Thursday, January 12, 2017


দেশভাগ এবং ......

শীলা ঘটক  

শামুর মা----- ওর আসল নাম পদ্ম। কিন্তু সবাই তাকে শামুর মা বলেই চেনে বা ডাকে। সরকারী আবাসনের পাম্প ম্যান রামপ্রসাদ সাহুর বউ। স্বামী-স্ত্রী র বয়সের অনেকটা তফাৎ , ‘বৃদ্ধস্য তরুনী ভার্যা’ বলাই যায়। লেখাপড়া না জানা, কালো, বেঁটে খাটো চেহারা--- শামুর মায়ের সঙ্গে আমার হৃদ্যতা দেখে হাউসিং এর মহিলা মহলে মাঝে মধ্যেই চুপিসারে চর্চার ঢেউ খেলত। মানুষটাকে আমি যে খুব ভালবাসতাম সেটা স্বীকার করতে আমার কোন অসুবিধা নেই। আমার স্বামী একজন সরকারী চাকুরে...... তার চাকরির সূত্রেই আমি কোচবিহারের এই আবাসনের বাসিন্দা
সারাদিনের কাজের ফাঁকে ফাঁকে শামুর মায়ের ঘরের সামনে সিমেন্টের বেঞ্চে বসে অনেকরকম গল্প করতাম আমরা দুজনে। পদ্ম নাম হওয়া সত্ত্বেও সবাই তাকে শামুর মা বলেই ডাকতো এবং পদ্ম সেটাই পছন্দ করতো---- এই বিষয়ে বলি দুর্ভাগ্যবশতঃ কিছু বছর হোল শামু গাছ থেকে পড়ে গিয়ে বুকের পাঁজর ভেঙে  মারা যায়। সকলের ডাকের মধ্যে তার ছেলে বেঁচে থাকুক এটাই ছিল তার মনের একান্ত ইচ্ছে।
শামুর মা আমার থেকে বয়সে কিছু বড়। রোজ কিছু না কিছু বিষয় নিয়ে আমাদের মধ্যে গল্প হত, একদিন আমি প্রশ্ন করলাম বাংলাদেশ থেকে কিভাবে এখানে এলে?  আর শামুর বাবার সঙ্গে তোমার বিয়ের গল্প বলো। আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল...... বুঝতে পারলাম না জিগ্যেস করাটা ঠিক হোল কিনা! আমাকে বলল, শুনবেন? আমি বললাম, হ্যাঁ ...... পদ্ম বলতে শুরু করলো তার জীবনের ঘটনা---
সালটা ১৯৭১ ---- বাংলাদেশ তখন উত্তাল, পূর্ব পাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্তানের বিচ্ছিন্ন হওয়ার লড়াই, মানুষের ভালোবাসা, ঘরবাড়ি, পাড়া প্রতিবেশী, সবকিছু বিচ্ছিন্ন  হতে শুরু করলো! এই যুদ্ধে মানুষের বা দেশের কি হাল হয় তাতো সহজেই অনুমেয়।
পদ্ম আর তার পরিবার তখন বাস করতো দিনাজপুর (বাংলাদেশ), বাবা মারা গেছে দুবছর আগে। তিন মেয়ে আর কোলের ছেলেকে নিয়ে—মিলিটারিদের অত্যাচার থেকে বাঁচতে রাতের অন্ধকারে বাচ্চা-কাচ্চা, ব্যাগ- বোচকা নিয়ে পদ্মর মা  জলাজমি,ধানজমি পার হয়ে ভারত সীমান্তের দিকে হাঁটতে শুরু করলো। ঘুটঘুটে অন্ধকার একটু দূরের কিছু দেখা যায় না, কোনরকমে সীমান্তে পৌঁছে যেতে পারলেই আর চিন্তা নেই, ওখানে যে শরণার্থী শিবির আছে পৌঁছে যেতে পারলে দুশ্চিন্তা মুক্ত। এই ভাবনা নিয়ে সবাই সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে।  বাড়িঘর, দেশ, পাড়া প্রতিবেশী সবাইকে ছেড়ে ---একটু বাঁচার আশায় --- মাঝে মাঝে বুকের ভেতরটা  মোচড় দিয়ে উঠছিল। চোখের জল গাল বেয়ে পড়ে বুক ভেসে যাচ্ছিল পদ্মর।  পদ্মর বয়স তখন বারো বছর, খানাখন্দ, জল জঙ্গল পেরিয়ে আসতে আসতে কখন যে ও পথ হারিয়ে ফেলেছে—বুঝতেই পারেনি! সবে তখন পূবদিক একটু লাল হতে শুরু করেছে---- এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে মা,ভাই,দিদিরা কেউ নেই। সারি দিয়ে লোক চলছে ---- পদ্ম তখন সেই সারিতে মিশে যায়।
একসময় শরণার্থী শিবিরে এসে পৌঁছায়। রামপ্রসাদ সাহুর সঙ্গে ওই শিবিরেই তার দেখা, বয়সে প্রায় তিনগুন বড়, ওকে দেখে লোকটা এগিয়ে আসে, বলে, তোর খিদে পেয়েছে? পদ্ম মাথা নাড়ে।  খিদেতে পেটের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠছিলরামপ্রসাদ পদ্মকে হোটেলে খাইয়ে নিজের ভাড়াবাড়িতে নিয়ে গিয়ে হাজির হয়। বিহারে   রামপ্রসাদের বউ-ছেলে সব আছে। ছেলে পদ্মর থেকে বয়সে বড়। বয়সের এতোটা তফাতের জন্য কেউ কিছু প্রশ্ন করতো না, কারণ কাজের মেয়ে – এই পরিচয়ে পদ্মকে রেখেছিল।  কিন্তু রোজ রাতে ধর্ষণ হতে হতে পদ্ম একসময় ফুঁসে উঠলো।
বয়সটা তার এখন বেড়েছে। সে বিয়ে করার দাবি জানালো। যাইহোক রামপ্রসাদ কিছুটা চাপে পড়ে বিয়ে করতে বাধ্য হোল কারণ পদ্ম তখন চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা। মন্দিরে  গিয়ে মাথায় সিঁদুর দিয়ে তাকে বউএর স্বীকৃতি দিলো। ওদের আইনি বিয়ে বলে কিছু হয়নিরামপ্রসাদের দেশে ধানজমি, বাড়িঘর সব মিলিয়ে ভালোই সম্পত্তি ছিল, কিন্তু তাতে অন্তত শামুর মায়ের কোন অধিকার নেই এটা বলা যায়। এইভাবে নিজের জীবনের নানা চরাই উতরাই পার হয়ে বর্তমান জীবনে এসে উপস্থিত হবার ঘটনা পদ্ম বলে চলল। শুনতে শুনতে কখন যে সন্ধ্যে হয়ে গেছে খেয়াল করিনি। আমি প্রশ্ন করলাম বাংলাদেশের যেখানে তোমাদের বাড়ি ছিল সেখানকার ঠিকানা  তোমার মনে আছে? শুনে ও বলল, কেন মনে থাকবে না? নিজের বসত---নিজের ভিটে কেউ ভুলতে পারে গো! তুমি যদি শুনতে চাও আমি এখনই বলে দিতে পারি। আমি বললাম, দাঁড়াও দাঁড়াও আগে একটা কাগজ কলম আনি, তারপর বলো।
দোতলায় এসে একটা পেন আর কাগজ নিয়ে ঠিকানাটা লিখে নিলাম। প্রায় চল্লিশ বছর আগের ছেড়ে আসা ঠিকানা কিভাবে মানুষের মনে থাকে! ভেবে কিছুটা অবাক হলাম!  
কয়দিন পর ঠিকানাটা একটা খামে লিখে বিস্তারিত জানিয়ে আমি আমার স্বামীকে দিয়ে পোস্টঅফিস থেকে পোস্ট করালাম। ভাবলাম যদি কেউ আসে ,ওর সঙ্গে দেখা করে তো বেচারা একটু শান্তি পাবে। কিন্তু প্রায় দুমাস হয়ে গেলো –কোন উত্তর এলোনা । এদিকে শামুর মা খুব উদগ্রীব হয়ে রয়েছে যদি চিঠিটা পায় তাহলে নিশ্চয় ওদের সঙ্গে ওর দেখা হবে। কিন্তু চিঠির কোন উত্তর আসেনি দেখে ও কিছুটা হতাশ হয়ে পড়ল!  আমি বললাম, চিন্তা করো না, হয়তো হাতে পায়নি এখনও। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, সেই কবেকার কথা!--- কত যুগ হয়ে গেল।  ওরা কেউ বেঁচে আছে কিনা কে জানে!  চোখের জল মুছে আমাকে বলল, জানেন এদেশে যে inland  letter  (হাল্কা নীল রঙের ) এ সবাই চিঠি লেখে ওই চিঠি বাংলাদেশে যায় আমি জানি।
ওর দিকে তাকিয়ে বুঝলাম আমি যদি আরও একবার চেষ্টা করি তাহলে শামুর মা খুশী হবে। ওর ইচ্ছা পূরণ করতে আবার inland letter  এ হাউসিং এর ঠিকানা লিখে --- ম্যাপ এঁকে --- আমার ফোন নম্বর লিখে আবার পোস্ট করলাম। কিন্তু আমিও যে মনে মনে হতাশ হয়েছি এটা বলা যাবে না।    
প্রায় দিন পনেরো পর , হঠাৎ একদিন আমার ফোনে বাংলাদেশ থেকে ফোন এলো ...... বললাম, কে বলছেন? ও প্রান্ত থেকে ভেসে এলো, দিদি তুমি বাইচ্চা আছো? আমি তোমার ভাই চাঁদু। আমি বললাম একটু অপেক্ষা করুন লাইনটা কাটবেন না—বলে দৌড়ে গিয়ে ফোনটা শামুর মার কানে দিলাম, ______ বললাম তোমার  ছোটভাই চাঁদু বাংলাদেশ থেকে ফোন করছে। শুনে শামুর মার মুখের বাক্য সরে না... ও প্রান্ত থেকে দিদি দিদি বলেই যাচ্ছে, আমি ইশারা করে কথা বলতে বললাম। কিছুটা ধাতস্থ হয়ে ও কেঁদে ফেলল,  কাঁদতে কাঁদতে বলল, হ্যাঁ ভাই আমি বাইচ্যা আসি রে, তুই কি করতাসিস? তগো খবর ক? ও প্রান্ত থেকে জানালো, অনেকদিন হইল মা মইর‍্যা গেসে। দুই দিদির এই দ্যাশেই বিয়া হইসে।আর আমি বাংলাদেশ র‍্যালে চাকরি করতাসি, বিয়া করসি, একডা পোলা –একডা মাইয়া............ বেশ অনেকক্ষণ ধরে ওদের কথাবার্তা চলতে থাকলো। আমি হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম শামুর মায়ের দিকে...... দুই দেশের দুই ভাইবোনের কথাবার্তা শুনে নিজের মনেও খুব উত্তেজনা হচ্ছিল, ভাবলাম—যাক একটা ভালো লাগার মতো কিছু  করলাম।
একসময় ওই হাউসিং ছেড়ে অন্য হাউসিং এ চলে আসতে হোল। পরে জেনেছি পদ্মর ভাই চাঁদু তার দুই দিদিকে নিয়ে, নিজের পরিবার নিয়ে শামুর মায়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলো। অনেক খারাপ লাগার মাঝে কিছু ভাললাগা আছে বলেই হয়তো আমাদের বেঁচে থাকার ইচ্ছেটা বেঁচে থাকে।

   











No comments:

Post a Comment