বিবেকানন্দের হাসি
___________________
-ফিরোজ আখতার
___________________
সকাল সাতটা দশ । ঘুম থেকে উঠে খানিক আড়মোড়া ভাঙলো কাল্টু ৷ জিভটা একেবারে শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে ৷ ঢেঁকুরের সঙ্গে কিছুটা পিত্তি মেশানো তেতো জল উঠে এলো মুখে | বিকৃত মুখে সেটা জানলা দিয়ে বাইরে নিক্ষেপ করলো সে ! পাশের টেবিলে রাখা প্রায় খালি হয়ে আসা মদের বোতলটা কাত করে পুরো ঢেলে দিলো গলায় ৷ রেল কলোনীর বস্তির মা তুলে একটা অশ্রাব্য গাল পাড়লো | এই বস্তিতেই সে আছে আজ বছর পাঁচেক ৷ তড়াক করে খাট থেকে নেবে দড়িতে ঝোলানো গামছাটা তুলে নিলো | আজ সকালে একটা ছোট কাজ আছে | একটা বুড়ো মাস্টারকে একটু শায়েস্তা করতে হবে ৷ বেশি কিছু না, একটা হাত আর একটা পা ভাঙতে হবে | সেই পুরোনো বাড়িওয়ালা আর ভাড়াটে কেস | বুড়ো মাস্টারটা কিছুতেই নাকি ঘর ছাড়ছে না। রাতে সে দশ হাজার টাকা পেয়েছে মিতুলদার কাছ থেকে | মাস্টারের বাড়ির মালিক হলো মিতুলদা | মিতুল নন্দী | কাজ হয়ে গেলে আরও দশ হাজার দেবে বলেছে | শালা... লাখ লাখ টাকার মালিক শয়তানটা !
আজ বেশ সকাল সকালই উঠেছেন মানববাবু | মনটা আজ বেশ ফুরফুরে | আজ ১২ই জানুয়ারী, স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিন ৷ স্কুলে থাকাকালীন প্রতিবছরই তিনি এই দিনটায় ছাত্রদের নিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠান করতেন | আজ মাস ছয় হলো তিনি রিটায়ার করেছেন ৷ ছাত্রদের কথা খুব মনে পড়েছ আজ | বাজার করে একবার স্কুল থেকে ঘুরে আসবেন ঠিক করলেন ৷ বেশি দূর নয় ... ঘণ্টাখানেকের রাস্তা | পাশে নীতা বেঘোরে ঘুমাচ্ছে ৷ তার রিটায়ারমেন্টের পর নীতার ঘুমটা বেড়ে গেছে আগের থেকে | স্কুলে যাওয়ার নেই বলে সকালে উঠে রান্নাবান্নার তাড়াও নেই | নিঃসন্তান দম্পতি ওরা ৷ বউয়ের মায়ামাখা মুখের দিকে চেয়ে হালকা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মানববাবু | সকালের চা টা তিনিই করেন বরাবর | অালতো একটা আড়মোড়া ভেঙে মশারী তুলে রান্নাঘরের দিকে এগোলেন তিনি |
বিনোদ আজ পাঁচ বছর হলো গ্র্যাজুয়েশন করে ঘরে বসে আসে | ইতিহাসে অনার্স নিয়ে পড়েছিলো সে | রেজাল্ট ও খারাপ করেনি | ৫২% নম্বর পেয়েছিল সে গ্র্যাজুয়েশনে ৷ নিয়মিত সরকারি চাকরির পরীক্ষা দিচ্ছে ৷ কিন্তু পাশ করতে পারছে না | প্রিলিম পাশ করেছিল দুটোয়, কিন্তু মেন এ গিয়ে আটকে গেছে ৷ প্রাইভেট চাকরিরও চেষ্টা করেছিল দু একটা কিন্তু কোনটা টেই সে ২ মাসের বেশি টিকটে পারে নি । আজ সকালে রাকেশের সাথে দেখা করবে বলেছে ও | ক্লাবের মাঠে বিবেকানন্দের মূর্তির পাশে সকাল আটটায় থাকবে বলেছে রাকেশ | লোকাল কাউন্সিলার বিজয়দা ওদের একটা জায়গায় রেফার করবেন বলেছেন... | ছোটখাট যা পাওয়া যায় তাই-ই করবে সে মনস্থির করে নিয়েছে | নাই মামার থেকে কানা মামা ভালো ! সকাল নটায় সময় দিয়েছেন বিজয়দা | একটু তাড়াতাড়ি যাওয়াই ভালো | আজ আবার অনেক জায়গায় নানা অনুষ্ঠান... I কোথাও বেরিয়ে গেলেই কেলো হয়ে যাবে | কলঘরে উঁকি দিয়ে দেখলো কেউ নেই | মা বোধহয় রান্নাঘরে | কেরানীর চাকরি করা বাবা বাজারে গেছে বোধহয় ৷ কলঘরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিলো বিনোদ |
বাজার যাবার পথেই পড়ে ক্লাবের মাঠটা | চারপাশে রেলিং দিয়ে ঘেরা ৷ মাঝখানে একটা বিবেকানন্দের আবক্ষ মূর্তি | আজ মূর্তিটাকে খুব সুন্দরভাবে সাজানো হয়েছে ৷ মালা আর ফুল দিয়ে সবাই শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে গেছেন একটু আগেই মনে হচেছ | খুব ভালো লাগছে | মাঠে লোকজন নেই তেমন | শুধু একটু দুরে বছর পঁচিশের একটা ছেলে দাঁড়িয়ে নীল সোয়েটার গায়ে দিয়ে | মানববাবু বিবেকানন্দের মূর্তির সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন টান টান শরীরে | একদৃষ্টে চেয়ে আছেন তিনি মূর্তিটার দিকে | গতকাল মিতুল বাবুর সাথে ঝামেলাটা মনে পড়ে গেলো | অনেক দিন ধরে তাদের বাড়ির মালিক মিতুল বাবু তাদের তুলে দেবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন | কাল উনি স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন না উঠলে তাদের দেখে নেবেন ! এই বুড়ো বয়েসে এত দিনের প্রিয় বাড়িটা ছেড়ে তিনি কোথায় যাবেন তাই ভাবতে লাগলেন এক মনে |
পায়ে হঠাৎ একটা তীব্র ব্যাথা অনুভব করলেন মানববাবু | পড়ে যেতে যেতে দেখলেন নীল সোয়েটার পড়া ছেলেটি বিহ্বল দৃষ্টি তে চেয়ে আছে তার দিকে ৷ মাথার পিছনে বেশ জোরেই লাগলো | ওঠার চেষ্টা করতেই লোকটা মুখ দিয়ে একটা অদ্ভূত শব্দ করে ডান হাতটা তার মুচড়ে ধরলো পেছন দিকে | চোখে অন্ধকার দেখালেন মাস্টারমশাই | হাতটা তার ভেঙে যাবে বলে মনে হচ্ছে | পিঠে সজোরে একটা লাথি এসে পড়লো | ধনুকের মতো বেঁকে গেলেন তিনি | লোকটার হাতে একটা বাঁশ | বাশঁটা তুলে ধরেছে লোকটা তার কোমর লক্ষ্য করে ৷ চোখ বুজিয়ে ফেললেন ...মনে পড়ে গেলো নীতার মায়ামাখা মুখখানি ! কিন্তু কই... মারলো না তো লোকটা | চোখ চাইতেই দেখলেন এক অদ্ভূত দৃশ্য | লোকটার হাত থেকে বাশঁটা খসে পড়েছে ৷ দুহাত দিয়ে মাথাটা চেপে ধরেছে সে | রক্তে ভেসে যাচ্ছে মুখটা খুনীটার | আর পিছনে একটা থান ইট হাতে দাঁড়িয়ে সেই নীল সোয়েটার | ধপাস করে কাটা কলাগাছের মতো মুখ থুবড়ে পড়লো খুনীটা |
- " রাজেস... স্যার কে তোল !"
পিছন থেকে সমবয়সী আর একটা ছেলে এসে তোলার চেষ্টা করলো তাঁকে | ইট-টা ফেলে দিয়ে বন্ধুকে সাহায্য করার জন্য হাত লাগালো বিনোদ |
-" তাড়াতাড়ি কর ! শয়তানটার জ্ঞান ফেরার আগেই পালাতে হবে..." !
দুই নরেনের কাঁধে ভর করে যখন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন মানববাবু, একবার পিছন ফিরে তাকালেন বিবেকানন্দের মূর্তিটার দিকে ৷ স্পষ্ট দেখতে পেলেন মূর্তিটা মৃদু মৃদু হাসছে... ঠোঁটের কোণ দিয়ে ঝরে পড়ছে যেন নিখাদ পরিতৃপ্তি ...
No comments:
Post a Comment