আদিবাসীদের প্রাণের উৎসব ফাগুয়া এবং শরহুল
গৌতম চক্রবর্তী
প্রতিদিনের চেনাজানা জীবন-যাপনের ছক ভেঙে মন স্বাভাবিকভাবেই উদাসী হয়ে ওঠে কোথাও যেতে। একটু আনন্দ এবং একটু নতুনত্বের ছোঁয়া পেতে। দৈনন্দিন রোগ, শোক, দুঃখ থেকে মানুষ চায় অপার মুক্তি। চায় জগতের আনন্দযজ্ঞে অংশ নিতে। রুদ্ধ দুয়ার এর প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে সুদূরের আহবানে সাড়া দিয়ে তাই মেতে উঠতে চায় উৎসবে, মেলায়, নৃত্যগীতে, মানুষের সমাবেশে। আর এই আহ্বান এর মধ্য দিয়েই আমাদের জীবনে ঘুরে ফিরে আসে বারো মাসে তেরো পার্বণের বৈচিত্র্য। বারো মাসে তেরো পার্বণ। ঋতুচক্রের আবর্তনে মাস পেরিয়ে মাস যায়। ঘুরে আসে বছর। এর সঙ্গেই আবর্তিত হয় নানান পার্বণ এবং নানান উৎসব। উত্তরবঙ্গ এক আশ্চর্য ভূখন্ড। সাংস্কৃতিক সংহতি চেতনায় উদ্দীপ্ত এমন অঞ্চল ভারতে আর দ্বিতীয় নেই। এখানে রয়েছে নানা ভাষাভাষী বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মানুষের বসবাস। ভিন্ন তাদের ভাষা, ভিন্ন তাদের সংস্কৃতি। স্বাধীনতার অনেক আগে থেকেই অর্থাৎ বিগত কয়েকশ বছর ধরে জীবন ও জীবিকার সূত্রে উত্তরবঙ্গের বিস্তৃত অঞ্চলের ওপর দিয়ে নানা জাতি ও উপজাতির স্রোত বয়ে গেছে। দ্রাবিড়, অস্ট্রিক, ভোট চিনীয় এবং আর্য গোষ্ঠীর বিভিন্ন শ্রেণী নির্মিত ভাষা ছাড়াও নানান উপভাষা, নানান ভাষা এবং বিভাষার সন্ধান এই অঞ্চলে পাওয়া গেছে। অপরিচিত এই অঞ্চল এখন ক্রমশই হয়ে উঠছে গভীর মনোযোগের কেন্দ্র। এক কথায় বলা যেতে পারে উত্তরবঙ্গের এই অঞ্চল লোকায়ত মানব মেলার সার্থক পূণ্যভূমি। বর্তমান ভারতের প্রায় সব কটি ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করেন উত্তরবঙ্গের বিস্তৃত এলাকায়। এখানকার বিচিত্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রতিবেশী হিসেবে একটা সামাজিক সাংস্কৃতিক আন্তঃগোষ্ঠীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। এখানে একদিকে যেমন বসবাস করে আসছে মেচ, রাভা, গারো, তামাং, লিম্বুরা, অন্যদিকে চা বাগান অঞ্চলে স্থায়ীভাবে বসবাস করে আসছে ওঁরাও, মুন্ডা, সাঁওতাল, মালপাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মানুষ। রয়েছে পার্বত্য অঞ্চলে ডুকপা, টোটো, শেরপা, লেপচা, ভুটিয়া সম্প্রদায়ের মানুষ।
ঋতুচক্রের আবর্তনে পরিবর্তিত হয় পৃথিবী। পরিবর্তন হয় তার রূপের। শীতের রুক্ষতার পর তাই বসন্ত আসে ঋতুরাণী হয়ে। ফুলে ফুলে ভরিয়ে দেয় পৃথিবী। মানুষের মনে আসে নব আনন্দের জোয়ার। তারা মেতে ওঠেন আনন্দের উৎসবে, কথায় গানে এবং কবিতায়। বসন্তের জয়গান করেন মানুষ। বসন্ত যৌবনের জয়গান গায়। যৌবনের দূত হয়ে আসে। ভালোবাসার নিবিড় আহ্বানে বসন্তে যুবক-যুবতীরা মেতে ওঠে উচ্ছল আনন্দে। প্রকৃতির লাবণ্যময়ী রূপের সাথে সমানতালে নৃত্য-গীতে পলাশে ফাগুনের উদাস বাতাসে যৌবনের গানে সমানভাবে মেতে ওঠে উত্তরের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন ভাষার সরলমনা আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষেরা। উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, কোচবিহার এবং দার্জিলিং জেলায় বসবাসকারী বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠীগুলির মধ্যে রয়েছে মেচ, রাভা, টোটো, সাঁওতাল, ওঁরাও যাদের প্রত্যেকের মধ্যেই রয়েছে বসন্ত উৎসবের আনন্দ উচ্ছাসময় উৎসব। তাই বসন্তোৎসবের আনন্দ-উৎসবে অন্যান্যদের সাথে ডুয়ার্স অঞ্চলের আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষেরাও শামিল হন বসন্তের আনন্দধারায় তাদের নিজস্ব রীতিতে এবং নিজস্ব ভঙ্গিমায়। নৃতাত্ত্বিক বিচারে বোডো সম্প্রদায়ের মানুষেরা ইন্দো মঙ্গোলয়েড গোষ্ঠীর অন্তর্গত একটি শাখা। বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠীগুলির মধ্যে মেচ বা বোডোরা এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। পাশাপাশিভাবে নৃতাত্ত্বিক বিচারে একটি বিশিষ্ট উপজাতি ভোট ব্রহ্ম পরিবারের বোডো শাখার একটি অংশ রাভা। উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার আলিপুরদুয়ার মহকুমার মাদারিহাট থানার অন্তর্ভুক্ত ভারত-ভুটান সীমান্তের টোটোপাড়া গ্রামে বসবাস করেন পশ্চিমবঙ্গের ক্ষুদ্রতম উপজাতি সম্প্রদায় টোটোরা। বোডো, রাভা, টোটো সম্প্রদায়ের মানুষেরাও বসন্তকালে মেতে ওঠে নানান উৎসব অনুষ্ঠানে। আদিবাসীদের পূজার মধ্যে অতি প্রাকৃতিক শক্তির কাছে আত্মনিবেদনের ভাব প্রবল থাকে। অন্যদিকে পার্বণে আনন্দ-বিনোদনে মেতে ওঠে আদিবাসী সমাজ। আদিবাসীদের পার্বণগুলি মূলত পূজাকেন্দ্রিক। ধর্মকেন্দ্রিক নয়।
বসন্তের আগমনে যৌবনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে প্রকৃতির অপরূপ রূপ লাবণ্যের সাথে নিজেদেরকেও শামিল করে নানা সাজে মেতে উঠে আনন্দের নৃত্যগীতে বসন্ত উৎসবে মেচ যুবক-যুবতীরা অংশগ্রহণ করে। আসাম এবং ডুয়ার্সের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে মেচ বা বোডো সম্প্রদায়ের যুবক যুবতীর হৃদয়ও বসন্ত উৎসবের আনন্দে মেতে ওঠে। এই আনন্দের সমবেত রূপ দেখা যায় দৃষ্টিনন্দন নৃত্য এবং গীতে যা এই অঞ্চলে এখনো প্রচলিত। নব বসন্তের আনন্দের উন্মাদনায় প্রকৃতির রূপ পরিবর্তনের সাথে সাথে মাতৃতান্ত্রিক উপজাতি রাভা জনগোষ্ঠীর মানুষেরাও বসন্ত ঋতুতে মেতে ওঠে আনন্দ গান এবং নৃত্যে। নতুন সাজে সেজে উঠে নিজেদের নৃত্যগীতের মাধ্যমে নিজস্ব কৃষ্টি কলা তারা তুলে ধরে। এই উৎসবে গান গাওয়া হয় এবং সাথে থাকে সমবেত নৃত্য। যুবক-যুবতীদের মন দেওয়া-নেওয়ার পালা সাঙ্গ হয় এই উৎসবে। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষুদ্রতম উপজাতি সম্প্রদায় টোটো জনগোষ্ঠীর মানুষদেরও রয়েছে বসন্তকালীন পূজা উৎসব। চৈত্র মাসের মাঝামাঝি সময়ে সন্ধ্যাবেলায় সংঘটিত বসন্তোৎসবে গোয়াতি নদীর তীরে নির্দিষ্ট পাথরের বেদিতে পুরনো শিল্পীদের তত্ত্বাবধানে ডোমসার সামনে নতুন যুবদলকে নৃত্যগীতে অভ্যস্ত করানো হয়। টোটোপাড়ায় যখন গিয়েছিলাম তখন ভবেশদার কাছ থেকে শুনেছিলাম এই সময়ে আসা নতুন কমলালেবু এবং বাতাপিলেবুর নতুন ফুলের রক্ষার জন্যই এই পূজা উৎসব হয়ে থাকে এবং তাদের পূজা উৎসব না হওয়া পর্যন্ত এই ফল খাওয়া বারণ থাকে। বসন্তকালীন এই পূজা উৎসবে শুকর বলি দেওয়া হয়, সমবেতভাবে পূজা শেষে শুকরের মাংস ঝোল করে খাওয়া হয়, যুবক যুবতীরা নৃত্যগীতে মেতে ওঠে। পূজা উৎসব উপলক্ষে খাওয়া দাওয়া, মদ্যপান হয়। টোটো যুবারা যথেচ্ছভাবে মদ্যপান করে।
ইংরেজ দ্বারা চা বাগান পত্তনের যুগে আরকাঠি মারফত ছোটনাগপুর তথা বর্তমান ঝাড়খন্ড রাজ্য থেকে অন্যান্য জনজাতির সঙ্গে শ্রমিকের কাজ করার জন্য ওঁরাওদের নিয়ে আসা হয়। তারপর থেকে কয়েকপুরুষ যাবত তারা স্থায়ীভাবে বসবাস করছে উত্তরের ভূখন্ডে। এই সম্প্রদায়ের একটি অংশ স্থায়ী চা-শ্রমিক অথবা চা বাগানের অন্যান্য পেশায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। অপর অংশ বাগান সংলগ্ন বনভূমির জমি ক্রয় করে বা সরকারি জমি লিজ নিয়ে বা পাট্টা নিয়ে গ্রাম পত্তন করেছে এবং সেইসব গ্রামে বংশানুক্রমে চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করছে। ভূমির সঙ্গেও এদের যোগাযোগ আছে। আদিতে এরা ছিল কৃষি এবং অরণ্যকেন্দ্রিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত। চা বাগানে এসে এরা হলো কৃষিভিত্তিক শিল্প শ্রমিক। এদেরই একটা অংশ চা বাগান পরিত্যাগ করে গ্রামের পত্তন করে। ডুয়ার্সে চা বাগান অধ্যুষিত অঞ্চলে দেখা যায় শিক্ষার প্রসার এবং নগর সংস্কৃতির প্রভাবে এরা আধুনিক জীবনচর্চার প্রতি ঝুঁকে পড়েছে। তবে গ্রামাঞ্চলে এখনো প্রাচীন সংস্কৃতি এবং পরম্পরাকে ধরে রাখার একটা প্রচেষ্টা দেখা যায়। উত্তরবঙ্গের কিংবা আসামের চা বাগিচায় দেড় থেকে দুশো বছর আগে যেসব আদিবাসী জনজাতির মানুষ ব্রিটিশ চা ব্যবসায়ীদের হাত ধরে দলে দলে শ্রমিকের কাজ করতে এসেছিল তাদের মূল বাসভূমি ছিল মধ্য ভারতে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অন্য অনেক সংস্কৃতি হারিয়ে গেলেও ফাগুয়া পরব কিন্তু লুপ্ত হয়নি আদিবাসীদের মন থেকে। ভারতের যেখানেই আদিবাসীরা আছে সেখানেই ফাগুয়া তাদের প্রাণের উৎসব। উত্তরবঙ্গ থেকে শুরু করে অসমের চা বাগিচার আদিবাসী শ্রমিকেরা তাদের পরম্পরাগত এই উৎসবকে এখনো দলবদ্ধভাবে পালন করে। ডুয়ার্স বা অসম কোথাও কিন্তু উৎসবের নামে শালীনতার মাত্রা টপকে যাবার প্রয়াস কেউ কখনো করে না। এটাও আদিবাসীদের কাছ থেকে আমাদের একটা অন্যতম শিক্ষণীয় বিষয়। তাই আজও চা বাগানের শ্রমিক মহল্লায় মাঘ পেরিয়ে ফাল্গুন পড়লেই হাড়িয়ার নেশা ধরা কাঁপা হাতে বেজে ওঠে ধামসা মাদলের বোল যা জানান দেয় ফাগুয়া পরব আসছে।
ওঁরাও, মুন্ডা, সাঁওতাল, খেড়িয়া, শবর, অসুর কিংবা আরও কয়েকজন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর কাছে ফাগুয়া রংয়ের ভুবনে মাতিয়ে দেওয়ার উৎসব। আগে পলাশ ফুল জলে ভিজিয়ে সেই রঙ দিয়ে একে অপরকে রাঙানোর প্রথা প্রচলিত ছিল। কিন্তু এখন আদিবাসীদের ফাগুয়াতেও রাসায়নিক রংয়ের বাড়বাড়ন্ত। ফাগুয়ার অন্তত ১৫ দিন আগে থেকে শুরু হয় শিকার খেলা যা ফাগুয়ার অপরিহার্য উপাদান। দলবেঁধে জঙ্গলে গিয়ে ধনুকের সাহায্যে বুনো শুয়োর, হরিণ, খরগোশ শিকার এর প্রথা বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের জন্য প্রায় বন্ধই বলা যায়। তবুও ফাগুয়ার আগে এই শিকার একদম যে চলে না তা কিন্তু নয়। বনদপ্তরও তাই এই সময়কালে জঙ্গলগুলোতে নজরদারি বাড়িয়ে দেয়। আদিবাসী সমাজের নিয়ম মোতাবেক শিকারে গিয়ে যা পাওয়া যাবে তা সকলের মধ্যে ভাগ করে দিতে হয়। মহল্লার যারা শিকারে যায় না তাদেরকেও এর অংশ দিতে হয়। ফাল্গুনের প্রথম পূর্ণিমায় যেদিন ফাগুয়া পরবের তিথি উপস্থিত হয় সেদিন কচি শিমূল গাছের পাঁচটি ডাল বেদিতে স্থাপন করে খড় দিয়ে আগুনে পোড়ানো হয়। এর অর্থ পুরনো যা কিছু জীর্ণ তাকে বিদায় জানিয়ে নতুনের আহ্বান। এটা কার্যত ঋতুরাজ বসন্তকে স্বাগত জানানোর প্রথা। পাশাপাশি অনেকে এই প্রথাকে শীতের রুক্ষতাকে পেছনে ফেলে সবুজের অভিযান হিসাবেও দেখে। শিমুলের কিশলয় বা কুঁড়ি যা টুসা নামে পরিচিত তা থেকেই কিন্তু দক্ষিণবঙ্গের টুসু পরব এর নামকরণ হয়েছে। এভাবে ফাগুয়া, প্রকৃতি এবং আদিবাসী সমাজ একসূত্রে গ্রথিত হয়েছে।
উত্তরের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির ডালি নিয়ে পার্বণের আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে মাহালী, নাগেশিয়া, মুন্ডা, মালপাহাড়ি, অসুর সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ মেতে ওঠে বসন্তোৎসবে। বসন্তের আগমনে যখন গাছে ফুল ফোটে বা নতুন পাতা হয় তখন সারা পৃথিবী ভরে ওঠে ফুলে ফুলে। মহুয়া ফুলের গন্ধে যখন চারিদিকে মাদকতাময় গন্ধ বয়ে যায় তখন মাহালী সম্প্রদায়ের মানুষেরা প্রকৃতিকে বরণ করে নিতে প্রকৃতি দেবীর পুজো করে থাকে। বিশেষ ভাবে ব্যবহৃত হয় ফুল। ফুল ছাড়া এই পরব বা উৎসব হয় না। এই জন্যই এই উৎসবের নাম সারহুল। ফাগুন মাসে অনুষ্ঠিত মাহালীদের সারহুল উৎসব বসন্তকালীন উৎসব। মাহালী সম্প্রদায়ের সকলেই উৎসবের আনন্দে শামিল হয়। এই অনুষ্ঠানে পানভোজনের আয়োজন করা হয়। নৃত্যগীত হয়ে থাকে এই বসন্তকালীন উৎসবে। বসন্ত ঋতুর আগমনে পৃথিবীতে যখন সৌন্দর্যের সমারোহ, যখন গাছে গাছে নতুন ফুল ফোটে, প্রকৃতি যখন ফুলের গন্ধে ভরে যায় তখন প্রকৃতিদেবীর আরাধনায় আদিবাসীসুলভ স্বাভাবিক অনুভূতি নিয়ে নাগেশিয়া জনগোষ্ঠীর মানুষেরা উৎসবের আনন্দে মেতে ওঠে। অন্যান্য আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষের মতোগ্রামের সকল মানুষ নৃত্যগীত, পানাহার, প্রকৃতি দেবীকে তুষ্ট করতে নানা ধরনের বন্দনা গান সহ তারাও নাচে গানে মেতে ওঠে তাদের এই ফাগুন উৎসবে। যখন গাছে ফুল হয় এবং বনজঙ্গল ফুলের গন্ধে ভরে যায় এবং প্রকৃতি সাজে অপরূপ রূপে সেই সময় মুন্ডা সমাজও ফাগুন উৎসব পালন করে। এই উৎসব বসন্তকালে অর্থাৎ ফাগুন মাসে হয়। বলে এই উৎসব বা পরবকে শারহুল বলা হয়ে থাকে। এই উৎসবে শাল ফুল অবশ্যই প্রয়োজন। মূল উৎসবের দিন জঙ্গল থেকে শাল ফুল সংগ্রহ করে দেবতার উদ্দেশ্যে নিবেদন করা হয়। বসন্তকালীন ফুল উৎসব পালনের পর এই সমাজের মানুষেরা বাড়িতে পূর্বপুরুষদের স্মরণ করে শালফুল নিবেদন করে থাকে। কয়েকদিন ধরে চলা মুন্ডাদের এই শারহুল উৎসবে মুন্ডা যুবক-যুবতীরা প্রকৃতির দেবতাদের উদ্দেশ্যে আনন্দ সহকারে শ্রদ্ধা জানাতে ধামসা মাদল নিয়ে নৃত্যগীত এবং পানভোজনে অংশগ্রহণ করে থাকে। আপামর মুন্ডা জনজাতির মানুষ উৎসবের সাথে যুক্ত হয়ে পড়ে।
আসলে ধর্ম শব্দটির উৎসমূলের সংস্কৃত শব্দটিকে কিংবা রিলিজিয়ান শব্দের ল্যাটিন মূলটিকে খুঁজতে গেলে দেখা যায় উভয় শব্দই যে অর্থ প্রদান করছে তার মূল কথা ধর্ম ধারণ করে এবং সংহতি দান করে। বস্তুত একটি জনগোষ্ঠীর নিজস্ব পরিচয় প্রকাশ পায় তার ধর্ম এবং পূজা-পার্বণে। উত্তরবঙ্গে বসবাসকারী বিভিন্ন জনজাতি এবং আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত রয়েছে নানা ধরনের পূজো পার্বণ। সাধারণভাবে একথা বলা যায় যে, আদিবাসী জনজীবনে পূজা-পার্বণ মূলত সমাজের, গ্রামের এবং নিজস্ব পরিবারের মঙ্গল কামনাতেই হয়ে থাকে। বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায়ের পূজা-পার্বণের রীতিনীতিও আলাদা। বিশেষ বিশেষ সময়ে বিভিন্ন আদিবাসী সমাজে নানা ধরনের পূজা-পার্বণের প্রচলন রয়েছে। সাধারণত কৃষি, শিকার এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে ধর্মীয় ভাবধারায় বিভিন্ন পূজার আয়োজন হয়ে থাকে বিভিন্ন আদিবাসী সমাজে। বিভিন্ন পূজাকে উপলক্ষ করে আয়োজন করা হয় উৎসবের। তাই পূজা এবং উৎসব আদিবাসী জনজীবনের বিশেষ অঙ্গ। যে কোন ধর্মেরই দুটি প্রধান দিক আছে। একটি হল বিশ্বাসের দিক এবং অপরটি হল সক্রিয় আচরণগত দিক। পূজা-পার্বণ মূলত সক্রিয় আচরণগত দিক এবং এই বিশ্বাস আসলে অতিপ্রাকৃতিক জগত সম্পর্কে মানুষের বিশ্বাস, ভয় এবং শ্রদ্ধামিশ্রিত অনুভূতি। এই অতি প্রাকৃতিকতার গহীনে থাকে প্রাকৃতিক বিষয়াবলি। বর্তমান ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম দেখা যায় না। আদিবাসী এবং অন্যান্য জনগোষ্ঠীর পূজা-পার্বণগুলি প্রধানত চারটি বিষয়কে কেন্দ্র করে সংঘটিত হয়ে থাকে। একটি হলো কৃষি কেন্দ্রিক অথবা অর্থনৈতিক জীবনকেন্দ্রিক, একটি হলো নববর্ষ উৎসব আর অপর দুটি হলো গ্রাম দেবতার পূজো এবং পূর্বপুরুষ পুজো। এর বাইরে কখনো স্বতন্ত্রভাবে কখনো বা এই পূজাগুলির উদ্দেশ্যরূপে রোগব্যাধির দেবতার পূজা করা হয়। এই পূজাগুলিকে কেন্দ্র করেই ডুয়ার্সে পালিত হয় পার্বণ, পরব বা উৎসব।
মুজনাই সাপ্তাহিক বিশেষ সংখ্যা
'আনন্দ বসন্ত সমাগমে...`
No comments:
Post a Comment