Wednesday, January 18, 2017

ঘন কুয়াশা (৪)
 শীলা ঘটক       
         
 
বৌদি দরজা খুলে দাদাকে দেখে তো অবাক!  ভাবতেই পারেনি দাদা ফিরে আসবে, দাদা কে দেখে চন্দ্রদা জিজ্ঞেস করলো, কি  ফিরে এলে?   দাদা কোন উত্তর দিলনা। বেগতিকে দেখে চন্দ্রদা চলে গেল।  তারপর লাগলো দাদাবাবু আর বৌদির মধ্যে ভীষণ অশান্তি।   দাদাবাবু বৌদিকে মারলেন এক চড়।  বৌদি কাঁদতে কাঁদতে বললেন আমি থাকবনা এখানে, কোলকাতা চলে যাব।  এইভাবে প্রায়দিন ঝগড়াঝাঁটি লেগে থাকতো।  সুখের সংসার একেবারে শেষ!  দুজনের শোওয়ার ঘর আলাদা হয়ে গেল।  এইভাবে চলতে থাকলো।  দাদাবাবু আর বৌদির মধ্যে কথা বন্ধ হয়ে গেল।  যেটুকু  কথা আমার সঙ্গে দুজনে বলতো, চন্দ্রদা আসা বন্ধ করলো।   আমার তখন বয়স অনেক কম, দুজন কে যে কিছু বলবো সাহস হয়না, এইভাবে চলতে থাকলো।   দিন যায়---- একদিন শুনলাম বৌদি মা হতে চলেছে, দাদাবাবু  তখন দিল্লীতে।   বৌদি ফোন করে জানাল কথাটা।    শুনে দাদাবাবু ওখান থেকে বলল, এ বাচ্চা  আমার না, তুমি এখনই  কোয়ার্টার ছেড়ে তোমার বাবা-মার কাছে চলে যাও।  বৌদি অনেকক্ষণ চিৎকার চ্যাঁচামেচি করলো দাদার সঙ্গে।  তারপর বাবাকে ফোন করে সব জানালো, ফোন রেখে খুব কাঁদছিল।  বৌদি সেদিন কিছু খেল না।  পরের দিন আমাকে বলল, রাধেশ্যাম দুটো ফ্লাইটের টিকিট কেটে নিয়ে আয়, তোর আর আমার আমি বাড়ি যাব।   আমি বললাম, দাদাবাবু ফিরে আসুক দিল্লী থেকে তারপর নাহয়......... বৌদি খুব রেগে গেল আমার ওপর, বলল, না না কোন দরকার নেই আমি চলে যাব।  কি আর করি!  আমি বৌদিকে কোলকাতা পৌঁছাতে এলাম।   

বৌদির বাবা-মা, দাদাবাবুর সঙ্গে ফোনে কথা বললেন,  কিন্তু দাদাবাবুর একটাই কথা ওই বাচ্চা আমার না,  ওটা কার বাচ্চা আপনার মেয়ে খুব ভালো জানে।   এদিক থেকে তোমার দাদুভাই বললেন সবকিছু প্রমানের সুযোগ আছে, তুমি এভাবে একটা সম্পর্ককে নষ্ট করতে পারো না, কিন্তু কে শোনে কার  কথা-----  বৌদির পেটে তোমার একটু একটু করে বেড়ে ওঠা আর এদিকে আশান্তি চরমে উঠেছে। একদিন বৌদি বলল, আমি ডিভোর্স করবো ওকে।  ওর সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চাইনা। বৌদির মা অনেক  বোঝাল  বৌদিকে। কিন্তু বৌদির তখন একটাই জেদ--- দাদাবাবুর সঙ্গে আর সংসার করবে না। কোর্টে কেস করলো বৌদি, দাদাবাবু তখন দিল্লীতে।  ফোনে জানাল তোমার যা ইচ্ছে করো, আমি যাব না, তোমার মুখ দেখতে চাইনা......  একতরফা ভাবে বৌদি কেসে জিতল।   এই ঝামেলার মধেই তুমি হলে।  যতবার দেশে ফিরে যেতে চেয়েছি ততবার ওনারা বলতেন আর কদিন থেকে যাও।  এইভাবে প্রায় দুবছর আমি ওদের সঙ্গে  আছি।
একনাগাড়ে এতগুলো কথা বলে রাধেশ্যাম হাঁপিয়ে উঠেছে, বললাম, বাকিটা নাহয় পরে বোলো।  অন্যমনস্কভাবে বসে ছিল রাধেশ্যাম, মনে হয় শুনতে পায়নি আমার কথা।   আবার বলতে শুরু করলো, এরপর তুমি হলে।  দায়িত্ব আমার বাড়ল, মা, বাবুর অনেক বয়স হয়েছে , তাদের পক্ষে সম্ভব না তোমাকে দেখাশোনা করার, অগত্যা আমার ওপর বৌদির ভরসা বেড়ে গেল আরও।  কিছুদিনের মধ্যে বৌদি একটা চাকরিও জোগাড় করে নিল।  সকাল দশটায় বের হোতো আর বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায় রাত আটটা বাজত।  মা একদিন বৌদিকে বললেন, এতো ছোট বাচ্চা কে রেখে চাকরিতে যাবার কি দরকার ছিল? একটু বড় হলে না হয়------ বৌদি বলল, রাধেশ্যাম আছে ওইই দেখবে ওকে।   কেন তোদের খরচ কি আমরা চালাতে পারবো না?  মা রাগ করে বললেন। বৌদি বলল, তা হয়না মা।
চন্দ্রদার ওপর খুব রাগ হোতো আমার, যখন উড়িষ্যায় ছিলাম বৌদিকে নিয়ে এখানে যাওয়া, ওখানে যাওয়া, কন্ট্রাক্টরির পয়সা বুঝতেই পারছ, যত পারতো খরচ করতো, আর এসব ঘটনা ঘটার পর বৌদি কোথায় আছে?  কেমন আছে----  একটা ফোন করে খবর নেয় না -----  ছোট মুখে বড় কথা হয়ে যাবে, ওনার জন্য তো সুখের সংসারটা ভাঙল !!   যদি বৌদিকে ভালবেসে থাকে তাহলে পারতো না বৌদিকে আর তোমাকে তার কাছে ফিরিয়ে নিতে !! খুব ধৈর্যের সঙ্গে কথাগুলো শুনছিলাম। বললাম, তুমি কি মনে করো যে আমি চন্দ্রশেখরের ছেলে?   শুনে বলল, না তা মনে করিনা, কিন্তু ওনার জন্যই...... থামিয়ে দিয়ে বললাম, সেটা তো শুধু  বন্ধুত্বও হতে পারে! প্রেমের সম্পর্ক না হয়ে ! ----  রাধেশ্যাম বলল, দেখো খোকা আমি  মুক্ষু মানুষ, অত বুঝি না।  ওনার জন্য যেহেতু এদের সম্পর্কটা ভাঙল তাই......
কারোর জন্য কোন সম্পর্ক কি ভাঙে রাধেশ্যাম? নিজেদের বোঝাপড়ার ঘাটতি থাকলে তবেই ভাঙে। তুমি যাও একটু চা করে আনো, মাথাটা ধরেছে। রাধেশ্যাম চা করতে গেল।
অস্থির লাগছে শরীর-মন ! কিছু ভালো লাগছে না, কাল মায়ের ফিরে আসার কথা, কে আমার বাবা?  এই প্রশ্নটা মাথায় চেপে বসেছে, এর উত্তর একমাত্র মা দিতে পারবে আমি জানি, কিন্তু মাকে এই প্রশ্ন  করবো সে সাহসও হচ্ছে না, কারণ মায়ের সঙ্গে আমার সম্পর্কের অনেক ফারাক।  রাধেশ্যাম চা করে আনল।  চা খেতে খেতে বললাম, কাল সকালে বাজার যাবে, মা কাল ফিরবে।  শুনে রাধেশ্যাম বলল, একটু আগে বৌদির ফোন এসেছিল, বৌদি পরশু আসবে, কাল আসতে পারবেনা।  চায়ের কাপ নিয়ে দুজনে আবার বসে পড়লাম। আজও বের হবো না ভাবছি,  শরীরটা  ভালো লাগছে না। রাধেশ্যাম আবার বলা শুরু করলো, ...... তোমার যখন তিন বছর বয়স মা-বাবু গেলেন উত্তরভারত ঘুরতে। বাড়িতে তোমাকে দেখাশোনার পুরো দায়িত্ব তখন আমার।   বাইশ দিনের জন্য ওনারা বেড়াতে গেলেন। পাঁচ দিনের দিন হঠাৎ  টিভি তে দেখি ট্রেন এক্সিডেন্ট  হয়েছে, বৌদির কাছেও কিভাবে যেন খবরটা এসেছিল।  বৌদি তোমাকে আমার কাছে রেখে ছুটলেন ওনাদের খবর নিতে।  বাড়িতে তখন তুমি আর আমি।   ওনারা আর ফিরলেন না, ফিরল দুটো  ডেডবডি।  কথাগুলো বলতে বলতে রাধেশ্যাম খুব জোরে জোরে দীর্ঘশ্বাস ফেলছিল, বুঝলাম খুব কষ্ট হচ্ছে ওর কথাগুলো বলতে! আমি বললাম, তারপর......
তারপর আর কি রয়ে গেলাম এই বাড়িতে, চিরদিনের জন্য। আর দেশে ফেরা হোল না। বৌদি তোমাকে নিয়ে একদম একা একা কি করে থাকবে বোলো...... একদিকে চাকরি আর একদিকে তুমি। তুমি তখন অনেক ছোট।  
মা তাহলে কাল ফিরছে না? প্রসঙ্গটা পালটাবার চেষ্টা করলাম, ও বলল, পরশু ফিরবে, আর একটা কথা বৌদি ফিরলে এসব নিয়ে আমাকে কোন কথা জিজ্ঞেস করবে না কিন্তু।  আমি বললাম, না কিছু জিজ্ঞেস করবো না, কথা দিলাম।


ক্রমশঃ 

No comments:

Post a Comment