সবার উপরে শুধু এটুকুই প্রার্থনা, তোমার শহর, আমার শহর ছাড়িয়ে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ুক এই অনন্য বিপ্লবের সর্বগ্রাসী অগ্নিশিখা আর শেষমেষ সবকিছু নিঃশেষে দগ্ধ করে ফেলে শুদ্ধ করুক এ পোড়া সমাজকে যেখানে একইসাথে শান্তির শ্বাস নিতে পারে প্রতিটি প্রাণ, যেখানে লিঙ্গ পরিচয় যেন আর একটি মানুষেরও জীবনের নির্ণায়ক না হয়ে ওঠে।
No comments:
Post a Comment