Tuesday, January 31, 2017

একটি সাফাইকর্মীর লাশ =================== - ফিরোজ আখতার ====================== ম্যানহোলের মধ্যে থেকে – সবেমাত্র বের করে আনা হয়েছে, একটি সাফাইকর্মীর মৃতদেহ । বিষাক্ত গ্যাসে নীল হয়ে আসা একটি লাশ…। সর্বাঙ্গে পাঁকমাখা, দুর্গন্ধযুক্ত একটি লাশ… । চোখদুটি যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে, আর, নীল জিভটা খানিক বেরিয়ে আছে । লাশটি কয়েকঘন্টা আগেও ছিল একটা জলজ্যান্ত সাফাইকর্মী- একটা জলজ্যান্ত স্বামী, একটা জলজ্যান্ত বাপ – আর, জলজ্যান্ত ছেলেও বটে । ম্যানহোলে নামার আগে সহকর্মী বন্ধুদের সাথে তামাশা করেছিল সে – আর একদলা খৈনি মুখে নিয়ে নিয়ে ঝুপ করে নেমে গেছিলো একগলা পাঁকে… সঙ্গে ছিল একটা দড়িবাঁধা বালতি… বালতি দিয়ে তুলে তুলে দিচ্ছিল আমার-আপনার প্রতিদিনের জমা করা পাঁক । নর্দমার সুরঙ্গদেহে কোথায় যেন জমেছিল বিষাক্ত প্রাণঘাতী গ্যাস, কুণ্ডলী পাকানো সাপের মতো… গ্যাসটি শ্বাসের সঙ্গে যখন রক্তে মিশে গেল – ছটফট করেছিলো একদা লাশ হয়ে যাওয়া সাফাইকর্মীটি, ছটফট করেছিলো মৃত্যুর আলিঙ্গন ভেঙে বেরোনোর জন্য, কিন্তু পা বসে গেছিলো আমার-আপনার জমা করা পাঁকে… স্বরযন্ত্র বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলো শেষমুহুর্তে । আসন্ন মৃত্যকে দেখতে পেয়ে তাই চোখ ঠিকরে বেরিয়ে এসেছিল তার…

Monday, January 30, 2017

ডুয়ার্স- চার
শৌভিক রায়

কোদালবস্তি থেকে সামান্য দূরে,
রাস্তা যেখানে বেঁকে
চিরছে চিলাপাতাকে
রমণীয় সুখে,
পড়ে আছে সেখানেই
উদ্ভিন্নযৌবনা তপ্ত হরিণী কামসুখে,
বিলোপ হওয়া প্রাণে
চোরাশিকারীর বুলেট ক্ষত
দেহে তার এঁকে দিলেও
রক্ত মানচিত্র
চোখে তার শিরীষের প্রেম



বিষাদিয়া
--উদয় সাহা

বিদায় জানালাম সাদা বিষাদকে
স্বাগত জানালাম কালো বিষাদ
                       এক অন্য বিষাদ--
তুমি আঁকা আছ আমার হাতির ছবি দেওয়া টিকিটে
তুমি আঁকা আছ নরম আবেগের বিন্দুতে
তোমাকে দুঃখের আর এক নাম বলব না
এক গাল খোঁচা খোঁচা দাড়িতেও
এক টুকরো হাসি এখনও বর্তমান।
উষ্ণ অভিনন্দন বিষাদ
বছর শেষের সান্টা বুড়ো বলগা নিয়ে চলে গেছে
হাজিরা খাতায় অনবদ্য পারফরমেন্স

অঙ্কের খাতায় প্রমাণিত বলে কিছুই নেই
রাতদুপুরে চশমা পরে বড় বড় চোখে
মস্তিষ্ক জুড়ে বিষাদিয়া মুখ।

Sunday, January 29, 2017

কলমের চুম্বন ______________ ফিরোজ আখতার ________________ কলমের চুম্বনে ফুটে ওঠে কাগজে অক্ষরের প্রতিধ্বনি, রঙীন হয়ে ওঠে চুম্বনের আবীরে- ভরে ওঠে তার সারা দেহ চুম্বনের হরফে, আর চুম্বনের খোঁচায় যখন বাঙ্ময় হয়ে ওঠে অধরের স্পর্শগুলি, ওষ্ঠের দাগগুলি- তখনই যেন পূর্ণতা পায় কোরা কাগজের শূণ্য হৃদয় , পরিনত হয় সে সম্পূর্ণ মানবীতে | ভরে ওঠে যেন তার শূন্য দেহ- পল্লবিত হয় তার যৌবনের আর্তি ৷


ট্র্যাজেডিমায়া
সুবীর সরকার






















১।
তর্জনী টানটান করে লুকোন যোগসূত্র খুঁজি
বহু ক্রোশ দূরে পড়ে থাকছে কমিক ডাকতে ডাকতে উড়ে যাওয়া পাখিরা একটা বর্ণময় জীবন,ট্র্যাজেডিমায়ায়
২। জাহাজও বন্দরে ফেরে।হাতের মুদ্রায়
হাওয়া ও গমখেত।কোথাও চলে যাওয়া নেই।হাঁটা ও চলায় আপ্রাণ আর্মিব্যারাক হাসির ফোয়ারা তুলে বন্দরে ফেরে জাহাজ

Saturday, January 28, 2017

" নববধূ "
প্রশান্ত কুমার ঘোষ 


পদ্ম পাতায় জমে থাকা মোতি -
রক্তিম সূর্যের হাসিতে সে নববধূ
বাতাসের চুম্বনে তার হৃদস্পন্দন,
ঝোড়ো আলিঙ্গনে দিগ্ভ্রান্ত l 
তারপর -
একরাশ আশা বুকে নিয়ে 
অসীমের অস্তিত্বে লুকিয়ে পড়া l
"রাতপরীদের  কান্না"
শম্পা দত্ত

মোহময়ী রাতের শহর শুধু শোনে
রাতপরীদের  গুমড়ে ওঠা কান্না,
বুভুক্ষ আধপেটা অর্ধনগ্ন দেহ
রূপোজীবিনীর।
কত বসন্ত ওদের অজানা!!
দেখেনি বিগত বসন্তের বাহারি
মরশুমি ফুলফোঁটা।
        আজও শহর তাদের দেখে,
         এখনো বাঁকা চোখে,
        গণরাজ্যের তিনপয়সার পালায়
      তাঁরা নটীবিনোদীনি।
হাজার পুরূষের চোখে
ভোগবিলাসীনি!!!!!
রাত্রির ঘন উতপ্ত নিঃশ্বাস
জানায় নুতন বাঁচার প্রত্যয়,
নটীর ইতিহাসে তাঁরা জীবন্ত
দলীল লেখে!!!!!
বুদ্ধ তুমি জেগে থাকো
               শিবু

পায়ের তলায় একটা সাপ কুণ্ডলী পাকিয়ে আছে
কিছু গরমিল আছেই কোথাও না কোথাও
মনের কোণে কেবলই একটা খচখচানি লেগে আছে
টের পাই।
কি এক অস্থিরতা রামধনু-রঙ নিয়ে কাটাকুটি খেলে
কবি তুমি এগিয়ে যাও সবুজ গালিচা ধরে
নগ্ন পায়ে। জুতোপাটি তোমার আমি পায়ে পড়ে নেব
নয়ত মাথায় পড়ে নেব
তুমি লিখে চল কবি !অপার্থিব সৃষ্টি কিছু করে চল
জাগতিক করণ-কারণ আমি বয়ে চলি, দিনে-রাতে সর্পবাসে ঘুমিয়ে থাকি
আলো-বাতাস পেলে সময়ে সময়ে খোলস ছাড়ি।
বুদ্ধ তুমি জেগে থাকো আমার পাশে, আমি শুয়ে থাকি।




#জোৎস্না
--উদয় সাহা

পিকনিক মুডে হুডখোলা গাড়িতে আমরা নাচি
ডিস্কো , ট্যাঙ্গো , সালসা আর বাংলা
আকাশে তখন সূর্য তার চেনা পথে হাঁটে
আমরা ইচ্ছে করেই রংরুটে।
সাইডের বডিতে ভর দিয়ে থাকে অনামিকা
তাকিয়ে থাকে সবুজের সারির দিকে
স্বপ্ন দেখে পরের জন্মে গাছ হবার
              স্বপ্ন দেখে উজ্জ্বল মিটমিট আলো হবার
সন্ধ্যে নেমে আসে গাড়িতে
মনে পরে সামার অব নাইন্টি নাইন
অনামিকা স্বপ্ন দেখে জীবনের গ্রীষ্মে ফিরে যাবার
আমার ভাবনার কালি ওকে জাগিয়ে রাখে
আমার প্রতিবাক্যের শেষে ছেদ যতির মত ও
                                অভিব্যক্তি প্রকাশ করে
আমার শীর্ণকায় অস্ত্র আমায় স্বপ্ন দেখায় না
                         না দক্ষিণের না পশ্চিমের
আমি অনুসরণ করে চলি দিগন্তরেখা।

Wednesday, January 25, 2017

আবিরকান্তি পালের কবিতা

কঙ্কাল
আবীর কান্তি পাল

রক্ত মাংস চামড়ার শরীর রোদে শুকতে দিয়ে ,কঙ্কাল নিয়ে শুয়ে পরি বিছনায় !
পাহাড়ি সাধুর মত মন উড়তে থাকে বাতাসে ,লোভ কাম বিছিন্ন হয়ে বিবস্ত্র হয়ে অভিমান করে চলে !
আজ ভুলবো না কোন মোহে
ঘুরতে চাই জানতে চাই নিজের ভেতর !অন্য কোন শহর ,চাই অন্য কোন গ্রাম ,,!
আমার কাছে গ্রামটা মা ,শহর
হল পিতা !পিতা মানে হারাতে
ভয় পাই ,আর গ্রামের কাছে
মায়ের আঁচল পাতা !
খট্ করে দরজায় শব্দ !ওটা আমার মতো একটি কঙ্কাল !আমার স্ত্রী ,পাশে সয় !এটাই
শর্ত !
ভাল থাকার শর্ত !
একটু পর বুঝি কঙ্কাল নাক ডাকে ,আমি বাইরে ছুটি ,বহুদূর ,স্যার লিওনার্দ
ঘুময় নাকি !
প্রসব করে চলি বিশ্ব ইতিহাসের ,চিত্র কল্প ,কে বলে কবিতা সীমাবদ্ধ ,কোন বিশাল কবির কুক্ষীগত ,আমি পারি হাটতে ।
হাটতে হাটতে চলে যাই অন্য কোন পান্ডুলিপিতে !
ইস্ জানলায় চাঁদ এসে হাজির ,রাতের ঘড়ি দু -টো !
আমি তবুও চরি গাভীর মতো
পিঠে বক নিয়ে !পায়ের নীচে জন্ম ভূমির মাটি !হ্যা গো মায়ায় ভরা মাটি !যার কোলেতে এই কঙ্কাল শুইয়ে রাখি ॥

শঙ্খসাথি পালের কবিতা

Sunday, January 22, 2017

বলাই দাসের কবিতা

ধর্মাবতার
বলাই দাস

উত্তরাধিকারে পেয়েছি যৌনতা
পুরুষত্ব নাকি খুবই পোক্ত।

কোমল নাদুসনুদুস চেহারা দেখলেই মাংস খেকো জানোয়ার
কেমন ফনা তুলে দাঁড়ায় কেউটে!
আদিম যুগ গ্রাস করে অন্ধকার।

চার দেয়ালে আলো আসে যখন
কি লজ্জা কি লজ্জা!

  মোমবাতি যে এত উজ্জ্বল!
পুরে যাওয়া সলতের শেষ ধোঁয়া
   কখন যে দড়ি হয়ে ঝুলছে!

ধর্মাবতার আমি নিরপরাধ।
উত্তরাধিকারের দায়ে আমায়
ফাঁসাবেন না।

Friday, January 20, 2017

মৌসুমী চৌধুরীর কবিতা

সম্পর্ক
মৌসুমী চৌধুরী

গনগনে শরীরী তাপমাত্রায়
উষ্ণায়ন শিমূল তুলোর বালিশে ।
ঘোর লাগা তপ্ত ঘোলাটে চোখে
তোমায় খুঁজি চার দেওয়ালে ।
তোমার চোখের আলো গ্রাস করে রাহু
সূর্য গ্রহণে !
অন্ধ করে রাখে আমায় ।
শুধু মনের অলিন্দে জ্বলে
একটি  গভীর বিশ্বাসের আলো ।
তোমার কাছে দাবী ছিলো ----
এক মুঠো রোদেলা দুপুর ,
মৃত্যু থেকে চুরি করা এক মুঠো জীবন ,
একটুখানি  সুগন্ধ
যেখানে আমার 'আমিত্ব' বিলীন  হয় !
আমার শেষ নিঃশ্বাসেও
তোমার শব্দেরা
ফুল হয়ে  ঝরুক ।
একটি কথাই তোমায় বলে যেতে চাই ,
হৃদয় ঘটিত এই হিমোগ্লোবিনই
সম্পর্কের অন্য নাম ।

মুর্শিদ আলমের কবিতা

Thursday, January 19, 2017

অভিমান

কৌশিক চক্রবর্ত্তী


টেলিফোনটা সারাদিন ব্যস্ত কেন? তুমি ছুঁয়ে রেখেছো তাকে? তোমার ছোঁয়া নিয়ে সে কি মিলিয়ে গেছে দিগন্তের কোলে? আমি তবে সেই ছোঁয়াটুকু নিতে পাখি হয়ে নীল চরাচরে ধাই... চলার মুহূর্তে যদি আকাশেও তোমার ডাক আসে উপেক্ষা করবো না, সারা শরীর জুড়ে শুধু সমস্ত আলোছায়া মেখে তোমার বার্তা করে নিই খোদাই! টেলিফোনটা নিরবেই ব্যস্ত বলে... তুমি কি আশ্রয় চেয়েছো তার কাছে? তোমাকে আশ্রয় দিতে কি সে হারিয়েছে সাগরের নীলে? আমি জীবন সেজে অস্তাচলে ঢেকে তলিয়ে যাবো চোখের আড়াল থেকে যখন তোমার বার্তা আসবে, আমায় চাইবে ক্ষণে... আমি বলবো বিষাদ আমি লুকিয়ে আছি গভীর ক্ষতে বাঁচার অন্ত্যমিলে! তাও তো ব্যস্ত তোমার টেলিফোন বাজছে.... বাজছে.... বাজছে.... কে যেন ধরেছে টুঁটি চিপে চিৎকার করে বলছে বেজোনা নিরব থাকো, লুকিয়ে থাকো... যে আকাঙ্ক্ষার বার্তা তুমি যে আতিথ্যের তৃপ্তি তুমি বিলীন হয়েছে সে অনেক দুরে অণুবৃত্তের শেষে! আমি তখনো ডায়াল করি... ফোন তো ঠিক বেজেই চলেছে... বেজেই চলেছে... আমার অব্যক্ত আড়ষ্টতা আমি বলেই চলেছি... বলেই চলেছি... বলেই চলেছি... তুমি কি শুনতে পাচ্ছো?

ঘন কুয়াশা (৫)
 শীলা ঘটক              

সকালে ঘুম থেকে উঠে রাধেশ্যামকে বাজারে পাঠালাম। একটা চিন্তা সারারাত আমাকে ঘুমাতে দেয়নি, কে  আমার বাবা?  এক অসমাপ্ত জীবন কাহিনী----  সারাবাড়িতে কোথাও একটা বাবার ফটো নেই, বন্ধুদের বাবাদের যখন দেখতাম নিজের বাবাকে দেখার জন্য মন আকুল হোতো!  কতবার মাকে প্রশ্ন করেছি, মা আমার বাবা কোথায় ?  একবার আমাকে বাবার কাছে নিয়ে চলো।  মা বলতো, অনেকদূর দেশে থাকেন তোমার বাবা, সময় হলে ঠিক আসবেন।  তারপর সময় বয়ে গেছে তার আপন গতিতে, আমি আমার  জগতে-- আর মা, মায়ের জগতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
 রাধেশ্যাম বাজার গেছে,  ভাবলাম এই তো সুযোগ... মায়ের ঘরে একবার আমাকে ঢুকতেই হবে।  
তন্নতন্ন করে আলমারির চাবিটা খুঁজতে শুরু করলাম।  ড্রেসিং টেবিলের  কাঁচের পাল্লাটা সরাতেই পেয়ে গেলাম মায়ের আলমারির চাবিটা।   আলমারি খুলে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম-----  এতো কাপড়ের ফাঁকে কিছু পাবো কি !!  মা খুব সৌখিন মানুষ, প্রচুর শাড়ী, ম্যাচিং ব্লাউজ, বিভিন্ন গয়না।  বেশী নাড়াচাড়া করতে ভয় করছে যদি বুঝে ফেলে!   নীচের তাকের দিকে চোখ গেল---  তিনটে বড় বড় অ্যালবাম...... বের করে বিছানায় বসলাম। একটা একটা করে দেখা শুরু করলাম।
 প্রথমটা দাদু-দিদার সঙ্গে মায়ের ছোটবেলার ফটো, মা আমার দেখতে খুব সুন্দরী। ছোট ছোট চুল কাটা দাদু দিদার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে, অসংখ্য ছবি। বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন পোজে ...... সব কটা ছবি অনেকক্ষণ ধরে দেখলাম।
 তারপর পরেরটা খুললাম—মায়ের কলেজ জীবনের ফটো। কি উচ্ছল! হাসি-খুশী  ...... একঝাঁক বন্ধুদের মাঝে মাকেই বেশী চোখে পড়ছে। কোনদিন এইসব দেখার সুযোগ আমার হয়নি, আর মা যে এতোটা হাসিখুশি বুঝতেই পারিনি।   মাকে যেন অন্যভাবে আজ পাচ্ছি আমি--- খুব ভালো লাগছে দেখতে, একটা অচেনা মানুষ মনে হচ্ছে ......
শেষেরটা খুললাম, মায়ের বিয়ের গায়ে হলুদ দেওয়া হচ্ছে ফটোতে, একে একে দেখতে দেখতে চমকে উঠলাম আমি!  এ কাকে দেখছি আমি!...... এই তো সেই ভদ্রলোক যাকে আমি ট্রেনে দেখছিলাম, দীর্ঘ সময় কাটিয়েছি, কি আশ্চর্য !...... দেখতেও তো আমারই মতো!  অথচ চিনতেই পারলামনা সেদিন! হায়  ভগবান!  কি সুন্দর দেখতে লাগছে দুজনকে।  মালাবদল---- সিঁদুর দান--- খই পোড়ানো ...... চোখ দুটো জলে ঝাপসা হয়ে আসছে------ কত লোক, কত আয়োজন----  তাকিয়েই আছি ছবিগুলোর দিকে। সময়টা কতক্ষণ জানিনা।  নীচে দরজায় বেল বাজছে, রাধেশ্যাম এলো নিশ্চয় বাজার থেকে। ছুটে গেলাম দরজা খুলতে----
দরজা খুলেই রাধেশ্যামকে জড়িয়ে ধরলাম, ও বলল, হোল কি তোমার---- ঘামে ভিজে গেছি ছাড়ো ছাড়ো...  আমি বললাম, রাধেশ্যাম আমার বাবা কে আমি জেনে গেছি।  শুনে ও স্থিরভাবে তাকাল, তারপর বলল, কিভাবে?  আমি বললাম মায়ের আলমারি থেকে অ্যালবাম বের করে আমি দেখেছি।  শুনে ও আঁতকে উঠলো!  বলল, করেছো কি?  বৌদি নেই আর তুমি? ----- আমি বললাম, বেশ করেছি।  চাবি পেলে কোথায়?  আমি বললাম, যেখানে রাখে সেখান থেকে।  শুনে বলল, মেয়েদের কোনকিছুতে হাত দিতে নেই, তুমি জানো না?  বৌদি জানতে পারলে তোমাকে আস্ত রাখবে না, তারসঙ্গে আমাকেও----আমি বললাম, রাধেশ্যাম, তুমি যার কথা বলছ, উনি আমার মা।  তারপর বাবার ফটো দেখিয়ে বললাম, এনার সঙ্গে আমার ট্রেনে দেখা হয়েছিল।  শুনে ও বলল, বলো কি!!?? আমি বললাম,  হ্যাঁ । আমার কাছে থেকে কার্ড নিয়ে গেছে, ঠিক ফোন করবে দেখো। কিছুটা উত্তেজিত হয়ে ও বলল, খোকা তুমি আগে এগুলো ঠিকঠাক করে রাখো, বৌদি যেন বুঝতে না পারে।
ট্রেনে যা যা কথা হয়েছিল সব বললাম রাধেশ্যামকে। ওর চোখ দুটো জলে ভ’রে উঠলো!  যেমনটি ছিল সেইভাবেই রেখে দিলাম অ্যালবামগুলো।

মা ফিরে এসেছে---- সুযোগ বুঝে মাকে সব বললাম, শুনে মা কিছুটা উদাসভাবে তাকাল আমার দিকে, তারপর বলল, তুমি চাইলে ওনার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতেই পারো, কিন্তু ভুলেও কোনদিন আমাকে ওনার সঙ্গে দেখা করাবে এটা ভেবো না, আর একটা কথা--- এটা আমার বাড়ি, এখানে কোনদিন আসার কথা ওনাকে বলবে না, বুঝেছ?  আমি বললাম, পাবো কোথায় বাবাকে?  আমার কাছে কিছুই নেই জানার মতো----নির্লিপ্তভাবে মা উঠে চলে গেল, কোন কথা না বলে......


তারপর কত বছর কেটে গেছে, প্রায় দেখতে দেখতে কুড়ি বছর হতে চলল বাবার সঙ্গে ট্রেনে দেখা হয়েছিল।  বছর দশেক হোল আমি বিয়ে করেছি।  প্রিয়া আমার স্ত্রী আর রকি (আট বছর বয়স ওর) আমার ছেলে।   মা, অনেকদিন হোল চাকরি ছেড়ে দিয়েছে।  আমার সঙ্গে সম্পর্কের তফাৎ থাকলেও প্রিয়া আর রকি মায়ের খুব আদরের।     এই কুড়িটা  বছর শুধু একটা ফোনের অপেক্ষা করে কেটেছে, বাকি জীবনটাও হয়তো এই অন্তহীন অপেক্ষায় কাটবে আমার জীবন--- মনে মনে শুধু বলি, বাবা, একবার কি পারতে না আমি তোমার ছেলে এই কথাটা সবাইকে জানিয়ে যেতে! বুকটা ভারি হয় ওঠে!  রাধেশ্যাম এখন আর তেমন কাজ করতে পারেনা, বয়স হয়েছে--- সে শুধু রকির খেলার সাথি।

সমাপ্ত।


রাহুল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা

সার্জিক্যাল স্ট্রাইক
----------------------------------------
রাস্তার বুকে মিটমিটে কেরোসিন যারা কুড়াতে আসে.........তাদের কেন ফুচকার লাইনে দেখি না।
ওখানে কি এয়ারটেলের টাওয়ার নেই.......
থাকলেও বা কি - ফুচকায় প্রশাসনিক পেনশন্ বেশি।বেশ বেশ - গুলতানি পায়রার গপ্পো হোক!!!

শব্দরূপ : রাহুল

Wednesday, January 18, 2017

ঘন কুয়াশা (৪)
 শীলা ঘটক       
         
 
বৌদি দরজা খুলে দাদাকে দেখে তো অবাক!  ভাবতেই পারেনি দাদা ফিরে আসবে, দাদা কে দেখে চন্দ্রদা জিজ্ঞেস করলো, কি  ফিরে এলে?   দাদা কোন উত্তর দিলনা। বেগতিকে দেখে চন্দ্রদা চলে গেল।  তারপর লাগলো দাদাবাবু আর বৌদির মধ্যে ভীষণ অশান্তি।   দাদাবাবু বৌদিকে মারলেন এক চড়।  বৌদি কাঁদতে কাঁদতে বললেন আমি থাকবনা এখানে, কোলকাতা চলে যাব।  এইভাবে প্রায়দিন ঝগড়াঝাঁটি লেগে থাকতো।  সুখের সংসার একেবারে শেষ!  দুজনের শোওয়ার ঘর আলাদা হয়ে গেল।  এইভাবে চলতে থাকলো।  দাদাবাবু আর বৌদির মধ্যে কথা বন্ধ হয়ে গেল।  যেটুকু  কথা আমার সঙ্গে দুজনে বলতো, চন্দ্রদা আসা বন্ধ করলো।   আমার তখন বয়স অনেক কম, দুজন কে যে কিছু বলবো সাহস হয়না, এইভাবে চলতে থাকলো।   দিন যায়---- একদিন শুনলাম বৌদি মা হতে চলেছে, দাদাবাবু  তখন দিল্লীতে।   বৌদি ফোন করে জানাল কথাটা।    শুনে দাদাবাবু ওখান থেকে বলল, এ বাচ্চা  আমার না, তুমি এখনই  কোয়ার্টার ছেড়ে তোমার বাবা-মার কাছে চলে যাও।  বৌদি অনেকক্ষণ চিৎকার চ্যাঁচামেচি করলো দাদার সঙ্গে।  তারপর বাবাকে ফোন করে সব জানালো, ফোন রেখে খুব কাঁদছিল।  বৌদি সেদিন কিছু খেল না।  পরের দিন আমাকে বলল, রাধেশ্যাম দুটো ফ্লাইটের টিকিট কেটে নিয়ে আয়, তোর আর আমার আমি বাড়ি যাব।   আমি বললাম, দাদাবাবু ফিরে আসুক দিল্লী থেকে তারপর নাহয়......... বৌদি খুব রেগে গেল আমার ওপর, বলল, না না কোন দরকার নেই আমি চলে যাব।  কি আর করি!  আমি বৌদিকে কোলকাতা পৌঁছাতে এলাম।   

বৌদির বাবা-মা, দাদাবাবুর সঙ্গে ফোনে কথা বললেন,  কিন্তু দাদাবাবুর একটাই কথা ওই বাচ্চা আমার না,  ওটা কার বাচ্চা আপনার মেয়ে খুব ভালো জানে।   এদিক থেকে তোমার দাদুভাই বললেন সবকিছু প্রমানের সুযোগ আছে, তুমি এভাবে একটা সম্পর্ককে নষ্ট করতে পারো না, কিন্তু কে শোনে কার  কথা-----  বৌদির পেটে তোমার একটু একটু করে বেড়ে ওঠা আর এদিকে আশান্তি চরমে উঠেছে। একদিন বৌদি বলল, আমি ডিভোর্স করবো ওকে।  ওর সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চাইনা। বৌদির মা অনেক  বোঝাল  বৌদিকে। কিন্তু বৌদির তখন একটাই জেদ--- দাদাবাবুর সঙ্গে আর সংসার করবে না। কোর্টে কেস করলো বৌদি, দাদাবাবু তখন দিল্লীতে।  ফোনে জানাল তোমার যা ইচ্ছে করো, আমি যাব না, তোমার মুখ দেখতে চাইনা......  একতরফা ভাবে বৌদি কেসে জিতল।   এই ঝামেলার মধেই তুমি হলে।  যতবার দেশে ফিরে যেতে চেয়েছি ততবার ওনারা বলতেন আর কদিন থেকে যাও।  এইভাবে প্রায় দুবছর আমি ওদের সঙ্গে  আছি।
একনাগাড়ে এতগুলো কথা বলে রাধেশ্যাম হাঁপিয়ে উঠেছে, বললাম, বাকিটা নাহয় পরে বোলো।  অন্যমনস্কভাবে বসে ছিল রাধেশ্যাম, মনে হয় শুনতে পায়নি আমার কথা।   আবার বলতে শুরু করলো, এরপর তুমি হলে।  দায়িত্ব আমার বাড়ল, মা, বাবুর অনেক বয়স হয়েছে , তাদের পক্ষে সম্ভব না তোমাকে দেখাশোনা করার, অগত্যা আমার ওপর বৌদির ভরসা বেড়ে গেল আরও।  কিছুদিনের মধ্যে বৌদি একটা চাকরিও জোগাড় করে নিল।  সকাল দশটায় বের হোতো আর বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায় রাত আটটা বাজত।  মা একদিন বৌদিকে বললেন, এতো ছোট বাচ্চা কে রেখে চাকরিতে যাবার কি দরকার ছিল? একটু বড় হলে না হয়------ বৌদি বলল, রাধেশ্যাম আছে ওইই দেখবে ওকে।   কেন তোদের খরচ কি আমরা চালাতে পারবো না?  মা রাগ করে বললেন। বৌদি বলল, তা হয়না মা।
চন্দ্রদার ওপর খুব রাগ হোতো আমার, যখন উড়িষ্যায় ছিলাম বৌদিকে নিয়ে এখানে যাওয়া, ওখানে যাওয়া, কন্ট্রাক্টরির পয়সা বুঝতেই পারছ, যত পারতো খরচ করতো, আর এসব ঘটনা ঘটার পর বৌদি কোথায় আছে?  কেমন আছে----  একটা ফোন করে খবর নেয় না -----  ছোট মুখে বড় কথা হয়ে যাবে, ওনার জন্য তো সুখের সংসারটা ভাঙল !!   যদি বৌদিকে ভালবেসে থাকে তাহলে পারতো না বৌদিকে আর তোমাকে তার কাছে ফিরিয়ে নিতে !! খুব ধৈর্যের সঙ্গে কথাগুলো শুনছিলাম। বললাম, তুমি কি মনে করো যে আমি চন্দ্রশেখরের ছেলে?   শুনে বলল, না তা মনে করিনা, কিন্তু ওনার জন্যই...... থামিয়ে দিয়ে বললাম, সেটা তো শুধু  বন্ধুত্বও হতে পারে! প্রেমের সম্পর্ক না হয়ে ! ----  রাধেশ্যাম বলল, দেখো খোকা আমি  মুক্ষু মানুষ, অত বুঝি না।  ওনার জন্য যেহেতু এদের সম্পর্কটা ভাঙল তাই......
কারোর জন্য কোন সম্পর্ক কি ভাঙে রাধেশ্যাম? নিজেদের বোঝাপড়ার ঘাটতি থাকলে তবেই ভাঙে। তুমি যাও একটু চা করে আনো, মাথাটা ধরেছে। রাধেশ্যাম চা করতে গেল।
অস্থির লাগছে শরীর-মন ! কিছু ভালো লাগছে না, কাল মায়ের ফিরে আসার কথা, কে আমার বাবা?  এই প্রশ্নটা মাথায় চেপে বসেছে, এর উত্তর একমাত্র মা দিতে পারবে আমি জানি, কিন্তু মাকে এই প্রশ্ন  করবো সে সাহসও হচ্ছে না, কারণ মায়ের সঙ্গে আমার সম্পর্কের অনেক ফারাক।  রাধেশ্যাম চা করে আনল।  চা খেতে খেতে বললাম, কাল সকালে বাজার যাবে, মা কাল ফিরবে।  শুনে রাধেশ্যাম বলল, একটু আগে বৌদির ফোন এসেছিল, বৌদি পরশু আসবে, কাল আসতে পারবেনা।  চায়ের কাপ নিয়ে দুজনে আবার বসে পড়লাম। আজও বের হবো না ভাবছি,  শরীরটা  ভালো লাগছে না। রাধেশ্যাম আবার বলা শুরু করলো, ...... তোমার যখন তিন বছর বয়স মা-বাবু গেলেন উত্তরভারত ঘুরতে। বাড়িতে তোমাকে দেখাশোনার পুরো দায়িত্ব তখন আমার।   বাইশ দিনের জন্য ওনারা বেড়াতে গেলেন। পাঁচ দিনের দিন হঠাৎ  টিভি তে দেখি ট্রেন এক্সিডেন্ট  হয়েছে, বৌদির কাছেও কিভাবে যেন খবরটা এসেছিল।  বৌদি তোমাকে আমার কাছে রেখে ছুটলেন ওনাদের খবর নিতে।  বাড়িতে তখন তুমি আর আমি।   ওনারা আর ফিরলেন না, ফিরল দুটো  ডেডবডি।  কথাগুলো বলতে বলতে রাধেশ্যাম খুব জোরে জোরে দীর্ঘশ্বাস ফেলছিল, বুঝলাম খুব কষ্ট হচ্ছে ওর কথাগুলো বলতে! আমি বললাম, তারপর......
তারপর আর কি রয়ে গেলাম এই বাড়িতে, চিরদিনের জন্য। আর দেশে ফেরা হোল না। বৌদি তোমাকে নিয়ে একদম একা একা কি করে থাকবে বোলো...... একদিকে চাকরি আর একদিকে তুমি। তুমি তখন অনেক ছোট।  
মা তাহলে কাল ফিরছে না? প্রসঙ্গটা পালটাবার চেষ্টা করলাম, ও বলল, পরশু ফিরবে, আর একটা কথা বৌদি ফিরলে এসব নিয়ে আমাকে কোন কথা জিজ্ঞেস করবে না কিন্তু।  আমি বললাম, না কিছু জিজ্ঞেস করবো না, কথা দিলাম।


ক্রমশঃ 
অপেক্ষা মন্দিরা ঘোষ আসবে বললে,কই এলে না তো? ঘরদোর ঝাড়পোছ করলাম, উঠোনের তুলসী তলায় প্রদীপ দিলাম, জলচৌকি সাজালাম, পাখাটিও রাখলাম পাশে। সাদা বিছানার পাশে রেকাবিতে তোমার পছন্দের জুঁই ফুল; চাঁপাও রাখলাম কিছু। সাজলাম খুব,হলুদ ঢাকাই শাড়ি সর্ষেফুল রঙা, খোঁপায় বেলীর মালা! অপেক্ষার আলো নিয়ে ভোরের মারুলি ছুঁলো চোখ। আস্তে আস্তে লাল সূর্যের আলো নামল আমার পরিপাটি সাজানো উঠোনে অপেক্ষার প্রদীপ শিখাটি ম্লান করে। তুমি এলে না তো?

Tuesday, January 17, 2017

আইডেন্টিটি
শৌভিক রায়

তোমার খুব কাছেই
মৃত্তিকারা জন্ম নিয়েছে...
কৃষিবিদেরা নানা আদুরে নামে ডাকলেও
মৃত্তিকাদের প্রভেদ ছিল না কোন,
এমনটাই জানতাম আমি,
আমার নিজের কাছে নামগোত্রহীন
এই সকল মৃত্তিকারা
জন্ম দিয়েছিল দৈত্যকুলে প্রহ্লাদকে,
আবার কখনো রক্তবীজকে...
মৃত্তিকাদের যেত আসতো না তাতে কিছু
জন্ম দেওয়াটাই ছিল তাদের কাজ,
লালন নয়
জানার পরিধিটা এই অবধি হলে
বোধহয় কিছু অসুবিধে ছিল না,
মৃত্তিকার প্রকারভেদকে দূরে সরিয়ে
লালনের ওপর দায় চাপাতে পারতাম
কিন্তু মৃত্তিকারাও আজকাল
পৃথক আদুরে নামের মতো
প্রকারভেদে বিশ্বাসী
হয়তো তারাও আইডেন্টিটি চাইছে
চাইছে কোন নব্য ইতিহাস....
ঘন কুয়াশা (৩)
শীলা ঘটক 


আজ সকালের ফ্লাইটে মা অফিসের কাজ নিয়ে ব্যঙ্গালোর গেছে। বাড়িতে আমি আর রাধেশ্যাম। দুপুরে ভাত খেয়ে শুতেই চোখটা জুড়ে গেছিল-----
খোকা ওঠো--- দরজায় টোকা দিয়ে রাধেশ্যামের ডাকে ঘুম ভেঙে গেল। তাড়াতাড়ি উঠে দরজা খুলে দিলাম।
চা নিয়ে এসেছে, টেবিলের ওপর রাখতে রাখতে বলল, রাতে কি খাবে বলো? বৌদি  তো বলে গেছে তোমাকে চিকেন করে দিতে, ফ্রিজে রাখা আছে। চিকেন আর রুটি। বেশ, তাই করো---- কিন্তু কাল আবার চিকেন করোনা, কাল বাজার যাবে, ছোট মাছ আর সবজি নিয়ে আসবে। রাধেশ্যাম মাথা নেড়ে চলে গেল।
চা খেয়ে উঠে পড়লাম। অনেকটা দেরি হয়ে গেল, সন্ধ্যে হতে চলেছে। বেরিয়ে পড়লাম কাজে।
                                  ...............
সকালটা বেশ ঝলমল করছে আজ, সারা বাড়িতে এদিকওদিক প্রচুর ফুলগাছ  লাগিয়েছে রাধেশ্যাম, ওর এসবে খুব শখ। খাটতেও পারে মানুষটা! অপরাজিতা, টগর, জুঁই, কামিনী, গন্ধরাজ, আরও কত ফুলের গাছ--- অনেক গাছ আমি চিনিই না। সম্পর্কের দূরত্ব মায়ের সঙ্গে আমার যতটা, ঠিক ততটা আত্মিক সম্পর্ক আমার সঙ্গে রাধেশ্যামের।   পর যে কখন আপন হয় আর আপন যে কখন পর হয় বলা বড় কঠিন!
সারাদিনের হাজারো ব্যস্ততার মাঝে বেশ কয়েকবার ফোন আসে রাধেশ্যামের---- খোকা খাবার সময় হয়ে গেছে বাড়ি এসো। খাবো তো একবার--  তার আগে ফোন আসবে অন্তত পাঁচ/ছয় বার। আজ দুদিন হয়ে গেল মা ব্যাঙ্গালোর গেছে, একটাও ফোন করার দরকার মনে করে না। যেটুকু দরকার রাধেশ্যামের সঙ্গে ফোনে কথা বলে! সবকিছুই বড় অদ্ভুত লাগে!  আমার প্রতি মায়ের এই অবহেলাই হয়তো  আমার সঙ্গে রাধেশ্যামের সম্পর্কটা এতো মজবুত করেছে। একদিকে ভালই হয়েছে---- রাধেশ্যাম বিয়ে করেনি, দেশে তার কোন পরিবার নেই। বিয়ে করেনি—নাকি এইবাড়ির জন্য তার বিয়ে করা হয়নি , কে জানে!!! 
কাজের চাপে বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায় তিনটে হয়ে গেল। বেল বাজাতেই রাধেশ্যাম দরজা খোলে--- সেই কোন সকালে কি একটু সামান্য খেয়ে বেরিয়েছ, আর এই ফিরলে? (এই শাসনগুলো বেশ লাগে) --- বললাম, তুমি খেয়েছ? মাথা নাড়ে ও,   কেন খাওনি? প্রশ্ন করি---
সেটা হয়না, আজ অব্দি তোমায়  না খাইয়ে আমি খেয়েছি একদিন হয়েছে যে আজ খাবো?   যাও যাও তুমি স্নান করো আমি খাবারগুলো গরম করি।   রাধেশ্যাম চলে গেল।   ওর বয়স এখন মনে হয় ষাট এর বেশীই হবে,  বুঝি না ঠিক।  চিরকাল তো একরকম দেখছি, ধুতি আর হাফ হাতা শার্ট।  এই মানুষটির আন্তরিক টান মনে করিয়ে দেয় বাড়ি ফেরার কথা।
দুপুরের খাবার পর ঠিক করলাম আজ আর বের হব না, বাড়িতেই থাকবো আর ওর কাছে জানতে চাইবো আমার অতীত।  বাড়িতে মা না থাকার জন্য  রাধেশ্যামকেও বেশ স্বাচ্ছন্দ্য মনে হচ্ছিল আজ।  বিকেলে ফুলগাছগুলো জল দিচ্ছিল রাধেশ্যাম। ডাকলাম আমি----- নীচ থেকে সাড়া দিল, যাই খোকা।
ঘরে এসে চেয়ারে বসে বলল, বলো ডাকছিলে কেন? 
তোমাকে আজ সব জানাতে হবে, আমার জীবনের কথা যা তুমি জানো।
রাধেশ্যাম বলল, সে তো অনেক কথা বললে শেষ হবে না। আমি জোর করলাম ওকে, না তোমায় এখনই বলতে হবে......
একটু সিলিং এর দিকে তাকিয়ে ও বলতে শুরু করলো------
দাদাবাবু মানে তোমার বাবা তখন সদ্য বিয়ে করে বৌদিকে নিয়ে উড়িষ্যার কটকে গেছেন।  রেল কোম্পানিতে বড় পোস্টে কাজ করতেন দাদাবাবু।  বৌদি দেখতে কি সুন্দরীই ছিলেন তখন!  খুব ভালো ছিল দুজনে।  জানো,  ছুটিতে দুজনে এদিক ওদিক ঘুরতে যেত।   আমি রেলে অস্থায়ী কর্মী হিসেবে কাজ করতাম, এই দাদাবাবুর ফাইফরমাশ আর কি।  এছাড়া কোয়ার্টারেও কাজ করতাম আমি, দাদাবাবু- বৌদি দুজনেই আমাকে খুব ভালোবাসতো!  বলতে বলতে ওর চোখদুটো চিক্‌ চিক্‌ করে উঠলো...... আমি বললাম তারপর----
এইভাবে কাটল দুবছর, (চুপ করে মাথা নীচু করে আঙুল খুঁটতে লাগলো) তুমি কিন্তু বৌদিকে কিছু বলতে পারবে না খোকা, বৌদি শুনলে আমাকে তাড়িয়ে দেবে।  আমি বললাম আরে না না, তোমার বৌদি আজ পর্যন্ত আমাকে তার ছেলে মনেই  করতে পারল না, মনে করলে সে নিজেই বলতো!!---- চমকে উঠলো রাধেশ্যাম,  বলল, তুমি কেন বললে এই কথা?  আমি বললাম মায়ের ব্যবহার দেখে, যাইহোক তুমি বলো।  তারপর...... তারপর কি হোল??   তর সয় না আমার---  আবার বলতে শুরু করলো,   রেলের এক কনট্রাক্টরের সঙ্গে দাদাবাবুর খুব বন্ধুত্ব হোল।
কি নাম তার? প্রশ্ন করলাম—
চন্দ্রশেখর নন্দী।
তারপর----
তিনজনের মধ্যে খুব বন্ধুত্ব ছিল। পরে পরে দাদাবাবু – বৌদি একা নয় যেখানে যেত চন্দ্রশেখরদা ও ওদের সঙ্গে যেত। সে কি হাসি- ঠাট্টা- গল্প হোতো তোমায় কি বলবো! একসঙ্গে খাওয়া, বেড়ানো, ঘোরা, বাজার- হাট ------ (বুকের ভেতর থেকে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বের হয় এলো) বললাম,  তারপর----
তারপর দাদাবাবুর কাজের চাপ বাড়ল, অফিসের কাজ নিয়ে  এই রাজ্যে, ওই রাজ্যে প্রায়ই যেতে হোতো, কাজে ভীষণভাবে জরিয়ে পড়ল দাদাবাবু,  এদিকে  চন্দ্রদা (চন্দ্রশেখর) প্রায় দিন আসতো, বৌদি কে নিয়ে বাইরে যেত, অনেক রাতে ফিরত বৌদি। কোয়ার্টারের সামনে গাড়ি  থেকে নামিয়ে দিয়ে চলে যেত। সব কিছু দেখেও দাদাবাবু কে কোনদিন কিছু বলিনি।  দাদাবাবু না থাকলেও বেডরুমে বসে সে কি গল্প !! একদিন দাদাবাবুর  দিল্লী যাবার জন্য বের হয় অফিসের কাজে।  তারপর সন্ধ্যের সময় চন্দ্রদা এলো, বাইরে থেকে খাবার কিনে নিয়ে এলো, আমাকে বলল,  তোকে রান্না করতে হবে না, তুই যা বেটা, আজ তোর ছুটি। আমি ভাবলাম, কাজ করি দাদাবাবুর ওনার কোথায় কেন যাব? যাব না----- রান্নাঘরে কাজ করতে গেলাম। প্রায় তখন রাত দশটা হবে--- দেখি অফিসের গাড়ি থেকে দাদাবাবু নামছেন, রান্নাঘরের জানলা থেকে দেখে আমার বুকটা ধড়াস করে উঠলো। চন্দ্রদা ঘরে বসে কথা বলছে বৌদির সঙ্গে  দাদাবাবু কিভাবে নেয় কে জানে!!  দরজা বন্ধ ছিল--- দাদাবাবু দরজায় টোকা দিলেন----
ক্রমশঃ
             

    

Monday, January 16, 2017

ঘন কুয়াশা (২)
শীলা ঘটক  

বাড়ি ফিরে রাধেশ্যাম কে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা রাধেশ্যাম তুমি আমার বাবাকে  কোনদিন দেখেছো? ও,   না শোনার ভান করে ও ঘরে ব্যাগপত্র রেখে চলে গেল।  
বেশ কিছুদিন হয়ে গেল দিল্লী থেকে ফিরেছি। ভদ্রলোক আজও ফোন করলেন না। মনটা খারাপ লাগে! কি অদ্ভুত লাগে, কয়েক ঘণ্টা আলাপ তাতেই কতটা মনে জায়গা করে নেয় মানুষ! রোজ ভাবি মাকে কথাগুলো জানাবো, কিন্তু বলতে গিয়ে আর ইচ্ছে করে না---- ফিরে আসি। বাড়িতে তিনজন আমরা---আমি,  মা,  আর রাধেশ্যাম। আমার আর মায়ের জগত সম্পূর্ণ আলাদা। মা থাকে মায়ের মতো আর আমি থাকি আমার মতো।  সারাদিনে কথা বলার সুযোগ খুব কম। মা, অফিস থেকে ফিরে সামান্য কিছু খেয়ে নিজের ক্লাব এ যায়, ফেরে অনেক রাতে। মা চিরকাল ই একটু বেশী আধুনিকা। আর আমি আমার ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত।  খাবার সময় ও সেভাবে দেখা হয়না। একমাত্র রবিবার দুপুরে আমি আর মা একসঙ্গে খাই, তাও  যদি বাইরে কোন কাজ থাকে তাহলে তাও হয়না, বলা যেতে পারে ছোট থেকে মায়ের সঙ্গ আমি সেভাবে পাইনি। আমাকে নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করা---- মাকে কোনদিন দেখিনি। প্রায় একা একা বড় হয়ে ওঠা...... অধিকাংশ মানুষ তার মাকে  যেভাবে  পায় আমি তা পাইনি।  ফলে সম্পর্কের দূরত্বটা অনেক বেড়ে গেছে। এই বাড়িতে শুধু আমরা দুজন নয়, আরও একজন আছে--- রাধেশ্যাম। যার কথা না বললে অনেক কথা অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। রাধেশ্যাম উড়িষ্যার লোক।  বেঁটে খাটো, ফর্সা মানুষটিকে এক ঝলক দেখলেই বোঝা যায় ভালো  মানুষ। আমার জ্ঞান হওয়ার পর থেকে আমি ওকে আমাদের বাড়ির সব কাজ একা  হাতে করতে দেখেছি। ছোটবেলায় স্কুল যাবার সময় ড্রেস পরানো, খাওয়ানো,   স্কুলবাসে তুলে দেওয়া আবার ফিরে আসলে বাস থেকে নামিয়ে আনা। প্রাতহ্যিক সব কাজ একাই সামলে গিয়েছে চিরকাল।  এই মানুষটাকেই দেখেছি আমার জন্য আকুল হয়ে অপেক্ষা করতে। আমার সব বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ খেয়াল রাখতে। ভাবলাম রাধেশ্যাম কে জিজ্ঞেস করবো, ও আমার বাবাকে দেখেছে কি না---- আবার ভাবছি না থাক যদি কিছু ভাবে! এই  কয়দিন বাবার কথা কেন এতো মনে পড়ছে  জানিনা---কে আমার বাবা? দীর্ঘ এতগুলো বছরে কোনদিন বাবার কথা মনে পড়েনি। এর একটা কারণ আমার সঙ্গে কোনদিন কেউ বাবাকে নিয়ে আলোচনা  করেনি। বাবার একটা ফটোও দেখিনি।
                         .................................

রাধেশ্যাম----- রাধেশ্যাম-----
যাই খোকা (রান্নাঘর থেকে সাড়া দেয়)
চা দাও---( চা নিয়ে এসে রাধেশ্যাম ডাইনিং টেবিলে রাখে)
আর কি খাবে বলো?  সেই তো দুপুরে ভাত খেয়েছো, চিকেন স্যান্ডুইচ করে দেবো? বেশী সময় লাগবে না। তাকালাম রাধেশ্যামের দিকে , কি ভীষণ আন্তরিক মানুষটা! পঁচিশটা বছর ধরে এক রকম দেখছি । না কিছু খাবো না, তুমি এখানে বসো, (চেয়ারটা দেখাই)। ও পাশে এসে বসে। তুমি তো আমার সেদিনের প্রশ্নের উত্তর দিলে না?
কি জানতে চেয়েছিলে মনে নেই তো খোকা----
মিথ্যে কথা বোলোনা তুমি, আমার বাবার কথা বলছিলাম।
রাধেশ্যাম জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকায়। বুঝলাম কিছু একটা গোপন করতে চাইছে, বললাম, মা আসতে অনেক দেরি, প্লীজ তুমি যদি কিছু জানো তো আমাকে জানাও। আমার জানাটা খুব জরুরি। কে  আমার বাবা? কেমন দেখতে?  কি কাজ করতো? আজ পর্যন্ত কিছুই বলা হয়নি আমাকে, কেন বলা হয়নি জানতে পারি?বেশ অস্থির লাগছিল ওকে ...... সল্টলেকের এই বাড়িটা আমার দাদুরবাড়ি, মা ওদের একটাই সন্তান। এখানেই আমার জন্ম, পড়াশোনা, খেলাধুলা, বড় হয়ে ওঠা সব এই বাড়িতেই।
বলো, বলো চুপ করে থেকো না-----
একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস তার বুক থেকে বেরিয়ে এলো। খুব করুণ ভাবে তাকিয়ে বলল, বলবো, সব বলবো  তোমাকে খোকা।
এখনই বলতে হবে তোমায়।
জেদ করোনা খোকা, সবকিছু বলার একটা সময় আছে, আমাকে একটু সময় দাও ঠিক বলবো, কথা  দিলাম। এখন বলার সময় নয়, আর কিছুক্ষণ পর বৌদি ফিরবে অফিস থেকে, আর বৌদি কিছু বুঝতে পারুক এটা আমি চাইছি না খোকা।
অফিসের কাজে মাকে মাঝে মাঝে সাউথ ইন্ডিয়া যেতে হয়। এবার ও মা তিনদিনের জন্য অফিসের কাজ নিয়ে গেল। একটা মাল্টি নাশ্যানাল কোম্পানিতে মা দীর্ঘদিন চাকরি করে। বাড়িতে আমি আর রাধেশ্যাম। ভাবলাম যাক, এবার ও আমাকে এড়িয়ে যেতে পারবেনা। এই তিনদিনের মধ্যে ওর কাছ থেকে সব জেনে নেবো। 
আজ পর্যন্ত ওই ভদ্রলোকের কোন ফোন পেলাম না, খুব অবাক লাগছিল, আবার ভাবলাম কে না কে ---আমাকে চেনেনা, জানেনা, সামান্য কিছুক্ষণের আলাপ—ফোন নাই করতে পারে। ভাবনাগুলো এলোমেলো হয়ে মনে ভিড় করছে বার বার।
ক্রমশঃ
              


Sunday, January 15, 2017

ব্যবধান 
অর্ণব দেবনাথ 

তারপর অনেক অলিগলি ঘুরে 
মৃত্যুর পাশ কাটিয়ে 
পথশ্রমে ক্লান্ত অবসন্ন অসুস্থ 
আমি 
এক পড়ন্ত বিকেলে 
আবার তোমার কাছেই ফিরে এলাম 

তুমি ওষুধ দিলে 

কিন্তু আমি একটু আদর চেয়েছিলাম 
ঘন কুয়াশা
শীলা ঘটক                      

দিল্লী থেকে ফেরার সময়  রাজধানী এক্সপ্রেস ধরার জন্য স্টেশনের দিকে রওনা হলাম, স্টেশনে ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে, ব্যাগটা নিয়ে ওঠার সময় এক ভদ্রলোক গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সিগারেট খেতে ব্যস্ত।  কিছুটা ধাক্কা দিয়েই উঠতে হোল। নিজের সিটটা খুঁজে নিয়ে বসলাম।   কিছুক্ষণ পর ট্রেন ছাড়ল।  গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে ভদ্রলোকটির সিট আমার সিটের অপরদিকে। উনিও এসে বসলেন, ট্রেন ছেড়ে দিল----  বেশ লম্বা প্রায় ছয় ফিটের মতো, গায়ের রঙ মাঝারি, চোখ- নাক টানা টানা, বুদ্ধিদীপ্ত চাউনি, একসময় বেশ সুপুরুষ ছিলেন বোঝা যায়। মাঝে মাঝে আমার দিকে তাকাচ্ছিলেন। আমিও দেখছিলাম ওনার দিকে। কতক্ষণ আর চুপ করে থাকা যায়! জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় যাবেন? ঠোঁটে সিগারেট নিয়েই উত্তর দিলেন, কোলকাতা।  ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে--- জানলার দিকে তাকিয়ে  বাইরেটা দেখার চেষ্টা করছি। কালো কাঁচের ভেতর দিয়ে সেভাবে কিছুই দেখা যায় না। কি করা হয়?  অপর প্রান্ত থেকে প্রশ্ন ছুটে এলো, তাকিয়ে বললাম, ব্যবসা।
কিসের ব্যবসা?   
মেডিসিনের----
ভদ্রলোক সিগারেট ধরিয়ে আবার প্রশ্ন করলেন, লাভ কেমন?
সবে তো শুরু করেছি, দেখা যাক----
ভদ্রলোকের কেন জানিনা একটু বেশী কৌতুহল বলে মনে হোল। বেশী কথা আর না বলে একটা ম্যগাজিন খুলে পড়া শুরু করলাম। খুব ক্লান্ত ছিলাম তাই আর বেশী কথার উত্তর দিতে ভালো লাগছিল না।  খুব তীব্র গতিতে ট্রেন ছুটে চলেছে----- মনে হোল উনি আরও কিছু বলতে চান...... একটার পর একটা সিগারেট খাচ্ছেন আর গেটের দিকে যাচ্ছেন আবার এসে বসছেন। কিছুক্ষণ পর আমিই জানতে চাইলাম, আপনি কি করেন? উত্তর দিলেন, কিছু না---
কোলকাতার কোথায় থাকেন?
একবার আড়চোখে তাকিয়ে চুপ করে রইলেন। আমারও আর জানার ইচ্ছে হোল না। ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়লাম। কতক্ষণ যে ঘুমালাম মনে নেই, ঘুম ভাঙতে  ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে  দেখলাম একই ভাবে বসে আছেন। কি আশ্চর্য! এতক্ষণ একভাবে বসে আছেন! বললাম, একটু ঘুমিয়ে নিতে পারতেন। আমার দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হাসলেন শুধু ---- কি আর বলি! খিদে পাচ্ছে,  ভদ্রলোককে কেমন যেন লাগছিল, নিজের মতো করে চলতে ভালবাসেন সেটা বুঝলাম। খেয়ে নিয়ে বাথরুমের দিকে গেলাম হাত-মুখ ধুতে।  ফিরে এসে আবার ম্যগাজিনটা খুলে পড়তে রইলাম।
বাড়িতে কে কে আছেন?  
আমি,আমার মা আর রাধেশ্যাম মানে----
মা কি এখনো চাকরি করেন?
হ্যাঁ করেন। কিন্তু আপনি কি আমার মাকে চেনেন?
আবার আড়চোখে তাকালেন, পকেটে সিগারেটের বাক্স আর লাইটারটা খুঁজছেন, যেন শুনতেই পাননি। আবার প্রশ্ন করলাম, আমার মা চাকরি করেন আপনি জানলেন কি করে?   উত্তর দিলেন না।  বাথরুমের দিকে চলে গেলেন।  কি আর বলি, কেউ যদি কথার উত্তর দিতে না চায় তাকে তো জোর করা যায় না--- বাথরুম থেকে এসে খাবার নিয়ে বসলেন খেতে। বার বার দেখছিলাম ওনাকে, কখনো দেখেছি কি না মনে করার চেষ্টা করতে লাগলাম, কিন্তু না কোনদিন দেখেছি বলে মনেপড়ে না।  ভাবলাম, মায়ের সঙ্গে হয়তো একসঙ্গে কাজ করেছেন তাই মা কে চেনেন। যাকগে এখন আর কোন কথা বলার দরকার নেই। ভদ্রলোক খাচ্ছেন----  

ম্যগাজিনটা পড়তে পড়তে কখন যে আবার ঘুমিয়ে পড়েছি মনে নেই।  ঘুম যখন ভাঙল তখন দেখি উনি ঘুমাছেন। মনের ভেতর প্রশ্নটা বার বার উঁকি দিতে লাগলো---- উনি আমার মাকে চেনেন, অথচ আমি তো চিনিনা ওনাকে----- দুরন্ত গতিতে ট্রেন এগিয়ে চলেছে......... হুইসেলের আওয়াজ বাইরের  বাতাসকে এফোঁড়ওফোঁড় করে ট্রেনটা সামনের  দিকে এগিয়ে চলেছে  .........
                                             .....................

আপনার নামটা জানা হয়নি, কি নাম? আমাকে প্রশ্ন করলেন----
আকাশ ভৌমিক , ডাকনাম শুভ।
থাকেন কোথায়?
সল্টলেক,
আপনি কোলকাতায়  কোথায় থাকেন?
ঠিকানা নেই, যেখানে জায়গা পাই সেখানে----
মানে?
মানে আর কিছু নয়, আমি আমেরিকাতে থাকি , কয়েক বছর পর পর আসি কিছু কাজ নিয়ে কোলকাতায়, তখন যেকোন হোটেল বা লজে থাকি। এই প্রথম ভদ্রলোক কথা বললেন,  ভাবলাম এবার জিজ্ঞেস করলে হয়তো বলবেন, আপনি আমার মায়ের পরিচিত?  আমার মাকে দেখেছেন?  ভদ্রলোক বললেন, আজ থাক----আবার যদি কোনদিন দেখা হয় তখন না হয়ে বলবো।
আর যদি কোনদিন দেখা না হয় তাহলে?
তাহলে আর জানার দরকার পড়বে না-----
খুব কৌতূহলী হয়ে উঠছি, খুব অদ্ভুত ধরনের মানুষ! মনটা অস্থির হয়ে উঠলো, বললাম, আপনার ঠিকানা, ফোন নং দিন আমিই যোগাযোগ করবো। ভদ্রলোক কথায় সায় দিলেন না,  চুপ করে রইলেন। কিছুক্ষণ পর বললেন, আপনার অ্যাড্রেস আর ফোন নং টা দিন আমি যোগাযোগ করে নেবো।  অগত্যা ব্যাগ থেকে কার্ড বার করে দিয়ে দিলাম।  বয়স্ক মানুষ বিশেষ তো কিছু বলা যায় না।  ট্রেন ঢুকচ্ছে স্টেশনে---- ব্যাগপত্র গুছিয়ে নামার জন্য  তৎপর হলাম, উনিও ব্যস্ত নামার জন্য---- ট্রেন থামল, একে একে সবাই নামছে, আমরাও নামলাম, দেখি ভদ্রলোক কোনকিছু না বলে নিজের মতো এগিয়ে গেলেন, দূর থেকে বললাম ফোন করবেন---- শুনতে পেল কিনা জানিনা এগিয়ে যাচ্ছেন ---ভারি অদ্ভুত মানুষ তো!  মিলিয়ে গেলেন লোকারণ্যে......  হঠাৎ  দেখি রাধেশ্যাম পেছন থেকে ব্যাগটা ধরে টানছে, চলো চলো, কখন এসেছি তোমাকে নিতে আর তুমি দাঁড়িয়ে আছো---- চিরকাল রাধেশ্যাম একটু বেশী উৎসাহী হয়ে পড়ে আমাকে দেখলে...... চলো, ব্যাগপত্র নিয়ে ও এগিয়ে যেতে থাকলো, আর আমি বার বার পেছন ফিরে সেই মানুষটিকে খুঁজতে রইলাম।
 

ক্রমশঃ