Monday, January 16, 2017

ঘন কুয়াশা (২)
শীলা ঘটক  

বাড়ি ফিরে রাধেশ্যাম কে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা রাধেশ্যাম তুমি আমার বাবাকে  কোনদিন দেখেছো? ও,   না শোনার ভান করে ও ঘরে ব্যাগপত্র রেখে চলে গেল।  
বেশ কিছুদিন হয়ে গেল দিল্লী থেকে ফিরেছি। ভদ্রলোক আজও ফোন করলেন না। মনটা খারাপ লাগে! কি অদ্ভুত লাগে, কয়েক ঘণ্টা আলাপ তাতেই কতটা মনে জায়গা করে নেয় মানুষ! রোজ ভাবি মাকে কথাগুলো জানাবো, কিন্তু বলতে গিয়ে আর ইচ্ছে করে না---- ফিরে আসি। বাড়িতে তিনজন আমরা---আমি,  মা,  আর রাধেশ্যাম। আমার আর মায়ের জগত সম্পূর্ণ আলাদা। মা থাকে মায়ের মতো আর আমি থাকি আমার মতো।  সারাদিনে কথা বলার সুযোগ খুব কম। মা, অফিস থেকে ফিরে সামান্য কিছু খেয়ে নিজের ক্লাব এ যায়, ফেরে অনেক রাতে। মা চিরকাল ই একটু বেশী আধুনিকা। আর আমি আমার ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত।  খাবার সময় ও সেভাবে দেখা হয়না। একমাত্র রবিবার দুপুরে আমি আর মা একসঙ্গে খাই, তাও  যদি বাইরে কোন কাজ থাকে তাহলে তাও হয়না, বলা যেতে পারে ছোট থেকে মায়ের সঙ্গ আমি সেভাবে পাইনি। আমাকে নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করা---- মাকে কোনদিন দেখিনি। প্রায় একা একা বড় হয়ে ওঠা...... অধিকাংশ মানুষ তার মাকে  যেভাবে  পায় আমি তা পাইনি।  ফলে সম্পর্কের দূরত্বটা অনেক বেড়ে গেছে। এই বাড়িতে শুধু আমরা দুজন নয়, আরও একজন আছে--- রাধেশ্যাম। যার কথা না বললে অনেক কথা অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। রাধেশ্যাম উড়িষ্যার লোক।  বেঁটে খাটো, ফর্সা মানুষটিকে এক ঝলক দেখলেই বোঝা যায় ভালো  মানুষ। আমার জ্ঞান হওয়ার পর থেকে আমি ওকে আমাদের বাড়ির সব কাজ একা  হাতে করতে দেখেছি। ছোটবেলায় স্কুল যাবার সময় ড্রেস পরানো, খাওয়ানো,   স্কুলবাসে তুলে দেওয়া আবার ফিরে আসলে বাস থেকে নামিয়ে আনা। প্রাতহ্যিক সব কাজ একাই সামলে গিয়েছে চিরকাল।  এই মানুষটাকেই দেখেছি আমার জন্য আকুল হয়ে অপেক্ষা করতে। আমার সব বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ খেয়াল রাখতে। ভাবলাম রাধেশ্যাম কে জিজ্ঞেস করবো, ও আমার বাবাকে দেখেছে কি না---- আবার ভাবছি না থাক যদি কিছু ভাবে! এই  কয়দিন বাবার কথা কেন এতো মনে পড়ছে  জানিনা---কে আমার বাবা? দীর্ঘ এতগুলো বছরে কোনদিন বাবার কথা মনে পড়েনি। এর একটা কারণ আমার সঙ্গে কোনদিন কেউ বাবাকে নিয়ে আলোচনা  করেনি। বাবার একটা ফটোও দেখিনি।
                         .................................

রাধেশ্যাম----- রাধেশ্যাম-----
যাই খোকা (রান্নাঘর থেকে সাড়া দেয়)
চা দাও---( চা নিয়ে এসে রাধেশ্যাম ডাইনিং টেবিলে রাখে)
আর কি খাবে বলো?  সেই তো দুপুরে ভাত খেয়েছো, চিকেন স্যান্ডুইচ করে দেবো? বেশী সময় লাগবে না। তাকালাম রাধেশ্যামের দিকে , কি ভীষণ আন্তরিক মানুষটা! পঁচিশটা বছর ধরে এক রকম দেখছি । না কিছু খাবো না, তুমি এখানে বসো, (চেয়ারটা দেখাই)। ও পাশে এসে বসে। তুমি তো আমার সেদিনের প্রশ্নের উত্তর দিলে না?
কি জানতে চেয়েছিলে মনে নেই তো খোকা----
মিথ্যে কথা বোলোনা তুমি, আমার বাবার কথা বলছিলাম।
রাধেশ্যাম জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকায়। বুঝলাম কিছু একটা গোপন করতে চাইছে, বললাম, মা আসতে অনেক দেরি, প্লীজ তুমি যদি কিছু জানো তো আমাকে জানাও। আমার জানাটা খুব জরুরি। কে  আমার বাবা? কেমন দেখতে?  কি কাজ করতো? আজ পর্যন্ত কিছুই বলা হয়নি আমাকে, কেন বলা হয়নি জানতে পারি?বেশ অস্থির লাগছিল ওকে ...... সল্টলেকের এই বাড়িটা আমার দাদুরবাড়ি, মা ওদের একটাই সন্তান। এখানেই আমার জন্ম, পড়াশোনা, খেলাধুলা, বড় হয়ে ওঠা সব এই বাড়িতেই।
বলো, বলো চুপ করে থেকো না-----
একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস তার বুক থেকে বেরিয়ে এলো। খুব করুণ ভাবে তাকিয়ে বলল, বলবো, সব বলবো  তোমাকে খোকা।
এখনই বলতে হবে তোমায়।
জেদ করোনা খোকা, সবকিছু বলার একটা সময় আছে, আমাকে একটু সময় দাও ঠিক বলবো, কথা  দিলাম। এখন বলার সময় নয়, আর কিছুক্ষণ পর বৌদি ফিরবে অফিস থেকে, আর বৌদি কিছু বুঝতে পারুক এটা আমি চাইছি না খোকা।
অফিসের কাজে মাকে মাঝে মাঝে সাউথ ইন্ডিয়া যেতে হয়। এবার ও মা তিনদিনের জন্য অফিসের কাজ নিয়ে গেল। একটা মাল্টি নাশ্যানাল কোম্পানিতে মা দীর্ঘদিন চাকরি করে। বাড়িতে আমি আর রাধেশ্যাম। ভাবলাম যাক, এবার ও আমাকে এড়িয়ে যেতে পারবেনা। এই তিনদিনের মধ্যে ওর কাছ থেকে সব জেনে নেবো। 
আজ পর্যন্ত ওই ভদ্রলোকের কোন ফোন পেলাম না, খুব অবাক লাগছিল, আবার ভাবলাম কে না কে ---আমাকে চেনেনা, জানেনা, সামান্য কিছুক্ষণের আলাপ—ফোন নাই করতে পারে। ভাবনাগুলো এলোমেলো হয়ে মনে ভিড় করছে বার বার।
ক্রমশঃ
              


No comments:

Post a Comment