আজকের নারী
ছবি ধর
আজকের নারী যখন সমস্ত প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে এভারেস্ট শীর্ষে পা রাখছে, নারী আজ দক্ষ স্পেস ক্র্যাফট চালক, শিক্ষা, বৈজ্ঞানিক গবেষণা, খেলাধুলা, সব রকমের পেশায় সাফল্যের পরিচয় দিয়ে নিজেকে পুরুষের সমকক্ষ প্রমাণ করেছে, তখনও আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষিত রক্ষণশীল সম্প্রদায় নারীর বিকাশকে সর্বপ্রকারে আঁধারে ঠেলে দিতে তৎপর। সর্বক্ষেত্রে নারীর বিস্ময়কর অগ্রগতি সত্ত্বেও নারীকে হেয় করার প্রবণতা, নারীনির্যাতন, লাঞ্ছনা বেড়েই চলেছে। নারীকে পণ্য হিসেবে তাকে ব্যবহার করা হয়। এখনো নারীর পরিচয় নির্ধারিত হয় পুরুষের উপভোগ্যতা সাপেক্ষে। আজকের নারী বিশ্বায়নের বহু বিপ্লবী নেত্রী রূপে প্রতিষ্ঠিত হলেও, তাকে দেখা হয় পুরুষের পরিপ্রেক্ষিতে- কুমারী হলে পিতৃপরিচয়ে, বিবাহিত হলে স্বামীর পরিচয়ে। প্রাচীন সামন্ততান্ত্রিক মূল্যবোধের সমাজে নারীর পরিচয়ে নারীর নিজস্ব পটভূমিকা অত্যন্ত জরুরি এবং আবশ্যক। পিতৃতান্ত্রিক ক্ষমতার পরাকাষ্ঠা থেকে নারীকে নিজের ক্ষমতায় ও দক্ষতায় পারদর্শিতা অর্জন করতে সকল স্তরের নারীকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে হবে আরও ব্যাপক ভাবে।
উনিশ শতকের সূচনাকালে এদেশে মেয়েরা ছিল শিক্ষার আলোক থেকে বঞ্চিত,বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে সম্পর্কশূন্য,মানবিক প্রায় সমস্ত অধিকার থেকেই বঞ্চিত। আদিম যুগ থেকেই পুরুষ শিশু ও পশু পালনে নারীকে গৃহবন্দী করে তার মস্তিষ্ককে বিকশিত হওয়ার পথ বন্ধ করাই ছিলো একমাত্র উদ্দেশ্য।
কন্যাসন্তানের জন্ম পূর্ব ভ্রূণ হত্যা বা জন্ম পরবর্তী সময়ে গলা টিপে হত্যা করার ঘটনাও লক্ষিত হয়। অনাকাঙ্ক্ষিত জীবনের ভার সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হয় আজও অনেক ক্ষেত্রেই। ভালোভাবে কিছু বোঝার আগেই বিয়ে হয়ে যেত মেয়েদের। সরকারি আইনের ক্ষেত্রে বিবাহের বয়স সীমা নির্ধারণ করা সত্ত্বেও আজও অপরিনত মেয়ের বিবাহ দেওয়া হয়।পিতা মাতার আরো অনেক বেশি সচেতন হওয়ার প্রয়োজন। রক্ষণশীল পুরুষতন্ত্র ও সমাজ পতিদের দৃষ্টি এড়িয়ে উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে মেয়েরা সংসারের কাজের অবসরে কলম ধরতে শুরু করলো। তৎকালীন 'রাম সুন্দরীর' লেখায় আমরা বহু তথ্য পাই।
সভ্যতার পীঠস্থান ইংলন্ডে অষ্টাদশ শতাব্দীতে যে-নারী শুধুমাত্র কলমের শক্তিতে সমাজ ও বিশ্ব ময় বহু চর্চিত লেখিকা ওয়াল স্টোন ক্রাফ্ট "এ ভিনডিকেশন অব দ্য রাইটার অব উওম্যান" এই বইতে তিনি সমাজের অবহেলিত নারীদের প্রতি সমাজের দৃষ্টি ভঙ্গি নিয়ে ব্যক্ত করেছিলেন।বহু সংঘর্ষ হয় বইটি নিয়ে,আমাদের সকলেরই হয়তো জানা।
বেদ পরবর্তী যুগে নারীর অবস্থার অবনতির প্রভাব পড়েছিল সর্বত্র। মনু সাহিত্যে, কৌটিল্যের' অর্থ শাস্ত্র ', বাৎস্যায়নের 'কামসুত্র', কালিদাসের নাটকে, বানভটের কাদম্বিনী ও হর্সচরিত হর্ষবর্ধনের 'রত্নাবলী ' বিভিন্ন গ্রন্থে পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর অবস্থান সুস্পষ্ট হয়েছে।
সে সময় নারীদের কোন স্বাধীনতা ছিল না। বেদপাঠ, খেলাধুলা ছিলো নিষিদ্ধ। সতীদাহ প্রথার প্রকোপে বিষাক্ত হয়ে উঠেছিল নারী। রাজ পরিবারের পুরুষ বহু বিবাহ করে নারীর প্রতি মার ধোর নিত্য দিন অত্যাচারও করতো , বংশ রক্ষার চাবিকাঠি হয়ে ভারতীয় নারীর আত্ম মর্যাদা বলি দিতে হতো সেসময় কার রানী দেরও। সবচেয়ে জঘন্য ছিলো কুল জাত ও ধর্মীয় কুসংস্কারের দোহাই দিয়ে নাবালিকা শিশু কন্যার সাথে আশি বছরের বৃদ্ধের সাথে বিবাহ। সহমরণ ছিলো চরম আর এক অভিশাপ। রাজা রামমোহন রায় তৎকালীন সমাজের বিপক্ষে আপ্রাণ চেষ্টা করেন সতীদাহ রোধে তিনি সফল হন। এর পর ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় সতীদাহ প্রথা বন্ধ করে বিধবা বিবাহ প্রচলন করেন নিজ পুত্রের সাথে বিধবা বিবাহ দিয়ে। এর পরই ব্রাহ্ম সমাজের নারীরা সেসময় লেখা পড়া শুরু করে। বাংলা সাহিত্য ও ইংরেজি ভাষার বই পাঠ, গান শেখা শুরু করে ।
উত্তর ভারতের ঝাঁসি ও মারাঠার রানী লক্ষীবাই দক্ষতার সাথে সন্তান পালন ও ইংরেজ দের বিরুদ্ধে প্রথম তরবারী তুলে ধরেছিলেন। সভা সমিতিতে বিভিন্ন আন্দোলনে পথ সভায় নারী সর্বাগ্রে আসেন তাদের শেষ সম্বল গহনা টুকু দিয়েও পরাধীন ভারতকে স্বাধীনতার গ্লানি মুছে দেন। প্রণম্য মাতাঙ্গিনি হাজরা ছিলেন অন্যতম।
প্রয়াত ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন সফলতায় শীর্ষে , পিটি ঊষা, সুনীতা উইিয়ামস, কল্পনা চাওলা, সানিয়া মির্জা, ঝুলন গোস্বামী, মিতালী রাজ, হিমা দাস, সুষমা স্বরাজ, শীলা দীক্ষিত, মেহবুবা মুফতি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, গায়েত্রী দেবী, মেরি কম প্রমুখের মতো যোগ্য নারীরা আজ পরবর্তী প্রজন্মের কাছে অণুপ্রেরণা।
ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার পাইলট শিক্ষক হয়ে আজও কোন কোন নারী অধিকার থেকে বঞ্চিত নিজের পরিবারের লোকের কাছেই। সারাদিন কাজের পর স্বামী, পিতা অথবা অন্য কেউ তার মাইনের টাকা ছিনিয়ে নিয়ে ঠেক বা আড্ডায় বসে নেশা করে মধ্য রাতে এসে বাড়ীর মেয়ে বউকে আজও অত্যাচার করে। নারী অধিকার পূর্ণতা পেতে আজও দেরী আছে। এখনও প্রয়োজনে শহর হোক বা গ্রাম নারী একলা রাতে বাড়ি থেকে বেড় হবার সাহস করে না।
দেশ হোক বা রাষ্ট্র তখনই উন্নত হবে সেই দেশের নারী ও শিশু যখন সম্পূর্ন সুরক্ষিত । ভয় ও কুসংস্কারকে জয় করে ভারত সহ প্রতিটি রাজ্য থেকে ধর্ষক নিশ্চিহ্ন করতে হবে আগামীর নারীকেই।শক্তি সাহস আর সুশিক্ষায় শিক্ষিত হলেই নিজের অধিকার আর ব্যক্তি স্বাধীনতা মিলবে নচেৎ নয়। শিক্ষা দীক্ষাই একমাত্র মুক্তির পথ ।
No comments:
Post a Comment