স্মরণ
শ্রদ্ধাঞ্জলি
অদিতি মুখার্জী (সেনগুপ্ত)
"বেলা শেষে " নিভল যে "সাঁঝবাতি",
"হীরক রাজার দেশে" "সোনার কেল্লা" তে এল যে "অশনি সংকেত"।
"পোস্ত"- এর "ফেলুদা" এখন হয়েছে "প্রাক্তন",
"বসন্ত বিলাস"- এ সকলের আঁখিতে আজ "শ্রাবণের ধারা"।।
'অরণ্যের দিন রাত্রি " তে "আকাশ-কুসুম" ভাবেন "গণদেবতা ",
তাঁর "স্বরলিপি" রবে "ঘরে-বাইরে " "অপরাজিত"।
"কনি", "চারুলতা" সবাই এখন "সমান্তরাল",
"শাখা-প্রশাখা" বিস্তারিত হওয়ার আগেই হল "অভিযান" - এর "সমাপ্তি"।।
পিয়াস গোস্বামী
বেলা শেষের পারে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ,অভিভাবক হারা হলেন টালিগঞ্জ
বটু কৃষ্ণ হালদার
২০২০ সালের শুরু থেকেই মানব সভ্যতার কাছে মোটেই সুখকর নয়। কোভি ড_১৯ শ্রেষ্ঠ সভ্যতার কাজে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চেনা পৃথিবী,পরিবেশ মানুষজন সব অচেনা হয়েছে। কান পাতলেই শুনতে পাওয়া যায় পরিজন হারানোর আর্তনাদ। করোনার সাথে যুদ্ধ করতে করতে ইতিমধ্যে আমরা হারিয়েছি ডাক্তার নার্স পুলিশ স্বাস্থ্যকর্মীদের।না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছে শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি জগতের অনেক ই।তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলো সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, যাঁকে ভালোবেসে অনেকেই ডাকতেন পুলু বলে। টালিগঞ্জ স্টুডিও পাড়া শোকস্তব্ধ।স্টুডিও পাড়া অভিভাবক কে হারালেন, এ কথা অস্বীকার করার কোন জায়গা নেই এই মুহূর্তে। মৃত্যু চিরন্তন সত্য। এই তত্ত্ব কে সামনে রেখে জীবন যুদ্ধে হার মেনেছে তাঁর নশ্বর দেহ টা। কিন্তু সামাজিক প্রেক্ষাপটে বাস্তব চিত্রায়নে দিয়ে গেছেন মহামূল্যবান স্বাক্ষর। যা আঁকড়ে তিনি যুগের পর যুগ বেঁচে থাকবেন তাঁর অনুগামীদের হৃদয়ে।
জনপ্রিয় অভিনেতা হওয়ার আগে পুলুর জীবন সম্বন্ধে টুকরো ঘটনা গুলো যা আমাদের হৃদয়ের সাড়া জাগায়। ১৯৪৬ সালের জানুয়ারির ঘটনা। এই সময় পুলুর সঙ্গে আলাপ হয় বন্ধু অশোক পালিতের।ওই সময় তার পরনে ছিল খাঁকি হাফ শার্ট আর হাফ প্যান্ট।শার্টের দুদিকে বুক পকেটের বাঁদিকে একটি ব্যাজ আটকানো ছিল। তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন এটা কিসের ব্যাজ?পুলু উত্তর দিয়েছিল "আই এন এ র"। কৃষ্ণনগরের নাকি বারাসাত, কোথায় যেন কোন এক আই এন এর সোলজার ওই পদক টা পুলু কে দিয়েছিল। আই এন এ মানে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি। অর্থাৎ আজাদ হিন্দ ফৌজ।এর থেকে আশা করা যায় তিনি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সংস্পর্শে এসে ছিলেন। ভাবা যায়।
পড়ুয়া সৌমিত্র কলকাতায় থাকাকালীন বহু সময়ই নাটক ,সিনেমা দেখতে গিয়েছেন। ডেসিকার ফিল্ম দেখার জন্য লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কেটেছেন।‘জলসাঘর’ ছবির শুটিং চলছে তখন। সত্যজিৎ রায়ের সিনেমার শুটিং দেখতে আসেন অনেকেই। নাটকের অভিনেতারাও আসেন। এমনি একটি ছেলেকে হঠাৎ ডেকে পাঠালেন স্বয়ং পরিচালক। ঘরের মধ্যে তখন ছবি বিশ্বাস এবং সত্যজিৎ রায়। আগন্তুক ছেলেটির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে গিয়ে সত্যজিৎ রায় ছবি বিশ্বাসকে বললেন, ‘এই আমার পরবর্তী ছবির নায়ক’। ব্যাস্, এভাবেই হঠাৎ করে ঢুকে পড়া সিনেমার জগতে। ১৯৫৯ সালে মুক্তি পেল ‘অপুর সংসার’। তারপর এই ৬১ বছর ধরে একভাবে টলিউডের বুকে ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।এমন এক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে যুবক 'অপু'র খোঁজ করতে গিয়ে আলাপ সত্যজিৎ রায়ের। ১৯৫৯ সালে 'অপুর সংসার' এর হাত ধরে একজন এমন বাঙালি ছাপোষা অথচ উজ্জবল চেহারার অভিনেতাকে সত্যজিৎ স্ক্রিনে ধরেছিলেন ,যাঁর ব্যক্তিত্বে বাঙালি বিভোর হয়েছে। ততদিনে বিভূতিভূষণের অপু সৌমিত্রের হাত ধরে যেন ঠিক পাশের বাড়ির ছেলে। এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। অপুকে যেভাবে বাঙালিবুকে জড়িয়েছে, তেমই ৭০ এমএম পর্দার ফেলুদাকে বাঙালি সৌমিত্রর চেহারাতেই চিনতে পেরেছে। সত্যজিৎ-সৌমিত্রর হাত ধরে এসেছে হীরক রাজার দেশের মাস্টার মশাইয়ের চরিত্র, এসেছে 'শাখা প্রশাখা' ,'অরণ্যের দিনরাত্রি'র মতো ছবি করেছেন।১৯৮৪ র 'কোনি',১৯৭৩ র 'বসন্ত বিলাপ',১৯৭২ এ উত্তম কুমারকে সমানে সমানে টক্কর দিয়ে 'স্ত্রী' বাঙালিকে আজও বিভোর করে। ১৯৬১ সালে একইভাবে বাংলার মহানায়ক উত্তম কুমারের সঙ্গে কাঁটায় কাঁটায় তাল মিলিয়ে সৌমিত্র অসামান্য অভিনয় উপহার দেন 'ঝিন্দের বন্দি' ছবিতে। ১৯৬৪ এর 'চারুলতা'য় মাধবী,শর্মিলার সঙ্গে ১৯৫৯, এ "অপুর সংসার',১৯৬০ এ 'দেবী', ১৯৬১ তে অপর্ণার সঙ্গে 'তিনকন্যা', যেন সৌমিত্রকে নায়কের থেকেও এক উঁচুস্তরে নিয়ে যায়। বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের সঙ্গে 'তাহাদের কথা',পরবর্তীকালে ঋতুপর্ণের সঙ্গে ' অসুখ' এরপরের যুগে ' বেলা শেষে' সৌমিত্রকে যেন 'পরিচালকের অভিনেতা' করে তুলেছিল। যুগ, কাল,বয়সের উর্ধ্বে তিনি হয়েছিলেন 'অভিনেতা'।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্য়ায়ের লেখা বই'মানিক বাবুর সঙ্গে ' মুক্তি পাওয়ার আগে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের আত্মজীবনী মূলক বই ছিল 'পরিচয় '।এছাড়াও ','চরিত্রের সন্ধানে' ,'শব্দরা আমার বাগানে', 'মধ্যরাতের সংকেত' সহ বহু বই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের হাত ধরে বাঙালির কাছে আসে।তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ছয়টি। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ছিল 'জলপ্রপাতের ধারে দাঁড়াবো বলে'(১৯৭৫),।এরপরে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ গুলি হল "ব্যক্তিগত নক্ষত্রমালা(১৯৭৬),","শব্দরা আমার বাগানে"(১৯৮১),"পড়ে আছে চন্দনের চিতা"(১৯৮৩), "হায় চির জল"(১৯৯২),এবং সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা(১৯৯৩)।
থিয়েটারের সঙ্গে তার নাড়ির সম্পর্ক ছিল।শিশুকাল থেকেই তিনি থিয়েটারে অভিনয় করে আসছেন।পুলুর বাবা ও বড় ভাই খুব ভালো অভিনয় করতেন।১৬ বছর বয়সে তিনি যখন কলকাতায় কলেজে ভর্তি হলেন,সেসময় শিশির ভাদুড়ীর অভিনীত একটি নাটক দেখতে গিয়েছিলেন। সেই থেকেই তার মাথায় অভিনয় ভর করে বসে।১৯৬৩ সালে 'তাপসী' দিয়ে শুরু সৌমিত্র চট্টোাপাধ্যায়ের নাট্যজীবন। এরপর রাজকুমার, ফেরা, চন্দনপুরের চোর, নীলকন্ঠ, টিকটিকির মতো নাটক কখনও তাঁর অভিনয়ে কখনও বা তাঁর নির্দেশনায় সমৃদ্ধ হয়েছে।তবে তিনি বাংলা রঙ্গমঞ্চের বিপ্লব ঘটালেন "নামজীবন" নাটক দিয়ে।সম্প্রতি তার নাটক টিকটিকি মঞ্চে দারুণভাবে সাড়া ফেলে দিয়েছিল।শেষে ৭৬ বছরের স্বপ্নপূরণ করলেন জীবনে প্রথম শেক্সপিয়ারের কিং লিয়ার চরিত্রে অভিনয় করে।অভিনয়ের টানে পুলু এন এম এ পরীক্ষায় বসেনি।সেই কয়েক মাস কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যদল নিয়ে দিল্লিতে আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় গিয়েছিল। সেই প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠ অভিনেতার শিরোপা তার মাথায় উঠেছিল। নাটকের টানে এম এ পড়া হলো না। কারণ ভাগ্যলক্ষী তাকে অন্যদিকে ডাকছে।১৯৫৮ তে ডাক পান অপুর সংসার ছবিতে। বাকিটা তো ইতিহাস হয়ে রইলো।
তিনি শুধু মহান অভিনেতা ছিলেন না। ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। অভিনয়ের পাশাপাশি,১৯৬০ সালে প্রথম প্রকাশিত "এক্ষণ" নামক পত্রিকার সম্পাদনা, সঙ্গী ছিলেন সহপাঠী কবি নির্মাল্য আচার্য,পরিচালক,চিত্রকর,গায়ক হিসেবে আমরা তাকে পাই।একজন দক্ষ কবি হিসেবেও আমরা তার দক্ষতার ছাপ পেয়েছি। অভিনয় জীবনে প্রথম প্রেম ছিল। কিন্তু পাশাপাশি লিখে গেছেন বহু কবিতা। শুধু তাই নয় তিনি একজন সমৃদ্ধ বাচিকশিল্পী ও বটে।তিনি স্বীকার করে গেছেন শিশুকাল থেকে কবিতা লিখতেন না। যখন তিনি ক্লাস টেনে পড়ে তখন থেকে কবিতা লিখতে শুরু করেছেন।সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা লেখার প্রথম বাঁধানো খাতার প্রথম পাতায় যে কবিতাটা ছিল তার নাম সম্ভবত "দীপান্বিতা"। কবিতার শুরুতে ছিল এরকম একটা লাইন_"কে গো তুমি দীপান্বিতা"।কবিতার প্রতি ভালোবাসা ছিল বাড়ি থেকে। কারণ তার বাবা খুব ভালো আবৃত্তি করতেন। শুধু তাই নয় মা কবিতা বলে তাকে ঘুম পাড়াতেন।তাঁর প্রথম কবিতা ছাপা হয় কলেজ ম্যাগাজিনে।তখন তিনি মাস্টার ডিগ্রী করছেন। এই সময়ে তার কলেজ বন্ধু সুধীর চক্রবর্তীর সম্পাদনায় একটা কাব্য সংকলন বার হয়েছিল। কাব্য সংকলন টি প্রথমে বেরিয়েছিল হাতে লিখে। তার নাম ছিল "অমৃত যন্ত্রণা"।সেটা এত খ্যাতি পেল যে বন্ধুবান্ধবরা টাকা দিয়ে প্রকাশ করল।সেটা প্রকাশ করেছিলেন প্রয়াত কবি তারাপদ রায়(১৩৬৩ সাল)।আশ্চর্যজনকভাবে মাত্র তিন মাসে তার ৫০০ কপি বিক্রি হয়ে গেল। কাগজে ভালো সমালোচনা বার হল।সেই কাব্য সংকল নে প্রকাশিত সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার কয়েকটি লাইন দেওয়া হল।কবিতার নাম_"এই বাদাম গাছের ছায়ায়"_
লেখক_সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়
এই বাদাম গাছের ছায়ায়
তোমায় আমি উপহার দেব একটি শোক
যেনো আজ এই চৈত্র দিনের সন্ধ্যায়
তার থেকে আপন
আর তোমার কেউ নেই।
এরপর কৃত্তিবাস পত্রিকায় কবিতা ছাপা হয়। তার কফি হাউসে কবি বন্ধু ছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়,সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সহ বহু জ্ঞানীগুণী ব্যক্তি।তিনি ব্যক্তিগতভাবে স্বীকার করেছেন সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতা গুলি তাকে অনুপ্রেরণা যোগাতে সাহায্য করত।তাঁর গভীর অন্দরে এক কবিসত্তা কবিতার জগতে অন্য মাত্রা এনে দিয়েছে। তার মুখে আবৃত্তি গুলো আবৃত্তি প্রেমী মানুষ দের হৃদয়ে করাঘাত করে।
পারিবারিক সূত্রে বহু গুণে পরিবারের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক ছিল। অভিনেতা প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় একটি লেখাতে স্বীকার করেছেন, তার অন্নপ্রাশন মুখে ভাতটা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নিজের কোলে বসিয়ে দিয়েছিলেন। উত্তম কুমার এবং সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে বাঙ্গালীদের কাছে তর্জার বিষয় ছিল ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগান এর মত।অথচ দুজনের পারস্পারিক সম্পর্ক ঠিক তেমন ছিল না। ঝিন্দের বন্দী সিনেমা তে উত্তম কুমারের সঙ্গে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম অভিনয়। এই প্রসঙ্গ উঠতেই তিনি বলেছেন ব্যক্তিগতভাবে উত্তম কুমারের সঙ্গে তার পরিচয় ছিল।তার ভগ্নিপতির বন্ধু ছিলেন উত্তম কুমার।সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বোনের বিয়েতে বরযাত্রী হিসেবে এসেছিলেন তাদের বাড়িতে। এরপর থেকে সুসম্পর্কের শুরু হয়। উত্তম কুমারের নাতি গৌরবের অন্নপ্রাশনের সময় উত্তম কুমারের ছেলে গৌতম কুমার ও তরুণ কুমার সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে নেমন্তন্ন করতে এসেছিলেন। এসময় তারা তরুণ কুমার সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কে বলেছিলেন, দাদা তো নেই, আপনাকে একটু দাঁড়িয়ে সবকিছু দেখে নিতে হবে। এমনই ছিল উত্তম কুমারের সঙ্গে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পারিবারিক সম্পর্ক। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কলেজপাড়া কালিনী উত্তম কুমারের ফ্যান ছিলেন।সেসময় বলিউডে উত্তম কুমার সুচিত্রা জুটি ছিল বাঙালির হার্টথ্রব। একের পর এক হিট ছবিতে বাজিমাত করে চলেছে।তার সঙ্গে ঝিন্দের বন্দী তে অভিনয় করে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় পরম তৃপ্তি লাভ করেছিলেন।বাংলা চলচ্চিত্র জগতের উত্তম কুমারের সঙ্গে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ছয় টি ছবিতে অভিনয় করেছেন।ছবি গুলির নাম হল ঝিন্দের বন্দী অপরিচিত স্ত্রীর প্রতিশোধ দর্প চূর্ণ দেবদাস।তার চোখে উত্তম কুমার মানেই অসামান্য ক্যারিশমাটিক রোমান্টিসিজম। একদিকে উত্তম কুমার সব সময় ধরে রাখতে চেষ্টা করেছেন নায়কসুলভ গ্ল্যামার। সে দিক থেকে সৌমিত্র বার বার চেনা সব ভেঙে এগিয়ে এসেছেন বিভিন্ন চরিত্রে। শুধু তাই নয় তিনি ছিলেন মুম্বাইয়ের প্রখ্যাত অভিনেতা নাসিরুদ্দিন শাহ র খুব প্রিয়।২৫ শে আগস্ট, ২০১৬ সালে দে'জ প্রকাশিত হয় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা গদ্য সংগ্রহ, যা নন্দনে প্রকাশ করেছিলেন মুম্বাইয়ের প্রখ্যাত অভিনেতা নাসিরুদ্দিন শাহ, সহ কবি শঙ্খ ঘোষ রঞ্জিত মল্লিক। সেই সময় একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে বলেছেন_"সৌমিত্রদা আমার কাছে একজন সেরিব্রাল অভিনেতা।তার বুদ্ধি,বিচার,বিশ্লেষণ ক্ষমতা,মেধা,মঞ্চ_ থিয়েটার নির্মাণ তার নির্দেশনা চরিত্রের রূপ নির্মাণ_ এক কথায় অসাধারণ। তিনি আরো জানিয়েছিলেন আলকাজি দুবের মত খুব শক্তিশালী নাট্য নির্দেশক সৌমিত্রদা। পাশাপাশি জর্জ বার্নাড শ, সেক্সপিয়র, ইসমত চুঘতাই,মন্টুর সঙ্গে তুলনা টানা যায় সৌমিত্রদার প্রতিভার। সত্যজিৎ রায়ের এক ডজন ছবিতে কাজ,তাঁর লেখা, তাঁর আঁকা,শিশির ভাদুড়ী ছাত্র, রবীন্দ্র অনুরাগী সৌমিত্রদার মত অনন্য প্রতিভার ভূ-ভারতে বিরল"।
অভিনয়জগতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এক বলিষ্ঠ ও সাবলীল অভিনেতা। চোখের সামনে ভেসে ওঠে অপু ফেলুদা উদয়ন পন্ডিত আর অবশ্যই নরসিংহ সহ বহু কালজয়ী চরিত্র।তবে সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় অভিযান ছবিতে একজন ট্যাক্সি ড্রাইভার এর চরিত্র দর্শককে মুগ্ধ করেছিল। সিনেমা জগতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কে আলাদাভাবে চিনতে শুরু করে। এই বাংলা সিনেমার সঙ্গে জড়িয়ে ছিল অন্য এক কিংবদন্তির নাম। হয়তো সেদিন উত্তমকুমারকে এই চরিত্রে দেখা যেত। সময়টা ছিল ষাটের দশকের শুরু।প্রযোজক বিজয় চট্টোপাধ্যায় ঠিক করলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস নিয়ে একটি ছবি তৈরি করবেন। পরিচালনা করবে অভিযাত্রিক গোষ্ঠী। গল্পের মুখ্য চরিত্রে ছিলেন একজন ট্যাক্সি ড্রাইভার। এই ছবিতে অভিনয় করার জন্য পরিচালক ছুটে গেলেন মহানায়ক উত্তমকুমারের কাছে।কিন্তু এই চরিত্রে অভিনয় করতে গেলে নায়ক সুলভ গ্ল্যামার ছেড়ে বেরিয়ে আসতে হবে এই কথা শুনেই না করে দিলেন উত্তম কুমার। পরিচালক বাধ্য হয়ে ছুটে গেলেন সত্যজিত্ রায়ের কাছে। সত্যজিৎ রায় হাসিমুখে পরিচালনার দায়িত্ব তুলে নিলে ন। তিনি বেছে নিলেন অপুর সংসার, দেবী খ্যাত সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কে। আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। এক্ষেত্রে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় পরে বলেছিলেন"ভাগ্যিস উত্তমদা অভিনয় করতে রাজি হননি"।
সত্যজিৎ রায় তখনও পরিচালনার খাতা খুলতে পারেননি। ইতিমধ্যেই উত্তম কুমার সবার হৃদয় জয় করে বসে আছে। উত্তমকুমারকে যখন সত্যজিৎ রায় বড় পর্দায় দেখেন তখন তিনি মহানায়ক। পরিচালক নির্মল দের বসু পরিবার ছবিটি সত্যজিতের মন জয় করেছিল। তিনি অবাক হয়েছিলেন এটা দেখে একজন মঞ্চ অভিনেতা হয়েও সিনেমার অভিনয় কোন মঞ্চের ছাপ ছিল না। সুচিত্রা সেন ও উত্তম কুমারের রোমান্টিক জুটি তখন সারা বাংলা কাঁপিয়ে চলেছে।কিন্তু সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে উত্তম কুমারের দুটি ব্যতিক্রমী ছবি হল "নায়ক" ও "চিড়িয়াখানা"।১৯৬৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত নায়ক গল্পের রচয়িতা সত্যজিৎ রায় নিজেই ছিলেন।এই কিংবদন্তি পরিচালকের সঙ্গে সর্বাধিক কাজ করা অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এসে একদিন সত্যজিৎ রায় কে জিজ্ঞাসা করলেন নায়ক সিনেমা তে আমাকে নিলেন না কেন? সত্যজিৎ রায় সৌমিত্র দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেছিলেন তুমি কি উত্তম? নায়ক উত্তম কে দেখেই মনে হয়। ক্যারিজমা উত্তমকে দেখেই মনে হয়। প্রেমিক উত্তমকে দেখেই মনে হয়। তাই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নিশ্চয়ই ভালো অভিনেতা ছিলেন। কিন্তু নতুনভাবে প্রেমে পড়ার লুক, ছোট ছোট দিক, যেটা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মধ্যে ছিল না।আর সেজন্যই নায়ক ছবির জন্য উত্তম কুমার কে বেছে নিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়।
তবে পঞ্চাশ ষাটের দশকে তখন বাংলা সিনেমা বলতে ছিল মূলত উত্তম কুমার সুচিত্রা সেন।বাজার, হাট, সেলুন, চায়ের দোকান,রাস্তার মোড়,গাছের তলায় আলোচনার মূল বিষয়বস্তু ছিল উত্তম কুমার। তার হাঁটার স্টাইল, চশমা,চুলের কাটিং,কথা বলার ধরন,জমা,প্যান্ট পরার ধরন, শব কিছু তাকে নকল করে চলছিল।নারী,পুরুষ উভয়ের লীপের ডগায় আলতো স্পর্শ হতো শুধু উত্তম কুমার।বর্তমান সমাজ প্রেক্ষাপটে বোঝা যায়, নারী রাত কতটা পরাধীন ছিল।সেই জায়গায় থেকে বাড়ির পরিজন,পাড়া প্রতিবেশীর চোখ এড়িয়ে কলেজ কাট মেরে সিনেমা হলে ছুটে গেছে শুধু উত্তম কুমারের টানে।অনেকে বাড়ির বড় দের থেকে বকুনি,কানমলা খেয়েছে তাতে ও কুছ পরোয়া নেহি।টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে উত্তম চরিত্র কেন্দ্রিক পত্রিকা কিনে নিজের ব্যাগে রাখা র মত মহা অপরাধ কে তুচ্ছ করেছে অনেকেই।টিফিন টাইমে বন্ধুরা মিলে একসঙ্গে চুপি চুপি দেখা,দেখতে দেখতে হৃদয়ে ঢেউ তোলা সেই জমানার অলংকার ছিল।সেই বাঁধা ছক ভেঙে মহানায়ক উত্তম কুমারের জনপ্রিয়তায় ব্রেক লাগানো মানুষটির নাম হলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ধীরে ধীরে সমস্ত জায়গায় উত্তম কুমারের পাশাপাশি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে লাগলো। শুরু হলো দুইজনকে নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ। তবে যাই হোক দুজনেই তাদের কাজের জায়গায় স্বমহিমায় উজ্জ্বল ছিলেন। তাই একজনের জায়গা অন্য কেউ নিতে পারে না। সমাজের মুখে দুজনেই আলাদা আলাদা সত্ত্বা হয়ে উঠলেন।সত্যি ভাবতে খুব অবাক লাগছে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আর নেই। কল্পনার অতীত, এভাবেই থমকে যাবে অপুর সংসার। কষ্ট হচ্ছে এটা ভেবে তোমাকে ঘরে-বাইরে খুঁজলেও আর কোনোদিন দেখতে পাবো না।তবে শ্রাবণের ধারার মতো প্রতিটি বিন্দুতে, সোনার কেল্লার প্রতিটা পাথরে, শাখা প্রশাখায়,সাঁঝবাতির প্রথম শিখায়, এমনকি জীবনের প্রতিটা পদক্ষেপে আমরা তাকে নতুন করে অনুভব করব। তিনি যেখানে গেছেন সুখে থাকুন। তাঁর আত্মার চিরশান্তি কামনা করি।
No comments:
Post a Comment