সিঁদোল
অখিল ঘোষ
ছেলেকে নিয়ে নীরবালার স্বপ্নগুলো হারিয়ে গেছে কবেই। মনের ভেতর গ্রন্থিত আশাগুলি আষাঢ়-প্লাবিত মরা রায়ডাকের স্রোতে ভেসে গেছে তার বহুদিন আগেই। আর আজ যেন সেই স্বপ্নাধার মনটাই ভেঙ্গে গুড়িয়ে গেল।
মনে পড়ে নীরবালার--- ছেলে ছোটবেলায় দূর মাঠে যখন খেলতে যেত, বেলা ঢলে পড়ত পশ্চিমের বাঁশবাগানের আড়ালে, পুবের দিঘি থেকে হাঁসেরা উঠে এসে ধীরগম্ভীর পদে এগুতে থাকত নিজেদের আস্তানার দিকে, উত্তরের গুয়াবাগানের ওপর দিয়ে বাসায় ফিরত সাদা বকের সারি, দক্ষিণের 'ধুয়া' মাঠের ওপর দিয়ে বাদুড়েরা একটা দুটো করে রাতের সফরে বেরোতে শুরু করত, একদল শালিক 'ডারিঘর'-এর চালে বসে দিনের শেষ জটলাটা সেরে নিত, চড়ুই পাখিগুলো ফুড়ুৎ করে উড়ে শেষবারের মত ঝাপড়া আম গাছটার ভেতর সেঁধিয়ে পড়ত, তখনও ছেলের ফিরবার নাম নেই দেখে বুকের ভেতরটা কেমন করতো ওর। 'আগদুয়ারির' বিষহরি মণ্ডপে 'গছা' দিয়ে আসতে আসতে গলা ছেড়ে হাঁক পাড়ত সে--- অারে কা-ন্দু-রা রে-এ-এ...!
কান্দুরা ওর ডাকনাম। 'ছুঁয়াঘর' এ থাকার সময় দিনরাত শুধু কাঁদত বলে ওর ঠাকুর্দা এই নামটা দিয়েছিল। আসল নাম মংলু--- মঙ্গলবারে জন্মেছিল বলে--- এখন অবশ্য সেই নামটিও নেই, কলেজে ওঠার সময়ে কোর্টে গিয়ে পাল্টে 'মঙ্গল' হয়েছে।
হাঁক শুনে ছেলে ছুটে এসে জিজ্ঞেস করত-- কী হইছে মাগো, ডেকাইস্ ক্যানে?
--- ডেকাং ক্যানে! সাইনঝ্যা পার হয়া যাবার ধইরচে, এ্যালাও বাড়িত আইসার নাম না করিস ক্যানে তো? জানিন্ ন্যা, এই সমায় খ্যাতে পাতারে, ঘাটায় আঘাটায় কত দ্যাও মাষাণ ভূত পেত্যানি ঘুরি বেড়ায়!
---ভূত পেত্যানি মোর কী করিবে? --ছেলে নিজের বাহুতে চাপড় মেরে তাকে ভরসা দিত--- মোর সোতে পাইবে কিতা উমরা ? মোর ঝা গায়ের জোর!
--- তোর গায়ের জোর বিরাইবে ; বুজিবু, ঝেদিন গদ্দানত ঠাসি ধইরবে।
সে কথায় পাত্তা না দিয়ে নীরবালাকে জাপটে ধরে মুখটা কীরকম যেন মায়ালু করে তুলে আব্দারী স্বরে বলত, ম্যালা ভোক নাগিছে মাগো, এ্যাকনা এ্যাও দিবু, আধাফুটা ?
কপট রাগের স্বরে বলত নীরবালা--- যা হাঠ্যাং ধুয়্যা আয় আগোত। খেয়াদেয়া পড়া পড়ির বসিবু !
হাত-পা ধুয়ে এসে এক 'জামখোরা' ভরে দুধ-আঁঠিয়া কলা দিয়ে আধাফুটা খেত হাপুস হুপুস করে। যেন কতদিনের ভুখা।
ওর খাওয়া দেখতে বড় ভাল লাগত নীরবালার। যেদিন সিঁদোল হত, সেদিন তো খাওয়া ওর শেষই হত না। শেষে কারো বকুনি খেয়ে তারপর উঠত পাত থেকে। খাওয়ার ভারে উঠতেই পারত না। কোনওরকমে উঠে কুঁজো হয়ে হাত ধুতে যেত। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পর্যন্ত পারত না। পেটটা হয়ে উঠত পুরো হাওয়া ভরা গোলগাল শক্ত একটা ফুটবলের মতো। কী ভালোটা যে লাগত তা দেখে নীরবালার ! হাত ধুয়ে এসে ঝালের চোটে সারা বাড়ি ঘুরে ঘুরে ' হু-হা' করে বেড়াত। আর মাঝেমধ্যে বলত, 'খালুং রে খালুং, সে-ই খান খালুং আজি !'
সিঁদোল খেতে এত ভালবাসত ছেলেটা, আর আজ....
এই তো সেদিনও, কলেজে পড়ার সময়, হোস্টেল থেকে বাড়ি ফিরেই বলত, মাগো, আজি সিঁদোল রান্দিবু! তোর হাতের সিঁদোল খাবার বাদে জিঁউ এ্যাক্কেরে আখাস ফাকাস নাগাইছে !
এমনকি ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় যে ক'দিন বাড়িতে থাকত, সাধ মিটিয়ে তো খেতই, যেদিন ফিরে যেত, হটপট-এ করে নিজের ও বন্ধুদের জন্য নিয়েও যেত। আর,মাঝেমধ্যেই বলত, মাগো ! তোর নাকান সিঁদোল রান্দিবার আর কাঙোয় নাপায়। উ-আ-হ ! কী সোয়াদ যে নাগে তোর সিঁদোলের !
নীরবালার মনে যে কী আনন্দই হত সেসব শুনে !
আসলে নীরবালা সিঁদোলটা তৈরিও করে খুব মন দিয়ে আর খেটেখুটে।
লেখাপড়ায় খুব ভাল ছিল কান্দুরা। দ্বিতীয় হয়নি কখনও কোনও ক্লাসে। ইউনিভার্সিটির পড়া শেষ হতে না হতেই মুম্বাইতে বড় একটি সংস্থায় বেশ উঁচু পদে চাকরী পেয়ে যায়। ফ্রিতে ফ্ল্যাট, ব্যক্তিগত গাড়ি, ট্রেনে-বিমানে যাতায়াত সবই কোম্পানি বহন করে। বেতনও দেয় বিরাট অঙ্কের।
সেই যে গেল ছেলে দূরে, নীরবালা আর নাগালই পেল না তার। মন শুধু তার আঁকুবাকু করে মরে। ছেলে রয় সুদূরে দিন-মাস-বছর। সযত্নে তৈরি করা সিঁদোল তার পড়ে থাকে অনাদরে। বর্ষায় ভরভরন্ত খেতপাথার নদীনালা খালবিল থেকে জাল-জাখৈ-ঝাঁটি-ঢোসকা-টেমাই-বুরুং ভরতি করে উঠে আসে চ্যাং শাটি দ্বারিকা খলিসা পুটি মলা কই শিঙি মাগুর ; ফাগুন-চৈতে 'বাহো' দিয়ে অথবা খালবিলের জল সেঁচেও ধরা পড়ে প্রচুর মাছ। বেছে বেছে যত্ন করে শুটকি দেয় নীরবালা, সিঁদোল বানায়; কিন্তু কেউ আর এসে বলে না--- মাগো, তোর হাতের সিঁদোল খাবার বাদে জিঁউ এক্কেরে আখাস-ফাকাস নাগাইছে !
প্যালকা ভ্যালকা আধাফুটা ফোকতানি নীরবালার পড়ে থেকে থেকে আস্তাকুঁড়ের খাদ্য হয় শেষে। কান্দুরা ( নীরবালা ওকে কান্দুরা বলেই ডাকে এখনও) চলে গেছে দূরে, সেসব খাওয়ার মানুষ নেই। অন্যেরা খেলেও সেই তৃপ্তির ছাপ খুঁজে পায় না কারো চোখেমুখে নীরবালা। বলা ভাল, অন্য কারো তৃপ্তি তাকে তেমন শান্তি বা আনন্দ দিতে পারে না।
সেই যে গেল ছেলে, আর তো কই এলোই না। বিষুয়া যায়, পুষনা যায়, তেরাবেড়া যায়, যাত্রা
যায়; যায় রাস, দোল সোয়ারি মেলা, নীরবালার দিন শুধু পথের পানে চেয়েই যায়।
যদিওবা দু একটিবার আসে ও, উল্কার মতো মুহূর্তে মিলিয়ে যায়। নীরবালা রোজ বিষহরি মণ্ডপে 'গছা' দেয়, দূরে মাঠের দিকে তাকায়, ছোট ছোট ছেলেরা মাঠে খেলা করে, নীরবালার মনটা হু হু করে ওঠে। ওর মনে হয় ছোট্ট কান্দুরা বুঝি ওই মাঠে খেলা করছে। আকুল হয়ে মনটা ওর ডেকে ওঠে--- আরে কান্দুরা রে-এ-এ-এ...
অন্তরের সেই ডাক কোথাও পৌঁছায় কিনা জানে না সে, কিন্তু ওর ভেতর থেকে সে ডাক উঠতেই থাকে, উঠতেই থাকে বিষুয়া থেকে পুষনায়, যাত্রা থেকে তেরাবেড়ায়। কান্দুরা আসে না। বড় কোম্পানি, বড় পদ, বড় বেতন, বড় দায়িত্ব; তাই ছুটি নেই। বহুদিন পর হয়তোবা আসে ধুমকেতুর মতন, আবার চলে যায় নিমেষে; আবার প্রতীক্ষায় থাকে নীরবালা। সে আসে না, তার টাকা আসে মাসে মাসে নিয়মিত। নীরবালা সে টাকা শুঁকে তুলে রাখে সিন্দুকে। মাঝেমাঝে বের করে শোঁকে, আবার রেখে দেয়। সে টাকায় গন্ধ আছে কান্দুরার। সেই গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে দুচোখ জলে ভরে যায় নীরবালার।
পরপর তিন মেয়ের পর ষাইটোল মায়ের দয়া একমাত্র ছেলে কান্দুরা। একে পাওয়ার জন্য কী না করেছে নীরবালা--- কত জায়গায় হত্যা দিয়েছে; কত মায়ের পাট, বাবার থানে মানত করেছে। করেছে কত ব্রত পালন। বক্সিরহাটের পলিকা মেলায় গিয়ে মনস্কামনা কালী মাকে 'কইতর' দিয়ে পুজো দিয়েছে। ধুমপুরের মাসানকালী মন্দিরে পাঁঠা মানত করেছে। 'ডাংধরা মাও' এর পূজায় উপোস থেকে সোনার নথ দিয়ে সঙ্কল্প করেছে। করেছে মাসান পূজা, বুড়া ঠাকুরের পূজা, ষাইটোল পূজা, মূর্তি দিয়ে কাতিপূজা ; শেষে ভোঙর ডাঙানো, তাবিজ-কবজ, জলপড়া-ফলপড়া কিছুই বাদ রাখেনি নীরবালা একটি পুত্রসন্তানের জন্য। ওঝা ডেকে এনে বাড়ির চারপাশে অপদেবতার ' নজরকাটা' করেছে। ভাল করে পুজো করে লাগিয়েছে হনুমান নিশান--- যে যেটা বলেছে, অগাধ বিশ্বাস নিয়ে করেছে সেটাই। ছুটে গেছে কাছেদূরে সব থান-পাটে; মানত করেছে, পুজো করেছে গলবস্ত্র হয়ে, আঁচল পেতে যাচ্ঞা করেছে একটি পুত্রসন্তান।
সেই বহু আকাঙ্খিত বুকের ধন, হৃদয়ের টুকরা এখন বৈদেশিয়া।
বুকের ভেতরটা চৈতের দুপুরের মতো খা-খা করে নীরবালার সবসময়। কান্দুরা বিহনে সেখানে মিষ্টি পাখিডাকা নেই, শীতল বাতাস নেই, মিঠে রোদ নেই, কাশফুলের দোলা নেই, বৃষ্টির ঝরঝর নেই। সেখানে আছে শুধু বিষণ্ণ সকাল আর বিবর্ণ বিকেল ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত নিদ্রাহীন রাত। না জানি ছেলেটা কত কষ্টে আছে। ঠিকমতো খেতে পাচ্ছে কিনা কে জানে। খেতে ভালবাসে, কিন্তু কে খাওয়াবে ওকে যত্ন করে বিদেশ বিভুঁইয়ে? এই ভাবনার আবহেই নীরবালার দুঃস্বপ্নকণ্টকিত প্রতিটি রাত কাটে প্রায় বিনীদ্রভাবে।
নীরবালার মাঝেমাঝে মনে হয়, ছেলেকে অত ভাল করে লেখাপড়া না শেখানোই ভাল ছিল। জমিজিরেত যতটুকু আছে, 'হাইল্যার' আর পাঁচটা ঘরের ছেলের মতন হালকৃষি করলে মোটা ভাত মোটা কাপড়ের অভাব হত না। বুকের সোনাধন থাকত বুকের কাছেই। জমি থেকে ফিরে এলে রোজ দুপুরে আঁচল দিয়ে ঘর্মাক্ত কর্দমাক্ত শরীর মুছিয়ে দিতে পারত। 'বাইরড্যাগ' এ কাঁঠাল গাছের তলায় বাঁশের মাচার উপর চাটাই পেতে দিত, কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে থাকত কান্দুরা আর তালের পাখা দিয়ে বাতাস করত নীরবালা। একটু জুরোলে গাছের জামির লেবু ছিঁড়ে এনে সরবত বানিয়ে দিত ; 'পাইছলা বাড়ি' র গাছ থেকে পাকা জম্বুরা পেড়ে এনে কাঁচা শুল্কি মরিচ চিনি লবন দিয়ে ঝাল করে মেখে দিত এক গামলা। তাড়িয়ে তাড়িয়ে তা খেয়ে দিঘি থেকে গা ধুয়ে এলে যত্ন করে সিঁদোল দিয়ে ভাত বেড়ে দিত। খেয়ে উঠে পরম তৃপ্তিতে বলত--- সে-ই খান খালুং!
লেখাপড়া শিখে ছেলে এখন কোন যখের পুরীতে আটকে আছে কে জানে।
চাকরিতে যাবার পর থেকে তিনবছর এভাবেই কাটল। তারপর একদিন খবর এল--- ও বিয়ে করেছে। পাত্রী কোলকাতার এক বনেদি ঘরের মেয়ে। ইউনিভার্সিটি পড়ার সময়েই পরিচয় আর প্রেম। কোচবিহারের তপশিলী জাতি তথা রাজবংশী ছেলের সঙ্গে তাঁদের একমাত্র মেয়ের বিয়ে দিতে রাজি নয় মেয়েটির বাবা-মা। তাঁরা অন্যত্র বিয়ের বন্দোবস্ত করছিলেন। মেয়েটি তাই বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে সোজা কান্দুরার ফ্ল্যাটে গিয়ে ওঠে এবং উকিল ডেকে বিয়ে করে নেয় দুজনে।
নীরবালার বুকটা ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেল এ খবরে। একমাত্র ছেলের বিয়ে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল তার। সে তার মনের অন্দরে সযত্নে একটু একটু করে বহুদিন ধরে থরে থরে সাজিয়ে রাখছিল নানা রঙীন পরিকল্পনা। স্বপ্নের সেই বিন্যাস নিজেই কখনও ভেঙ্গেছে সে, নিজেই আবার করেছে বিন্যস্ত আপনমনে, নৈমিত্তিক নিয়মে। দৈনন্দিন জীবনে নীরবালার অবশ্যকরণীয় একটা কাজে পরিণত হয়েছিল কিছুদিন যাবৎ এটা।
নিকট দূর সব আত্মীয়-স্বজনকে নিয়ে খুব ধুমধাম করে বিয়ে হবে কান্দুরার, সমস্ত রীতি-প্রথা পুঙ্খানুপুঙ্খ মেনে। 'জব ছেঁড়া'-র পর মা সুবচনীকে গুয়াপান দেওয়া থেকে শুরু করে 'ষোলমাতৃকা পূজা' সবই যাতে ঠিকঠাক মতন হয়, সেজন্য উপযুক্ত এঁয়ো-বৈরাতির তালিকা প্রস্তুত করে রেখেছে মনে মনে। এছাড়া মনে মনে ঠিক করে রেখেছে--- বিয়ের দিন 'নারদের ভার' কে নেবে, কাকে 'মিতর ধরা' হবে, কে হবে 'পানি ছিটা বাপ' সবকিছু। 'সেরকীয় মারৈ' বিষহরি পূজা হবে, হবে 'জাগানি ভাসানি গীত', 'কইন্যা জুরানি গান'। দেশি ভুঁইমালীর বাজনার তালে তালে বৈরাতী নাচ নাচতে নাচতে হাইল্যার সকল সধবা জল ভরতে বা গঙ্গা নিমন্ত্রণ করতে যাবে...ইত্যাদি আরও কত যে পরিকল্পনা ছকে রেখেছে নীরবালা ! আর...
আর... মনের একেবারে মধ্যিখানে একটা ইচ্ছা জমাট বেধেছিল--- একটা টুকটুকে রাজবংশী পাত্রী দেখে বিয়ে দেবে কান্দুরার। যাকে সে একেবারে নিজের মতন করে গড়ে তুলতে পারবে। বংশের তথা সমাজের চিরাচরিত আচার অনুষ্ঠান রীতিনীতি সংস্কার সব হাত ধরে শিখিয়ে পড়িয়ে যেভাবে নীরবালার শাশুড়ী নীরবালাকে এক পরিপূর্ণ রাজবংশী রমণীতে পরিণত করে দিয়েছিলেন, ঠিক তেমনিভাবে সে নিজেও তার পরম্পরাগত দায়িত্ব পালন করবে, এই বাসনাও মনের মধ্যে লালন করে এসেছে বহুদিন থেকে নীরবালা। বারো মাসে তেরো পার্বণের যে পরম্পরা তাকে তো বহমান রাখতে হবে আগামী প্রজন্মে।
বুক ভেঙ্গে কান্না এসেছিল নীরবালার সে খবর শুনে। সমস্ত আশা আকাঙ্ক্ষা স্বপ্ন এভাবে গুড়িয়ে দিতে পারল কান্দুরা ! ভেবেছে নীরবালা। ওকে নিয়ে মায়েরও যে কিছু বাসনা থাকতে পারে, মায়ের যে আর দুটো ছেলে নেই যাকে দিয়ে অপূরিত সেই মনোসাধ চরিতার্থ করবে--- কান্দুরা কেন সেকথা একবার ভেবে দেখল না ? বহুদিন এসব ভেবেছে আর গুমড়ে গুমড়ে কেঁদেছে নীরবালা। যে পুত্রমুখ দর্শন করার জন্য একদিন কত থানে-পাটে-মন্দিরে হত্যা দিয়েছিল, সেই পুত্রেরই আর মুখদর্শন করবে না বলে প্রতিজ্ঞা করে সে। লাগাতার চলে অশ্রুবর্ষণ একান্তে, কতদিন তার হিসেব নেই। কান্দুরাকে ভুলতে তো পারে না, ক্ষণেক্ষণে পলেপলে মনে পড়েছে ; যখনই মনে পড়েছে, দুচোখ ভরে গিয়েছে জলে। শাওনের আকাশের মতো ঝরতেই থেকেছে ঝরতেই থেকেছে বিরামহীন। অবশ্য বেশ কয়েকবার ফোন করেছিল কান্দুরা, কিন্তু কথা বলেনি নীরবালা।
'সময়' একটা বড় গুণীন। তারই অতিবাহনে নীরবালার অভিমানী মাতৃহৃদয় একদিন প্রবোধ খুঁজে পায়--- আহা ! ছেলের সুখেই তো তার সুখ ! কান্দুরা যদি সুখী হয়, তবে তার আর কীসের দু:খ ! আর আজকালকার ছেলেমেয়ের বিয়ের ব্যাপারে বাবা-মার প্রত্যাশা রাখাটাই বোকামী। এটাই যুগধর্ম। আর পরম্পরা রক্ষা ? নিজের সম্প্রদায়ের মেয়েকে পুত্রবধূ করলেই যে সে নীরবালার সবকিছু মেনে নিয়ে আগ্রহ সহকারে শিখেপড়ে নেবে তারই বা কী নিশ্চয়তা ? চারদিকে কম কিছু তো দেখছে না নীরবালা ! একটু আধটু স্কুল কলেজে পড়াশোনা করে একেবারে সব বিদ্যেধরী হয়ে ওঠে। নিজের সমাজের, সম্প্রদায়ের, বংশের কৃষ্টি-সংস্কৃতিকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা, অশ্রদ্ধা করা বা অপ্রাসঙ্গিক মনে করাটাকেই তারা শিক্ষিত হওয়া বা আধুনিক হওয়া বলে মনে করে। এমনকি, নিজের মাতৃভাষায় কথা বলতেও সঙ্কোচ বোধ করে। তাদের শিক্ষাদীক্ষার দম্ভ-অহমিকার কাছে নীরবালার মতন প্রবীণেরা তো আজকে জবুথবু, অস্তিত্বসঙ্কটে খাবি খাওয়া প্রাণী। নীরবালার কাঙ্ক্ষিত রাজবংশী পুত্রবধূও যে সেরকমটি হত না তা কে বলতে পারে ?
সময়ের ব্যবধানে নীরবালার হৃদয়ের ক্ষতস্থানগুলি প্রায় ভরে এসেছিল, কিন্তু আজ আবার এক প্রবল আঘাতে তীব্রবেগে শুরু হল সেগুলি থেকে রক্তক্ষরণ।
দুদিন আগে স্ত্রী আর তিন বছরের মেয়েকে নিয়ে বাড়ি এসেছে কান্দুরা। বিয়ের পরপরই কোম্পানি ওকে বিদেশে পাঠিয়েছিল। বউকে সঙ্গে নিয়েই গেছিল। মেয়ের জন্ম ওখানেই। তিনবছর বয়স হয়ে গেল মেয়ের, না হল 'জাতকবচ', না হল 'ছুঁয়াকাটা নবুদ'; 'ভাতছোঁয়া', 'চূড়াকরণ' কিছুই হল না। হল না তো হল না, ও নিয়ে অতটা ভাবিত হয়না নীরবালা আর। নিয়ম আচার তো ধীরে ধীরে উঠেই যাচ্ছে সব।
ওরা আসার পর ঘটনাবহুল কয়েকটা দিন কেটে গেছে। ভাললাগা মন্দলাগা দুটো মিলিয়েই সবটা মেনে নিয়েছে নীরবালা। কিন্তু একটু আগেই যে ঘটনাটা ঘটে গেল, তাতে ভেঙ্গে দুমড়ে মুচড়ে গেল ভেতরটা ওর। বিছানায় শুয়ে শুয়ে চোখের জলে বালিশ ভিজিয়ে ফেলছে নীরবালা এখন।
এখানে আসার পর থেকেই কান্দুরার বউ কেমন যেন একটা নাক কোঁচকানো ভাব করছিল। কেমন একটা ঘেন্নাঘেন্না ভাব। মেয়েটাকেও কোলে দিতে চায় না। কখনও কোলে নিলে প্রায় ছোঁ মেরে নিয়ে চলে যায় নানান বাহানা করে। নাকি 'ইনফেকশন' না কী যেন হয়ে যাবে। এখানকার কোনও কিছুই নাকি কী বলে, 'হাইজিনিক' নয়। কথাগুলো এই ক'দিনে এতবার শুনেছে যে, মুখস্থ হয়ে গেছে নীরবালার। কিন্তু মানে জানে না একটিরও। তবে, সম্ভবত 'ভাল নয়' বা খুব খারাপ একটা কিছু হবে এটুকু অনুমান করেছে নীরবালা। মেয়েটাও হয়েছে তেমনি, কোলে নিলেেই ভ্যাঁ করে কেঁদে ওঠে। কাল সন্ধ্যেবেলাই তো, কোলে নিয়ে গান করে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছিল নীরবালা--- "আয় নিন্দোবালী আয়/ মোর সোনামইনা নিন্ যাবার চায়।/ এক শিয়ালে রান্দেবাড়ে তিন শিয়ালে খায়/ কানকাটা এক বুড়া শিয়াল ভুড়কি মারি চায়।"...
কিন্তু মেয়ে ঘুমোবে কী, আরও বেশি করে কাঁদতে শুরু করলো। ওর মা ছুটে এসে কোল থেকে কেড়ে নিল। সুর করে কেমন এক 'হামটি ডামটি' বলল, আর মেয়ে চুপ করে ঘুমিয়ে পড়ল।
টুকটুকে পুতুলের মতো দেখতে নাতনীটিকে কত আদর করতে ইচ্ছে করে, কোলে নিয়ে বেড়াতে ইচ্ছে করে, ঘুম পাড়াতে ইচ্ছে করে; কিন্তু...
আজ দুপুরে সবাইকে রান্না করে খাওয়াল বৌমা। মুরগীর মাংস রান্না করল। ওরকম মাংস রান্না জীবনে দেখেনি নীরবালা। তরকারিটার নামও আছে আবার একটা--- চিলি চিকেন !
ওদিকে কান্দুরার কাকিমা কবুতরের মাংসের তরকারি দিয়ে গেছে। এটাও কান্দুরার প্রিয় খাবারের মধ্যে একটি। কান্দুরা বউকে বলল, খাবে নাকি?
--- কী এটা ?
--- চিলি কইতোর ! হাসতে হাসতে বলল কান্দুরা, মানে রেড চিলি আচ্ছা করে বেটে দিয়ে, লাল টকটকে ঝালেঝোলে পায়রার মাংস !
--- পায়রা ! ইউ মিন, পিজিওন ? পায়রাও খাও তোমরা? ম্যা-গো ! কী খাও আর কী না খাও তোমরা ! ছিঃ !
আজ রাতে সিঁদোল হয়েছে। এতদিন বাদে কান্দুরার পাতে সিঁদোল দেবে, তাই সন্ধ্যা থেকেই প্রস্তুতি নিচ্ছিল নীরবালা। আহা ! কতদিন পর আজ কান্দুরার ভোজনতৃপ্ত মুখখানি দেখতে পাবে সে ; কতদিন পর আজ ওর হাতের সিঁদোলের প্রশংসা শুনতে পাবে ; অথবা শুনতে পাবে--- সে-এ-ই খালুং !
সেই কবে থেকে এসবের জন্য খরা কবলিত খেতের মতো তৃষিত হয়ে আছে নীরবালার ভেতরটা ! বৌমাকেও খেতে দেবে খানিকটা। কে জানে সমস্ত কিছু অপছন্দের মধ্যে ওর গ্রাম্য শাশুড়ির হাতের এই প্রাচীন খাবারটির অনুপম স্বাদ তৃপ্ত জিভের ডগায় করে নিয়ে যাবে তার বিদুষী বৌমা। হয়ত দূর ভবিষ্যতে যখন সে থাকবে না, তখন কোনওদিন কোনও ক্ষণে মনে পড়বে এই খাদ্যটির কথা, এই স্বাদের কথা। সেইসঙ্গে মনে পড়বে কোচবিহারের প্রত্যন্ত গ্রামের পুবে দিঘি, পশ্চিমে বাঁশবন, উত্তরে সুপারিবাগান, দক্ষিণে ধুধু মাঠঘেরা বাড়ির এক বিধবা রমনীর কথা--- 'কান্দুরা' ডাকনামের এক ছেলের মায়ের কথা। সেদিন নীরবালা যেখানে যে অবস্থাতেই থাক, একটা শান্তির বা সুখের বার্তা তার আত্মার কাছাকাছি পৌঁছে যাবে।
বৌমার পাতে সিঁদোল দিতেই জিজ্ঞেস করল--- এটা কী ?
কান্দুরা বলল--- এটা উত্তরবঙ্গের খুবই জনপ্রিয় একটা স্থানীয় খাবার। শুটকি মাছ গুড়ো করে---
--- ওয়াক ! ওয়াক ! ওয়াক !
শুধুমাত্র 'শুটকিমাছ গুড়ো' শুনেই বৌমা এমন ভাব করতে লাগল, যেন তার অন্নপ্রাশনের ভাত বেরিয়ে আসছে। ওয়াক ওয়াক করতে করতে পাত থেকে উঠে কলতলায় ছুটে গেল। কান্দুরাও চলল পেছন পেছন। ওকে দেখে ক্ষিপ্ত বাঘিনীর মতো গর্জন করে উঠল ওর বউ--- আমাকে মেরে ফেলার জন্য এখানে নিয়ে এসেছ ? ওয়াক !...ওয়াক !...
হাতে পায়ে মুখে-চোখে মাথায় জল দিয়েও থামছে না 'ওয়াক ওয়াক'।
" এরকম একটা আনহাইজিনিক আনসিভিলাইজ্ড এঁদো পাড়াগাঁ... আর একদিনও এখানে থাকলে আমি মরে যাব!"...
মুহূর্তের মধ্যে হুলুস্থূল লেগে গেল যেন। বউমার মুখ দিয়ে যেন খই ফুটতে লাগল। শুরু হয়ে গেল তীব্র বাদানুবাদ। ক্ষিপ্ত বউকে কোনওরকমে থামানোর চেষ্টা করতে লাগল কান্দুরা। কী বলছে আর কী না বলছে বৌমা ! কান্দুরা প্রাণপণে চেষ্টা করছে ওকে চুপ করানোর। ইশারায় বোঝাতে চাইল--- মা শুনছে সব !
কিন্তু কে শোনে কার কথা ?
" আর না, একদণ্ডও এখানে থাকতে পারব না আমি। কালই এখান থেকে যাবার ব্যবস্থা কর তুমি, নইলে আমি একাই চলে যাব বলে রাখলাম !...ওয়াক !...
কান্দুরা ওকে কিছুতেই থামাতে না পেরে কোনওরকমে ঠেলে ধাক্কিয়ে ঘরে ঢুকিয়ে খিল এঁটে দিল দরজায়।
ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গেল নীরবালা। সে স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে রইল অনেকক্ষণ। নিজেকে বারবার ধিক্কার দিতে লাগল--- কেন সে বৌমাকে সিঁদোল দিতে গেল !
খাবারদাবার যেমন ছিল তেমনই ঢাকা দিয়ে নিজের ঘরে এসে বিছানায় উপুড় হয়ে বালিশে মুখ গুঁজে দিল। ওর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ আর অনর্গল ধারার চোখের জল সবটাই শুষে নিচ্ছে বালিশটা।কান্দুরা ইতিমধ্যে ওর কাকাতো ভাইকে দিয়ে হোটেল থেকে খাবার কিনে আনিয়েছে। ওদের ঘরে এখন দরজা আঁটা, খাওয়া দাওয়া চলছে।
চোখের জলে বুক ভেসে যাচ্ছে নীরবালার। চারপাশ থেকে এক বিকট রিক্ততা এসে ওকে ঘিরে ধরেছে। যে ছেলে ওর হাতের সিঁদোল পেলে অমৃতও স্পর্শ করত না, আজ সে হোটেল থেকে এনে খাবার খাচ্ছে ! পাতের সিঁদোল পাতেই পড়ে রইল ! নিজের পেটের একমাত্র ছেলে এভাবে পর হয়ে গেছে, একথা মনে হতেই কান্নার দুরন্ত স্রোত এসে নীরবালার বুকটাকে প্লাবিত করে দিচ্ছে। কেবলই মনে হচ্ছে, কে যেন ওর হৃৎপিণ্ডটাকে--- ওর কান্দুরাকে ওর বুক থেকে টেনে হিঁচড়ে খুলে নিয়ে যাচ্ছে। কান্দুরা যতই দূরে থাকুক, নীরবালার সবসময়ই মনে হত একেবারে কাছটাতেই রয়েছে ও ; এই বুঝি আবদারী সুরে বলে উঠবে--- মাগো, এ্যাকনা এ্যাও দিবু ?... মাগো, তোর সিঁদোল খাবার বাদে জিঁউ এক্কেরে আখাস-ফাকাস নাগাইচে !... মাগো...
এখানকার সবকিছুর মধ্যে থেকে নীরবালা সবসময় শুনতে পায় কান্দুরার কিশোর কণ্ঠের 'মাগো'..., 'মাগো'...
কান্দুরা যে মাঠে খেলত, সুপুরিবাগানের যেখানে দোলনা খাটিয়ে দোল খেত, ঘরের যে কোণ থেকে কোকিলপাখির ডাক নকল করে চেঁচাত--- কু-উ-উ-উ-উ !...প্রতিটি জায়গা থেকে ওর আবদারী ডাক শুনতে পায় নীরবালা--- মাগো !...মাগো !...মাগো !...
কিন্তু আজ এখন মনে হচ্ছে কান্দুরা চলে গেছে দূরে,অ-নে-ক দূরে ! সেই ডাক আর সে শুনতে পাবে না।
বুকের ভেতরটা ওর যেন ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতে লাগল, ভেঙ্গে দুমড়ে মুচড়ে খানখান হয়ে যেতে লাগল।
"মাগো !... মাগো !..."
"মাগো !... মাগো !... নিন্ গেচিস্ মাগো ?"
নীরবালা ধড়মড়িয়ে ওঠে। আরে, এ যে---
দরজা খুলে দেখে, কান্দুরা দাঁড়িয়ে আছে, "ভাত দে মাগো, ভোক নাগিচে !"
"ক্যানে, তুই খাইন্ নাই ?"
" তুই ভাবিলু ক্যাংকরি মাগো, বাড়িত আসিয়া মুই তোর হাতের সিঁদোল না খেয়া ওইল্যা খাইম ! বোলে তোর হাতের সিঁদোলের বাদে কুন্দিন থাকিয়া জিঁউ মোর আখাস-ফাকাস নাগাইচে !
বুক তোলপাড় করে দুচোখ ঝাঁপিয়ে দুরন্ত বেগে কান্না আসতে চায় নীরবালার। কোনওরকমে সামলে নিয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায় সে।
No comments:
Post a Comment