Thursday, January 19, 2017

ঘন কুয়াশা (৫)
 শীলা ঘটক              

সকালে ঘুম থেকে উঠে রাধেশ্যামকে বাজারে পাঠালাম। একটা চিন্তা সারারাত আমাকে ঘুমাতে দেয়নি, কে  আমার বাবা?  এক অসমাপ্ত জীবন কাহিনী----  সারাবাড়িতে কোথাও একটা বাবার ফটো নেই, বন্ধুদের বাবাদের যখন দেখতাম নিজের বাবাকে দেখার জন্য মন আকুল হোতো!  কতবার মাকে প্রশ্ন করেছি, মা আমার বাবা কোথায় ?  একবার আমাকে বাবার কাছে নিয়ে চলো।  মা বলতো, অনেকদূর দেশে থাকেন তোমার বাবা, সময় হলে ঠিক আসবেন।  তারপর সময় বয়ে গেছে তার আপন গতিতে, আমি আমার  জগতে-- আর মা, মায়ের জগতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
 রাধেশ্যাম বাজার গেছে,  ভাবলাম এই তো সুযোগ... মায়ের ঘরে একবার আমাকে ঢুকতেই হবে।  
তন্নতন্ন করে আলমারির চাবিটা খুঁজতে শুরু করলাম।  ড্রেসিং টেবিলের  কাঁচের পাল্লাটা সরাতেই পেয়ে গেলাম মায়ের আলমারির চাবিটা।   আলমারি খুলে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম-----  এতো কাপড়ের ফাঁকে কিছু পাবো কি !!  মা খুব সৌখিন মানুষ, প্রচুর শাড়ী, ম্যাচিং ব্লাউজ, বিভিন্ন গয়না।  বেশী নাড়াচাড়া করতে ভয় করছে যদি বুঝে ফেলে!   নীচের তাকের দিকে চোখ গেল---  তিনটে বড় বড় অ্যালবাম...... বের করে বিছানায় বসলাম। একটা একটা করে দেখা শুরু করলাম।
 প্রথমটা দাদু-দিদার সঙ্গে মায়ের ছোটবেলার ফটো, মা আমার দেখতে খুব সুন্দরী। ছোট ছোট চুল কাটা দাদু দিদার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে, অসংখ্য ছবি। বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন পোজে ...... সব কটা ছবি অনেকক্ষণ ধরে দেখলাম।
 তারপর পরেরটা খুললাম—মায়ের কলেজ জীবনের ফটো। কি উচ্ছল! হাসি-খুশী  ...... একঝাঁক বন্ধুদের মাঝে মাকেই বেশী চোখে পড়ছে। কোনদিন এইসব দেখার সুযোগ আমার হয়নি, আর মা যে এতোটা হাসিখুশি বুঝতেই পারিনি।   মাকে যেন অন্যভাবে আজ পাচ্ছি আমি--- খুব ভালো লাগছে দেখতে, একটা অচেনা মানুষ মনে হচ্ছে ......
শেষেরটা খুললাম, মায়ের বিয়ের গায়ে হলুদ দেওয়া হচ্ছে ফটোতে, একে একে দেখতে দেখতে চমকে উঠলাম আমি!  এ কাকে দেখছি আমি!...... এই তো সেই ভদ্রলোক যাকে আমি ট্রেনে দেখছিলাম, দীর্ঘ সময় কাটিয়েছি, কি আশ্চর্য !...... দেখতেও তো আমারই মতো!  অথচ চিনতেই পারলামনা সেদিন! হায়  ভগবান!  কি সুন্দর দেখতে লাগছে দুজনকে।  মালাবদল---- সিঁদুর দান--- খই পোড়ানো ...... চোখ দুটো জলে ঝাপসা হয়ে আসছে------ কত লোক, কত আয়োজন----  তাকিয়েই আছি ছবিগুলোর দিকে। সময়টা কতক্ষণ জানিনা।  নীচে দরজায় বেল বাজছে, রাধেশ্যাম এলো নিশ্চয় বাজার থেকে। ছুটে গেলাম দরজা খুলতে----
দরজা খুলেই রাধেশ্যামকে জড়িয়ে ধরলাম, ও বলল, হোল কি তোমার---- ঘামে ভিজে গেছি ছাড়ো ছাড়ো...  আমি বললাম, রাধেশ্যাম আমার বাবা কে আমি জেনে গেছি।  শুনে ও স্থিরভাবে তাকাল, তারপর বলল, কিভাবে?  আমি বললাম মায়ের আলমারি থেকে অ্যালবাম বের করে আমি দেখেছি।  শুনে ও আঁতকে উঠলো!  বলল, করেছো কি?  বৌদি নেই আর তুমি? ----- আমি বললাম, বেশ করেছি।  চাবি পেলে কোথায়?  আমি বললাম, যেখানে রাখে সেখান থেকে।  শুনে বলল, মেয়েদের কোনকিছুতে হাত দিতে নেই, তুমি জানো না?  বৌদি জানতে পারলে তোমাকে আস্ত রাখবে না, তারসঙ্গে আমাকেও----আমি বললাম, রাধেশ্যাম, তুমি যার কথা বলছ, উনি আমার মা।  তারপর বাবার ফটো দেখিয়ে বললাম, এনার সঙ্গে আমার ট্রেনে দেখা হয়েছিল।  শুনে ও বলল, বলো কি!!?? আমি বললাম,  হ্যাঁ । আমার কাছে থেকে কার্ড নিয়ে গেছে, ঠিক ফোন করবে দেখো। কিছুটা উত্তেজিত হয়ে ও বলল, খোকা তুমি আগে এগুলো ঠিকঠাক করে রাখো, বৌদি যেন বুঝতে না পারে।
ট্রেনে যা যা কথা হয়েছিল সব বললাম রাধেশ্যামকে। ওর চোখ দুটো জলে ভ’রে উঠলো!  যেমনটি ছিল সেইভাবেই রেখে দিলাম অ্যালবামগুলো।

মা ফিরে এসেছে---- সুযোগ বুঝে মাকে সব বললাম, শুনে মা কিছুটা উদাসভাবে তাকাল আমার দিকে, তারপর বলল, তুমি চাইলে ওনার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতেই পারো, কিন্তু ভুলেও কোনদিন আমাকে ওনার সঙ্গে দেখা করাবে এটা ভেবো না, আর একটা কথা--- এটা আমার বাড়ি, এখানে কোনদিন আসার কথা ওনাকে বলবে না, বুঝেছ?  আমি বললাম, পাবো কোথায় বাবাকে?  আমার কাছে কিছুই নেই জানার মতো----নির্লিপ্তভাবে মা উঠে চলে গেল, কোন কথা না বলে......


তারপর কত বছর কেটে গেছে, প্রায় দেখতে দেখতে কুড়ি বছর হতে চলল বাবার সঙ্গে ট্রেনে দেখা হয়েছিল।  বছর দশেক হোল আমি বিয়ে করেছি।  প্রিয়া আমার স্ত্রী আর রকি (আট বছর বয়স ওর) আমার ছেলে।   মা, অনেকদিন হোল চাকরি ছেড়ে দিয়েছে।  আমার সঙ্গে সম্পর্কের তফাৎ থাকলেও প্রিয়া আর রকি মায়ের খুব আদরের।     এই কুড়িটা  বছর শুধু একটা ফোনের অপেক্ষা করে কেটেছে, বাকি জীবনটাও হয়তো এই অন্তহীন অপেক্ষায় কাটবে আমার জীবন--- মনে মনে শুধু বলি, বাবা, একবার কি পারতে না আমি তোমার ছেলে এই কথাটা সবাইকে জানিয়ে যেতে! বুকটা ভারি হয় ওঠে!  রাধেশ্যাম এখন আর তেমন কাজ করতে পারেনা, বয়স হয়েছে--- সে শুধু রকির খেলার সাথি।

সমাপ্ত।


No comments:

Post a Comment